ঈদ আনন্দের। ছোটবেলা থেকে সবারই তাই মনে হয়। অন্য দিনগুলো থেকে নানা দিক দিয়ে দিনটা বিশেষ হয় বলে, আনন্দের।
যখনই দিনটা আসে, পেছনের কথা মনে পড়ে খুব। মনে পড়ে গ্রামে সন্ধ্যাবেলায় চাঁদ দেখতে পাওয়ামাত্রই বাজারের মাইকের দোকান থেকে বাজিয়ে দেওয়া হতো, ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশীর ঈদ।’ পুরো গ্রামে ছড়িয়ে যেত সেই আনন্দের বার্তা। ওই সন্ধ্যায় বইপত্র নিয়ে বসতে হতো না ছোটদের, বাইরে যেতে মানাও ছিল না।
ব্রিজের ওপর, রাস্তার মোড়ে, চায়ের দোকানগুলোর সামনে, পুকুরঘাট বা বাজারের এখানে–ওখানে মানুষেরা জটলা পাকিয়ে গল্পে মেতে উঠত। সেসব গল্প হতো এমনি এমনি, কিন্তু এটি ছিল একসঙ্গে হওয়ারও উপলক্ষ। এই মানুষেরা পাশাপাশি বাস করে, সবাই সবাইকে প্রতিদিন দেখে, কথা হয়; তবে চাঁদ দেখার পর উচ্ছ্বাস, আনন্দ আর উৎসবের আমেজ তাদের বানিয়ে দিত অন্য নতুন মানুষ।
এদিক–সেদিক থেকে জোরে জোরে কথা, হাসি ভেসে আসত। পটকা ফোটাচ্ছে তরুণেরা, ছোটরা তারাবাজি জ্বালিয়ে ছোটাছুটি করছে—যেদিকে চোখ যায়, গমগম করত ঈদ, এসেছে ঈদ এসেছে ভাব।
ঈদগাহে ঢোকার মুখে বড়–ছোটরা মিলে শুরু করে দিত দেবদারুপাতা দিয়ে তোরণ বানানোর কাজ। প্রতিবছরের কাজ বলে সবার তা জানা। তাই যে যখন পারে, সেই আনন্দে শামিল হতে ছুটে আসত। সে ধুমধাম চলত গভীর রাত পর্যন্ত। হ্যাজাকের আলো ঘিরে উৎসবে হইহই করত রাতের পোকারাও।
রঙিন ঘুড়ির কাগজ দিয়ে সাজানোর জন্য নকশা কাটাকাটি, সেই কাগজ ফালি করে কেটে এ রঙের পরে ও রং জুড়ে দিয়ে শিকল বানানো—কী যে আনন্দের ছিল! অনেকে মিলে কাগজের তিন কোনা পতাকা কেটে কেটে চিকন দড়িতে আঠা দিয়ে লাগাতাম। তা দিয়ে ঘিরে ফেলা হতো পুরো ঈদগাহ। গুরুজনেরা গরম জিলাপির ঠোঙা নিয়ে আসতেন, ‘আয়, খা তোরা।’
বাজারের দোকানপাট এমনিতে বন্ধ হয়ে যায় রাত দশটার দিকে। ঈদের আগের রাত ছিল অন্য রকম। যেন গভীরই হতো না। সে সন্ধ্যায় বড় দোকানগুলোয় জ্বালানো হতো হ্যাজাক লাইট। মানুষের চলনে–বলনে আর বাড়তি আলোয় সেই রাত্রির রূপ জানান দিত, আগামীকাল ঈদ।
ময়রার দোকানের আশপাশে গরম, নতুন মিষ্টির ঘ্রাণ, কাপড়ের দোকানে সামনে নতুন কাপড়ের গন্ধ আর দরজির দোকানে দোকানে পায়ে চালানো সেলাই মেশিনের ঝোড়ো শব্দে আনন্দগ্রামে পরিণত হয়ে যেত আমাদের পারুলিয়া।
সে পারুলিয়াকে পারুলিয়া গেলে আর খুঁজে পাওয়া হয় না। নিয়ম এ রকমই। ছোট ছিলাম, এখন ছোট নেই। আমরা বলি দিনবদল, আসলে দিন বা রাত—কোনোটারই রং বদলায় না। বদলায় মানুষ, মানুষের ধরন।
কোনো কোনো মনে পেছনের সৌন্দর্য, শোভার টান থেকেই যায়। মানুষে মানুষে সম্পর্ককে ঝালাই করে নেওয়ার সুযোগ, উপলক্ষ ছিল ঈদ। ঈদ বলতে এ রকমই বুঝত সবাই, অনুভব এমনই ছিল।
এখন পাল্টে গেছে আনন্দ প্রকাশ ও উৎসব উদ্যাপনের ধরন। এখন ঈদের চাঁদ দেখা গেছে—খবরটা শোনা হয় টেলিভিশন খবরে। দেখার চেষ্টা করে না দেখতে পেলেও চাঁদ দেখা কমিটির বরাত দিয়ে জানানো হয়, ঈদের চাঁদ দেখা গেছে। আগামীকাল ঈদ।
তার আগে এই জীবন ঘিরে উড়তে থাকে বড়কালের বিচিত্র ঈদের আমেজ। খবর বের হয়, এই ঈদ লেহেঙ্গটার দাম আড়াই লাখ টাকা। ঈদ উপলক্ষে কোটি টাকার ফ্ল্যাটে বিশেষ ছাড়। অমুক হোটেলে ঈদে মধ্যাহ্নভোজের দারুণ অফার। অফারের শেষ নেই। সব অফারেই বিচ্ছিন্ন হওয়ার সাদর আমন্ত্রণ। নিজেরা নিজেরা ধুমধামে ঈদ উপ্যাপন করো—সেটাই বিশেষ। পাশাপাশি বা সামনাসামনি বসবাস করা মানুষদের সঙ্গে দেখা হয় না। পরস্পরের দরজা থাকে বন্ধ। লিফটে দেখা হয়ে গেলে নিরুপায় হাসি, মেকি কুশল বিনিময়—এভাবেই চলে বিশেষ দিন উদ্যাপন।
দাওয়াত দেওয়াদেওয়ি, উপহার লেনদেনের পেছনে থাকে কড়া হিসাব। দিনটায় অমুক অমুককে ফোন করে হে হে করতে হবে। অমুক অমুকের বাড়ি হাজিরা দিয়ে আসা জরুরি—এমন অঙ্ক কষা, ঘাড়ে ধরা ও দেখানো উদ্যাপনেই এখন আনন্দ। আনন্দকেও হতে হবে লাভজনক। জীবনযাপনের চলতি ফর্মুলা ডিঙিয়ে পুরোনোতে কে ফিরতে চায়! যদি চায় কেউ, অস্বস্তি হবে। মনে মনে প্রশ্ন জাগবে, কোন দেশে থাকে এই লোক! সৌভাগ্য, সে প্রশ্ন থাকে গোপন।
তবে ব্যতিক্রমও আছে, আছে বলেই পুরোনো টিকে থাকে। সব সমান হয়ে গেলে পুরোনোর জন্য মায়া, দুঃখ করার দরকারই পড়ত না।
গত বছরের ঈদে কাছের মানুষদের কাছে পাওয়া যায়নি। ঈদ যে বিশেষ, তা ২০২০–এ নতুন করে, বিশেষ করে বুঝতে পেরেছে মানুষ। বিচ্ছিন্নতা যে অসুন্দর, তা–ও তো বোঝা হয়েছে। পাশে থাকি, হাসি আর জানান দিই ভালোবাসি—সেটাই ঈদ, উদ্যাপন।