ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস-বিকৃতি

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন

বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন জাতীয় চরিত্রের একটি ঐতিহাসিক আন্দোলন। সূচনায় ছাত্র-আন্দোলন হিসেবে এর প্রকাশ ঘটলেও দ্রুতই তা দেশজুড়ে গণ-আন্দোলনে পরিণত হয় সর্বশ্রেণির মানুষের সমর্থন নিয়ে। এর মূল দাবি পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলা হওয়া সত্ত্বেও এ আন্দোলন দেশের সাহিত্য-সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে বাঁকফেরা গুণগত পরিবর্তন ঘটায়। প্রমাণ, বায়ান্ন থেকে পরবর্তী কয়েক বছরের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তন।
বিশেষ প্রমাণ মেলে বিভাগোত্তর চার বছরের সাহিত্যের সঙ্গে একুশে-সাহিত্য এবং একুশে-উত্তর সাহিত্যচর্চার তুলনামূলক বিচারে এবং ১৯৫২ থেকে ১৯৫৭ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত সাহিত্য সম্মেলনগুলোর (কুমিল্লা-ঢাকা-কাগমারী) বহুমাত্রিক চরিত্রে—যে চরিত্র একাধারে জাতীয়তাবাদী, প্রগতিবাদী ও লোক-সাংস্কৃতিক। রাজনীতিতে এর প্রভাব বিশেষভাবে প্রকাশ পেয়েছে নির্বাচনী একুশ দফার গণতন্ত্রী, জাতীয়তাবাদী ও জনকল্যাণী আদর্শের কর্মসূচি বাস্তবায়নের দাবিতে। বাস্তবে রাজনৈতিক সুফল বহুমতের যুক্তফ্রন্টের বিজয় ও স্বৈরাচারী-সম্প্রদায়বাদী মুসলিম লীগের অভাবিত পরাজয়ে। রাজনীতিতে এর উত্তরপ্রভাব আরও প্রকাশ পেয়েছে ষাটের দশকে জাতীয়তাবাদী স্বাধিকার চেতনার ক্রমবিকাশে।
স্বৈরাচারী মুসলিম লীগ শাসনের চরম দমননীতি ও রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুকে নিয়ে রাজনৈতিক জবরদস্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে প্রতিবাদী শক্তি সংহত করতে গঠন করা হয় বহুমতের সর্বদলীয় সংগঠন। আর এতেই ছিল আন্দোলনের সবলতা-দুর্বলতা—দুই-ই। এবং তা একাধিক ভিন্নমতের প্রকাশ্য ও প্রচ্ছন্ন দ্বন্দ্বের উপস্থিতিতে। মতাদর্শগত এ দ্বন্দ্বের তাৎক্ষণিক ও উত্তরপ্রভাব স্পর্শ করেছে আন্দোলনের চিত্রচরিত্র উপস্থাপনকে। আরও একটি অবাঞ্ছিত বিষয় উচ্চাভিলাষী রাজনীতিকেরা এ আন্দোলনকে ব্যবহার করতে চেয়েছেন তাঁদের ব্যক্তিক বা দলীয় আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের লক্ষ্যে। উদাহরণ কম নয়।
সত্যি বলতে কি, ভাষা আন্দোলনের দু-একটি প্রামাণ্য গ্রন্থের কথা বাদ দিলে ভাষা আন্দোলনের তথ্যবিকৃতি, মূল্যায়নবিকৃতি ঘটেছে নানাভাবে, বিশেষ করে আন্দোলনে সংশ্লিষ্ট কুশীলবদের নৈরাজ্যিক স্মৃতিচারণায়। এ ধারাতেই তথ্যগত ভুলভ্রান্তি সর্বাধিক এবং সম্ভবত বিস্মৃতি বা ঝাপসা স্মৃতির কারণে। এ ছাড়া কখনো মতাদর্শগত বৈপরীত্যও এ ধরনের বিকৃতির কারণ।
শেষোক্ত ক্ষেত্রে অনেকের প্রবণতা আপন আদর্শিক ভূমিকা, বাস্তব ভূমিকা বড় করে তোলা এবং বিপরীত ধারাকে ভাসিয়ে দেওয়া। সে ক্ষেত্রে ইতিহাসের সত্য বিকৃত হয়েছে, হয়েছে পূর্বোক্ত তিন মতাদর্শের পরস্পরবিরোধী পরিপ্রেক্ষিতে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আন্দোলনের মূল কারিগরদের বাইরেও তাদের কোনো কোনো আদর্শিক অনুসারী অধিকতর দৃঢ়তায় ইতিহাসবিরোধী পথে চলতে আগ্রহী। এ সম্পর্কে পরে আলোচনায় আসছি, তার আগে প্রাথমিক পর্বের দু-একটি ঘটনা উদ্ধার জরুরি, মূলত উল্লিখিত বক্তব্যের যথার্থতা প্রতিষ্ঠার জন্য।

২.
ভাষা আন্দোলনের আদিপর্ব অর্থাৎ এর তাত্ত্বিকপর্বে লেখক-সাংবাদিক আবদুল হক ও মাহবুব জামাল জাহেদী প্রমুখের লেখা এবং ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, ড. এনামুল হক প্রমুখের রচনাদি ছিল যুক্তিসজ্জিত। কিন্তু এর পাশাপাশি ১৯৪৭-এর সেপ্টেম্বরে যে সংগঠনটি অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে সোচ্চার হয়ে ওঠে, তার আদর্শ ছিল ধর্মভিত্তিক। তাই বিপরীত মতাদর্শের রাজনীতি, বিশেষভাবে সমাজবাদীদের দূরে রেখে সম্ভাব্য আন্দোলনে একক প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা ছিল তাদের বরাবরের লক্ষ্য।
তাদের বক্তৃতা-বিবৃতি ও রচনায় সমাজবাদবিরোধিতা যেমন স্পষ্ট, তেমনি তাতে ইতিহাসের সত্যও লঙ্ঘিত। ১৯৪৮ সালে সরকারের সঙ্গে তাদের আপসরফার বিষয়টি অস্পষ্ট ছিল না, যা তাদের একাধিক নেতার বিবৃতিতে প্রকাশ পেয়েছে। ঢাকায় ১৯৪৮ মার্চের আন্দোলনে সর্বদলীয় নেতৃত্বের প্রশ্নে রাজপথে বাস্তব তৎপরতায় দেখা যায় জাতীয়তাবাদী ও সমাজবাদী নেতাদের প্রাধান্য। এমনকি জিন্নাহ সাহেবের ঢাকা সফর উপলক্ষে আন্দোলন স্থগিত করার বিরুদ্ধে ছিলেন বিশেষভাবে মোহাম্মদ তোয়াহা ও তাজউদ্দীন আহমদ। আন্দোলন বন্ধের বিপক্ষে ছিল সাধারণ ছাত্রসমাজ।
অথচ ভাষা আন্দোলনের ইতিকথায় অনেকে লিখে থাকেন ১৯৪৮-এর ভাষা আন্দোলনে তমদ্দুন মজলিসের একচেটিয়া ভূমিকার কথা, যদিও ঢাকায় ওই আন্দোলনে পিকেটিংয়ের নেতাদের রাজনৈতিক পরিচয় নিতে গেলে ভিন্ন চিত্র উঠে আসে। তাই অবাক হতে হয়, যখন ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস-লেখক বশীর আল-হেলাল অতিরিক্ত গুরুত্ব দেন ১৯৪৮ আন্দোলনে মজলিসের বিশেষ ভূমিকার ওপর। তমদ্দুন মজলিসের প্রচারিত পুস্তিকাদিতে দেখা যায় ইসলামি সমাজব্যবস্থা কায়েমের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। দেখা যায়, এরা সমাজবাদী আদর্শের ঘোর বিরোধী। তাই শেষোক্তদের ভূমিকা নিয়ে ইতিহাসকে ভিন্নপথে চালনা করাই হয়ে ওঠে তাদের লক্ষ্য। সে জন্য অন্যদের ভূমিকাকে তারা খর্বিত করে দেখায়।
দু-একটি উদ্ধৃতি বিষয়টি স্পষ্ট করবে। যেমন মজলিসপ্রধান অধ্যাপক আবুল কাসেমের বক্তব্য: ‘বস্তুত কমিউনিস্টরা এই আন্দোলনের জন্য কোনো চেষ্টাই করে নাই।...এই সুবিধাবাদীগণই নাজিম-মন্ত্রিসভাকে কায়েদে আজমের সম্মুখে আমাদের আন্দোলন ও উদ্দেশ্যের অপব্যাখ্যার সুযোগ দান করিয়াছে।...অতি প্রগতিশীলরা ছাত্রদের মধ্যে দলাদলি সৃষ্টি করিয়া ছাত্রদের ঐক্যের মূলে কুঠারাঘাত করিয়া নৈরাশ্যের মধ্যে ফেলিয়া দেয়।’ (একুশের সংকলন, ১৯৮০)।
অথচ আমরা জানি, কি ১৯৪৮-এ কি ১৯৫২-এ, প্রগতিবাদীদের বরাবরের চেষ্টা ছিল আন্দোলনকে সর্বদলীয় চরিত্রে গড়ে তোলা, যাতে এর শক্তি বৃদ্ধি হয়। বিভাজিত শক্তি যে দুর্বল শক্তি—এ সত্য অভিজ্ঞতা তাদের শিখিয়েছিল। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনের সর্বস্তরে তাঁরা এ আদর্শই অনুসরণ করেছেন। এই ধারায় কমরেড মুজাফ্ফর আহমদের ভূমিকা সম্পর্কে অধ্যাপক কাসেমের অভিযোগের জবাবে প্রথমোক্তের একটি বাক্যই উদ্ধার করছি: ‘খুব বিনয়ের সঙ্গে আমাকে বলতে হচ্ছে যে এই বক্তব্যে কিঞ্চিৎ সত্যের অপলাপ আছে’ ইত্যাদি (সৈনিক, শহীদ দিবস সংখ্যা, ১৯৫৩)। ১৯৪৮-এর আন্দোলন সম্পর্কে ১৬ মার্চের ঘটনা নিয়ে শাহেদ আলীর বক্তব্যও অনুরূপ বিভ্রান্তিকর তথ্যে দুষ্ট। (একুশের সংকলন, ১৯৮০)। রচনা-সংক্ষেপের তাগিদে এ সম্পর্কে বিস্তারিত উদ্ধৃতিদান সম্ভব হলো না।
বিশেষ এ রাজনীতির অনুসারী কেউ কেউ একুশ শতকে পূর্বোক্ত ঐতিহাসিক বিভ্রান্তি নতুন নতুন তথ্যে সাজিয়ে তুলেছেন, তাতে একুশের ইতিহাস ও আনুষঙ্গিক চিত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ নিয়ে তমদ্দুনপন্থী এবং লেখকের রচনায় ভ্রান্ত তথ্যের প্রকাশ ঘটেছে, বিশেষ করে স্মৃতিস্তম্ভের নকশা-আঁকা ও আঁকিয়ের রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে। সেই সঙ্গে এসেছে ডা. সাঈদ হায়দারেরও নাম। রচনাটি প্রকাশিত হয় প্রথম আলোর ১৪ ফেব্রুয়ারি (২০০৪) সংখ্যায়।
বদরুল আলম প্রয়াত। হয়তো তাই এ বিষয়ে ভাষাসংগ্রামী সাঈদ হায়দার লেখেন: ‘আমি তমদ্দুন মজলিসের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না। প্রকৃত তথ্য হলো ওই সময় ঢাকা মেডিকেল কলেজে তমদ্দুন মজলিসের বা “ছাত্রশক্তি”র কোনো ইউনিট ছিল না।...আমার বিশিষ্ট বন্ধু বদরুল কোনো রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেই যুক্ত ছিল না (প্রথম আলো, ১৮-২-২০০৪)। এ বিষয়ে একই রকম কথা বলেছেন তৎকালীন মেডিকেল ছাত্র শরফুদ্দিন আহমদ, যিনি ছিলেন কলেজ ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক’ (প্রথম আলো, ২৪-২-২০০৪)। তাঁর ভাষায়: ‘বদরুল আলম ও সাঈদ হায়দার সাহেবদের তমদ্দুন মজলিসের সঙ্গে যুক্ত করে জনাব বার্নিক ইতিহাসের তথ্য বিকৃতি ঘটিয়েছেন।’

৩.
একদিকের বিভ্রান্তিকর তথ্যের উদ্ধৃতি না বাড়িয়ে অন্যদিকে নজর ফেরানো যাক। বিশেষ করে আন্দোলনের নেতৃস্থানীয় কারও কারও স্মৃতিচারণার দিকে। তাতে দেখা যায়, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের নানা দিক নিয়ে তথ্যবিচ্যুতি অনেক বেশি। যেমন খ্যাতিমান যুবলীগ নেতার জাতীয় রাজনীতি গ্রন্থে, তেমনি একাধিক ভাষাসংগ্রামীর স্মৃতিচারণায়। সেগুলো কখনো পরস্পরনির্ভর, কখনো পরস্পরবিরোধী।
ছোটখাটো ভুলত্রুটির কথা, কিংবা আমতলার সভায় টিয়ার গ্যাসের জ্বালায় শত শত ছাত্রের পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়ার মতো কল্পিত ঘটনা যদি বাদ দিই, তাহলেও দেখা যাবে, পুলিশের গুলিবর্ষণ ও হতাহতের ঘটনা নিয়ে ইতিহাস-বিকৃতি সর্বাধিক। এমনকি শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ নিয়েও। তথ্যগত ভুল যেমন ক্বচিৎ সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে, তেমনি উদ্দেশ্যমূলক বিকৃতি এলিস কমিশনের তদন্ত প্রতিবেদনে। আর অপপ্রচার হিসেবে মিথ্যা তথ্য প্রতিবেদন প্রকাশের ঘটনা সর্বাধিক মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনের বেতার বক্তৃতা ও কোনো কোনো মন্ত্রী বা দলনেতার বক্তব্য-বিবৃতিতে। ‘মাথায় গুলি লাগা সালাউদ্দিন’কে আজ পর্যন্ত শনাক্ত করা যায়নি, কিন্তু মাথায় গুলি লাগা রফিকউদ্দিনের ছবি ঠিকই ছাপা হয়েছে কাগজে। অথচ কল্পিত সালাউদ্দিনকে নিয়ে অনেক বাগাড়ম্বর করা হয়েছে জাতীয় রাজনীতি গ্রন্থে। এবং কারও কারও লেখায়।
দিন-তারিখের ভুলভ্রান্তি ঘটেছে ভাষাসংগ্রামী অধিকাংশের স্মৃতিচারণায়। কিন্তু বিস্তৃতির কারণে নতুন নতুন ঘটনার জন্ম দিয়েছেন অনেকে, ছোট ঘটনাকে বড় করতে বা কল্পিত ঘটনা প্রতিষ্ঠিত করতে—যেমন রফিকউদ্দিনকে, তেমনি আবুল বরকতকে নিয়ে। বন্ধুস্থানীয় বা ঘনিষ্ঠ পরিচিত এসব লেখকের নাম উল্লেখ না করাই বোধ হয় সমীচীন। হাসপাতালের স্ট্রেচার এবং নার্স, ওয়ার্ড বয়দের নিয়েও পরিবেশিত হয়েছে গল্প—যদিও তাঁদের একজনও স্বাভাবিক কারণেই একুশের দুপুরে হোস্টেল প্রাঙ্গণে হাজির হননি। ছিলেন না কোনো ‘ধাঙড়’।
অসতর্ক সাংবাদিকতাও মাঝেমধ্যে ঘটনায় ভুলত্রুটির জন্ম দিয়েছে। সালাউদ্দিন প্রসঙ্গের মতোই একই দৈনিকে পাঁচুয়ার গ্রাম্য যুবা শহীদ জব্বারের পরিচয় হয়ে ওঠে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। এ ধরনের ভুল ইতিহাসের বিচারে নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ।
শহীদদের নিয়ে জানাজা প্রসঙ্গেও অনেকে ভুল তথ্য পরিবেশন করেছেন। প্রকৃতপক্ষে লাশ নিয়ে পরদিন মিছিলের সিদ্ধান্ত একুশে ফেব্রুয়ারি তারিখেই। গায়েবানা জানাজার প্রসঙ্গ আসে পরদিন সকালে, যখন জানা গেল গভীর রাতে হাসপাতাল থেকে লাশ উধাও। ২২ ফেব্রুয়ারি দৈনিক আজাদ-এ ঠিকই বলা হয় যে ‘২১ ফেব্রুয়ারি বেলা চারটার পর হোস্টেলের মধ্য হইতে মাইকযোগে নিহতদের জানাজায় শরিক হওয়ার জন্য ছাত্র ও জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।’
জাতীয় রাজনীতির ভুল তথ্যগুলো থেকে উদ্ধার করতে গিয়ে অনেকের মতো বশীর আল-হেলালও ভুল করেছেন এমন কথা লিখে যে, ‘আন্দোলনের নেতাদের এই সময় আর দেখতে পাওয়া যায় না।...তাদের অধিকাংশ আত্মগোপন করেছিলেন।’ এ তথ্য ঠিক নয়। ২৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মতিন, তোয়াহা, ইমাদুল্লাহ, জাহেদী, সুলতানদের হোস্টেলে আসা-যাওয়া করতে দেখেছি, কাউকে কাউকে দীর্ঘ সময় অবস্থান করতে দেখেছি। জাহেদী তো সার্বক্ষণিক বাসিন্দা ডক্টরস ব্যারাকে। তা ছাড়া একসময় ছাত্র এলাকা মুক্ত এলাকা। ২৬ তারিখ থেকে শুরু চরম দমননীতি, মাইক জব্দ, স্মৃতিস্তম্ভ ধ্বংস এবং গ্রেপ্তার ইত্যাদির মাধ্যমে। ভাষা আন্দোলনের নানান দিক নিয়ে ত্রুটিবিচ্যুতি ও ভুল তথ্যের পরিমাণ এত বেশি যে ছোটখাটো নিবন্ধে তা সম্পূর্ণ তুলে ধরা সম্ভব নয়। তাই শহীদ মিনার প্রসঙ্গেই লেখার ইতি টানছি। এক ভাষাসংগ্রামী বন্ধু লিখেছেন: ‘বাইশে ফেব্রুয়ারি রাত। মেডিকেল কলেজ এবং ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্ররা...শহীদ মিনার গড়ে তুললেন।’ এ বিষয়ে অধিকতর ভুল তথ্য জাতীয় রাজনীতিতে পরিবেশিত। ভুল শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ উদ্বোধন প্রসঙ্গেও।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিতর্কিত ঐতিহাসিক বিষয় বায়ান্ন-ফেব্রুয়ারিতে জননেতা শেখ মুজিবুর রহমানের কারাগারে অনশনের তারিখ এবং সেই আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা নিয়ে পরস্পরবিরোধী মতামত। এ বিতর্কের ধারাবাহিকতা স্বাধীনতা-উত্তরকালে পর্যন্ত গড়িয়েছে, কিন্তু বিতর্কের অবসান ঘটেনি। এ বিষয়ে জিল্লুর রহমানের সঙ্গে গাজীউল হকের যেমন ভিন্নমত, তেমনি ভিন্নমত তোয়াহার সঙ্গে খন্দকাল গোলাম মোস্তফার। কে জি মুস্তাফার বক্তব্যকে গাজীউল বলেছিলেন, ‘বানোয়াট গল্প’ (একুশের স্মৃতিচারণ, ১৯৮০, বাংলা একাডেমি)। আবার দীর্ঘ সময় পর গাজীউলই এ সম্বন্ধে সম্পূর্ণ বিপরীত বক্তব্য পেশ করেছেন।
এভাবে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে বিভিন্নধর্মী উদ্দেশ্যের লাগাম পরানো ও বিস্মৃতিচারণার কারণে ইতিহাসের সত্য প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে, যা কোনো ইতিহাসের ক্ষেত্রেই বাঞ্ছিত নয়। কিন্তু উল্লিখিত একাধিক কারণে ভুল, ত্রুটি ও বিতর্কের বাস্তবতা থেকে ইতিহাসকে মুক্ত করা যায়নি। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা সর্বপ্রতিষ্ঠানগ্রাহ্য হয়ে ওঠে না বলে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসকে বিতর্কমুক্ত করতে সর্বজনগ্রাহ্য প্রাতিষ্ঠানিক প্রচেষ্টা প্রয়োজন।