মার্কিন দলিলে মুক্তিযুদ্ধ: নথির পাতায় অতীতের দায়

নদী পেরোচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধারা, ১৯৭১। ছবি: সংগৃহীত
নদী পেরোচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধারা, ১৯৭১। ছবি: সংগৃহীত

একটি মার্কিন নথি অনুযায়ী, নয়জন মার্কিন সিনেটর ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন যে পূর্ব পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার যে নীতি নিয়ে অগ্রসর হচ্ছেন, তা সঠিক। মেরিল্যান্ডের কলেজ পার্কে অবস্থিত মার্কিন জাতীয় মহাফেজখানায় এ নথিটির আলোকচিত্র তুলেছিলাম ২০১২ সালে।

১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর তারিখটি ছিল বিশ্বমানচিত্রে বাংলাদেশ অভ্যুদয়ের দিনটি থেকে মাত্র ১০ দিন দূরে। এ রকম একটি সময়ে দাঁড়িয়েও নয়জন দুর্দান্ত সিনেটর একদম বুঝে উঠতে পারেননি, মাত্র ১০ দিন পরে কী ঘটতে যাচ্ছে। ওই দিন তাঁদের কথায় ভারত–পাকিস্তান সবশেষ যুদ্ধ পরিস্থিতি সম্পর্কে স্বয়ং পররাষ্ট্রমন্ত্রী সিনেটরদের ব্রিফ করেছিলেন।

যুদ্ধে বরং মার্কিন নীতি বিষয়ে কিছুটা ভিন্নমতাবলম্বী ছিলেন আরেক রাজনীতিক উইলিয়াম পি রজার্স। রজার্সকে বিভিন্ন নথিতে বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতিশীল মনে হয়েছে। তাঁর প্রতি কিসিঞ্জারকে বিরক্তি প্রকাশ করতেও দেখা গেছে। সাধারণভাবে কিসিঞ্জারের সঙ্গে ঘোরতর মতের অমিলের জন্য তিনি সুবিদিত। কিসিঞ্জারের নীতিকে তিনি ম্যাকিয়াভেলিয়ান মনে করতেন। একাত্তরের আগস্টে পাকিস্তানকে দিয়ে গোপনে চীনে কিসিঞ্জারের অভিযানের পরিকল্পনা রজার্সের কাছেও গোপন রাখা হয়। বেইজিং যাত্রার দিনই তিনি শুধু তা জানতে পারেন।

হোয়াইট হাউস ইয়ার্স বইটিতে কিসিঞ্জার লিখেছেন, রজার্স ছিলেন বেশ গর্বিত এবং তিনি নিজে আরও বেশি একগুঁয়ে। রজার্স ২০০১ সালে ৮৭ বছর বয়সে মারা যান। তিনি একজন সফল অ্যাটর্নি জেনারেল ছিলেন। ১৯৭৩ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক খেতাব ‘মেডেল অব ফ্রিডমে’ ভূষিত হন। 

যে নথিটি নিয়ে আমরা কথা বলছি, সেটি বেশ ব্যতিক্রম। এখানে দেখা যাচ্ছে, খোদ পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং নয়জন সিনেটর সবাই অবলীলায় এখানে একমত হয়েছেন যে নিক্সনের বাংলাদেশ নীতি অভ্রান্ত। তিন পৃষ্ঠার এ নথিটি তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম পি রজার্সের জবানিতে টাইপ করা। তবে এতে তাঁর পক্ষে সই করেছিলেন রাহমিলার নামে অন্য একজন, সম্ভবত মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের কোনো কর্মকর্তা।

রজার্সের জবানবন্দিতে সেখানে আছে, ‘আমি আজ প্রায় ১ ঘণ্টা ধরে সিনেট নেতৃত্বকে ভারত–পাকিস্তান যুদ্ধ সম্পর্কে অবহিত করেছি। প্রথমে তাঁদের ধারণা দিই সাধারণ পরিস্থিতি সম্পর্কে। ভারত যাতে পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক শক্তি প্রয়োগ না করে, সে জন্য মার্কিন প্রশাসন কীভাবে উপর্যুপরি চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, এরপর তার বিবরণ দিই। আমি অবশ্য ইয়াহিয়াকে দেওয়া আমাদের সুপারিশমালা এবং তার মধ্যে যেসব বিষয় তিনি মেনে নিয়েছেন, সে সম্পর্কে বিশদভাবে বলি।’

উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর সকালে যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে প্রদেয় ৮৭ দশমিক ৬ মিলিয়ন ডলারের অর্থনৈতিক সহায়তা স্থগিত করার ঘোষণা দেয়। বাস্তবে নিক্সন প্রশাসনের নানাভাবে পাকিস্তানকে সহায়তা দেওয়ার বিষয়টি তাদেরই নানা নথিপত্রে প্রকাশ পেয়েছে। আনুষ্ঠানিকভাবেই তারা মেনে নিয়েছে যে একাত্তরে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের প্রতি ঝুঁকে পড়েছিল, ‘দ্য টিল্ট’ নামে যা পরিচিত। এই সত্য সিনেটরদেরও অজানা থাকার কথা নয়।

রজার্স লিখেছেন, ‘সিনেটরদের আমি বললাম, আমরা কিন্তু এর সঙ্গে যুক্ত হব না।’ তিনি অবশ্য আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধে না জড়ানোর কথাও বলে থাকতে পারেন। রজার্স এ সময় উপমহাদেশে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার দীর্ঘ ঘৃণা এবং সংকটের বিবরণ দিয়ে বলেন, ‘এসব আমাদের কোনো কাজের ফল নয়।’ নিরাপত্তা পরিষদ বিষয়ে রজার্স সিনেটরদের বলেন, ‘আমি আমাদের অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করি। সামনে যে আমরা সাধারণ পরিষদে নেব, সেটাও বলেছি।’

নথির একটি অংশ যথেষ্ট অস্পষ্ট। ডেমোক্র্যাট–দলীয় সিনেটর জেমস উইলিয়াম ফুলব্রাইট, যাঁর নামে বিখ্যাত ফুলব্রাইট স্কলারশিপটি বিশ্বজুড়ে পরিচিত, সিনেট ফরেন রিলেশনস কমিটির দীর্ঘতম মেয়াদে সভাপতি ছিলেন। জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠারও ছিলেন বিরাট সমর্থক। মার্কিন কনসাল জেনারেল আর্চার ব্লাডের প্রতি কিসিঞ্জারের ‘অসদাচরণের’ পরে ফুলব্রাইট প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করে ব্লাডের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। এ ঘটনা ডিসেম্বরের আগের। সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি তত দিনে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠনে অনেক সাফল্য নিয়ে এসেছেন।

রজার্স লিখেছেন, ‘আমি ব্রিফিং শেষ করার পরে ফুলব্রাইটই প্রথম বললেন, পরিস্থিতিতে না জড়িয়ে আমরা অবশ্যই ঠিক কাজটি করেছি। তিনি আরও বললেন, মার্কিন নীতি বিষয়ে তাঁর কোনো সমালোচনা নেই। সিনেটর গর্ডন স্টেনিস বললেন, প্রেসিডেন্ট নিক্সনের নীতির প্রতি তিনি তাঁর অত্যন্ত শক্তিশালী সমর্থন ব্যক্ত করছেন। এ সময় আর যাঁরা উপস্থিত ছিলেন এবং একইভাবে নিজেদের মত ব্যক্ত করেছেন, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন মাইক ম্যানসফিল্ড, হিউ স্কট, রবার্ট পল গ্রিফিন, মার্গারেট েচজ স্মিথ, নোরিস কটোন, জর্জ আইকেন ও গর্ডন অ্যালোট।’

এই সিনেটরদের প্রায় সবাই প্রথিতযশা। তাঁদের সামান্য পরিচয় তুলে ধরা যাক।

সিনেটর স্টেনিস মারা যাওয়ার পর দ্য নিউইয়র্ক টাইমস লিখেছিল, ১৯৭০–এর দশকে কংগ্রেসে মার্কিন সামরিক বিষয়ে সবচেয়ে প্রভাবশালী কণ্ঠস্বর ছিলেন তিনি। ছিলেন ব্যাপকভাবে শ্রদ্ধাভাজন। সততা, নিষ্ঠা এবং ন্যায়পরায়ণতার জন্য বারংবার রাজনৈতিক বিষয়ে তদন্ত করতে সিনেট কেবল তাঁরই শরণাপন্ন হয়েছে। তাঁকে মার্কিন সিনেট প্রতিষ্ঠানটির বিবেক হিসেবে দেখা হয়। জীবনের সর্বশেষ নির্বাচনে তিনি কৃষ্ণাঙ্গদের ভোটে নির্বাচিত হয়েছিলেন। 

মাইক ম্যানসফিল্ড টানা ১৬ বছর সিনেটের মেজরিটি লিডার ছিলেন। মারা যাওয়ার পর দ্য নিউইয়র্ক টাইমস তাঁর সম্পর্কে লিখেছিল, ‘১৯৬০ ও ১৯৭০–এর দশকে মানবাধিকার–সংক্রান্ত উল্লেখযোগ্য সব আইন পাশে অনুঘটক ছিলেন মন্টানা থেকে নির্বাচিত এই ডেমোক্র্যাট সিনেটর।

রিপাবলিকান সিনেটর হাফ ডগেট স্কটের খ্যাতিও ছিল উদারপন্থী রাজনীতিক হিসেবে। কংগ্রেসে কাটানো ৩৪ বছরের মধ্যে শেষ ৭ বছর ছিলেন সংখ্যালঘু নেতা।

রবার্ট পল গ্রিফিন ছিলেন মিশিগানের কংগ্রেসম্যান ও সিনেটর। দুর্নীতিবিরোধী জিহাদি হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন। নিক্সনের অনুগত হিসেবে পরিচিত হলেও নিক্সনের পদত্যাগের আগেই তাঁর ওপর থেকে সমর্থন তুলে নিয়েছিলেন।

এক দশক প্রতিনিধি পরিষদে কাটিয়ে ১৯৪৯ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত সিনেটর ছিলেন মার্গারেট চেজ স্মিথ। তিনিই ছিলেন প্রথম রিপাবলিকান নারী প্রেসিডেন্ট প্রার্থী।

নিউ হ্যাম্পশায়ারের রিপাবলিকান সিনেটর নরিস কটোন ১৯৮৯ সালে মারা যাওয়ার পরে লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমস লিখেছিল, কটোন একজন আইকন। দারুণ স্বাধীন। একজন বিবেকবান মার্কিন রাষ্ট্রনায়ক।

রিপাবলিকান সিনেটর জর্জ আইকেন ১৯৮৪ সালে মারা গেলে ওয়াশিংটন পোস্ট লিখেছিল, ‘৩৪ বছর সিনেটে থাকা আইকেন স্বাধীনচেতা মানবাধিকার প্রবক্তা হিসেবে খ্যাতিমান ছিলেন। ভিয়েতনাম যুদ্ধে মার্কিন সংশ্লিষ্টতার সমালোচক ছিলেন।

রিপাবলিকান সিনেটর গর্ডন অ্যালোট বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধকালে ছিলেন সিনেট রিপাবলিকান পলিসি কমিটির চেয়ারম্যান। তিনি অবশ্য ছিলেন ভিয়েতনাম যুদ্ধে যেকোনো মূল্যে জয়ী হওয়ার পক্ষপাতী।

আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে রোহিঙ্গা গণহত্যার বিচারকে সামনে রেখে কয়েকজন মার্কিন সিনেটর মিয়ানমারের নীতির নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন। ১৯৭১ সালে প্রভাবশালী এই সিনেটররা গণহত্যার প্রতি মার্কিন নীতির নিন্দায় বিরত ছিলেন। সফল ও আকর্ষণীয় রাজনীতিকেরাও যে সব পরিস্থিতিতে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না, এ নথিটি তারই নমুনা। 

সিনেটরদের ওপরে বর্ণিত জীবনচিত্র থেকে এটা খুবই পরিষ্কার যে তাঁরা খুবই বর্ণাঢ্য ও সফল এক রাজনৈতিক জীবন অতিবাহিত করলেও বাঙালি জনগোষ্ঠীর স্বাধীনতার মূল্য বুঝে উঠতে পারেননি। চেষ্টা করেননি বাঙালির গণহত্যায় তাঁদের করণীয় নির্ধারণ করতে। আমরা আশা করব, নতুন প্রজন্মের মার্কিন সিনেটররা ইতিহাসের দায়িত্বের প্রতি নির্লিপ্ত থাকবেন না। অতীতের ভুল শুধরে তাঁরা নিজেদের ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করবেন।

মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক