রোবট গবেষণার নতুন দুয়ার

বোমা নিষ্ক্রিয় করাসহ যেকোনো বিপজ্জনক কাজ করতে সক্ষম হিউম্যানয়েড রোবট এসএম-১৮০৫ তৈরি করেন চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী মাঈনুল হাসান। সংগৃহীত
বোমা নিষ্ক্রিয় করাসহ যেকোনো বিপজ্জনক কাজ করতে সক্ষম হিউম্যানয়েড রোবট এসএম-১৮০৫ তৈরি করেন চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী মাঈনুল হাসান। সংগৃহীত

মঙ্গল গ্রহ কিংবা চাঁদে অভিযান, শিল্পপ্রতিষ্ঠান বা খাবারের দোকান পরিচালনা—এখন কোথায় নেই রোবট! নিখুঁত অভিযান, ভূগর্ভস্থ খনিজ অনুসন্ধান করতে গিয়ে ঝুঁকি এড়ানো কিংবা কারখানায় উৎপাদন  বাড়াতে বর্তমানে রোবটের সহায়তার কোনো বিকল্প নেই। পৃথিবীব্যাপী রোবটের অগ্রগতি প্রতিনিয়ত প্রত্যাশাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এই আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে পিছিয়ে নেই বাংলাদেশও।

রোবট চর্চায় অনেক দিন পার করে দিয়েছে এই দেশ। দেশের সরকারি ও বেসরকারি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোই রোবট গবেষণায় নেতৃত্ব দিচ্ছে দেশে। দেশের ইতিহাসে রোবটিকস চর্চায় অনন্য স্বাক্ষর রেখেছে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট)। পেয়েছে নানা সাফল্য। বিদেশের মাটিতে বারবার উজ্জ্বল করছে দেশের নাম। অর্জনের এসব কথা জানা যাক।

প্রথম রোবট দৌড়ে সফলতা

সময় ২০১১ সাল। রোবটিকস চর্চায় বাংলাদেশ তখন সবে প্রবেশ করতে শুরু করছে। জাতীয় পর্যায়ে দেশে প্রথমবারের মতো রোবট দৌড় প্রতিযোগিতার আয়োজন করে চুয়েটের রোবটিকস গবেষণা সংস্থা রোবো মেকাট্রনিক্স অ্যাসোসিয়েশন (আরএমএ)। এতে চতুর্থ হয়েছিলেন চুয়েটের শিক্ষার্থী রিনি ঈশান। এই অর্জনই তাঁর সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা জোগায়। স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলেন রোবট নিয়ে দিগন্ত ছোঁয়ার।

রোবটিকস চ্যালেঞ্জে চ্যাম্পিয়ন চুয়েট

২০১৩ সালের শুরুর কথা। উন্নত বিশ্বে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন রোবট নিয়ে তখন বিস্তর গবেষণা চলছে। বাংলাদেশ পিছিয়ে থাকবে কেন! ওই বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকার জাতীয় হ্যান্ডবল স্টেডিয়ামে ইঞ্জিনিয়ারিং স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইএসএবি) আয়োজন করে রোবটিকস চ্যালেঞ্জ। এক দিনের প্রতিযোগিতা হওয়ায় বাড়তি চ্যালেঞ্জ ছিল সব প্রতিযোগীর কাছে। দম ফেলার ফুরসত নেই কোনো প্রতিযোগীর, একটু এদিক-ওদিক হলেই ফসকে যাবে জয়। যেখানে প্রতিটি রোবট একটি করে গোলকধাঁধা সমাধান করবে। এই প্রতিযোগিতায় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৬টি দল অংশগ্রহণ করে। চূড়ান্ত পর্বে শক্তিশালী দল বুয়েট এবং কুয়েটের রোবটকে হারিয়ে বিজয়ীর মুকুট ছিনিয়ে নেয় চুয়েটের রোবো মেকাট্রনিক্স অ্যাসোসিয়েশনের রোবট ‘অটোনমাস মেজ সলভিং’। চ্যাম্পিয়ন দল হওয়ার সুবাদে সে বছর ভারতের কানপুরে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক রোবটিকস চ্যালেঞ্জে অংশগ্রহণ করার সুযোগ পায় বিজয়ী দলটি।

চাঁদে হাঁটবে চুয়েটের লুনাবট  

একটি রোবট চাঁদে হাঁটছে। চলার পথে পাথর বা শক্ত মাটি থাকলে তা নির্বিঘ্নে অতিক্রম করছে। সেই সঙ্গে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করছে, সেগুলো পৌঁছে দিচ্ছে পৃথিবীতে। ২০১৩ সালে এমন স্বপ্নই দেখতে শুরু করেছিলেন চুয়েটের শায়েখ আহমেদ, রিফাত মাহমুদ, নাহিন বাহার চৌধুরী এবং রিনি ঈশান। সেই অনুযায়ী তৈরি করলেন রোবট লুনাবট।

চার শিক্ষার্থীর প্রতিভাকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরার মঞ্চ দিয়েছিল ন্যাশনাল অ্যারোনেটিকস অ্যান্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (নাসা)। ২০১৩ সালের ২০ থেকে ২৪ মে আয়োজন করে লুনাবোটিকস মাইনিং কম্পিটিশন। এই প্রতিযোগিতার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় অবস্থিত মহাকাশ গবেষণাকেন্দ্র নাসার কেনেডি স্পেস সেন্টারে তৈরি করা হয়েছে কৃত্রিম চন্দ্রপৃষ্ঠ। সেখানে অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, কলম্বিয়া, পোল্যান্ড, মেক্সিকো, ভারতসহ ৫০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে কৃতিত্বের সঙ্গে অংশগ্রহণ করে চুয়েটের দল টার্মিনেটর। প্রতিযোগিতার মোট তিনটি পর্ব থেকে দুটি পর্ব পার হয়ে ফাইনালপর্বের আগেই ছিটকে পড়েছিল চুয়েটের দল টার্মিনেটর। তবে বিশ্বমঞ্চের সেই ঝরে পড়া পরবর্তী সময়ে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল।

চুয়েটের শিক্ষার্থীদের তৈরি রোবট ‘রোভার মঙ্গল অভিযাত্রিক ৭১’।  সংগৃহীত
চুয়েটের শিক্ষার্থীদের তৈরি রোবট ‘রোভার মঙ্গল অভিযাত্রিক ৭১’। সংগৃহীত

স্বপ্ন যখন রোবট রপ্তানির

ক্যাম্পাসের গল্প–আড্ডায় সবার মুখে মুখে যন্ত্রমানব কারিগর রিনি ঈশানের কথা। পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে স্বপ্নকে এগিয়ে নিতে ‘প্ল্যানেটর বাংলাদেশ’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন তিনি। এই প্রতিষ্ঠানের মূল লক্ষ্যই হলো বাণিজ্যিকভাবে রোবট তৈরি করা।

এই প্রতিষ্ঠানের অন্যতম সাফল্য হলো রোবট ‘আইরা’। এটি একটি টেলি-প্রেজেন্স রোবট। মোবাইলের ইন্টারনেট ব্যবহার করে এটিকে দূর থেকেই নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। আইরার পর্দায় নিয়ন্ত্রককে যেমন অন্য সবাই দেখতে পারবে, তেমনি নিয়ন্ত্রকও অন্য সবাইকে দেখতে পারবে। অনেকটা ভিডিও কলের মতো। কিন্তু পার্থক্য হলো, এই রোবট চলাচলে সক্ষম, ফলে চিকিৎসক ও শিক্ষকেরা নিজের কর্মস্থলে উপস্থিত না থেকেও তাঁদের কাজ করতে পারবেন এই রোবটের সহায়তায়।

এ ছাড়া কর্মজীবী মায়েরাও পারবেন কর্মস্থলে থাকার সময় তাঁদের বাচ্চাদের খেয়াল রাখতে। সম্প্রতি রোবটটি রাশিয়ার স্কলকোভো ইনোভেশন সেন্টারে আয়োজিত স্টার্টআপ ভিলেজ নামক প্রদর্শনীতে জায়গা করে নিয়েছে। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানটি গত সাত বছরে রোবটিকস প্রশিক্ষণ প্রকল্পের মাধ্যমে প্রায় আট হাজার প্রকৌশলী ও শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে।

স্ব-পুনর্গঠনযোগ্য রোবটের যাত্রা  

হলিউডের তুমুল জনপ্রিয় সায়েন্স ফিকশনাল মুভি ট্রান্সফরমার অনেকেরই পছন্দ। এই মুভিতে দেখানো হয়েছিল একদল রোবট, যারা প্রয়োজন অনুযায়ী নিমেষেই আকৃতি পরিবর্তন করে। কিন্তু এই কল্পকাহিনিকেই বাস্তবে রূপ দিলেন প্ল্যানেটর বাংলাদেশ লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী রিনি ঈশান ও প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা রাকিব রেজা। তাঁদের সহযাত্রী হয়েছেন চুয়েটের সপ্তম ব্যাচের ছাত্র হাসানুল ইসলাম এবং একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৩ ব্যাচের শিক্ষার্থী কায়সার রায়হান। রোবটটি প্রধানত বিনোদনমূলক হলেও এটিকে ব্যবহার করা যাবে পরিদর্শন ও গোয়েন্দা রোবট হিসেবে।

বোমা নিষ্ক্রিয় করবে মাঈনুলের রোবট

বোমা নিষ্ক্রিয়করণ ও অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ কাজে রোবটের ব্যবহার উন্নত বিশ্বে হরহামেশাই দেখা যায়। বাংলাদেশকে এ ধরনের রোবটের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন চুয়েটের ১২ ব্যাচের শিক্ষার্থী মাঈনুল হাসান। তিনি উদ্ভাবন করেছেন একটি মানবসদৃশ রোবট, যা বোমা নিষ্ক্রিয়করণ, যুদ্ধক্ষেত্র ও অন্যান্য দুর্ঘটনায় উদ্ধার তৎপরতাসহ ঝুঁকিপূর্ণ, বিপজ্জনক নানা কাজে ব্যবহার করা যাবে। তিনি এর নাম দিয়েছেন হিউম্যানয়েড রোবট এসএম-১৮০৫। এটি বাংলাদেশে উদ্ভাবিত সব রোবটের চেয়ে আকারে বড় এবং আধুনিক। চার ফুট উচ্চতার রোবটটি ম্যানুয়াল ও অটোমেটিক—দুই মুডেই চলতে সক্ষম।

মঙ্গল ছোঁয়ার স্বপ্ন নিয়ে বিশ্বজয়

২০১২ সালে মঙ্গল গ্রহে প্রেরিত নাসার কিউরিওসিটি রোভারের কথা মনে আছে? বাংলাদেশ থেকেও এমন একটি রোভার যাবে মঙ্গলগ্রহে। এই গ্রহের দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে মাটির আর্দ্রতা, পরিবেশের তাপমাত্রা এবং দূষণ পরিমাপ করবে। এই তথ্য বিশ্লেষণ করে পাঠাবে পৃথিবীতে। ঠিক এমন স্বপ্নই দেখেছিলেন চুয়েটের ১২ ব্যাচের শিক্ষার্থী মাঈনুল হাসান। ২০১৩ সালে শুরু করেন স্বপ্নপূরণের কাজ। পরবর্তী সময়ে তাঁর নেতৃত্বে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আমানুল রিয়াদ এবং নাজিমুল ইসলাম মিলে গড়ে তোলেন মঙ্গল গ্রহে প্রেরণের উপযোগী রোভার মঙ্গল অভিযাত্রিক ৭১। ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার কেনেডি স্পেস সেন্টারে অনুষ্ঠিত নাসা হিউম্যান এক্সপ্লোরেশন চ্যালেঞ্জ এবং ইউকে ইউনিভার্সিটি রোভার চ্যালেঞ্জের জন্য মনোনীত করলেও নানান ভিসা জটিলতার কারণে অংশ নিতে পারেনি দলটি।

রোবটিকসে সাফল্যের কারণ

রোবট তৈরিতে চুয়েটের শিক্ষার্থীদের উত্তরোত্তর সাফল্যের মুখ্য কারণ হলো বিজ্ঞানচর্চার উপযুক্ত পরিবেশ। প্রায় এক যুগ ধরে এই পরিবেশ বজায় রাখছে অ্যান্ড্রোমিডা স্পেস অ্যান্ড রোবটিকস রিসার্চ অর্গানাইজেশন (অ্যাসরো) এবং রোবো মেকাট্রনিক্স অ্যাসোসিয়েশন (আরএমএ) নামের এই দুই সংগঠন। শিক্ষার্থীদের রোবটচর্চার উৎসাহ দিতে প্রতিবছর এই দুইটি সংগঠন জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ের নানা প্রতিযোগিতার সফল আয়োজক।

সাধারণ শিক্ষার্থীরা যেন বিনা মূল্যে কারিগরি সহায়তা পান, এ উদ্দেশ্যে অ্যাসরো ২০১২ সালে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সর্ব হলভিত্তিক রোবটিকস ল্যাব তৈরি করে। অ্যাসরো এরই মধ্যে সফলভাবে আয়োজন করেছে রোবটের যুদ্ধ ‘রোবোফাইট’। এ ছাড়া তাঁরা জাতীয় পর্যায়ে রোবরেস সিজন-১ ও টেকনোক্রেজ-২০১৯–এর সফল আয়োজক। সংগঠনটি শুধু বিশ্ববিদ্যালয় নয়, বরং মাধ্যমিক পর্যায়ের তরুণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে রোবট চর্চায় উৎসাহ জাগানোর জন্য নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠা পর থেকেই বিভিন্ন মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ব্যবহারিক ক্লাসে নিজেদের তৈরি আধুনিক যন্ত্র বিতরণ করে যাচ্ছেন সংগঠকেরা।

শুধু সাংগঠনিক কার্যক্রমে সীমাবদ্ধ নেই কার্যক্রম। এই সংগঠনের সদস্যরা নিয়মিত বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে বাজিমাত করে যাচ্ছেন। 

এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ২০১৪ সালে ডিজিটাল ইনভেনশনস ফেয়ারে প্রথম স্থান অর্জন, ২০১৭ সঙ্গে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত ফুটবোটে চ্যাম্পিয়ন। সর্বশেষ তাঁরা ২০১৮ সালে ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটিতে আয়োজিত ম্যাড ট্রেক রেসে চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন।

সাংগঠনিক দিক থেকে সমান তালে এগিয়ে যাচ্ছে রোবো মেকাট্রনিক্স অ্যাসোসিয়েশন। সংগঠনটি ২০১৬ ও ২০১৭ সালে জাতীয় পর্যায়ে আয়োজন করে ফুটবোট এবং এক্সপিডিশাস। এ ছাড়া এ বছরে তারা আয়োজন করে ‘এসো রোবট বানাই’। যেখানে সাধারণ শিক্ষার্থীদের আইডিয়ার ওপর ভিত্তি করে রোবট বানাই রোবো মেকাট্রনিক্স অ্যাসোসিয়েশন (আরএমএ)।

চুয়েটের মেকাট্রনিক্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রভাষক ও অ্যাসরোর পরামর্শক আবদুর রহমান বলেন, ‘ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা এবং আমাদের অ্যাসরো। রোবটিকস চর্চায় গবেষণা, প্রতিযোগিতামূলক অংশগ্রহণ থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রেই রয়েছে সমান বিচরণ।’