বাংলাদেশে সত্যজিৎ

পুর্বপুরুষ এই বঙ্গের বাসিন্দা হলেও সারা জীবনে দুইবার মাত্র বাংলাদেশে এসেছিলেন সত্যজিৎ রায়। দুবারই ঢাকাতেই সীমাবদ্ধ ছিল তার গতিবিধি। প্রথমবার মায়ের সঙ্গে এসে ছিলেন দুই কী তিনদিন। তখন তার বয়স মোটে পাঁচ কী ছয়, ঢাকা তখন ব্রিটিশ বাংলার দ্বিতীয় গুরুত্বপুর্ণ নগরী। আর দ্বিতীয়বার ছাত্রলীগের আমন্ত্রণে পশ্চিমবঙ্গের আরো কয়েকজন শিল্পী সাহিত্যিেকর সঙ্গে এসেছিলেন, ছিলেন এক দিনেরও কম। তখন তিনি ৫০ বছরের পরিনত মানুষ, বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্রকার, আর ঢাকা সদ্যস্বাধীন এক দেশের রাজধানী।

আরও কয়েকবার আসার কথা হয়েছিল। পদ্মানদীর মাঝি এখানেই করার কথা ছিল, বাবা সুকুমার রায়কে নিয়ে তথ্যচিত্র বানানোর সময়ও আদি ভিটেমাটির ছবি তোলার জন্য আরেকবার আসার পরিকল্পনা হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনোটাই আর বাস্তবরূপ লাভ করেনি।

তবে সশরীরে আর না আসলেও বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে তার নিয়মিত যোগাযোগ ছিল আমৃত্যু। কলকাতায় গেলে তার সঙ্গে দেখা করতেন চিত্রালী সম্পাদক এস এম পারভেজ, চলচ্চিত্রকার আলমগীর কবির। শোনা যায় আলমগীর কবিরের ধরিয়ে দেওয়া তার ছবির একটা ভুল সংশোধন পর্যন্ত করেছিলেন সত্যজিৎ। আলোকচিত্রী আমানুল হক আর সাইদা খানম তো পারিবারিক সদস্যই হয়ে উঠেছিলেন। আর বিয়েতে দাওয়াত না-করায় ববিতাকে রীতিমতো অনুযোগই করেছিলেন।

বাংলাদেশের সাহিত্যও যে নিয়মিতই পরতেন তার প্রমাণ শাহেদ আলী আর সেলিনা হোসেনের লেখা দুটি গল্পের তার করা মুল্যায়ন। কারো রেকমেন্ডশনে না, নিজেই গল্প দুটোর খুঁজে বের করেছিলেন সত্যজিৎ, তার মধ্যে সেলিনা হোসেনের গল্পটা তো একেবারেই নতুন, আর সেলিনা হোসেনও তখন বিখ্যাত কেউ না। বোঝাই যায় বাংলাদেশের সাহিত্য নিয়মিতই পড়তেন তিনি। বাংলাদেশের পত্রপত্রিকাও যেতো তার কাছে। বিটিভিও যে দেখতেন তার প্রমাণ, মুস্তফা মনোয়ারের রক্তকরবী। নাটকটি ভালো লাগার কথা সে সময় কাউকে কাউকে তিনি বলেছিলেন।

সত্যজিৎ জন্মশতবর্ষে বাংলাদেশের সঙ্গে তার সম্পর্কের বয়ান নিয়েই আমাদের এই আয়োজন।

১৯৭২ সােলর ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্রলীগের আমন্ত্রণে ঢাকা আসেন সত্যজিৎ রায়। অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত এই সফর সাকল্যে ২৪ ঘণ্টাও স্থায়ী ছিল না। ফ্লাইট বিলম্বিত হওয়ায় সকালের বিমান আসতে আসতে দুপুর হয়ে যায়। বিকেলেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ, সন্ধ্যায় পল্টনে ভাষণ; পরদিন সকালে এফডিসি ঘুরে সোজা এয়ারপোর্ট। ইন্টারকন্টিনেন্টালে তাঁর থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল। কিন্তু ঋত্বিক ঘটক প্রমুখের সঙ্গে থাকবেন বলে অপেক্ষাকৃত ছোট হোটেল পূর্বাণীতে গিয়ে ওঠেন। এই পূর্বাণীতেই তাঁর সঙ্গে দেখা করেন কবি জসীমউদ্দীন। এরপর আসেন আমানুল হক। ’৬৫-র পর দেখা। নানা বিষয়ে জমে থাকা কথা বলতে বলতে কখন যে রাত দুটো বেজে যায়, টেরও পাননি। আলাপের মাঝে মাঝেই দূর থেকে ভেসে আসা স্টেনগানের আওয়াজ সত্যজিৎকে উত্কণ্ঠিত করে। তাঁর কাছে এ সময় যুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশের সংক্ষিপ্ত একটি চিত্র তুলে ধরেন আমানুল হক।

বক্তৃতা

‘আমার রক্তে বইছে বাংলা ভাষা’

সত্যজিৎ রায়

বহুদিন থেকে শহীদ দিবসের কথা শুনে আসছি। একুশে ফেব্রুয়ারির কথা শুনে আসছি। কিন্তু এখানে এসে নিজের চোখে না দেখলে আমি বিশ্বাস করতে পারতাম না, আমি বুঝতে পারতাম না যে আপনারা বাংলা ভাষাকে কতখানি ভালোবাসেন। বাংলা ভাষা যখন বিপন্ন, তাকে বাঁচানোর জন্য যে সংগ্রাম হয়েছিল, তাতে যাঁরা আত্মোত্সর্গ করেছেন, তাঁদের যে কতখানি শ্রদ্ধা করেন আপনারা, তাঁদের স্মৃতিকে, সেটা আমি আজকে এখানে এসে বুঝতে পারছি।

আমরা যারা পশ্চিমবঙ্গে থাকি, আমরাও বাংলা ভাষাকে ভালোবাসি। এটা ঠিক যে পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতির মধ্যে আরও পাঁচ রকম সংস্কৃতির প্রভাব এসে সেটাকে একটা পাঁচমিশালি ভাব এনে দিয়েছে। ইংরেজির প্রভাব আমরা এখনো পশ্চিমবঙ্গে সম্পূর্ণ কাটিয়ে উঠতে পারিনি। তার একটা কারণ এই বোধ হয় যে পশ্চিম বাংলা হলো ভারতবর্ষের একটা প্রাদেশিক অংশমাত্র। কিন্তু তাই বলে এই নয় যে আমরা বাংলা ভাষাকে ভালোবাসি না। বাংলা সাহিত্য, বাংলা গান, বাংলা চলচ্চিত্র, বাংলা থিয়েটার—এই সবই পশ্চিমবঙ্গে এখনো বেঁচে আছে, টিকে আছে। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, বঙ্কিমচন্দ্র, শরত্চন্দ্র—এঁদের আমরা এখনো ভালোবাসি।

আমি ব্যক্তিগতভাবে বলতে পারি যে আমি আজ ২০ বছর ধরে বাংলা ছবি করছি। এর মধ্যে বহুবার বহু জায়গা থেকে অনুরোধ এসেছে যে আমি বাংলাদেশ, বাংলা ভাষা পরিত্যাগ করে অন্য দেশে, অন্য ভাষায় চিত্র রচনা করি। কিন্তু আমি সেই অনুরোধ বারবার প্রত্যাখ্যান করেছি। কারণ, আমি জানি যে আমার রক্তে যে ভাষা বইছে, সে ভাষা হলো বাংলা ভাষা। আমি জানি যে সেই ভাষাকে বাদ দিয়ে অন্য ভাষায় কিছু করতে গেলে আমার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাবে, আমি কূলকিনারা পাব না, শিল্পী হিসেবে আমি মনের জোর হারাব।

আমি ছেলেবেলা থেকে শুনে আসছি যে পূর্ববঙ্গে নাকি আমার দেশ। আমার ঠাকুরদাদা উপেন্দ্রকিশোর রায়ের নাম হয়তো আপনারা কেউ কেউ শুনেছেন। আমার তাঁকে দেখার সৌভাগ্য হয়নি, কিন্তু শিশুকাল থেকে আমি তাঁর রচিত ছেলেভোলানো পূর্ববঙ্গের কাহিনি টুনটুনির বই পড়ে এসেছি, ভালোবেসে এসেছি। তাঁর রচিত গানে আমি পূর্ববঙ্গের লোকসংগীতের আমেজ পেয়েছি। যদিও এ দেশে আমি আসিনি, আমার দেশে আমি কখনো আসিনি বা স্থায়ীভাবে আসিনি; এই সব গান, এই সব রূপকথা শুনলে আমার মনে হতো যে এই দেশের সঙ্গে আমার নাড়ির যোগ রয়েছে।

যখন আমার পাঁচ কি ছয় বছর বয়স, তখন আমি একবার ঢাকা শহরে এসেছিলাম। দু-তিন দিন মাত্র ছিলাম। আমার মামাবাড়ি ছিল ওয়ারীতে, র‌্যাঙ্কিন স্ট্রিটে। সে বাড়ি এখনো আছে কি না জানি না, সে রাস্তা এখনো আছে কি না জানি না। বাড়ির কথা কিছু মনে নেই, মনে আছে শুধু যে প্রাচীরে বাঁদরের উপদ্রব। সে বাঁদর এখনো আছে কি না, তা-ও আমি জানি না।

তারপর মনে আছে পদ্মায় স্টিমারে আসছি, ভোরবেলা ঘুম ভেঙে গেছে, মা আমাকে বাইরে ডেকে এনে দেখাচ্ছেন যে পদ্মার ওপর সূর্যোদয় হচ্ছে। আর দেখাচ্ছেন যে পদ্মা আর শীতলক্ষ্যার জল যেখানে এসে মিশেছে, সেখানে এক নদীর জলের সঙ্গে আরেক নদীর জলের রঙের কত তফাত। সেই থেকে বারবার মনে হয়েছে যে একবার নিজের দেশটা গিয়ে দেখে আসতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু সে আশা, বিশেষত দেশ বিভাগের পর, ক্রমেই দুরাশায় পরিণত হতে চলেছিল। হঠাৎ কিছুদিন আগে ইতিহাসের চাকা ঘুরে গেল, আমার কাছে আমার দেশের দরজা খুলে গেল এবং আজ শহীদ দিবসে এসে, আপনাদের সামনে দাঁড়িয়ে, ঢাকা শহরে এসে আমার স্বপ্ন অন্তত কিছুটা অংশে সফল হলো।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে শ্যামল মিত্র ও সত্যজিৎ রায়

এবার আমি অনেক জরুরি কাজ ফেলে চলে এসেছি। এবার আর বেশি দিন থাকা সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু আমার ইচ্ছা আছে, আমার আশা আছে যে অদূর ভবিষ্যতে আমি আবার এ দেশে ফিরে আসব, এ দেশটাকে ভালো করে দেখব। এ দেশের মানুষের সঙ্গে এমনভাবে জনসভায় নয়, সামনাসামনি, মুখোমুখি বসে কথা বলে তাদের সঙ্গে পরিচয় করব। এ আশা আমার আছে।

আমি আর বিশেষ কিছু বলতে চাই না, সংগীতের অনুষ্ঠান রয়েছে। আপনারা যে আমার কাজের সঙ্গে পরিচিত বা আমার কাজ সম্পর্কে যে আপনাদের কৌতূহল আছে, সে খবর আমি এর আগেই পেয়েছি। কয়েক বছর আগে যখন মহানগর ছবি এখানে দেখানো হয়েছিল, তাতে এখানকার জনসাধারণ কী ধরনের আগ্রহ, কৌতূহল প্রকাশ করেছিল এবং তার ফলে কী ঘটনার উদ্ভব হয়েছিল, সে খবর আমার কানে যখন প্রথম পৌঁছায়, আমি সে কথা বিশ্বাস করিনি। কিন্তু তারপর এখান থেকে বহু পরিচিত-অপরিচিত ব্যক্তি, বন্ধু আমাকে চিঠি লিখে, খবরের কাগজের খবর কেটে পাঠিয়ে, ছবি কেটে পাঠিয়ে আমাকে জানিয়েছিলেন সেই ঘটনার কথা। তখন বিশ্বাস হয়েছিল। আর বিশ্বাস হলে আমি হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। আমি ভাবতে পারিনি যে এটা হতে পারে। একজন শিল্পী হিসেবে এর চেয়ে বড় সম্মান, এর চেয়ে গর্বের বিষয় আর কিছু হতে পারে না।

গত ২০ বছরে অনেক জায়গায় অনেক দেশে অনেকবার নানানভাবে সম্মানিত হওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। কিন্তু আমি জোর গলায় আজকে এখানে দাঁড়িয়ে এই শহীদ দিবসের পুণ্য তিথিতে আমি বলতে পারি যে আজকের যে সম্মান, সে সম্মানের কাছে আগের সমস্ত সম্মান হার মেনে যায়। এর চেয়ে বড় সম্মান আমি কখনো পাইনি আর আমার মনে হয় না, আমি আর কখনো পাব।

জয় বাংলা।

আমানুল হকের সঙ্গে সত্যজিৎ রায়

মুল্যায়ন

বিশ বছরের বেশি আমানুলকে জানি

সত্যজিৎ রায়

বাংলাদেশের মানুষের জীবনযাত্রা নিয়ে আমানুল হকের ছবির বই করার কথা ছিল। সে বইয়ের সম্পূর্ণ টেক্সট লিখে দিতে চেয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়। কিন্তু তাঁর অকালপ্রয়াণে কাজটা অসম্পূর্ণই থেকে যায়। এখানে সত্যজিতের লিখে দেওয়া সেই অসমাপ্ত রচনার অনুবাদ।

কল্পনাপ্রবণ, দক্ষ আর উদ্যমী এক আলোকচিত্রী হিসেবে বিশ বছরের বেশি আমানুল হককে জানি। সময়ের সঙ্গে কারিগরি যে অগ্রগতি, তার সঙ্গে তাল রেখে সে চলেছে আর যথার্থের সৃষ্টিশীল ব্যাখ্যাতা হিসেবে তার যে লক্ষ্য, তাকে আরও অনেক দূর এগিয়ে নিতে এগুলোকে কাজে লাগিয়েছে। এক প্রজন্মের বেশি দৃশ্যত তার দেশের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রকেই সে ধারণ করেছে, এতে বাঙালি জীবন ও সংস্কৃতির সামগ্রিক প্রকাশের প্রতি তার গভীর ভালোবাসা প্রকাশ পেয়েছে। প্রামাণ্য রীতিতে চলচ্চিত্রে রূপায়িত করার যোগ্যতাও তার আছে। বোঝা যায়, চলচ্চিত্রেরও েস কত মনোযোগী ছাত্র—ষাটের প্রথম দিককার আমার লিখনরীতির পর্যবেক্ষক। আশা করি, আমানুলের দুর্লভ গভীরতা তাঁর প্রাপ্য স্বীকৃতি আদায় করে নেবে।

কথাবার্তা

অকপট সত্যজিৎ রায়

আমানুল হক

১৯৬৫-তে কলকাতা ছেড়ে আসার বহু আগে থেকেই কাপড়ের ঝোলাব্যাগে লুকোনো টেপরেকর্ডারে সত্যজিৎ রায়ের মুখের কথা ধরে রাখতে শুরু করেন আমানুল হক। খট করে রেকর্ডারের টেপ শেষ হয়ে গেলে একবার ধরাও পড়ে যান। ‘ব্যাগের ভেতর তোমার যন্ত্রটি কি চলছিল?’ জানতে চান সত্যজিৎ। ‘হ্যাঁ’ শোনার পরও নির্বিকারই ছিলেন রায়! আমানুলের প্রতি এতটাই ছিল আস্থা ও প্রশ্রয়।

সন্দীপ রায়ের প্রথম ছবি ফটিকচাঁদ-এর প্রথম প্রদর্শনী উপলক্ষে ১৮ বছর পর ‘৮৩তে আবার যখন কলকাতার যান, তখনো তার সঙ্গী ছিল রেকর্ডার। প্রতিদিন দীর্ঘ সময় ধরে নানা প্রসঙ্গে কথা হতো। এভাবেই গোপনে টেপের ফিতায় ধরে রেখেছেন সত্যজিতের অনেক মুহূর্ত। নিচের টুকরো আলাপগুলো তারই সংক্ষিপ্ত লিখিত রূপ।

আমানুল হক: সুদীর্ঘ ১৮ বছরের সময়সীমায় আপনি পৃথিবীর অনেক জায়গায় গিয়েছেন। তা ছাড়া ভারতবর্ষই তো বিশাল দেশ। এই পরিপ্রেক্ষিতে বোড়াল গ্রামের পাশে এক রাস্তা দিয়ে বংশী চন্দ্রগুপ্তের সঙ্গে যাওয়ার সময়, হঠাৎ দেখা সেই অপূর্ব সুন্দরী চাষিকন্যার চেয়েও আর কোনো সুন্দরীর দেখা পেয়েছেন কি? আপনি বলেছিলেন যে এত সুন্দরী মেয়ে আমি জীবনে দেখিনি!

সত্যজিৎ রায়: আমি জীবনে দেখিনি। এখনো বলছি।

[কথোপকথনের এই পর্যায়ে ঘরে বিজয়া রায়ের প্রবেশ]

বিজয়া রায়: কী বিষয়ে আলোচনা করছ তোমরা?

আমানুল: বৌদিকে বলেননি ওই মেয়েটির কথা?

সত্যজিৎ: না।

আমানুল: তা হলে শুনিয়ে দিন।

সত্যজিৎ: খুব আর্লি স্টেজে বংশী আর আমি বোড়ালের কাছে একটি গ্রাম—সেখান দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে যাচ্ছি—একটা চাষার বাড়ি। পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটা দৌড়ে এসে দরজাটা...আমাদের দেখেই চলে গেল। কী তার ইয়ুথফুলনেস আর বিউটি! আমাদের মনটাই খারাপ হয়ে গেল।

বিজয়া: ছবি তুললে না?

সত্যজিৎ: ছবি তুলব কোথায়! সে তো দেখেই পালিয়েছে। লাইক আ ইয়ং গডেস। রংটা কাঁচা সোনার মতো মসৃণ। মসৃণ গড়ন! কমপ্লিটলি আনএফেক্টেড। কোনো কনসাসনেস নেই। সেইটেই সবচেয়ে বড় কথা।

আমানুল: হালে তো ন্যাচারাল বিউটি উঠেই যাচ্ছে।

সত্যজিৎ: শুধু সাঁওতালদের মধ্যে আছে।

***

আমানুল: সুরের প্রতি, সংগীত সৃষ্টির প্রতি আপনার আসক্তি, গান লেখার দিকে তো আপনার...।

সত্যজিৎ: গানটা আমার ভেতর এমনভাবে রয়েছে...সংগীত মানে...আমি (গীতিকার), সুরকার সে অর্থে হইনি—রবীন্দ্রনাথ যে অর্থে। আমার ছবির সঙ্গে যা যাবে—ফাংশনাল গান লেখায় আমার ঝোঁক, প্রবল টান আছে…যেটা নাটকের মধ্যে আমি ব্যবহার করতে পারব। এমনি কোনো একটা সেন্টিমেন্ট নিয়ে গান—কি বসন্ত, কি গ্রীষ্ম, কি বর্ষা...কি প্রেম, কি প্রকৃতি—এই নিয়ে আমার গান লেখার কোনো রকম ইচ্ছে জাগে না।...কিন্তু একটা গল্পের মধ্যে—গুপীর জন্য গান লেখা...আমার একটা ভয়ানক, প্রবল একটা...!

***

আমানুল: মারি সিটনের বইয়েই দেখলাম, আপনি যখন ইংল্যান্ডে গেলেন—তারপর ছবিটবি দেখার চাপ্টারে লেখা আছে যে আপনি পথের পাঁচালীর আগে, মোস্ট ইমপরটেন্ট ফিল্ম বিফোর পথের পাঁচালী, দেবদাস আর মন্ত্র...।

সত্যজিৎ: মন্ত্রমুগ্ধ।

আমানুল: ও, উদয়ের পথে মোস্ট ইমপরটেন্ট ফিল্ম।

সত্যজিৎ: আমি বলেছি?

আমানুল: বিফোর পথের পাঁচালী।

সত্যজিৎ: আমি বলেছি?

আমানুল: হ্যাঁ, এটা মারি সিটনের অবজারভেশন।

সত্যজিৎ: হ্যাঁ, আমি তো দেবদাস–এর কথা বলতেই পারি না।

আমানুল: দেবদাস–এর কথা বলতেই পারেন না?

সত্যজিৎ: অপছন্দ।

আমানুল: এ জন্যই আমি জিজ্ঞেস করছি। ঢাকায় দেবদাস–এর যে পুরোনো কপি পাওয়া গেছে, তা নিয়ে ওখানে হইচই ব্যাপার, ওখানে পূর্বাণী থেকে আপনার একটা মন্তব্য তুলে ধরেছে। সে মন্তব্যটা কী আপনি বলুন?

সত্যজিৎ: তা তো জানি না, কী?

আমানুল: ওটাকে, মানে দেবদাসকে, এমন একটা কিছু গুরুত্ব আপনি দেন না।

সত্যজিৎ: (হাসি)

আমানুল: এই সব...আপনার মন্তব্য আর কি?

সত্যজিৎ: হ্যাঁ, ওখানে আমি বলেছি।

আমানুল: কী রকম, আমি শুনি আবার।

সত্যজিৎ রায়ের পারিবারিক জীবনের ছবি সাইদা খানমের মতো খুব কম আলোকচিত্রীই তুলতে পেরেছেন

সত্যজিৎ: দেবদাস...প্রমথেশ বড়ুয়াকেই আমি দিই না।...কোনো গুরুত্ব দিই না।

আমানুল: এইটা কিন্তু বাংলা ফিল্মের যে ফেস্টিভ্যাল হয়েছিল আমরা থাকার সময়, ’৬৪-র দিকে হয়তো, তখন কিন্তু ক্রিটিক এবং আপনিও বোধ হয়...দেখা গেল মধু বোসকেই সবাই একটু বেশি প্রশংসা করলেন। কমপেরিজন উইথ প্রমথেশ বড়ুয়া... তো মধু বোসের সেই আলীবাবা, আলীবাবা অনেকেই মনে করে যে এটা বোধ হয় একটা ওই ধরনের...কিন্তু সিনেমাটিক, টেকনিক্যাল দিক, সেটাও কিন্তু বেশ—এটা বললেন শো শেষ হলে ফিল্ম সোসাইটির তখনকার উদীয়মান, খুব ভালো লিখতেন, মৃগাঙ্কশেখর রায় চৌধুরী।

সত্যজিৎ: ও...।

আমানুল: সে যখন প্রশংসা করল, তখন মধু বোস বললেন যে আমার আগামীকালের ছবিটি দেখুন। সামাজিক ছবি। তো, সে ছবিটিও ভালো। এ ধরনের কি কোনো কমপেরিজন আপনি...।

সত্যজিৎ: না, আমি করি না, তবে আমার মনে হয় না যে ওই যুগে এমন কোনো বাংলা ছবি হয়েছে যেটা কোনো দিন ইতিহাসে টিকে থাকবার মতো। বিশেষ করে...কনসিডারিং যে তখন ওয়ার্ল্ড সিনেমায় যে সমস্ত জিনিস হচ্ছে এবং যে সমস্ত ছবি কলকাতায়...যে সমস্ত উদাহরণ এরা দেখতে পেত, এই সবের কথা চিন্তা করলে...সেগুলো কিছু না।

আমানুল: এবং এটা কি মনে হয় না যে তারা আইজেনস্টাইনের যে থিওরি, তা সম্পর্কে আদৌ ওয়াকিবহাল ছিলেন?

সত্যজিৎ: শুনলেও বা পড়লেও এ কানে ঢুকত ও কান দিয়ে বেরিয়ে যেত বা তাদের নিজেদের কাজে কোনো রকম তার ছাপ পাওয়া যায় না।

আমানুল: কিন্তু প্রমথেশ বড়ুয়া তো শোনা যায় রবীন্দ্রনাথের চিঠি নিয়ে ফ্রান্সের বিখ্যাত স্টুডিওতে সিনেমাটোগ্রাফি এবং আরও সব কাজ...।

সত্যজিৎ: তিনি যেটা শিখেছিলেন, একধরনের ফটোগ্রাফি, হয়তো খানিকটা শিখেছিলেন স্টুডিও লাইটিং একধরনের...।

আমানুল: কিছুটা লোকেশনের যে বৈশিষ্ট্য...।

সত্যজিৎ: না না, এদের কারও ছবিতেই ল্যান্ডস্কেপের কোনো মুডকে ধরতে পেরেছে বলে আমার কোনো দিন মনে হয়নি। আলোর সঙ্গে মুডের যে কতটা সম্পর্ক, গভীর সম্পর্ক, সেটা কেউ কোনো দিন উপলব্ধি করেছে বলে আমার কোনো দিন মনে হয়নি। একজনকে দেখেও আমার মনে হয়নি। প্রথমত, রোদ ছাড়া তো ছবিই তুলত না।

আমানুল: অভিনয়েও তো অসম্ভব ম্যানারিজম ছিল।

সত্যজিৎ: হ্যাঁ, ডায়ালগে কেউ রিয়ালিজমের ধারেকাছে দিয়েও যেত না। সকলেই ওই সিনেমা…সিনেমা একটা আলাদা রিয়ালিটি বলে ধরে নিত। সিনেমায় এই করতে হবে, সিনেমায় ওই করতে হবে...।

আমানুল: তবে প্রমথেশ বড়ুয়া কিন্তু মারাত্মকভাবে তাঁর ওই ধরনটাকে পপুলারাইজ করতে পেরেছিলেন।

সত্যজিৎ: তা করবেন না কেন?

আমানুল: সব কালেই বোধ হয় এ রকম একজন থাকে।

সত্যজিৎ: হ্যাঁ।

আমানুল: ...যাদের নিয়ে সব লোক মত্ত হয়ে থাকে। প্রমথেশ বড়ুয়া তো সেকালের এক কিংবদন্তি...।

সত্যজিৎ: হ্যাঁ, সে রাজকুমার ছিল, ভয়ানক শিকারের হাত ভালো ছিল, সে ভীষণ মদ খেত, তাঁর মেয়েঘটিত সব ব্যাপার ছিল, এই সব মিলিয়ে...।

আমানুল: তা ছাড়া তিনি সিনেট মেম্বারও ছিলেন ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটির।

সত্যজিৎ: তা–ও হবে।

আমানুল: তাঁর জীবনে ট্র্যাজেডিও তো বিপুল।

সত্যজিৎ: ইন্ডিয়ান ফিল্মটা দেখেছ? কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে বেরিয়েছে।

আমানুল: না, ওটা দেখিনি, ওটাতে কী বিষয়ে?

সত্যজিৎ: ওটাতে ইন্ডিয়ান ফিল্ম সম্বন্ধে...বেস্ট ইতিহাস হচ্ছে ওইটে, একজন আমেরিকান ভদ্রলোক এরিক বার্নো। সে আমার সঙ্গে কাঞ্চনজঙ্ঘা শুটিংয়ের সময় ছিল। আর একজন, কৃষ্ণস্বামী বলে একজন মাদ্রাজি ছেলে মিলে।

আমানুল: ওর মধ্যে কী?

সত্যজিৎ: ওর মধ্যে প্রমথেশ বড়ুয়া সম্পর্কে ইন্টারেস্টিং গপ্পোটপ্পো আছে।

আমানুল: ওইটুকুই তাঁর রেকগনিশন বলতে হবে।

সত্যজিৎ: হ্যাঁ। ইন্ডিয়ান সিনেমা সম্পর্কে লিখতে গেলে এদের কথা তো লিখতেই হবে। সে বিষয়ে তো কোনো কথাই নেই। এরা তো কাজ করে গেছে তখনকার দিনে। কিন্তু তার অ্যাসেসমেন্ট যদি...ডিসপ্যাশনেটলি অবজেক্টিভ অ্যাসেসমেন্ট করা হয়, তা হলে দেখা যাবে যে তাঁদের কিচ্ছু নেই, যেটা তাঁকে একটা মানে, উচ্চ আসন দিতে পারে—ওয়ার্ল্ড সিনেমার ইতিহাসে, সেসব কিচ্ছু নেই।

আমানুল: নীতিন বসু পরবর্তীকালে...।

সত্যজিৎ: নীতিন বসু, এদের মধ্যে একটা জিনিস ছিল, ফটোগ্রাফিটা ভালো, সাউন্ডটা তখনকার দিনের পক্ষে বেশ ভালো। আর মোটামুটি একটা চিত্রনাট্যের ছিমছাম ব্যাপার, তা–ও সে সমস্ত ব্যাপারটাই...এরা সব সময়েই ধরে নিত সিনেমা হচ্ছে পপুলার মিডিয়াম, পপুলার মিডিয়াম, পপুলার মিডিয়াম!

***

সত্যজিৎ: আচ্ছা, ওর [ববিতা] মা কি সুন্দরী?

আমানুল: সে তো বলা মুশকিল।

সত্যজিৎ: বলা মুশকিল মানে...ব্যাপারটা হচ্ছে কি, বাপ তো একেবারেই, তাঁর মধ্যে চেহারার কোনো রকম কিছু ছিল না। ববিতার চেহারাটা এত...এই ধরনের হলো কী করে?

আমানুল: ববিতার মা বোধ হয় আগেই মারা গেছেন।

***

সত্যজিৎ: আমি হেসেছিলাম, [অশনি সংকেত-এর শাড়ি বিষয়ে সমালোচকের] এ মন্তব্য পড়ে। ওদের একটা অদ্ভুত রোমান্টিক ধারণা যে দরিদ্র মানেই নোংরা, মলিন এবং রং থাকবে না...এটা তো একেবারেই মিথ্যে কথা। একেবারে বাজে কথা।

আমানুল: গ্রামে ঘুরলে দেখা যায়, আগে যারা তাঁতের শাড়ি পরত, ট্রেডিশনাল, তারা এখন চায় ছাপা শাড়ি।

***

সত্যজিৎ: ঘরে-বাইরে প্রধানত প্রেমের গল্প, তবে প্রেমের গল্পের যেভাবে পরিণতি হয়েছে, সেটা পলিটিকস ছাড়া হতে পারত না। পলিটিক্যাল এলিমেন্টটা আছে বলেই পরিণতি একটা পাওয়া যাচ্ছে গল্পের, সেটা রাজনীতির মাধ্যমেই যাচ্ছে। নাটকীয় গল্প হিসেবে ঘরে-বাইরেকে আমার খুব উঁচু দরের লেখা বলে মনে হয়। বিশেষ করে এর মধ্যে যে আয়রনির দিকটা আছে, সেটা আমার কাছে ফিল্মের প্রচণ্ড উপযোগী বলে মনে হয়। তিনটে চরিত্রকে একেবারে সমান মর্যাদা দিয়ে গল্পটিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া...।

আমানুল: আপনি আগেও যে আকৃষ্ট হয়েছিলেন, সে তো একই কারণে?

সত্যজিৎ: একই কারণে।

***

আমানুল: আর্থার ক্লার্ক তখন কী বললেন?

সত্যজিৎ: না, আমি কতগুলো প্রশ্ন ওকে করেছিলাম। যেমন এই যে প্রটেক্টিভ কালার, কালারেশন, প্রটেক্টিভ জন্তু–জানোয়ারেরও থাকে। বলে যে লেপার্ডের স্পট থাকে, যাতে লেপার্ডকে চট করে না দেখা যায় জঙ্গলের মধ্যে। বা স্ট্রাইপ থাকে। ক্যামোফ্লেজ বলে। আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলুম ক্যামোফ্লেজটা স্পিসিজ নিজেই ভেবে ভেবে বের করে, না কেউ একটা করে? বা ওটা কী চট করে ওভারনাইট হয়ে যায়, নাকি লাখ লাখ বছর ধরে হয়? কি হয়? সেটা হচ্ছে যে আমি অ্যাজ আ স্পিসিজ, আমি বাঁচতে চাই, কাজেই আমার কতগুলো প্রটেক্টিভ কালারেশন দরকার। ক্যামোফ্লেজ দরকার। এটা কী আমি ভাবছি? তাহলে এক জেনারেশনে হচ্ছে না কেন? আমার...মানে...চিন্তাটা কী ট্রান্সমিটেড হচ্ছে জেনারেশন আফটার জেনারেশন? (হাসি) এই ধরনের কতগুলো করেছিলাম। ও বলল যে জানি না কেন হয়, তবে একটা জিনিস জানি, একধরনের মথ ছিল, তারা, তাদের একটা বিশেষ কালার ছিল, প্রটেক্টিভ কালারেশন, তা–ও সেখানে ইন্ডাস্ট্রি গড়ে উঠল, তখন স্মোকের কালার হয়ে গেল সেটা, আস্তে আস্তে গ্রে হয়ে গেল। হয়ে গেল, ঠিকই (হাসি) হয়ে গেল সেটা, নিজেরাই কী চাইল যে আমাদের হোক?

আমানুল: না, কিন্তু মারি সিটনের বইয়ে যে ওই উক্তিটি আপনার আছে, একদম ক্যাটাগরিক্যাল সেটা।

সত্যজিৎ: হু, নোওওজ।

আমানুল: সেটা কী আপনি ওই রকমভাবেই বলেছিলেন, একদম সরাসরি?

সত্যজিৎ: কী?

আমানুল: আনটিল ম্যান ক্যান ক্রিয়েট লাইফ অর হিমসেলফ।

সত্যজিৎ: হ্যাঁ, আমার মনে হচ্ছে যে একটা জায়গায় গিয়ে মানুষ আটকে রয়েছে, অনেএএএক দূর অগ্রসর হচ্ছে কিন্তু তারপরও একটা জায়গায় গিয়ে আটকে রয়েছে। আটকে রয়েছে এবং সেটা যেদিন সলভড হয়ে যাবে, সেদিন মানুষ তো গড হয়ে যাবে।

আমানুল: কিছুদিন আগে কাগজে বেরিয়েছিল যে ব্রিটিশ একজন বৈজ্ঞানিক তিনি ইয়ে করেছেন যে একটা মানুষের ইয়ের থেকেও আরেকটা ইন্টেলিজেন্ট ইয়ে আছে, যারা মানুষকে ডিভাইজ করেছে। তো আমার তখন খুব অ্যামিউজিং মনে হলো যে তাকে কে করেছে তাহলে? মানুষের থেকেও যদি একটা ইন্টেলিজেন্ট ইয়ে থাকে।

সত্যজিৎ: সে তো, এখন পর্যন্ত ইউনিভার্সটা কী করে কখন গ্রো করল, কেউ তো জানে না।

আমানুল: আর জানে না মানে, বৈজ্ঞানিকভাবে যেটা হয়েছিল, সেটাও তো বদলে যাচ্ছে।

সত্যজিৎ: বদলে যাচ্ছে।

আমানুল: হোয়েল–নারলিকার যে থিওরি বের হয়েছিল, সেটাও নাকি ইতিমধ্যে বদলে গেছে এবং ইউনিভার্স ভাস্ট একপেন্ডিং একটা ব্যাপার। কল্পনায়ও সেটা ইয়ে করা যায় না।

সত্যজিৎ: অ্যাটমিক লেভেলে আর কসমিক লেভেলে দুটি জিনিসই মানুষের কাছে রহস্য রয়ে গেছে। একেবারে অ্যাটমিক লেভেলে, মলিকিউলার লেভেলে আর একেবারে কসমিক লেভেলে—এই দুটি জিনিস মানুষ কিছুতেই কূলকিনারা করতে পারছে না।

আমানুল: এমন একটা পর্যায় আছে, তার বাইরে গিয়ে আর হচ্ছে না।

সত্যজিৎ: না। হচ্ছে না, থেমে যাচ্ছে।

আমানুল: আচ্ছা, লোকে বলে, লোকের বিস্ময় থেকেই কৌতূহল এবং জ্ঞানের সৃষ্টি। আবার সেই জ্ঞানের শেষও বিস্ময়। এবং বিস্ময়েই আবার শেষ হয়ে যাচ্ছে সবকিছু। তার মানে জ্ঞানটা পরিপূর্ণ হচ্ছে না, মানে সবই জানি, এটা হচ্ছে না।

সত্যজিৎ: নাহ।

আমানুল: তাহলে এটাই বোধ হয় শেষ কথা।

সত্যজিৎ: হ্যাঁ। আমার...।

আমানুল: কিন্তু বিস্ময়ের, এটাকে বোধ হয় পুরাপুরি এক্সপ্লেইন করা যায় না।

সত্যজিৎ: হু। এক্সপ্লেইন করা যায় না বলেই তো দর্শনের সৃষ্টি। তা না হলে, কোশ্চেন না থাকলে আর দর্শনটা আসছে কোত্থেকে? ফিলোসফিটা আসছে কোত্থেকে? ফিলোসফি তো শেষ হয়ে যাবে তাহলে, সব জানা হয়ে গেলে।

আমানুল: উনি কী আর কিছু বলেছেন, আর্থার ক্লার্ক আপনার...।

সত্যজিৎ: আর্থার ক্লার্ক বলেছেন, আমি তো বায়োলজিস্ট না, আমি তো হচ্ছি অ্যাস্ট্রোনমার। কাজেই আমাকে এ প্রশ্নটা কোরো না। আরও দু–একজনের নাম করেছিলেন। তাদের...।

আমানুল: না, ওর বিশ্বাসটা কী পর্যায়ের তাহলে?

সত্যজিৎ: ওর বিশ্বাস, যেমন আমরা, অতিপ্রাকৃতের অনেক উদাহরণ আমার ফ্যামিলিতেই রয়েছে, এগুলো ওরা একদম মানতে চায় না। এখন সেই নিয়ে আমি বলিনি, আমার বাবার সেই চিঠি, বিখ্যাত চিঠি, সেসব নিয়ে...।

আমানুল: প্রিমনিশন?

সত্যজিৎ: হ্যাঁ।

আমানুল: আপনার মায়ের কাছে আমি শুনেছি, ইভেন তাঁর মৃত্যুর তারিখও নাকি উনি আগেই বলে দিয়েছেন।

সত্যজিৎ: না, তারিখটা বলেননি, তবে...।

আমানুল: মানে, মাস আরকি। হ্যাঁ, মাস।

সত্যজিৎ: এবং সেই অবস্থায়, প্রায় অক্সিজেন নেওয়ার অবস্থায় কী করে শ্রেষ্ঠ রচনা উনি করে গেছেন। সেটাই বা কী করে...।

আমানুল: সেটা তো আপনার ওই যে আপনি যেটা এডিট করেছেন।

সত্যজিৎ: হুঁ।

আমানুল: ওর মধ্যে আছে যে, কোনো শিল্পী তাঁর ঠিক মৃত্যু আসছে এবং মৃত্যুর শেষে এত রসোত্তীর্ণ শিল্প বের করে আমার জানা নেই।

***

আমানুল: এই যে রবীন্দ্রনাথ আপনাকে লিখে দিয়েছিলেন, ‘দেখিতে গিয়েছি পর্বতমালা, দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু।’ ওটা কিন্তু ঢাকায় অনেকেই অত খুঁটিয়ে দেখেননি। শওকত ওসমান সাহেব সবার কাছে বলে বেড়াতেন, দেখ জহুরিই জহর চেনে। রবীন্দ্রনাথ এঁকে কত ছোটবেলায় আইডেন্টিফাই করতে পেরেছিলেন। পরে ওই একটা ক্ষণিকা না কনিকা? রবীন্দ্রনাথের? ওই রকম একটা বই বের করেছিলেন।

সত্যজিৎ: ওটা বেরিয়েছিল স্ফুলিঙ্গতে।

আমানুল: ও। তা আরেকটা তো বের হয়েছিল। আরেকটা সংকলন ছিল।

সত্যজিৎ: ক্ষণিকা।

আমানুল: হ্যাঁ, ক্ষণিকা।

সত্যজিৎ: তবে ভালো সংকলন হচ্ছে স্ফুলিঙ্গ।

আমানুল: তা আপনার ডিটেইলস কিছু মনে আছে?

সত্যজিৎ: সেটা আমি তো লিখেছি আমার ছেলেবেলার কথাতে। সেই খাতাটাও হারিয়ে গেছিল। এরপর খুঁজে পেলেন (রবীন্দ্রনাথ), অনেক টেবিলভর্তি কাগজ, বইটই, তার মধ্যে। কোথায় ঢুকিয়ে রেখেছেন ছোট্ট পাতা। বেরোল যখন, ওটা মাকে দিলেন। মাকে দিয়ে বললেন, এটা এখন বুঝতে পারবে না, আরেকটু বড় হলে।

আমানুল: ও হ্যাঁ, তারপর আপনার মায়ের মুখে শুনেছিলাম, আপনার বাবার জন্মদিনে উনি শান্তিনিকেতনে গেছেন, শেষ বিকেলের আগে বোধ হয়, তখন বেশি সময় ছিল না। রবীন্দ্রনাথকে যখন বলা হলো যে এই রকম জন্মদিন তো, বললেন, এটা আগে বলোনি কেন? তাহলে আমি তোমার উদ্দেশে একটা গান লিখতাম। এটা তো আপনার জানা আছে?

সত্যজিৎ: না, এইটা জানতাম না।

আমানুল: এটা কিন্তু আমি মায়ের চিঠিতে পড়েছি। আচ্ছা এটা খুবই ইয়ে লাগে, অনেকেই তো অবাক হয়, এই সেদিনও কে যেন বলছিল আপনার বাবার কথা, যে ইংল্যান্ডে রবীন্দ্রনাথকে প্রথম তিনিই ইন্ট্রোডিউস করেন। অ্যালবার্ট হলে। একটা প্রবন্ধ লিখে সেটা পড়েন।

সত্যজিৎ: এটা ঠিক।

আমানুল: তাহলে দেখা যায় আরেকজন পেইন্টারকে, উনি বোধ হয় রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে ইয়েটস আর ইয়েকে কী লিখেছিলেন, একজন পেইন্টার?

সত্যজিৎ: রোদেনস্টাইন।

***

আমানুল: গল্প এক দিনেই শেষ হয়ে যায়, হার্ডলি দুই দিন, তিন দিন আর সিনারিও তো আপনি ফার্স্ট ড্রাফট আট থেকে দশ দিনে।

সত্যজিৎ: হ্যাঁ, তা করি। তবে একটা পর্ব থাকে একটু বসে বসে চিন্তা করার। চিন্তার পর্বটা শেষ হলে লিখতে আমার ভীষণ কম সময় লাগে।

আমানুল: আরেকটা কথা হচ্ছে, আপনি যে পরিমাণ বই পড়েন, আমার তো মনে হয় এটাও আপনার ব্যক্তিগত দিক থেকে বিবেচনা করলে সাংঘাতিক, এটাও একটা অসাধারণ ক্ষমতা।

সত্যজিৎ: ক্ষমতা নয়, এটা তো একটা শখের ব্যাপার। আমি তো আর জোর করে [অস্পষ্ট] অতীত জানার মতো করে বই পড়ি না।

আমানুল: না, সেটা তো বোঝাই যায়। এটা একটা প্যাশন। কিন্তু অনেক পণ্ডিত ব্যক্তির কাছেই পড়াটা রীতিমতো একটা লেবরিয়াস। আপনি পড়েন কোন সময়টা?

সত্যজিৎ: রাতে আর দুপুরে।

আমানুল: মানে সব কাজ সারা হওয়ার পরে। তাহলে আপনি কখন ঘুমান?

সত্যজিৎ: কাল যেমন দেড়টা হয়েছে।

আমানুল: দেড়টা। আর বেশি হলে?

সত্যজিৎ: দেড়টা প্রায়ই হয়। দুটো, দেড়টা-দুটো প্রায়ই হয়।

আমানুল: ধরুন দুশো পৃষ্ঠার একটা বই, আপনি কতক্ষণে শেষ করতে পারেন?

সত্যজিৎ: দুদিন। ডিপেন্ডস। মানে খুব হালকা যদি বই হয় দুদিন। তবে একেকটা বই খুব আঁটসাঁট কঠিন বই যেমন ফিল্ম ফর্ম–এর মতো বই আমি নিশ্চয় দুদিনে পড়ব না।

আমানুল: ফিল্ম ফর্ম, ফিল্ম সেন্স?

সত্যজিৎ: হ্যাঁ, ফিল্ম ফর্ম, ফিল্ম সেন্স।

আমানুল: অনেকে তো পড়েই বলে যে, না, এ বুঝিনি।

সত্যজিৎ: [অস্পষ্ট] না না, বুঝি না।

আমানুল: হ্যাঁ, অনেকে বলেছেন, অনেক পণ্ডিত লোকই সিনসিয়ারিটি প্রকাশ করে যে না, এ আমরা ঠিক বুঝতে পারিনি। এ এত কঠিন।

সত্যজিৎ: কঠিন তো বটেই।

আমানুল: পুডোভকিনের লেখা বরং সহজ।

সত্যজিৎ: খুউউউব সহজ।

আমানুল: কিন্তু আইজেনস্টাইন তো খুবই কঠিন।

সত্যজিৎ: আইজেনস্টাইন যেটা বলতে চেয়েছেন, সেটা সহজে বলা যায় না।

আমানুল: হ্যাঁ, সহজে বলা যায় না। আর আমার কাছে সবচেয়ে আশ্চর্য মনে হয় যে একটা আয়রন কার্টেনে বাস করে যে, এই যে [অস্পষ্ট], এত পাণ্ডিত্য, আসলে এর কোনো ব্যারিয়ার নেই, পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে বসে থাকুন না কেন।

সত্যজিৎ: সত্যি নেই। আর তা ছাড়া আরেকটা ব্যাপার, ও যে সময় মানুষ হয়েছে, তাঁর শিক্ষাদীক্ষা, [অস্পষ্ট] সব ইউরোপিয়ান। তাঁর সঙ্গে ওর মনটা ভীষণ ইউরোপিয়ান মন ছিল। তাঁর মনটা রাশিয়ান মন না। তাঁর কালচারটা হচ্ছে ওয়েস্ট ইউরোপীয়ান কালচার, ভীষণভাবে তাঁর মধ্যে ছিল।

আমানুল: তার মানে ওর যে বইয়ে কাবুকি থিয়েটারকে যেভাবে উনি ইয়ে করছেন...তাতে মনে হয় পৃথিবীতে একে ওই রবীন্দ্রনাথ যেমন লালন ফকিরকে ইন্ট্রোডিউস করেছিলেন, কাবুকিকে...।

সত্যজিৎ: তবে একটা জিনিস [অস্পষ্ট] করতে পারেননি, একটা জিনিস করার সময় হয়নি। সেটা হলো ভারতবর্ষের জিস্টটা মানে ওরিয়েন্টাল কালচার, ওরিয়েন্টাল-ইন্ডিয়ান কালচার। ওটা মানে ঘটনাচক্রে ওর সামনে পড়েনি।

আমানুল: আর ওর লেখাগুলো, বলা হয় যে এত বেশি পড়াশোনা করেছেন...।

সত্যজিৎ: খুবই।

আমানুল: যে তার কোনো সীমা–পরিসীমা নেই। ইতিহাস থেকে শুরু করে [অস্পষ্ট] সব।

সত্যজিৎ: ও হচ্ছে রিয়েল স্কলার পণ্ডিত।

আমানুল: উনি এমনিতে আর্কিটেক্ট ছিলেন, মনে হয়।

সত্যজিৎ: হ্যাঁ। সে এককালে করেছেন। কিন্তু সেটা তার পরেও...আর্কিটেক্টের কাজ আর কদ্দিন। অসাধারণ ভালো ছবি আঁকতে পারতেন।

আমানুল: আপনার তো ঘরে মোটে ছবি ওই একটিই আছে, আইজেনস্টাইনের।

সত্যজিৎ: হ্যাঁ। ওটা রাশিয়া থেকে এসেছিল। একজন ক্রিটিক এসেছিল। খুব, মানে গভীর ক্রিটিক। সে পুনাতে ছিল এক মাস। সেখানে আমার বারোটা না চোদ্দটা ছবি দেখেছে, আর্কাইভে। দেখে এসে, কলকাতায় আমার সঙ্গে দেখা হলো, বলল, আই অ্যাম দ্য ওনলি সিভিলাইজড ম্যান ইন...অ্যাম দ্য মোস্ট সিভিলাইজড ম্যান ইন রাশিয়া। আমি বললাম কেন? বিকজ আই অ্যাম দ্য ওনলি ওয়ান হু হ্যাজ সিন সো মেনি অব ইয়োর ফিল্মস।

আমানুল: পথের পাঁচালী তো বোধ হয় পাবলিক স্ক্রিন করেন রাশিয়ায়। আর্কাইভে রেখে দিয়েছে, তাই না? আপনি মস্কো ঘুরে এসে লিখেছিলেন।

***

আমানুল: জীবনে আপনি তো সংগ্রাম, দুঃখ-কষ্ট, সুখ-আনন্দ, প্রেম-ভালোবাসা—সবই ছুঁয়ে ছুঁয়ে গেছেন নিশ্চয়। তাতে কোনোভাবে কি বলা যায় যে জীবন সম্পর্কে একটা দার্শনিক মন্তব্য?

সত্যজিৎ: না, আমি দার্শনিক মন্তব্য করতে পারব কি না জানি না, তবে যেটা আমার সবচেয়ে বড়, আমার মিশন এবং আমার একমাত্র কর্তব্য বলে মনে হয়, সেটা হচ্ছে কাজ করা। আমি কাজেই সবচেয়ে আনন্দ পাই! কাজে রিলাক্সেশন পাই, কাজে তৃপ্তি পাই। আমার কাজ হচ্ছে সবকিছু মিশিয়ে। কাজে আমার ক্লান্তিও আছে, কাজে আমার আনন্দও আছে, উত্সাহও আছে—সব আছে। কাজটাকে আমি সবচেয়ে বড় বলে মনে করি। এবং এই জন্য আমার [অস্পষ্ট]দের দেখলে ভয়ানক একটা কি রকম গা ঘিন ঘিন করে। তারা নিজের থেকে নিজেদের সরিয়ে নিয়ে [অস্পষ্ট]। কোথায় দেখা যায়, কোথায় দেখা যায় না। কাজটাকে তারা বড় মনে করে না। আমার কাছে কাজটা সবচেয়ে বড় মনে হয়। আমার মিশনই হচ্ছে কাজ।

***

মহানগর ছবির এডিটিংয়ের সময় সত্যজিৎ রায়
ছবি: সাইদা খানম

সত্যজিৎ: ওটা [ছাগ বলি] আমি কোনো গপ্পে লাগাব। ছাগ বলিটা যাতে একেবারে কারেক্ট মুহূর্তে হয়, তার জন্য স্পেশাল ক্রনোমিটার ওয়াচ ছিল। আগে তো কম্পিউটার ইলেকট্রনিক কিছু হতো না। সেই ক্রনোমিটারটা হ্যামিলটনে থাকত, পরে রেগুলার অর্ডারে রাখত, যাতে একচুলও এদিক-ওদিক না হয়। পুজোর সময় আসত এবং সেই ঘড়ি ধরে অ্যাকর্ডিং টু ক্রনোমিটার, বলি হতো। ফিফটিন্থ সেকেন্ডের মধ্যে বলিটা কমপ্লিট হতে হবে।

ভিক্টর ব্যানার্জি: রোজ বিবিসি থেকে মিলাতো।

সত্যজিৎ: (হাসি। বলির বাদ্য অনুকরণ করে) ড্যাডাং...ড্যাং...ড্যাংড্যা...ড্যাং! বলি হলো।

স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত: এক কোপে কাটতে হবে...যদি না মরত?

সত্যজিৎ: সেটা মোষের ব্যাপারে। ভয়ের একটা কারণই থাকত মোষ বলির ব্যাপারে...কত দিন ধরে সেই গলায় রগড়ে রগড়ে রগড়ে মালিশ করে করে করে করে...নীরদ সির বইয়ে সাংঘাতিক বর্ণনা আছে। এরপর সেই রক্তমাখা...বাপরে বাপ! এখানে কী রকম নৃশংস প্রিমিটিভ ট্রাইবাল একটা ব্যাপারে চলে যায়!

***

আমানুল: যখন ছোট ছিলাম তাতে আপনি মিচকে ফররুখের কথা লিখেছেন।

সত্যজিৎ: হ্যাঁ।

আমানুল: সে আসলে কে?

সত্যজিৎ: ফররুখ তো ভয়ানক একটা পাকিস্তানি ইয়ে হয়ে গিয়েছিল, না?

আমানুল: হ্যাঁ, এবং সে কিন্তু খুব বিখ্যাত কবি।

সত্যজিৎ: হ্যাঁ, আমি জানি।

আমানুল: কিন্তু এত রিঅ্যাকশনারি যে...।

সত্যজিৎ: শুনেছি আমি। সেটা পরে শুনেছি আমি।

আমানুল: কিন্তু আপনি আরেকটা ঘটনা বোধ হয়, সেটা একদিন আমাকে বলেছিলেন যে আমরা যখন বালিগঞ্জ স্কুলে পড়তাম, তখন ওই লোক, কবি নজরুলের কথা প্রসঙ্গে যে, একজন মুসলমান ছেলে ছিল, আমাদের বন্ধু, কোনো ফাংশন হলেই সে ওই নজরুল ইসলামের ইসলামি গান করত। ‘রমজানের ওই রোজার শেষে।’ ওই ছেলেই আসলে ফররুখ। আপনি তাঁকে ওই পর্যন্ত চিনতে পারছেন।

আর ফররুখ আহমদ আমার ছোট ভাইকে বলেছে, শোন, তোরা এই যে—আপনার নাম, ভালো নাম উল্লেখ করে বলেছে, তোরা যে বলিস, আসলে সুকুমার রায়ের তো একই ছেলে ছিল এবং সে তো আমাদের সহপাঠী। তাঁর নাম তো ছিল মানিক। তখন আমার ছোট ভাই বলেছে, হ্যাঁ, ওই মানিকই তো—

সত্যজিৎ: সত্যজিৎ।

আমানুল: সত্যজিৎ রায়। ‘তাই বলো।’ বলে যে ‘একটা অসাধারণ ঘটনা আছে তাঁর সম্পর্কে, বলি, শোন।’ কী ঘটনা? ‘বলছি। ক্লাসে যখন কোনো কঠিন প্রশ্ন ধরা হতো, আমরা কেউ পারতাম না, তখন ওই মানিক তা বলে দিত।’

অজ্ঞাত কণ্ঠ: মিথ্যা কথা বলেছে।

সত্যজিৎ: [হাসি]।

আমানুল: না, সে তাই বলেছিল। এবং...।

সত্যজিৎ: স্কুলে তো আমি ভালো ছাত্র ছিলাম।

অজ্ঞাত কণ্ঠ: [ব্যঙ্গ করে] অ্যাঁ, ভালো ছাত্র ছিলে!

সত্যজিৎ: হ্যাঁ, স্কুলে ফার্স্ট-সেকেন্ড ছাড়া হইনি কখনো।

আমানুল: হ্যাঁ, ফররুখ আমাকে তা–ই বলেছে। ডেফিনিট। এবং উনি আরও ইন্টারেস্টিং যেটা বলেছিলেন যে যখন সে বলতে পারত না, তখন বলত যে আমি কাল বলব।

সত্যজিৎ: [হাসি]

আমানুল: বলে যে ‘শেষে আমরা খুব কৌতূহলী হয়ে উঠলাম। কারণ, পরের দিন ঠিকই বলে দিত সে। আমরা ইয়ে করলাম যে তাঁর সোর্স কী? শেষে খোঁজ নিয়ে নিয়ে আমরা আবিষ্কার করেছিলাম যে তাঁর মা-ই হচ্ছে সোর্স।’

সত্যজিৎ: হুঁ।

আমানুল: আরেকটা ঘটনা হচ্ছে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের, তাঁরও বন্ধু।

সত্যজিৎ: ও আচ্ছা।

আমানুল: তো তাঁর ঘটনা বলি। ওই সুভাষ মুখোপাধ্যায় বাংলাদেশ হওয়ার পরে, না পাকিস্তানি আমলে...।

সত্যজিৎ: আচ্ছা ফররুখ বেঁচে আছে?

আমানুল: না মারা গেছে। মারা গেছে মানে সে বাংলাদেশকে একসেপ্টই করেনি এবং অলমোস্ট স্টার্ভ করে মারা গেছে। শেষের দিকে ওর একটা মেয়েও মারা গেছে। ওষুধ কেনার পয়সা নেই। কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, তখনো সে তারস্বরে ডিক্লেয়ার করছে যে আমি এইগুলো স্বীকারই করি না।

সত্যজিৎ: এই রকম রিঅ্যাকশনারি!

আমানুল: এত রিঅ্যাকশনারি। তারপর বলে, মেয়েটি আবার এ রকম যে তাকে তাবিজ পানিপড়া এসব খাওয়াচ্ছে। ওষুধ কেনার পয়সাও ঠিক নেই। পরের দিকে সবাই পয়সাটয়সা দিয়ে গেল। কিন্তু মেয়েটি বাঁচলই না।

সুভাষবাবুর ঘটনাটা শুনুন। পাকিস্তানি আমলে যখন যুক্তফ্রন্ট উইন করেছিল, সেটা প্রোগ্রেসিভ গভর্নমেন্ট। তখন একটা সাহিত্য সম্মেলন হয়েছিল। তখন ‘আমার দেশ’ একজিবিশন করেছিলাম, ওই সূত্রেই সুভাষবাবুর সাথে পরিচয়। সুভাষবাবু বলল, আমানুল, চলো, রেডিওতে আমাদের এক বন্ধু আছে, তাঁর সাথে দেখা করে আসি। গিয়ে দেখলাম সেই ফররুখ আহমেদ। যাওয়ার পরই হঠাৎ, কী কারণে মনে নেই, সুকান্ত সম্পর্কে আলোচনা শুরু হলো এবং আলোচনার মুখেই ফররুখ আহমদ বলে বসলেন যে সুকান্তকে আমরা কবি হিসেবে স্বীকার করি না। সুভাষ মুখোপাধ্যায় তো একদম চুপ করে গেলেন। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর বললেন, দেখরে, মার্ক্সসিজম না পড়েই তোর আজ এই দশা। হাহ হা হা। তো সেই তিনজনের যে একটা যোগ সেটাই বলছিলাম। কিন্তু আমি তিনজনের সাথেই ছিলাম, ফলে এই ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছি যে আপনার সাথে তাঁর শৈশবের কী সম্পর্ক।

সত্যজিৎ: ছাত্র খারাপ ছিল না কিন্তু। ভালো ছিল।

আমানুল: কিন্তু মজার কথা, এখন কিন্তু বাংলাদেশে তাঁকে স্টেট রিকগনিশন দেওয়া হয়েছে।

সত্যজিৎ: দেওয়া হয়েছে?

আমানুল: হ্যাঁ ।

কথাবার্তা

রায়ের সঙ্গে এক সকাল

আলমগীর কবির

২৭ এপ্রিল ১৯৮০

আলমগীর কবির: ২৫ বছর ধরে ছবি বানানোর পর আপনার কেমন বোধ হচ্ছে?

সত্যজিৎ রায়: কেউ স্মরণ করিয়ে না দিলে আমার কিছু বোধ হয় না।

কবির: আপনার কী মনে হয়, এর মধ্যেই আপনার সেরাটা আপনি তৈরি করে ফেলেছেন?

সত্যজিৎ: তেমনটা হলে তো ছবি বানানোই বন্ধ করে দিতাম।

কবির: সোনার কেল্লা ও জয় বাবা ফেলুনাথ—স্বল্প সময়ের ব্যবধানে আপনি ছোটদের জন্য পুর্ণদৈর্ঘ্য দুটি ছবি করলেন। এখন শেষ করলেন হীরক রাজার দেশে, ওটাও একই ঘরানা। আপনি কি এই ধরনের ছবিতেই মনোনিবেশ করছেন?

সত্যজিৎ: না, মোটেও না। আপনার হয়তো মনে আছে, এই একই সময়কালে আমি শতরঞ্জ কী খিলাড়িও বানিয়েছি। আমার পরের ছবিও বড়দের জন্য হবে।

কবির: চিত্রনাট্য ঠিক করে ফেলেছেন?

সত্যজিৎ: না, এখনো না।

কবির: হীরক কী নিয়ে?

সত্যজিৎ: এটা গুপির সিকুয়েল। বেশ কিছুকাল ধরেই আবার একটা মিউজিক্যাল বানানোর তাড়না বোধ করছিলাম।

কবির: স্থিরচিত্রে দেখলাম একই মুখ্যশিল্পীদের ব্যবহার করেছেন। রবি ঘোষ ও তপেন চট্টোপাধ্যায়—১২ বছর আগে এরাই গুপি ও বাঘা হয়েছিলেন। যদিও এখনো তাঁদের দেখে মনে হয় না তেমন বয়স হয়েছে, তারপরও তো কখনো কখনো তাঁদের অধিক বয়সী মনে হতে পারে?

সত্যজিৎ: সেটা সামাল দেওয়া গেছে। হীরকের গল্প গুপির ১২ বছর পর।

কবির: এইবার কত গান রাখলেন?

সত্যজিৎ: ১২টা গেয়েছে তপেন, আর কয়েকটা লোকগায়কেরা।

কবির: গীত আর সুর কী আপনিই করেছেন?

সত্যজিৎ: হ্যাঁ।

কবির: হীরক কবে নাগাদ দর্শকের কাছে পৌঁছাবে বলে মনে করেন?

সত্যজিৎ: সত্যি বলতে কি, ওই নিয়ে আমি অত উতলা না। ছবিটার অর্থায়ন করেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। এটা আমি রঙিন শুট করেছি আর বাজেটের মধ্যেই আমি আনসার প্রিন্ট (মূল নেগেটিভ থেকে মুক্তির উপযোগী করে তৈরি চলচ্চিত্রের প্রথম প্রিন্ট) সম্পন্ন করতে পেরেছি। প্রিভিউয়ের পর কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেব। এর পরিবেশন খুব সম্ভবত তারা নিলাম করবে। অবশ্য বিশেষ কোনো পরিবেশককে যদি আমি সুপারিশ করি, তারা তা রাখবে। তবে আমার কোনো ছবিরই পরিবেশনা নিয়ে সাধারণত আমি মাথা ঘামাই না। অত সময় আমার নেই।

কবির: তীব্র বিদ্যুৎ–বিভ্রাট তো মনে হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের চলচ্চিত্রশিল্পকে প্রবল ধাক্কাই দিয়েছে। বাংলাদেশে তো আমরা এমন গুজবও শুনেছি যে আপনাকে পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গ থেকে সরে ভারতের অন্যত্র ছবির শুটিং করতে হয়েছে। এটা কি সত্য?

সত্যজিৎ: না, এটা সত্য না। কিছু বহির্দৃশ্যের পাশাপাশি আমার সমস্ত অন্তর্দৃশ্যই বিদ্যুৎ বরাদ্দের সঙ্গে সমন্বয় করে আমি এখানেই ধারণ করেছি। তবে সাউন্ড মিক্সিংয়ের জন্য আমাকে বোম্বাই যেতে হয়েছে, কিন্তু সে তো আমি বরাবরই করে থাকি, কারণ ওখানকার উন্নততর রেকর্ডিং কোয়ালিটি। কলকাতায় সাউন্ড রেকর্ডিংয়ের মান খুবই পড়ে গেছে। স্টপওয়াচ ধরে আবহসংগীত আর গান রেকর্ড করার জন্য এখন দমদমের এইচএমভি স্টুডিও অবশ্য চমত্কার স্কোরিং থিয়েটার। তবে মিক্সিংয়ের জন্য বোম্বে ফ্লোরগুলো অনেক অনেক বেশি সন্তোষজনক।

কবির: আমি জানি, চলচ্চিত্র নির্মাণে ব্যয়িত সিকি শতাব্দীর কথাটা মনে করিয়ে দেওয়াটা আপনি পছন্দ করেন না। এরপরও এটাকে মনে করার মতো একটা উপলক্ষ করতে চায় সিকোয়েন্স। অন্যান্য লেখার পাশাপাশি সিকোয়েন্স আপনার ও আপনার ছবি বিষয়ে ষষ্ঠিব্রতর মূল্যায়ন পুনর্মুদ্রণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাঁর লেখা আপনার কেমন মনে হয়?

সত্যজিৎ: ষষ্ঠি আমার অধিকাংশ ছবিই দেখেনি। ফলে নিজস্ব প্রতিক্রিয়ার বদলে তাঁকে অনেক বেশি এখানকার বা অন্য সমালোচকের লেখার ওপর নির্ভর করতে হয়। লন্ডনে আমার সর্বশেষ সফরকালে আমাদের পরস্পরের এক সাধারণ বন্ধুর মাধ্যমে সে আমার একটা সাক্ষাত্কার প্রার্থনা করে। অতি টানাটানি সময়ের দুর্লভ তিনটা ঘণ্টা তাঁকে আমি দিই। তবে দুর্ভাগ্যবশত মোলাকাতটি থেকে সে সন্তোষজনক কিছু বের করতে পারেনি।

কবির: এক ফরাসি সমালোচক আমাকে লিখেছেন, ফ্রান্সে আপনার ছবিগুলোর যে পরিচিতি ও স্বীকৃতি পাওনা ছিল, অবশেষে তা দেওয়া হয়েছে। আপনার কেমন লাগছে?

সাইদা খানমের ক্যামেরায় সত্যজিৎ রায়

সত্যজিৎ: আগ্রহ তৈরি হতে তাদের যে ১৮ বছর লাগল, এটা আমার কাছে একটা আনন্দদায়ক চমক। আগে পর্যন্ত ফরাসি দর্শক শুধু পথের পাঁচালী, জলসাঘর আর মহানগর দেখেছিল। আর এখন রোশেলে দেখানো সব ছবির ব্যাপারেই তারা প্রকৃত আগ্রহ দেখাচ্ছে। সম্প্রতি আমার ছবির একটা রেট্রোস্পেকটিভ সিজন তারা শেষ করেছে। কয়েক দিন আগে ফরাসি টেলিভিশনের চ্যানেল ৮ আমার একটা সাক্ষাত্কার সম্প্রচার করেছে। তাদের জন্য ৩০ মিনিটের স্বল্পদৈর্ঘ্যের একটা ছবি বানাতে আমি অনুরুদ্ধ হয়েছি।

কবির: আপনার ধারার চলচ্চিত্র নির্মাণের বিরুদ্ধে আগে তো ফ্রাঁসোয়া ক্রুফোসহ কয়েকজনের রীতিমতো প্রবল একটা পক্ষই ছিল?

সত্যজিৎ: হ্যাঁ। তবে অধিকাংশই এখন আমার পক্ষে যোগ দিয়েছে।

কবির: ভারতীয় দূরদর্শনের খবর কী? তারা কোনো প্রস্তাব নিয়ে আপনার কাছে কি এসেছে?

সত্যজিৎ: হ্যাঁ, সম্প্রতি তারা এসেছে। বানানোর জন্য অতি অল্প টাকাই তারা দিতে পারবে, তারপরও তাদের জন্য ছয়টার মতো স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি বানাতে আমি রাজি হয়েছি। ওই সব বাংলা ছোটগল্প থেকে ছবিগুলো হবে, যেগুলোকে টেনে পূর্ণদৈর্ঘ্য করা যাবে না বা করা উচিত না। এই রকমের বেশ কয়েকটা ভালো ছোটগল্প আছে।

কবির: কোনো তথ্যচিত্র কী সম্প্রতি বানিয়েছেন?

সত্যজিৎ: তথ্যচিত্র ঠিক আমার ক্ষেত্র না। গল্প বলাতেই আমি বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। অতীতে যেসব তথ্যচিত্র আমি বানিয়েছি, সেগুলো কমবেশি আমার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। না, ওভাবে সময় পার করাটা আমি উপভোগ করি না। বদলে ছবিতে আমি বরং একটা গল্প বলব। আপনার নিজের কী খবর? এখন কী করছেন?

কবির: বাংলাদেশে দর্শকরুচির চেয়ে বাজেট নিয়েই আমাদের যুদ্ধ করতে হচ্ছে বেশি। কাঁচামালের লাগামছাড়া মূল্যবৃদ্ধি আমাকে সত্যিকারের বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে। ১৬ মিমি রঙিন রিভার্সাল ফিল্মে শুট করে, পরে হংকং ল্যাবরেটরিতে প্রিন্ট-টু-প্রিন্ট ব্লোআপ করে রিলিজ প্রিন্ট বানিয়ে আমি এটা অতিক্রমের চেষ্টা করছি। আমার বর্তমান ছবির নাম মোহনা।

সত্যজিৎ: কার গল্প?

কবির: আমার নিজের। সত্যি বলতে কি, অতর-ফিল্ম ঘরানায় আমার পূর্ববর্তী সব ছবির চিত্রনাট্যই আমার নিজস্ব। অধিক থেকে অধিকতর সামাজিক-রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা থেকে আমি সিনেমা ভ্যারাইটি নিয়ে নিরীক্ষা করছি। চলচ্চিত্রিক মহান গল্পবলিয়েদের কাজ আমার ভালো লাগে বটে, তবে নিজের ক্ষেত্রে আমি ‘ফ্যাকশনাল’ উপাদানের ওপর ভর করতেই বেশি পছন্দ করি।

সত্যজিৎ: বাংলাদেশে ভালো ভালো গল্প লেখক আছেন, তাঁদের কয়েকজনকে চলচ্চিত্রায়িত করতে পারেন আপনি।

কবির: এখানে ভালো ভালো গল্প লেখক আছেন, আমি একমত, কিন্তু এই মুহূর্তে সিনেমা দু পাপা স্টাইলে গল্প বলাটা ঠিক আমার লাইন না। ফ্রান্সেসকো রসি বা কস্টা গাভ্রাসের মতো কাজে আমি বরং বেশি আগ্রহ বোধ করি।

সত্যজিৎ: কিন্তু বাংলাদেশে তারা কি রাজনৈতিক ছবি অনুমোদন করে?

কবির: আমার মনে হয়, উপনিবেশী প্রশিক্ষণ পাওয়া যেকোনো প্রশাসনের কাছেই আমার শেষ ছবি রূপালি সৈকতে রীতিমতো রাজনৈতিক। তারপরও সেন্সর থেকে ছবিটা ‘আনকাট’ পাস পেয়েছে। আমি মরিয়া লাফ দিয়েছিলাম, আর পারও পেয়ে গেছি। আর এ থেকে আমার প্রত্যয় জন্মেছে, আমাদের চলচ্চিত্র বিষয়বস্তুতে রাজনৈতিক শৌর্যবীর্যের অভাবের জন্য সেন্সরের কুঠারের চেয়ে চলচ্চিত্রকারের আত্ম-সেন্সরশিপই বেশি দায়ী। রাজনৈতিক চলচ্চিত্র বিষয়েই যখন আছি, তখন [জিজ্ঞাসা করি,] মৃণাল সেনের ছবি নিয়ে আপনার ভাবনা কী?

সত্যজিৎ: তাঁর সর্বশেষ ছবি একদিন প্রতিদিন এখন পর্যন্ত তাঁর সেরা ছবি। অবশেষে তিনি মাটিতে নেমে এসেছেন, আবিষ্কার করেছেন যে তাঁর পূর্ববর্তী ছবিসমূহের কয়েকটির অপ্রয়োজনীয় জটিলতার চেয়ে একটা সাদাসিধা থিম অধিকতর ফলপ্রসূ ও কার্যকর।

কবির: তাঁর তেলেগুভাষী ছবি ওকা উরি কথা [আ ভিলেজ স্টোরি] বিষয়ে আমার ঠিক একই মত। আমি মনে করি ওটা মি. সেনের প্রথম সাচ্চা সিনেমা আর নিশ্চিতভাবে এ দেশে বানানো অন্যতম ভালো ছবি। আমি অবশ্য একদিন প্রতিদিন দেখিনি।

সত্যজিৎ: এটা আরও ভালো। কান উত্সব এই বছরের প্রতিযোগিতা [বিভাগের] জন্য এটাকে মনোনীত করেছে। আমি অবশ্যই আশা করি তিনি সমালোচকের মনোযোগ আকর্ষণ করবেন, এই ছবি সত্যিই যার দাবিদার।

অনুবাদ: জামিল বিন সিদ্দিক

চিঠিপত্র

আমানুল হককে লেখা চিঠি

ভাষাশহীদ রফিেকর গুলিিবদ্ধ মাথার ছবি েতালার দােয় ঢাকায় থাকাই অসম্ভব হয়ে উঠল। ঢাকার পাট চুকিয়ে একদিন তাই কলকাতা চলে গেলেন আমানুল হক। কলকাতায় নতুন সাহিত্য সম্পাদক অনিল সিংহ হয়ে উঠলেন তাঁর আশ্রয়। কাজের পাশাপাশি নতুন সাহিত্য–এ চলত আড্ডা। এই আড্ডাতেই কবি পূর্ণেন্দু পত্রী প্রমুখের কাছে শুনতে পান সত্যজিৎ রায়ের নানা কর্মকাণ্ডের খবর। তাঁর সঙ্গে কাজ করার যে তাঁর ভীষণ ইচ্ছা! কিন্তু কে করিয়ে দেবে পরিচয়? কেন, সুভাষ মুখোপাধ্যায়। সুভাষ তো সত্যজিতের বন্ধু।

এক রোববার সকালে তাঁকে নিয়ে ৩ নম্বর লেক টেম্পল রোডে হাজির হলেন সুভাষ। পরিচয় করিয়ে দিতেই ভরাট গলায় সত্যজিৎ বললেন, ‘আপনার ছবি তো দেখেছি!’ টুকটাক কিছু কথা হলো, তোলা হলো কিছু ছবি আর সবচেয়ে যেটা জরুরি, আদায় করা গেল রায়ের পরের ছবি দেবীর স্থিরচিত্র তোলার অনুমতি।

বসার ঘর থেকে আমানুলের যে যাত্রা শুরু হয়েছিল, একসময় শোবার ঘর পর্যন্ত অবারিত হয়েছিল তার গতিবিধি। এই আস্থা অর্জন সহজ ছিল না, সময়ও লেগেছিল অনেক।

সেই যাত্রাপথে আমানুলের তোলা ছবি আজ সত্যজিৎ–চর্চার অমূল্য এক সম্পদ। আজকের উন্নত প্রযুক্তির ক্যামেরায় তোলা ছবির পাশে আমানুল হকের তোলা সত্যজিতের ছবির অনেকগুলোকেই মনে হবে কাঁচা। অনেক ক্ষেত্রেই আউট অফ ফোকাস, প্রায়ই ঝাপসা এসব ছবি দেখে মনে হবে বুঝি কোনো অ্যামেচারের তোলা। কিন্তু আমরা যেন ভুলে না যাই, কলকাতার সেকেন্ড হ্যান্ড মার্কেট থেকে কেনা সম্পূর্ণ অকেজো একটা ক্যামেরা দিয়ে এই ছবিগুলো তুলেছিলেন আমানুল। কেনার পরে নানান জোড়াতালি দিয়ে কোনো রকমে ছবি তোলার উপযোগী করা হয়েছিল সেই ক্যামেরা। লেন্সের মাঝের অংশ ঘষা লেগে অস্বচ্ছ হয়ে গিয়েছিল। সেই ক্যামেরা আর লেন্স দিয়েই তোলা হয়েছিল এসব ছবি। যার মধ্যে একটাকে সত্যজিৎ নিজেই বলেছিলেন, ‘আমার সেকেন্ড বেস্ট পোর্ট্রেট।’

১.

JANUARY 20, 1972

স্নেহের আমানুল,

গত ছ মাসে কমপক্ষে পঞ্চাশজন ওদিকের লোককে তোমার খবরাখবর জিগ্যেস করে কোনো সন্তোষজনক জবাব না পেয়ে গভীর উদ্বেগের মধ্যে ছিলাম। কাল শ্রীমান পারভেজের হাতে তোমার পাঠানো জিনিসপত্র পেয়ে যে কতখানি আশ্বস্ত ও আনন্দিত হয়েছি, তা বলতে পারি না। তোমার এদিকে আসার কোনো সম্ভাবনা আছে কি?

না হলে এমনিতে আমিই হয়তো ওদিকে যাব। ভাষা আন্দোলনের স্মারক তিথিতে ঢাকায় যাওয়ার আমন্ত্রণ পেয়েছি। যদি পারি যাব। তা না হলে আমার আগামী ছবির শুটিংয়ের সময় অবশ্যই তোমার সঙ্গে দেখা হবে। মার্চের মাঝামাঝি কাজ আরম্ভ করার ইচ্ছে আছে। পটভূমিকা খুলনা ও কলকাতা। অর্ধেকের ওপর শুটিং খুলনায় আউটডোরে করার ইচ্ছে আছে। কী গল্প সেটা পরে জানাব। সম্ভব হলে চিঠি লিখ। তোমার তোলা ছবি চমত্কার লাগল। অনেক পুরোনো কথা মনে পড়ছিল। মারি সিটনের বই তোমার হাতে এসেছে কি না জানি না। গত মে মাসে প্রকাশিত হয়েছে। দাম ৯০ টাকা। বলা বাহুল্য, তোমার তোলা অনেক ছবিই আছে বইটিতে এবং তোমার উল্লেখও আছে অনেক জায়গায়। আমরা তিনজনই তোমার কথা প্রায়ই স্মরণ করেছি। খোকন খুব ভালো ছবি তুলছে। তাকে দেখলে বোধ হয় চিনতে পারবে না! আমরা ভালো। আন্তরিক শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা নিও—আমাদের সকলের এবং আমার ইউনিটের সকলের।

ইতি

সত্যজিৎ রায়

২.

৯/৮/৮২

স্নেহের আমানুল,

তোমার চিঠি এইমাত্র পেয়ে খুব খুশি হলাম। কিন্তু তোমার শারীরিক, মানসিক ও আর্থিক দৈন্যের কথা জেনে উদ্বিগ্ন লাগছে। অসুস্থতা কী জাতীয় সেটা জানিও। কলকাতায় চিকিত্সা হয়তো ঢাকার চেয়ে ভালো হতে পারে। তুমি একবার এখানে আসতে পারলে আমরা সকলে যারপরনাই আনন্দিত হব। আমি আগস্ট ২১ থেকে সেপ্টেম্বর ১০ পর্যন্ত ভেনিসে থাকব। এবার ওখানে ফিল্মোত্সবের অন্যতম বিচারকের দায়িত্ব আমার ওপর পড়েছে।

খোকনের ছবি প্রায় শেষের মুখে। নানান আর্থিক অনটনের মধ্যে ছবি করতে হচ্ছে। ছ’মাসের জায়গায় প্রায় দেড় বছর লাগল। তবে মনে হচ্ছে ছবি ভালোই হবে। চিত্রনাট্য করে দেবার পর আমি ওকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছি; শুটিংও দেখিনি, রাশও দেখিনি। তবে এটা জানি যে লোকেরা ছবি ভালো লাগলে বলবে বাবাই সবকিছু করে দিয়েছে, আর খারাপ লাগলে বলবে, এই বাপের এই ছেলে!...

তোমার কলকাতায় আসার সম্ভাবনা থাকলে অবশ্যই আগাম খবর দিও। এখানে সকলের সঙ্গেই দেখা হবে। পূর্ণেন্দুকে আনন্দবাজারে চিঠি লিখলে সে অবশ্যই পাবে।

এই চিঠির সত্বর জবাব আশা করব। হতাশ কোরো না। খোকন সবে ম্যালেরিয়া থেকে উঠল; তোমার বৌদি মোটামুটি ভালোই আছেন। আমি ভালো। এবং যথারীতি নানান কাজে ব্যস্ত।

প্রীতি শুভেচ্ছান্তে

সত্যজিৎ রায়

৩.

১১/২/৮৪

স্নেহের আমানুল,

তোমার টেলিগ্রাম পেলাম, কিন্তু গ্রামাঞ্চল থেকে লেখা তোমার কোনো চিঠি এখনো আসেনি।

আমি এখন ভালো আছি, যদিও নানা রকম নিয়ম পালন করে চলতে হচ্ছে। তিনতলা উঠতে হবে বলে বাড়ি থেকে বেরোতে পারি না। লিফ্ট বসানোর ব্যবস্থা হচ্ছে, তখন আর কোনো ভাবনা থাকবে না। ঘরে বাইরের একটা আউটডোর বাকি ছিল সৌমিত্রকে নিয়ে, সেটা খোকন করেছে এবং খুব ভালোভাবেই করেছে। এরপর সামান্য দুটো রিটেক আছে, এ মাসের শেষে, তাহলেই শুটিং শেষ।

ছবির প্রিন্ট এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে বেরোবে। কথা ছিল পয়লা বৈশাখ রিলিজ হবার, কিন্তু প্রডিউসারের গাফিলতিতে সেটা এখন গিয়ে দাঁড়াবে বোধ হয় জুনের প্রথম সপ্তাহ। তুমি এপ্রিলের মাঝামাঝি এলে ছবি দেখতে পাবে তাতে সন্দেহ নেই, তবে দর্শকের সঙ্গে নয়।

এরপর খোকন ছবি করবে, আমার বিশ্রাম। ১৯৮৫-র গোড়ায় আবার আমার পালা আসবে।

আমার অসুস্থতার কারণ হলো অতিরিক্ত কাজের চাপ। নিজের কাজে আমার কোনো ক্লান্তি বা অনিষ্ট হয় বলে আমি বিশ্বাস করি না, কিন্তু অন্যের উপরোধে কতগুলো কাজ ঘাড়ে এসে চাপে, তাতে সত্যিই ক্ষতি হয়। সেটা এখন থেকে একেবারে বন্ধ। তোমার শরীর আশা করি মোটামুটি ভালো। এপ্রিলে এসো, খুশি হব।

প্রীতি শুভেচ্ছা

সত্যজিৎ রায়

৪.

২০/১১/৮৫

স্নেহের আমানুল,

তোমার চিঠি, তোমার পাঠানো জিনিসপত্র, সবকিছু পেয়েছি। তুমি আমাদের এত দাও, সেই তুলনায় আমরা কিছুই দিতে পারি না, এই যা আফসোস।

অপারেশনের পর এক বছর কেটে গেল। কোথা দিয়ে যে সময় চলে যায় বুঝতেই পারি না। আমি এখন ভালো আছি। ওষুধপত্র প্রচুর খেতে হচ্ছে এবং সিঁড়ি ওঠা বারণ; চেয়ারে করে তুলতে হয়, তাই বাড়ি থেকে বিশেষ বেরোই না। খোকন টিভির জন্য ১৩টা শর্স্ট স্টোরিেজর একটা সিরিজ করছে, তার অনেক গল্পই আমার লেখা। চিত্রনাট্যও আমি করেছি এবং সম্প্রতি মিউজিক করলাম। বাকি কাজ সবই ও করছে এবং খুবই ভালো করছে। ফেব্রুয়ারি ‘৮৬ থেকে সিরিজটা দেখানো হবে। ভাষা হিন্দি, কারণ দিল্লি থেকে টেলিকাস্ট হবে।

আমার নিজের ভবিষ্যৎ এখনো অনিশ্চিত। যদিও ডাক্তার বলছেন, ‘এবার একটা ছবি করার কথা ভাবুন’, কিন্তু সেই সঙ্গে এ–ও বলছেন যে স্টুডিওতে কাজ করাই বাঞ্ছনীয়। একেবারে আউটডোর–বর্জিত ছবি করার কথা ভাবতে ভালো লাগে না। দেখা যাক কী হয়।

তুমি আশা করি ভালো আছ এবং আগের মতোই তোমার কাজ চালিয়ে যাচ্ছ। পত্রিকার মলাটে তোমার তোলা আমার রঙিন ছবি এবং ভেতরের লেখা ভালো লাগল।

পারলে মাঝে মাঝে চিঠি লিখো। এখন আমার অফুরন্ত সময়, কাজেই উত্তরে বিলম্ব হবে না। সন্দেশ-এর জন্য কাজ সমানেই চলেছে।

আজ আসি। আমাদের সকলের প্রীতি শুভেচ্ছা নিও।

সত্যজিৎ রায়

৫.

২৩/১২/৯০

স্নেহের আমানুল,

তোমার কাছ থেকে চিঠি নিয়ে যাঁরা এসেছিলেন, তাঁদের সঙ্গে পরিচয় করে খুব আনন্দ পেলাম। একটা সুখবর কি তুমি পেয়েছ? সন্দীপ ও ললিতার একটি পুত্রসন্তান জন্মেছে এক মাস হলো। নামকরণ হয়েছে সৌরদীপ।

যেদিন পৌত্রের আবির্ভাব হয়, সেদিনই আমি নতুন ছবি আগন্তুক-এর শুটিং শুরু করি। আমারই গল্প। কাজ দ্রুত এগিয়ে চলেছে। শাখা-প্রশাখা সুযোগ পেলে অবশ্যই দেখো; আমার নিজের ধারণা, এটি আমার অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছবি। ব্যস্ততা হেতু এখানেই শেষ করি। আমরা সবাই ভালো এবং তোমার শুভকামনা করি। পারলে চিঠি লিখো।

ইতি

সত্যজিৎ রায়

৬.

২৮/১১/৯১

স্নেহের আমানুল,

তোমার চিঠিটা পেয়ে খুব ভালো লাগল। অনেক দিন তোমার কোনো খবর পাইনি। আমার শরীরটা সম্প্রতি আবার একটু খারাপ হয়েছিল। তাই এক মাস নার্সিং হোমে কাটিয়ে এলাম। অপারেশনের পর থেকে আজ অবধি এই সাত বছরে তিনখানা ছবি করেছি। গণশত্রু, শাখা-প্রশাখা আর আগন্তুক। তিনটে ছবিই আমাকে (এবং আরও অনেককে) বেশ আনন্দ দিয়েছে। সন্দীপও ছবি করে চলেছে। ওর নতুন ছবি গুপী বাঘা ফিরে এল অতি চমত্কার ছবি হয়েছে। আমার মনে হয় না টেকনিক্যালি এর চেয়ে ভালো ছবি ভারতবর্ষে আর হয়েছে।

আপাতত আমরা সকলেই ভালো আছি। অন্তত সৌরদীপকে দেখার জন্য একবার কলকাতা এসে পড় না!

আমি অপু ট্রিলজি সম্বন্ধে একটা ইংরেজি বই লিখছি—মাই ইয়ার্স উইথ অপু। এটা শেষ করতেই বাকি বছরটা কেটে যাবে।

তুমি আমাদের সকলের আন্তরিক শুভেচ্ছা নিও। ফটোগ্রাফির কাজ চালু রেখেছ আশা করি।

আজ আসি।

সত্যজিৎ রায়

শাহেদ আলীকে লেখা চিঠি

১৯৫৫ সালে কলকাতা থেকে পূর্ববাংলার সমকালীন সেরা গল্প নামে ৩০টি গল্পের একটি সংকলন করেন রুহুল আমিন নিজামী। সম্ভবত ১৯৫৯ সাল নাগাদ এটি সত্যজিৎ রায়ের হাতে পড়ে। সংকলনটিতে অন্তর্ভুক্ত শাহেদ আলীর ‘জিবরাইলের ডানা’ গল্পটির মধ্যে একটি চলচ্চিত্র-সম্ভাবনা দেখতে পান সত্যজিৎ রায়। ভবিষ্যতে তিন কন্যার মতো গুচ্ছ ছবি করলে তাতে যে ‘জিবরাইলের ডানা’ স্থান পাবে, এমন কথাও কাউকে কাউকে তিনি বলেন। বিষয়টি জানতে পেরে কলকাতারই কেউ একজন সত্যজিতের অজ্ঞাতে নামমাত্র মূল্যে গল্পটির চিত্রস্বত্ব কিনে নেওয়ার চেষ্টা করে। তবে গল্পের স্বত্ব শাহেদ আলী হাতছাড়া করেননি। যদিও সত্যজিতের আগ্রহের খবর তিনি জানতেন না।

১৯৬১-র শেষ বা ১৯৬২-র গোড়ায় ঢাকার মাসিক পূবালীতে খবর বেরোয় যে সত্যজিৎ রায় ‘জিবরাইলের ডানা’ নিয়ে ছবি করতে চলেছেন। খবরের কাটিংসহ সত্যজিৎকে একটি চিঠি দিয়ে প্রকৃত ঘটনা জানতে চান শাহেদ আলী। ১৯৬২-র ২২ ফেব্রুয়ারি সত্যজিৎ তাঁকে এই চিঠিটি দেন। পুরো চিঠিটি আমরা উদ্ধার করতে পারিনি। শাহেদ আলীর আত্মজীবনী জীবনকথা ও কলকাতার শারদীয় এক্ষণ ১৪০০ সংখ্যায় চিঠির আলাদা আলাদা দুটি অংশ শুধু পাওয়া গেছে। সে দুটিই এখানে জুড়ে দেওয়া গেল।

১৯৭২-এ ঢাকায় এসে ১০ বছর আগে লেখা চিঠির সূত্র ধরে শাহেদ আলীর খবর নেওয়ার চেষ্টা করেন সত্যজিৎ। কিন্তু সেবার আর তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটে উঠেনি। শেষ পর্যন্ত কাহিনিটিও আর চলচ্চিত্রে রূপ পায়নি।

২২/২/৬২

...তিন কন্যার মতো আরেকটি ছোটগল্পের চিত্রসংকলন যদি ভবিষ্যতে করি, তাহলে ‘জিবরাইলের ডানা’র কথা প্রথমেই চিন্তা করব। এ-প্রতিশ্রুতি আপনাকে দিতে পারি।

...গল্পটির জন্য আরেকবার আপনাকে ধন্যবাদ জানাই। এটি আমি আমার বহু পরিচিতকে পড়িয়েছি এবং ভবিষ্যতেও অনুমোদন করব।

সত্যজিৎ রায়

সুভাষ দত্তকে লেখা চিঠি

১৯/৭/৬৫

[১৯৬৫ সালে জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্টে এশীয় চলচ্চিত্র উত্সবে দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ পুরস্কার জেতে সুভাষ দত্তের সুতরাং। খবর শুনে তাঁকে অভিনন্দন জানিয়ে একটি বার্তা পাঠান সত্যজিৎ রায়। সুভাষ দত্তের কাছে পুরস্কারের চেয়ে বড় ছিল এই অভিনন্দনবার্তা। কারণ, সত্যজিতের পথের পাঁচালী দেখেই তো চলচ্চিত্রকার হতে মনস্থ করেছিলেন সুভাষ। অতি সত্যজিত্ভক্তির জন্য অনেকে তো তাঁকে ‘দত্তজিৎ’ বলেও ঠাট্টা করত। সেই গুরুর কাছ থেকে অভিনন্দন তাঁর জীবনের একটা বৃত্তকেই যেন সম্পূর্ণ করে।]

সুতরাং চলচ্চিত্রের ফ্রাঙ্কফুর্টে পুরস্কারপ্রাপ্তির জন্য শ্রী সুভাষ দত্তকে অভিনন্দন জানাই।

সত্যজিৎ রায়

সাইদা খানমকে লেখা চিঠি

১৯৬২ সাল। সাইদা খানম তখন চিত্রালীর আলোকচিত্রী কাম প্রতিনিধি। একবার কলকাতায় যাওয়ার আগে সম্পাদক এস এম পারভেজের কাছে গিয়ে প্রস্তাব করলেন, সত্যজিৎ রায়ের ইন্টারভিউ করতে চাই। রায়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয় থাকা সত্ত্বেও কেন যেন তাঁকে খুব একটা উত্সাহ দিলেন না পারভেজ। কলকাতায় গিয়ে কারণটা বুঝতে পারলেন সাইদা। শুনলেন, ভদ্রলোক ভীষণ অহংকারী ও দাম্ভিক। বেশি কথা বলেন না, ফটোও তুলতে দেন না। এরপরও সাহস করে একদিন ফোন করতেই ওপাশ থেকে ভেসে এল বিখ্যাত সেই কণ্ঠস্বর। দুদিন পরে সময় দিলেন।

নির্ধারিত দিনে কাঁপা কাঁপা বুকে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে সালাম জানিয়ে নিজের পরিচয় দিতেই ‘বসুন’ বলে লেখায় ডুবে গেলেন সত্যজিৎ। কিছুক্ষণ পর সাদাসিধে বাংলাদেশি এই মেয়েটির নার্ভাসনেস দেখে বোধ হয় তাঁর মায়া হলো। নরম গলায় জানতে চাইলেন, ‘কী জানতে চান বলুন?’ এই একটি কথাতেই আত্মবিশ্বাস ফিরে পেলেন সাইদা, জড়তাও কেটে গেল। এরপর অনেক বিষয়েই কথা হলো। শেষে ছবি তোলার অনুমতিও মিলল।

চলে আসার সময় সিঁড়ি পর্যন্ত তাঁকে এগিয়ে দিলেন বিজয়া রায়, আবার আসার অনুরোধ করলেন। সেই থেকে সত্যজিৎ রায়ের বাড়ির দরজা তাঁর জন্য সব সময়ের জন্য অবারিত হয়ে গেল। হয়ে গেলেন তাঁদের অতি প্রিয় বাদল।

পরের তিরিশ বছর রায়ের অনেক ছবি তুলেছেন সাইদা খানম। সত্যজিৎ রায়ের কর্মজীবনের ছবি অনেকেই তুলেছেন কিন্তু সাইদা খানমের মতো তাঁর পারিবারিক জীবনের ছবি কম আলোকচিত্রীই তুলতে পেরেছেন। এ ক্ষেত্রে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারেন আর একজনই—তিনিও বাংলাদেশি, আমানুল হক।

১.

১০/৪/৬৫

স্নেহের বাদল,

তোমার চিঠি এবং কাটিং দুই-ই সময়মতো পেয়েছি। স্থানীয় কাগজে খবরটা আগেই বেরিয়েছিল। এবং পড়ে বেশ হকচকিয়ে গিয়েছিলাম। তারপর তোমাদের ওখানের কাগজে ছবি ও আরও বিস্তারিত বিবরণ দেখে রীতিমতো স্তম্ভিত। তুমি যে এই ঘটনার জন্য বেশ কিছুটা অংশে দায়ী, তা অবিশ্যি আমার নিজেরও বিশ্বাস। যাই হোক না কেন, ঘটনা বোধ হয় অভূতপূর্ব। গর্ব, আক্ষেপ ও কিছুটা সংকোচ—এই তিনটে মনোভাবই বোধ করেছি। আক্ষেপ এই কারণে যে আজ আমাদের বাংলা ছবি তোমাদের ওখানে যাবার ও দেখাবার সুযোগ থাকলে আমাদের আর কোনো রকম চিন্তার কারণ থাকত না। ফিল্মের সঙ্গে একটা অনিশ্চয়তা যে সব সময়েই আমাদের মনকে উদ্বিগ্ন করে, সেটা বোধ হয় সম্পূর্ণ অপসৃত হতো। সংকোচ এই কারণে যে, যে আশা নিয়ে এত লোক এত অর্থ, সময় ও শ্রম ব্যয় করল; সেটা কি ছবি দেখার পর তাদের চার আনাও সার্থক বলে মনে হলো? কখনই না।

যাই হোক—তবু বলব—ভালো লাগে।

আমার এ-ছবি শেষ হয়ে এল। ৩০ এপ্রিল মুক্তি। বাক্সবদল ভীষণ ভালো চলল এবং লোকে খুবই উপভোগ করল। আমি নতুন গল্প নায়ক লিখতে শুরু করেছি। নাম ভূমিকায় উত্তমকুমার। উত্তমেরই জন্য লেখা গল্প। আমাদের ফিল্মজগতের চেহারা কিছুটা এতে তুলে ধরতে পারব বলে মনে হয়। তবে গল্পের অধিকাংশই ঘটছে একটা দিল্লিগামী ট্রেনের ভেতর—নায়ক চলেছেন দিল্লি সরকারি পুরস্কার নিতে। সেখানে ফ্ল্যাশব্যাকে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের কিছু ছবি আমরা দেখছি—ইত্যাদি ইত্যাদি।

আজ আসি। এখানে সব মোটামুটি ভালোই। কাল থেকে প্রচণ্ড গরম পড়েছে। দু–এক পশলা বৃষ্টি এবং একটি কালবৈশাখী ঝড়ও হয়ে গেছে। ইতি।

শুভাকাঙ্ক্ষী—

সত্যজিৎ রায়

২.

১০/২/৭৩

স্নেহের বাদল,

তোমার চিঠি কিছুদিন হলো পেয়েছি। আমি সবেমাত্র নতুন ছবিতে হাত দেওয়াতে (শংকরের জন-অরণ্য) খুবই ব্যস্ত হয়ে পড়েছি, তাই সংক্ষেপে সারতে হচ্ছে।

তোমরা ছবি করছ জেনে খুবই আনন্দ পেয়েছি। চারদিক দেখে-শুনে আটঘাট বেঁধে নেমো। এত চেনাশোনা লোক উত্সাহের সঙ্গে কাজে নেমে শেষরক্ষা করতে পারেনি যে আজকাল নতুন কেউ এ পথে এগোচ্ছে দেখলেই উত্সাহদানের সঙ্গে সঙ্গে সতর্কবাণীটাও দিয়ে দিতে হয়। দুটো জিনিস ভালো হওয়া চাইই চাই। এক হলো চিত্রনাট্য, আরেক হলো সম্পাদনা। এই দুটির দিকে আশা করি দৃষ্টি রাখবে।

ছোটদের গল্প ভালো পেলে তো আমিই বাছাই করে নিতাম! আমাদের সাহিত্যে পূর্ণদৈর্ঘ্যের ছবি হয়, এমন ভালো ছোটদের গল্প বেশি নেই। বেশি কেন, হাতে গোনা যায় বললেই চলে। রূপকথার কথা ভেবেছ কি? নাকি ও জিনিস অনেক হয়ে গেছে? তোমাদের ঝোঁক কোন দিকে, বাজেট কেমন, ইত্যাদি জানতে পারলে সুবিধা হতো।

প্রোডাকশনের নাম যদি কিছু মাথায় আসে তো জানাব।

আপাতত এখানেই শেষ করি। প্রীতি শুভেচ্ছা নিও। আমরা সকলে মোটামুটি ভালোই। চিঠি লিখো।

ইতি

মানিকদা

সেলিনা হোসেনকে লেখা চিঠি

[সেলিনা হোসেনের হাঙর নদী গ্রেনেড আদিতে ছিল ছোটগল্প। ছাপা হয় তরুণ সাহিত্যিকদের পত্রিকা টেরোড্যাকটিল-এ। সেখানেই প্রথম গল্পটি পড়েন সত্যজিৎ। গল্পটির মধ্যে একটি ভালো চলচ্চিত্রের সম্ভাবনা দেখতে পান তিনি। লোকমুখে বিষয়টি জানতে পেরে তাঁকে চিঠি লেখেন সেলিনা হোসেন।]

১.

শ্রীমতী সেলিনা হোসেন মাননীয়াসু,

আপনার চিঠি কিছুদিন হলো পেয়েছি। আমার নতুন ছবির কাজ এবং পুজোর লেখা নিয়ে একান্ত ব্যস্ত থাকায় উত্তর দিতে দেরি হয়ে গেল।

টেরোড্যাকটিল পত্রিকায় প্রকাশিত আপনার ছোটগল্পটি পড়ে আমার যে খুব ভালো লেগেছিল তা আমি অনেককেই বলেছিলাম। গল্পটি থেকে ভালো চলচ্চিত্র হয়, এ বিশ্বাসও আমার ছিল। কিন্তু তখন আমার হাতে অন্য ছবি আসায় ওটার কথা চিন্তা করতে পারিনি। পরে বাংলাদেশে গিয়ে ছবি করার প্রশ্ন ওঠে আরেকবার; তখন শুনেছিলাম ওদিকের অবস্থা ভালো নয়, কাজে নানা রকম অন্তরায়ের সম্ভাবনা আছে। সুতরাং পরিকল্পনাটি ‘স্থগিত’ থাকে।

এখন আমি আমার অন্য ছবির কাজে জড়িয়ে পড়েছি। কবে মুক্ত হব জানি না। এই অবস্থায় আপনাকেই বা কী করে গল্পটা ধরে রাখতে বলি তাও বুঝতে পারছি না। সংশয় হয় অন্য কারুর হাতে পড়লে এমন চমত্কার গল্পটি হয়তো যথাযথভাবে চিত্রায়িত হবে না। সে বিষয় যদি আপনি নিজে ভরসা করে চিত্তবাবুকে গল্পটা দিতে পারেন, তাহলে আমার কিছু বলার থাকে না। এ ব্যাপারে আপনি যা ভালো বোঝেন তাই করুন। এই আমার অনুরোধ।

আপনাদের শিশু পত্রিকার জন্য এ বছরে আর কোনো লেখা দিতে পারব বলে মনে হয় না। সন্দেশ-এর লেখাও এখনো লিখে উঠতে পারিনি।

আপনার গল্পটি উপন্যাসাকারে প্রকাশিত হলে পড়ার ইচ্ছা রইল।

নমস্কারান্তে

ভবদীয়

সত্যজিৎ রায়

১৩/৮/৭৫

শাহেদ আলী ও সেলিনা হোসেনের গল্প নিয়ে ছবি বানাতে চেয়েছিলেন সত্যজিৎ

২.

শ্রীমতী সেলিনা হোসেন মাননীয়াসু,

সবিনয় নিবেদন,

হাঙর নদী গ্রেনেড কাল পেয়েছি। আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানবেন। আমি কাল মাদ্রাজ যাচ্ছি একটা ডকুমেন্টারি ছবির ব্যাপারে, সঙ্গে আপনার বই নিচ্ছি। পড়ে অবশ্যই জানাব কেমন লাগল। বাংলাদেশে গিয়ে ছবি করার ইচ্ছে আছে। তবে এখনো যা খবর পাই, তাতে খুব ভরসা পাই না। আমার শুভেচ্ছা জানবেন।

ইতি ভবদীয়

সত্যজিৎ রায়

২৭/২/৭৬

পু: বাংলা একাডেমির ঠিকানাটা হাতের কাছে নেই। তাই আপনার প্রকাশকের ঠিকানাতেই চিঠিখানা লিখছি। আশা করি, আপনার হাতে পৌঁছাবে।

১/৩/৭৮

৩.

শ্রীমতী সেলিনা হোসেন মাননীয়াসু,

আপনার একটা চিঠি বেশ কিছুদিন আগে পেয়েছি, নানান ব্যস্ততাহেতু জবাব দেওয়া হয়নি। আপনার গল্প থেকে ছবি করার ইচ্ছে আছে, কিন্তু সেটা কবে পূরণ হবে জানি না। আমি আপাতত কিশোরদের জন্য একটা ছবি করছি। তারপর বছরের শেষে একটি সংগীতের ওপর ডকুমেন্টারি ছবি করব।

আপনার গল্পের প্রয়োজন হলে আমি আপনাকে নিজেই লিখে জানাব।

নমস্কার জানবেন। ভবদীয়

সত্যজিৎ রায়

মুহম্মদ খসরুকে লেখা চিঠি

‘আমার সেকেন্ড বেস্ট পোর্ট্রেট’ আমানুল হকের তোলা এই ছবিটার বিষয়ে সত্যজিতের মন্তব্য

১৯৬৩ সালে আনোয়ারুল হক খান, ওয়াহিদুল হক প্রমুখকে নিয়ে পাকিস্তান চলচ্চিত্র সংসদ গড়ে তোলেন মুহম্মদ খসরু। স্বাধীনতার পরে সংসদের নাম হয় বাংলাদেশ ফিল্ম সোসাইটি। ১৯৬৮ থেকে তাঁর সম্পাদনায় এই সংসদ থেকেই বের হতে থাকে ধ্রুপদী। এই চলচ্চিত্র সাময়িকীটিরই একটি সংখ্যার জন্য লেখা চেয়ে সত্যজিৎকে চিঠি লেখেন খসরু। সাড়া না পেয়ে আবার লেখেন। জবাবে এই চিঠিটি দেন সত্যজিৎ রায়।

বিশপ লেফ্রয় রোড

কলকাতা

১.১১.৭৪

শ্রী মুহম্মদ খসরু সমীপেষু

সবিনয় নিবেদন,

আপনার সেপ্টেম্বর ১০-এর চিঠি দুদিন আগে (অক্টোবর ৩০) পেলাম। আগের চিঠিটা পাইনি বলেই মনে হচ্ছে, কারণ ডাকের গোলমাল অনেক দিন থেকেই শুরু হয়েছে। আমি গত দুমাস অপেক্ষাকৃত মুক্ত ছিলাম, এখন আবার কাজে জড়িয়ে পড়ছি। এ অবস্থায় কোনো প্রবন্ধ লেখা সম্ভব হবে না। এমনিতেও আমি আগামী সপ্তাহে প্রায় ১০–১৫ দিনের জন্য কলকাতার বাইরে যাচ্ছি। তাছাড়া ডিসেম্বরে দিল্লি যেতে হবে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উত্সব উপলক্ষে।

আপনারা ’৭৫-এর মে মাসে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করলে ধ্রুপদীর পরবর্তী কোনো সংখ্যার জন্য লেখা দিতে পারি।

নমস্কারান্তে ইতি

সত্যজিৎ রায়

ম. মনিরউজ্জামানকে

লেখা চিঠি

চিঠিটির নেপথ্য গল্প প্রাপক গবেষক ম. মনিরউজ্জামানই শুনিয়েছেন: ‘কাঙাল হরিনাথকে কেন্দ্র করে একবার সত্যজিৎ রায়ের জীবনে একটি উড়ো খবর এবং অন্য একটি অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছিল। উড়ো খবরটি ছিল, দেড় যুগ আগে কাঙাল হরিনাথের খোয়া যাওয়া মূল্যবান অগ্রন্থিত ডায়েরিটি রক্ষিত আছে সত্যজিৎ রায়ের কাছে, যা নিয়ে তিনি কাঙালের ওপর একটি তথ্যচিত্র নির্মাণের প্রস্তুতি নিয়েছেন। তখন সত্যজিৎ রায় পরিচালিত চলচ্চিত্র পথের পাঁচালীর রজতজয়ন্তী উত্সবের প্রস্তুতি চলছিল। সেই সময় কলকাতার দু-একটি পত্রপত্রিকায় লেখালেখি হয়েছিল, কাঙাল হরিনাথের লেখা ‘হরি দিন ত গেল সন্ধ্যা হল’ গানটি পথের পাঁচালীতে সংকলন করেও পরিচালক ছবিতে বা কোনো লেখায় কাঙাল হরিনাথের নাম উল্লেখ করেননি।

‘উড়ো খবর শুনে ১৯৮০-র মাঝামাঝি সত্যজিৎ রায়ের কাছে একটা চিঠিতে জানতে চাই, “দিন ত গেল সন্ধ্যা হল” গানটি পথের পাঁচালীতে কার কণ্ঠে গাইতে দেখানো হয়েছে এবং নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী কে? সেই চিঠিতে আরও জানতে চেয়েছিলাম, গানটি যে কাঙাল হরিনাথের রচনা, এ কথা তিনি জানেন কি না। কাঙাল হরিনাথকে নিয়ে তথ্যচিত্র করার প্রসঙ্গ তুলে আরও জিজ্ঞাসা করি, কাঙালের ডায়েরি তাঁর কাছে সংরক্ষিত আছে কি না। চিঠির সঙ্গে আমার লালনজীবনী ও সমস্যা (১৯৭৮) বইটির একটি শুভেচ্ছা কপি পাঠিয়ে দিই।’

জবাবে নিচের চিঠিটি দেন সত্যজিৎ রায়।

১৫-১১-৮০

ম. মনিরউজ্জামান সমীপে

সবিনয় নিবেদন,

আপনার অনেক দিন আগে পাওয়া চিঠি ও লালন সম্পর্কিত বইটির জন্য ধন্যবাদ। নতুন ছবির কাজে ব্যস্ত থাকায় উত্তর দিতে দেরি হলো।

হরিনাথের ডায়েরি আমার সংগ্রহে থাকার খবরটা ভুল। তাঁর সম্পর্কে কোনো চলচ্চিত্র রচনার পরিকল্পনাও আমি করছি না।

‘দিন ত গেল সন্ধ্যা হল’ গানটি কাঙাল হরিনাথের রচনা বলেই আমি জানি। পথের পাঁচালী ছবিতে গানটি পর্দায় যাঁকে গাইতে দেখানো হয়েছে, তিনিই গেয়েছেন। অর্থাৎ ইন্দির ঠাকরুণের ভূমিকায় চুনিবালা দেবী। চুনিবালার মুখেই গানটি আমি প্রথম শুনি এবং শোনার পরে ছবিতে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিই।

শুভেচ্ছা ও নমস্কারান্তে

সত্যজিৎ রায়

নিমাই ঘোষের ক্যামেরায় ‘অনঙ্গ বউ’ ববিতা

ববিতা ও তাঁর বাবাকে লেখা চিঠি

স্বাধীনতার পরপর রাজ্জাকের বাসায়, এফডিসিতে, শুটিংয়ের ফাঁকে ফাঁকে, ঢাকার উঠতি নায়িকা ববিতার কিছু ছবি তুলেছিলেন নিমাই ঘোষ। বিষয়টাকে তখন তেমন একটা পাত্তা দেননি ববিতা। কারণ সেবার আরও অনেকের ছবিই তুলেছিলেন সত্যজিৎ রায়ের ওই স্থির আলোকচিত্রী। ববিতা তাই ভেবেছিলেন পত্রিকার কোনো কাজের জন্য ছবিগুলো তোলা হচ্ছে। সেসবের মধ্য থেকে ববিতার মেকআপহীন কয়েকটা ছবি সত্যজিৎকে দেখিয়েছিলেন নিমাই ঘোষ, যার চূড়ান্ত পরিণতিতে অশনি সংকেত-এর নায়িকা বনে যান ববিতা। এই সূত্রে ববিতা ও তাঁর বাবার সঙ্গে সত্যজিতের বেশ কিছু চিঠি বিনিময় হয়।

১.

August 31, 1972

ভাই ববিতা,

তোমাকে কদিন থেকেই লিখব লিখব করছি, কিন্তু এডিটিংয়ে ব্যস্ত থাকায় লিখতে পারিনি। দিন সাতেক হলো মাদ্রাজ থেকে ‘রাশ প্রিন্ট’ এসেছে। তোমার কাজ খুব ভালো হয়েছে। সেটা অবিশ্যি আমি আগেই জানতাম!

১০ তারিখ থেকে আমাদের আবার শুটিং শুরু। তুমি ৯ তারিখ শান্তিনিকেতনে পৌঁছাতে পারলে ভালো হয়, কারণ ১০ তারিখেই তোমার কাজ। পারবে তো?

প্রথমেই মেটে আলুর দৃশ্যটা তোলা হবে। বড় সিন। অন্তত তিন দিন লাগবে। এ ছাড়া মতি মুচিনীর মৃত্যু, ছবির শেষ দৃশ্য ইত্যাদি তোলা হবে। ডায়ালগ বেশি নেই, কাজেই তোমার চিন্তার কোনো কারণ নেই।

আশা করি তোমরা সকলে ভালো আছ।

তোমার দিদিকে ও বাবাকে আমার শুভেচ্ছা জানিও।

ভালোবাসা নিও।

ইতি

মানিকদা

২.

১০ মে ১৯৭৩

প্রিয় নিজামুদ্দিন ভাই,

আপনার পয়লা বৈশাখের চিঠির জন্য অনেক ধন্যবাদ। সুইডেনে ছিলাম বলে জবাব দিতে লম্বা সময় লেগে গেল। মাত্র কয় দিন হয় ফিরেছি। অশনি সংকেত শেষ হয়েছে, কয়েক দিন আগে একটা প্রাইভেট প্রদর্শনী হয়েছে। ববিতা ভীষণ ভালো করেছে, যারা দেখেছে তারা ছবিটাও পছন্দ করেছে। ভট্টাচার্যবাবু বর্ষা মৌসুমে ছবিটা মুক্তি দিতে চাচ্ছেন না; তাই আগস্ট অথবা সেপ্টেম্বরের শুরুতে মুক্তি পাবে। ২০ মের পরে যেকোনো সময় কলকাতা এলে জানাবেন, যাতে করে ছবিটা আপনাকে দেখাতে পারি। কয়েক দিনের মধ্যে বার্লিন থেকেও একটা খবর আশা করছি। তারা বাছাই করলে ছবিটা সেখানকার উত্সবে দেখানো হবে, যেটা নাকি আবার শুরু হবে ২৪ জুন।

আমরা সবাই ভালো আছি। অনুগ্রহ করে ববিতা ও সুচন্দাকে আমাদের শুভেচ্ছা জানাবেন। তারা দুজনই নিশ্চয় শুটিং নিয়ে খুব ব্যস্ত।

ঘুরে যাবেন।

একান্তই আপনার

সত্যজিৎ রায়

[ইংরেজি থেকে অনূদিত]

আমানুল হকের ক্যামেরায় সত্যজিৎ

৩. প্রিয় নিজামুদ্দিন ভাই,

আপনার চিঠি এইমাত্র পেলাম।

দৈনিক বাংলার সাক্ষাত্কারে ববিতা সম্পর্কে আমার উক্তি বলে যে অংশটি ছাপা হয়েছে, সেটি পড়ে আমি স্তম্ভিত হয়ে গেছি। এ ধরনের মিথ্যা যে কাগজে ছাপা হয় তা আমার ধারণা ছিল না। আজ পর্যন্ত আমি কারুর কাছে ববিতার অভিনয়ের নিন্দা তো করিইনি, বরং পঞ্চমুখে প্রশংসা করেছি। ববিতার একটি সংলাপও আমাকে বাদ দিতে হয়নি এবং তাকে নিয়ে আমার কোনো পরিশ্রমও করতে হয়নি। আমার ছবিতে সে অত্যন্ত সহজ ও সাবলীল অভিনয় করেছে। এখানে বলা দরকার যে ছবিটি মুক্তি পাবার পর দর্শক ও সমালোচকও আমার মত সমর্থন করেছে।

আপনি এই চিঠি দৈনিক বাংলা পত্রিকায় সাক্ষাত্কারের মিথ্যা উক্তির প্রতিবাদ হিসেবে ছাপাতে পারলে আমি নিশ্চিন্ত হব।

আপনারা সকলে আমার আন্তরিক প্রীতি ও শুভেচ্ছা গ্রহণ করুন।

ইতি ভবদীয়

সত্যজিৎ রায়

৩/৯/৭৩

৪. ভাই ববিতা,

এই ভদ্রলোক একটা হিন্দি ছবির ব্যাপারে তোর সঙ্গে দেখা করতে চান। আমাকে একটা চিঠি দিয়ে দিতে বললেন। কথা যা বলার তুই বলে নিস।

অনেক দিন কোনো খবর নেই। চিত্রালীতে তোর ছবি দেখি। বুঝতে পারি তুই ব্যস্ত আছিস।

আমাদের সকলের শুভেচ্ছা নিস।

পারলে চিঠি লিখিস।

মানিকদা

১০/৪/৭৯

মোরশেদুল ইসলামকে লেখা চিঠি

১৯৭৮-৭৯ সালে মাযহারুল ইসলাম বাবলা ও মোরশেদুল ইসলাম মিলে গড়ে তোলেন ‘লিটল থিয়েটার’। এটিই বাংলাদেশের প্রথম শিশু নাট্যদল। তখন মহিলা সমিতিতে শুক্রবার সকালে শিশুদের নাটকের নিয়মিত প্রদর্শনী হতো। দল বেঁধে নাটক দেখতে আসত ছোটরা। একসময় চাকরি নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে চলে যান বাবলা, একা হয়ে পড়েন মোরশেদুল ইসলাম। এ সময় চ্যালেঞ্জ নিয়ে সত্যজিৎ রায়ের হীরক রাজার দেশের নাট্যরূপ দেন তিনি। কিন্তু মুশকিল হলো মূল লেখকের অনুমতিই তো নেওয়া হয়নি। ন্যাশনাল ফিল্ম আর্কাইভে ফিল্ম অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্সে মোরশেদুল ইসলামের সহপাঠী ছিলেন চলচ্চিত্র সমালোচক মাহমুদা চৌধুরী। তিনি ভারত যাচ্ছেন শুনে তাঁকেই গিয়ে ধরলেন মোরশেদ, সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে দেখা করে অনুমতি এনে দিন। কলকাতায় তাঁর সঙ্গে দেখা করলেন মাহমুদা, বিনা আপত্তিতে নিজের প্যাডে সবুজ কালিতে স্বাক্ষর করে অনুমতি দিয়ে দিলেন সত্যজিৎ রায়। অনুমতিপত্রটা হারিয়ে ফেললেও কথাগুলো মোরশেদের আজও মনে আছে।

ঢাকার লিটল থিয়েটারে হীরক রাজার দেশে মঞ্চস্থ হচ্ছে জেনে আনন্দিত হলাম।

সত্যজিৎ রায়