'কী কান্তি তোমার...'

তাঁদের যৌবনে: সৈয়দ শামসুল হক ও আনোয়ারা সৈয়দ হক
তাঁদের যৌবনে: সৈয়দ শামসুল হক ও আনোয়ারা সৈয়দ হক

অনেক যুগ অগের কথা, তবু যেন মনে হয় এই তো সেদিন। এই তো সেদিন তাঁর সঙ্গে দেখা হলো এক অভিজাত রেস্তোরাঁয়। আমি তখন ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্রী। চতুর্থ বর্ষে উঠেছি। আর তিনি তখনই একজন নামকরা লেখক ও সিনেমা ব্যক্তিত্ব। এমন কোনো সপ্তাহ যায় না, যেখানে পত্রিকায় তাঁর নাম না ওঠে। হয় তাঁর সাহিত্য নিয়ে অথবা তাঁর সিনেমা-সম্পর্কিত সংবাদ নিয়ে, যেখানে তাঁর প্রশংসাই ছিল অবধারিত।

কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হলো, আমি তাঁকে কোনো দিন চোখে দেখিনি। কোনো পত্রিকাতেও তাঁর ছবি চোখে পড়েনি। অবশ্য তাঁকে চোখে দেখার ব্যাপারে মাত্র কয়েক মাসই সচেতন হয়ে উঠেছি। এর আগে তো তাঁকে চিনতামই না। আমাদের মেডিকেলের জীবন এমন রঙিন, সেই জীবনে লেখাপড়ার পাশাপাশি শিল্প-সাহিত্য, কবিতা, প্রেম, নাটক, পত্রপত্রিকা, দেয়ালিকা—সবকিছু এমন জমজমাট যে অন্য কোনো দিকে মনোযোগ দেওয়ার সময়ই-বা কোথায়; বরং মনে মনে ভাবছি, মেডিকেলের কোন ছেলেকে আমার মনে ধরে, কাকে আমি জীবনসঙ্গী করব! আবার এ-ও মনে হচ্ছে, কাউকেই যে আমার মনে ধরে না! অথচ চোখের সামনে আমার বন্ধুদের প্রেম হচ্ছে, বিয়েও হয়ে যাচ্ছে।

একদিন এই সব ভাবতে ভাবতেই স্নান করতে গেছি। হোস্টেলে থাকি, এখানে স্নানঘর সব সময় ফাঁকা পাওয়া যায় না। তবে সেদিন মওকা বুঝে ঢুকেছি আর কোত্থেকে অ্যাই বিরাট এক প্রজাপতি সেই ঘুপচি স্নানঘরে একেবারে আমার বাম কাঁধে বসে ডানা ঝাপটাতে লাগল!

দেখে তো ভয় পেয়ে চিৎকার দিয়ে উঠলাম আমি। কিন্তু কপাল এমনই পোড়া যে সেই সময় আমার সতীর্থরা কেউই দোতলায় নেই। তো হুসহাস করে প্রজাপতিটিকে কাঁধ থেকে সরালাম। এরপর মনে হলো, লোকে যে বলে গায়ে প্রজাপতি বসলে মানুষের বিয়ে হয়! কিন্তু আমার ত্রিসীমানায় তো কাউকেই চোখে দেখছি না, যাঁর সঙ্গে আমার বিয়ে হতে পারে। তাই বিরক্ত হয়ে ভাবলাম, এ প্রবাদ একেবারে ভুয়া।

এর দু-এক দিনের ভেতরেই আমার হোস্টেলের চিঠির বাক্সে হলুদ খামে একটা চিঠি এসে হাজির! আরে, এত সুন্দর ইংরেজি হাতের লেখায় কে আমাকে চিঠি পাঠাল? আর লেখার কালিটিও ভীষণ সুন্দর! গাঢ় চায়নিজ ইঙ্ক দিয়ে মোটা করে ছবি আঁকার মতো করে আমার নামটি লেখা—আনোয়ারা বেগম চৌধুরী, থার্ড ইয়ার, লেডিস হোস্টেল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, ঢাকা।

চিঠি খুলে আমার বিস্ময় আরও বাড়ল। সেই কবে একজন লেখক, যাঁর নাম সৈয়দ শামসুল হক, তাঁর লেখা তিন পয়সার জ্যোছনা পড়ে আবেগতাড়িত হয়ে চিঠি লিখেছিলাম তাঁকে। তারপর কোনো উত্তর না পেয়ে ভুলেও গিয়েছি ওই চিঠির কথা। এমন চিঠি তো মাঝেমধ্যেই আমরা নামকরা কবি-সাহিত্যিকদের লিখে থাকি, কিন্তু এই লেখক মনে করে আমার চিঠির উত্তরও দিয়েছেন! শুধু তা-ই নয়, এটা হলো আমাকে লেখা তাঁর দ্বিতীয় চিঠি। কেননা, তাঁর প্রথম চিঠিটি আমার হাতে পৌঁছেনি।

চিঠি পাওয়ার ঘটনায় আমি তো খুশিতে গদগদ। বন্ধুদের কাছে সাতগাল করে বলে বেড়াচ্ছি, তাদের দেখাচ্ছি চিঠিখানা। তিনি লিখেছেন, ‘সুচরিতাসু’। আমাকে ‘সুচরিতাসু’ সম্বোধনে এই পর্যন্ত কেউই তো চিঠি লেখেনি, কোনো দিন না। এত সুন্দর করে যে মেয়েদের সম্বোধন করা যায়, তা-ই তো জানতাম না। এসব সম্বোধন সেই রবীন্দ্রনাথের গল্পে পড়া। বাস্তবে এসব যেন হয়ই না।

তারপর আর কী! তারপর তো শুধু দিন কাটানো। আগে যখন ভাবতাম, আমাকে কোনো না কোনো দিন একজন চিকিৎসককে বিয়ে করতে হবে, নিদেনপক্ষে একজন প্রকৌশলী, মনটা কেমন যেন বিমর্ষ হয়ে উঠত। যেন মনে হতো, এ রকম সংসার আমি চাই না, আমি চাই শিল্প-সাহিত্য, সংগীত দিয়ে জীবনকে ঘিরে রাখতে, হতে চাই লেখক। সারা দিন জাগতিক কাজকর্মের ভেতরেও জীবনকে আমি ভরে তুলতে চাই অন্যভাবে, অন্য কিছু দিয়ে; যদিও সেই ‘অন্য কিছু’র হদিস তখনো আমার জানা ছিল না।

আরও কিছুদিন পর ১৯৬৪ সালের এক বিকেলবেলা যখন পুরান ঢাকার একটা চায়নিজ রেস্টুরেন্টে তাঁর সঙ্গে প্রথম দেখা করতে গেলাম, তখন তাঁর চোখ দেখে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম—এমন চকচকে বুদ্ধির ছটায় উদ্ভাসিত চোখ আমি জীবনে দেখিনি।

আমার সঙ্গে প্রথম দিনের আলাপে তাঁর সে কী স্বতঃস্ফূর্ত বাক্যালাপ! যেন তিনি আমাকে বহুদিন ধরে চেনেন, বহুদিন ধরে তাঁর সঙ্গে আমার পত্রালাপ। ফিরে আসার সময় আমার হাতভর্তি মিষ্টি পান দিয়ে বললেন, ‘তোমার বন্ধুদের জন্য, যারা তোমার হোস্টেলে ফিরে যাওয়ার অপেক্ষায় আছে!’

তবে তাঁকে দেখার পর আমার মনটা কেমন যেন দোনোমনো হয়ে আছে—হ্যাঁ কি না, না কি হ্যাঁ অবস্থা। এ রকম রোগা, চালচুলোহীন, বোহিমিয়ান মানুষ, যিনি চোখে দূরে কিছু দেখেন না, মোটা কালো ফ্রেমের চশমায় চোখ ঢাকা; যিনি ষোলো বছর বয়সে বাবার ক্যাশবাক্স ভেঙে টাকা হাতিয়ে মুম্বাই চলে গিয়েছিলেন বড় মাপের চলচ্চিত্রকার হবেন বলে; তারপর নানা ঘাটের পানি খেয়ে আবার স্বদেশে প্রত্যাবর্তন, এরপর লেখাপড়া শেষ না করে লেখকজীবন বেছে নেওয়া—এসব কি ঝুঁকির মতো ব্যাপার হয়ে যাচ্ছে না আমার জন্য? যে আমি সারা জীবন স্বপ্ন দেখছি সুন্দরভাবে বিয়ে করে স্বামীর ঘাড়ে চেপে নিশ্চিন্ত-নিরাপদে সাহিত্য সাধনা করব, সেখানে আমার ভাগ্যে এমন একজন ক্যান্ডিডেট! এ তো চোখেই দেখে না, রোজগার করবে কী!

রাতে দুহাত ভর্তি করে পান নিয়ে ফিরে এলাম হোস্টেলে। ভাবলাম, এখন দেখি বন্ধুরা কী পরামর্শ দেয়! কিন্তু বন্ধুদের হাতে পান তুলে দেওয়ামাত্র সবকিছু ভুলে তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলো তারা। আমার পাকিস্তানি সতীর্থ জাকেরা পান মুখে দিয়েই গম্ভীর মুখে বলে উঠল, ‘ইয়ে আদমি আচ্ছা মালুম হোতা হ্যায়!’

তবে বন্ধুরা বললে কী হবে। মনে আমার তখনো দোনোমনো ভাব। কিন্তু দোনোমনো হওয়ার সুযোগ আর দিলেন না সৈয়দ হক। পরদিনই বিকেলের মেইলে পোস্টবক্সে আবার আমার চিঠি এল। সেই হলুদ খামের চিঠি, সেই চায়নিজ কালিতে লেখা, মুক্তোর মতো করে অক্ষর সাজানো, ‘কী কান্তি তোমার তনু, লাবণ্যের প্রেমদ ছটায়...’

এরপর একজন নিষ্পাপ কুমারী মেয়েকে পটাতে আর কী লাগে!

>সৈয়দ শামসুল হক

প্রেম, উত্তর-তিরিশে

 

কী কান্তি! তোমার তনু, লাবণ্যের প্রেমদ ছটায়,

মরি! মরি! উত্তোলিত শীত;

স্বপ্নসার সবুজ গেলাশে, আবার বসন্ত বুঝি!

আমার হেমন্ত-সিঁথি যত দূর যায়

ওড়ায় গো-খুরে ধূলি, দুর্বিনীত নায়কের শব এই নিস্তাপ শরীর।

বলো তো আমার হবে যদি আসি প্রণয়ে তোমার? 

 

মোরে পথে প্রমত্ত কিশোর। ঘুরে ঘুরে ক্লান্তি তার

হয় না কখনো। তার

জীবনের পরস্পর লগ্ন কালবেলা;

খোলে গ্রন্থি আলোতে আঁধারে।

এইভাবে গিয়েছে যৌবন। শুনতে পাই

অবিরাম ঝরে ঝরনাধারা

যেন শাস্ত্র দর্শনের মুখস্থ প্রতিজ্ঞাগুলো ঝরে অবিরল;

মরে ফুল, সন্দেহের খুলে যায় দোর;

চিন্তার জ্বলন্ত হাত অকস্মাৎ অনভ্যস্ত বৃষ্টির ভিতরে;

সিঁড়িতে শয়ান স্বপ্ন—নেওয়া আর হয় না সে সিঁড়ি।

এখন রাত্রির মানে কম্বলের জ্যান্তব আরাম, 

আর যাত্রা শয্যা থেকে বারান্দার ধূমল কিচেনে;

উদ্দীপ্ত আলোয় আর বর্ণে বর্ণে ডোবে না শহর।

চোখে চোখে ভয়, যখন তোমাকে দেখি।

তুমি জানবে না, তুমি জানবে না, একদা আমারও

প্রণয়ের পত্রলেখা প্রথম কম্পিত

গদ্য গড়িয়েছে অমর্ত্য পদ্যের খাদে।

সে-ও তো সহজ ছিল, মঞ্চের আলোয় মৃত্যু,

বক্তৃতায় উচ্চকণ্ঠ বারবার অকুণ্ঠ মরেছি!

বলো তো আমার হবে, উত্তর-তিরিশে যদি হয় আজ হৃদয়-হরণ?

কী আছে সন্দেহ তাতে। জানি সেই দণ্ডে ভাঙে অনুক্রম, 

মিলায় সিঁড়িতে শাদা আপতিত রেখা,

বিষম ঘূর্ণির হাতে নাজেহাল তাড়িত হৃদয়

নাচে, একতাল একবৃত্তে মরণের ধ্বনি ওঠে

ফেনায় ফেনায়, বর্তুল প্রোথিত করে

ঋদ্ধি বুদ্ধি সংরক্ষণের সহাস্য নিনাদ,

মৃত্যুকে জীবন দেয়, জীবনের মৃত্যুকে ভোলায়;

কী কান্তি! তোমার তনু এ হৃদয়-আসন্ন-সন্ধ্যার পটে নাচায় নিয়ন।।