আনন্দ-বেদনার কাব্য

.
.
শুরুটা হয়েছিল দুর্দান্ত। কিন্তু টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ পরে বাংলাদেশের জন্য এসেছে শুধুই হতাশা হয়ে। সেই হতাশা ভুলে এবার আবারও আনন্দের দিনগুলোয় ফিরে যেতে পারবে কি বাংলাদেশ? লিখেছেন ফেরদৌস রহমান

সৈয়দ রাসেলের বলটি ছিল অফস্টাম্পের বাইরে, শর্ট লেংথের। ব্যাটসম্যান যখন ক্রিস গেইল, তখন এসব বলের ঠিকানা হয় বাউন্ডারিতেই। কিন্তু সেই দিনটা যে বাংলাদেশের ছিল! বল গেল পয়েন্টে সোজা অলক কাপালির কাছে। গেইল আউট! বদলে গেল ম্যাচের রং, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে উড়ন্ত সূচনা বাংলাদেশের।

২০০৭ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আগে অন্তত এ দেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের ধারণা ছিল, ক্রিকেটের এই নব্যতম সংস্করণের উদ্ভবই হয়েছে বাংলাদেশের জন্য। ছোট ফরম্যাট, ছোট মাঠ আর চার-ছক্কা হাঁকানোর জন্য হাত নিশপিশ করতে থাকা একগাদা ব্যাটসম্যান। টি-টোয়েন্টি তো আমাদেরই খেলা! নিজেদের প্রথম তিন ম্যাচের দুটিতেই জয় পেয়ে ওই বিশ্বকাপে আসা বাংলাদেশকে কিছুটা সমীহ করছিল অন্যরাও।
তবে তারপরও ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ওই ম্যাচে বাংলাদেশকে ‘ফেবারিট’ বলার সাহস দেখায়নি কেউ। বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচেই দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে প্রথম সেঞ্চুরি করা গেইল যে ছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলে! কিন্তু ম্যাচের তৃতীয় বলে গেইলের আউটটিই বদলে দিল সব। শেষ দিকে অধিনায়ক আশরাফুল বল হাতে দুই ওভারে ৪৪ রান না দিলে ওয়েস্ট ইন্ডিজের স্কোরটা ১৪০ পেরোতে কি না সন্দেহ!

.
.

ব্যাটিংয়ে অবশ্য বোলিংয়ের সেই দায় মিটিয়ে দিয়েছিলেন আশরাফুল। খুব দ্রুত বাংলাদেশের দুই ওপেনার ফিরে যাওয়ার পর সেই সময়ের টি-টোয়েন্টির দ্রুততম ফিফটি (২০ বলে) এল তাঁর ব্যাট থেকে। আশরাফুলকে যোগ্য সঙ্গ দিয়েছিলেন আফতাব আহমেদও। এই জুটিতে ১০.২ ওভারে ১০৯ করার পরই ম্যাচ শেষ হয়ে গিয়েছিল। শেষ দিকে ধীরেসুস্থে রান নিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের যন্ত্রণাই কেবল বাড়িয়েছিলেন আফতাব।
দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে বাংলাদেশের পরের ম্যাচটি সম্ভবত টি-টোয়েন্টির অন্যতম অদ্ভুত ম্যাচ; অন্তত বাংলাদেশের ইনিংসের প্রথম অংশটুকু তো বটেই। প্রথম বলেই চার মারলেন তামিম ইকবাল, উল্টো দিকে নিজের প্রথম বলেই আউট অন্য ওপেনার নাজিমউদ্দিন! বাউন্ডারি আর আউটের এ রকম বিপরীতমুখী খেলা চলল বেশ কিছুক্ষণ। ৪.২ ওভারেই বাংলাদেশের ৪ উইকেট নেই। রান ৫৮, যার মধ্যে বাউন্ডারি থেকেই এল ৫৪! সেদিন বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা যেন নেমেছিলেন ‘মারো নইলে মরো’ নীতি নিয়ে। ৩৬ রানে আউট হওয়ার আগে আফতাব খেলেছিলেন ১৪ বল। আশরাফুল খেলেছিলেন তিন বল—৬, ৪, আউট! ১০ ওভারেই ৯৬ ছোঁয়া বাংলাদেশ সেদিন অবশ্য করেছিল মাত্র ১৪৪। সেদিন ম্যাচ হারলেও কারও আর বোঝার বাকি ছিল না, এ সংস্করণ আসলেই বাংলাদেশের জন্য। একের পর এক উইকেট পড়ছে, এমন অবস্থায়ও যে দলের ব্যাটসম্যানরা ছক্কা হাঁকাতে ভয় পান না, এ খেলা তো তাঁদেরই!
কিন্তু সবাইকে ভুল প্রমাণ করতে বাংলাদেশ একটুও সময় নেয়নি। ওই বিশ্বকাপেরই দ্বিতীয় পর্বে টানা তিন ম্যাচে রানের জন্য খাবি খেতে খেতে বাংলাদেশের সাহসী ক্রিকেটটা হারিয়েই গেল, যে ধারা রয়ে গেছে এখনো। ২০০৭ বিশ্বকাপের পর একে একে আরও চারবার টি-টোয়েন্টির বিশ্বমঞ্চে খেলল বাংলাদেশ, টানা ১০ হারের মধ্যে একমাত্র সুখস্মৃতি হয়ে থাকল ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ওই ম্যাচই।
ঘরের মাঠে হওয়া সর্বশেষ টুর্নামেন্টে প্রথম পর্বে আফগানিস্তান ও নেপালের বিপক্ষে জয় দিয়ে সেই গেরো খুলেছিল বাংলাদেশ। কিন্তু হংকংয়ের বিপক্ষে হেরে আবারও ফিরে গেল ব্যর্থতার বৃত্তে। দ্বিতীয় পর্বের চারটি ম্যাচ মিলিয়ে আবারও টানা পাঁচ হার বাংলাদেশের।
সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার, এই ১৫টি ম্যাচের কোনোটিতেই এক মুহূর্তের জন্য মনে হয়নি বাংলাদেশ জিততে পারে। প্রায় প্রতিটি ম্যাচেই অসহায় আত্মসমর্পণ। নিজেদের প্রথম দুই ম্যাচে যে অকুতোভয়, দুঃসাহসী বাংলাদেশের দেখা মিলেছিল, তা আর পাওয়া যায়নি। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটকে মজা হিসেবে নেওয়ায় বাংলাদেশের যে প্রাণোচ্ছল পারফরম্যান্স দেখা গিয়েছিল, তা কেন যেন হারিয়ে গেছে পরের বছরগুলোয়।
অবশেষে সদ্য সমাপ্ত এশিয়া কাপে আবার পাওয়া গেল টি-টোয়েন্টিতে সেই প্রাণোচ্ছল বাংলাদেশের দেখা। বিশ্বকাপেও কি দেখা যাবে এই বাংলাদেশকে? যারা টি-টোয়েন্টিতেও প্রতি বলে বোলারের চোখে চোখ রেখে ছক্কা মারার হুমকি দেবে, বল হাতে ম্যাচের শুরুতেই প্রতিপক্ষের আত্মবিশ্বাসকে দুমড়ে-মুচড়ে দেবে!
প্রত্যাশা করেই দেখা যাক না!