ডাক্তারদের কষ্ট কেউ বোঝে না

করোনাকালে সম্মুখসারির যোদ্ধা হিসেবে দিনরাত লড়ে যাচ্ছেন চিকিৎসকেরা। পরম মমতায় দাঁড়াচ্ছেন মানুষের পাশে। কিন্তু চিকিৎসকদের করোনাকালের গল্পগুলো কি আমরা জানি, বুঝি কি তাঁদের কষ্ট? করোনা ইউনিটে কাজ করা কয়েকজন চিকিৎসকের জীবনের গল্প জানাচ্ছেন তাঁদের সহকর্মী আহাদ আদনান

কোভিডের এই নির্মম সময়ে চিকিৎসকদের অনেকের পরিবারেই রয়েছে অনেক বেদনার গল্প।
ছবি: সাইফুল ইসলাম

কোভিড ওয়ার্ডে ডিউটি তাঁর। ইফতার হবে কিছুক্ষণ পর। সহকর্মী চিকিৎসক আপু কথা বলছেন ভিডিও কলে। দূরে থেকেও শুনতে পাচ্ছি কান্নার শব্দ। অশ্রুর বাষ্পে ঘোলা হচ্ছে গগলস। ইফতারের পর শুনলাম তাঁর না–বলা গল্প।

‘ছেলেমেয়েটাকে শেষ কবে জড়িয়ে ধরেছি মনে নেই। বাসায় ফিরে ঢুকে পড়ি আলাদা ঘরে। দূর থেকে ওরা মাকে দেখে, ডাক দেয়, কান্না করে, ছুড়ে দেয় চুমু। তারপর দরজা বন্ধ। এভাবে আর নিতে পারছি না। ছোট ছেলেটা আজ রোজা রেখেছিল। জীবনের প্রথম রোজা। রাতে একবার ভিডিও কলে কথা হয়েছিল সাহ্​রির সময়। এখন আবার কথা হলো ইফতারের আগে। বারবার বলছিল, আমাকে ছাড়া ইফতার করবে না।’

কণ্ঠ জড়িয়ে আসে আমার সহকর্মী চিকিৎসক আপুর।

এ গল্প আমার এক স্যারের। তিনি ও তাঁর স্ত্রী একটি করোনা হাসপাতালের পরামর্শক চিকিৎসক। তাঁর বাসায়ও আছেন ছোট সন্তান আর বৃদ্ধ বাবা। একবার ম্যাডামের কোভিড ‘পজিটিভ’ হয়েছিল। অসুস্থ বৃদ্ধ বাবাকে তাই রাখতে হয়েছিল পাশেই, তাঁর বোনের ফ্ল্যাটে। স্যার এখন বাবাকে দেখেন দূর থেকে, ফ্ল্যাটের এক মাথায় দাঁড়িয়ে।

আমার আরেক চিকিৎসক বন্ধু এখন অসুস্থ হয়ে পড়ছেন মানসিকভাবে। চট্টগ্রামের একটি কোভিড হাসপাতালে তাঁর কর্মস্থল। সেদিন এক রাতেই তাঁর ওয়ার্ডে মারা যান তিনজন রোগী। সিপিআর (কার্ডিও পালমোনারি রিশাসিটেশন) দিতে দিতে হাত ব্যথা।

মৃত্যুসনদ লিখতে গিয়ে হাত কাঁপছে। বাকি গল্পটা তাঁর মুখেই শুনি, ‘বাইরে মৃত রোগীদের স্বজনদের আহাজারি। জীবনে অনেক মৃত্যুসনদ লিখেছি। কিন্তু সেই রাতে আমার নিজেরও যেন বুক ধড়ফড় করছে। কত রাত এভাবে মৃত্যু দেখতে দেখতে কাটাব? ভোরের দিকে আবার ডাক পড়ল। আরেক মুমূর্ষু রোগী চলে গেছে এপনিয়ায় (শ্বাস বন্ধ হওয়া)। আবার সিপিআর, আবার যুদ্ধ যমের সঙ্গে। হাত–পা কাঁপছিল আমার। একবার মনে হচ্ছিল, এই বুঝি পড়ে যাচ্ছি।’

ওই রাতে আরেকটি মৃত্যুসনদও লিখতে হয়েছিল আমার সেই বন্ধুটিকে। এসবের ফলাফল, এখন একদিকে তাঁকে খেতে হচ্ছে উচ্চ রক্তচাপ আর বুক ধড়ফড়ের ওষুধ, আরেক দিকে তিনি সময় নিয়ে রেখেছেন মানসিক চিকিৎসকের কাছ থেকে।

আরেক কোভিড হাসপাতালের আমার এই চিকিৎসক বন্ধুর গল্পটি হয়তো অনেকেরই জানা। কয়েক সপ্তাহ আগেও দেশে তীব্র সংকট দেখা দিয়েছিল আইসিইউ শয্যার। অপেক্ষমাণ মুমূর্ষু রোগীর স্বজনদের সারি দীর্ঘ হচ্ছিল ঘণ্টায় ঘণ্টায়। তেমনি এক রোগীর ছেলে ছিল তাঁর পরিচিত। ওঁকে বারবার বলতে হচ্ছিল, ‘কোনো শয্যা ফাঁকা নেই।

অতি মুমূর্ষু রোগীই আছেন ১১ জন। যেকোনো সময় যেকোনো কিছু হয়ে যেতে পারে।’ তখন সেই ছেলের ছিল একটাই জিজ্ঞাসা, ‘ভাই, কেউ মরছে আর? ভাই, এখনো মরে নাই? একজন মরলেও একটু বইলেন ভাই। একজন মরলেও একটু খোঁজ দিয়েন।’

কোভিডের এই নির্মম সময়টাতে অনেকের পরিবারেই রয়েছে এমন বেদনার গল্প। সামনের সারির পেশাজীবী হিসেবে চিকিৎসকদের গল্পগুলোও তাই এত করুণ, হৃদয়বিদারক। কিছু গল্প অনেকের জানা। কিছু কথা জানি শুধু আমরা সহকর্মী চিকিৎসকেরা। আর কিছু গল্প আছে, কেউ জানে না, জানবেও না কোনো দিন।

যেমন আমার এক সহকর্মী নারী চিকিৎসকের গেল বছরের গল্পটিও সবার অজানা। সম্পূর্ণ নিজ খরচে স্নাতকোত্তর পড়াশোনা করছেন তিনি, আর বিনা বেতনে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন সরকারি হাসপাতালে। তাঁর স্বামী কাজ করেন আরেক কোভিড হাসপাতালে।

তাই তাঁকে থাকতে হয় মা–বাবার সঙ্গেই। গত বছর হঠাৎই প্রথমে তাঁর বাবা, পরে মা করোনায় আক্রান্ত হলেন। তো তিনি ছাড়া তাঁদের দেখাশোনার কেউ নেই। অগত্যা পড়ালেখা জলাঞ্জলি দিয়ে তিনি দিনের পর দিন পড়ে থাকলেন মা–বাবার সঙ্গে। আগে থেকেই অসুস্থ ছিলেন তাঁরা। ফলে যুদ্ধে হেরে একদিন বিদায় নিলেন বাবা। মা বেঁচে থাকলেও করোনা–পরবর্তী জটিলতায় এখন প্রচণ্ড দুর্বল। এই গল্প মেয়েটা বলেন না কাউকে। একদিন শুধু কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলেন, ‘আমার বাবার মৃত্যুর জন্য মনে হয় আমিই দায়ী। আমার কোনো পিপিই ছিল না, মাস্কও ছিল নকল। তারা তো বাসাতেই বন্দী থাকত। হাসপাতাল থেকে ভাইরাস আমি ছাড়া আর কে নিয়ে গেছে, বলেন?’

চিকিৎসকদের এমন আত্মত্যাগের গল্প তাই চাপাই পড়ে থাকে। এক ডা. মইনের পরিবার ছাড়া ক্ষতিপূরণ পায় না কেউ। প্রতিশ্রুত প্রণোদনা শুধু তাদের জন্যই ব্রাত্য। গরমে রেইনকোট আর নকল মাস্ক পরে ডিউটির দায় নেয় না রাষ্ট্রের কেউ।

স্নাতকোত্তর পড়াশোনার নামে বিনা বেতনে সেবা দেওয়া, আর বেসরকারি হাসপাতাল–ক্লিনিকে কর্তব্যরত অনেক চিকিৎসকের পারিশ্রমিক যে একজন গাড়িচালকের বেতনের সমান, তা নিয়ে আলোচনা হয় না কোনো মিডিয়ায়, এসি রুমের টক শোতে।

এত বিপুল অবহেলা, অব্যবস্থাপনা আর অপ্রাপ্তি নিয়ে কোন সেক্টরে কে কাজ করছেন? অথচ এই সব ভুলে যাওয়া সম্ভব একটু ধন্যবাদ আর কৃতজ্ঞতার পরশ পেলে। এভাবে দিনের পর দিন একপেশে হলুদ অণুবীক্ষণযন্ত্রের নিচে কত দিন দায়িত্ব পালনে সুচারু হওয়া সম্ভব? আপনার চেয়ে সহস্রগুণ প্রবল শত্রু যুদ্ধে জয়ের ক্ষেত্রে তেমন প্রতিবন্ধকতা নয়। তবে লক্ষগুণ শক্তিশালী হয়েও আপনি হেরে যেতে পারেন মনোবল ভেঙে পড়লে।

(এই প্রতিবেদনে যেসব চিকিৎসকের গল্প রয়েছে, তাঁদের নাম–পরিচয় ঊহ্য রাখা হয়েছে।)


ডা. আহাদ আদনান: রেজিস্টার, শিশু–মাতৃস্বাস্থ্য ইনিস্টিিটউট (আইসিএমএইচ), মাতুয়াইল, ঢাকা।