অমর একুশে সেই ছবি এই ছবি

>১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগানে মুখর হয়ে ১৪৪ ধারা ভাঙে ছাত্রজনতা। তারপর রক্তাক্ত ইতিহাস। ভাষা আন্দোলনের ৬৮ বছর পর এই আয়োজনে আমরা মিলিয়ে দেখতে চেয়েছি একুশে ফেব্রুয়ারির ঐতিহাসিক স্থানগুলো। সেসব স্থান কি আজও কথা বলে? কালের বিবর্তনে কতটা বদল ঘটেছে এসব স্থানের? বিভিন্ন সূত্র থেকে সংগৃহীত ১৯৫২–এর পুরোনো ছবির সঙ্গে মিলিয়ে এবং একুশের স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলো ঘুরে নতুন ছবি তুলেছেন সৈয়দ লতিফ হোসাইন। লিখেছেন জাহীদ রেজা নূর

আমতলা

ঐতিহাসিক আমতলা এখন কেবলই স্মৃতি। সেটি ছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজের পুরোনো জরুরি বিভাগে ঢুকে কিছুটা ডানে গিয়ে বাঁয়ের মোড়ে। আমগাছটির দক্ষিণে ছিল মধুর ক্যানটিন। এখন সেখানে আমগাছটি নেই। ডাকসু ভবনে সেই আমগাছের কিছু অংশ সংরক্ষিত আছে। এখন সেখানে নিমগাছ এবং নতুন আমগাছ দেখা যায়।
ঐতিহাসিক আমতলা এখন কেবলই স্মৃতি। সেটি ছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজের পুরোনো জরুরি বিভাগে ঢুকে কিছুটা ডানে গিয়ে বাঁয়ের মোড়ে। আমগাছটির দক্ষিণে ছিল মধুর ক্যানটিন। এখন সেখানে আমগাছটি নেই। ডাকসু ভবনে সেই আমগাছের কিছু অংশ সংরক্ষিত আছে। এখন সেখানে নিমগাছ এবং নতুন আমগাছ দেখা যায়।

এখন দেখলে বোঝা যাবে না, এখানেই ছিল সেই ঐতিহাসিক আমতলা। একুশে ফেব্রুয়ারি বেলা ১১টা নাগাদ এখানেই বসেছিল ছাত্রদের সভা। সেই সভায় সিদ্ধান্ত হয়, সরকারের দেওয়া ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হবে। রাজনীতিবিদ শামসুল হক ও খালেক নেওয়াজ খান ১৪৪ ধারা ভঙ্গের বিরুদ্ধে বক্তব্য দেন; কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবদুল মতিন, যিনি ‘ভাষা মতিন’ নামে পরিচিত এবং সভার সভাপতি গাজীউল হক ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে মত দেন। সেখানেই সিদ্ধান্ত হয়, ১০ জন করে ছাত্ররা বেরিয়ে পড়বেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গেট দিয়ে। ছাত্রনেতা মোহাম্মদ সুলতানের ওপর এই ১০ জনি মিছিলের সদস্যদের নাম লেখার ভার পড়ে।

কে কোথায় শহীদ হলেন

এখন যেখানে ঢাকা মেডিকেল কলেজের আউটডোর, ডিসপেনসারি এবং নার্স হোস্টেল, তার পুরোটা জুড়েই ছিল এসব ব্যারাক।
এখন যেখানে ঢাকা মেডিকেল কলেজের আউটডোর, ডিসপেনসারি এবং নার্স হোস্টেল, তার পুরোটা জুড়েই ছিল এসব ব্যারাক।

দুপুরের দিকে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেডিকেল ব্যারাকের দিকে আসতে থাকেন। ব্যারাকে ছাত্র–অছাত্রদের বিশাল জমায়েত হয়। মূলত মেডিকেল কলেজের ছাত্রাবাস ছিল ব্যারাক। মেডিকেল ব্যারাকগুলো সংখ্যায় ছিল বিশটি। বাঁদিকে ছিল ১১টি ব্যারাক, যার প্রতিটিতে ছিল পাঁচটি করে কক্ষ। ডানদিকে ছিল ১২ থেকে ১৭ নম্বর ব্যারাক, যার প্রতিটিতে ছিল ছয়টি করে কক্ষ আর তিনটি নতুন ব্যারাক, ১৮ থেকে ২০ নম্বর—এখানে ছিল ১১টি করে কক্ষ। ১৪ নম্বর ব্যারাকের ডানদিকে রফিক গুলিবিদ্ধ হন। ১২ নম্বর ব্যারাকের সামনে গুলিবিদ্ধ হন বরকত। ২০ নম্বরের কাছাকাছি গুলিবিদ্ধ হন জব্বার। বলা ভালো, এখানে ব্যবহৃত মেডিকেল ব্যারাকের ছবিটি শিল্পীর অাঁকা।

ঐতিহাসিক গেট

মেডিকেল কলেজের এখনকার জরুরি বিভাগের সামনে এই গেটের বর্তমান অবস্থান। এখানে লেখা আছে ইতিহাসটি।
মেডিকেল কলেজের এখনকার জরুরি বিভাগের সামনে এই গেটের বর্তমান অবস্থান। এখানে লেখা আছে ইতিহাসটি।

আমতলার বৈঠক শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই গেট দিয়ে বের হতে থাকে একেকটি ১০ জনি খণ্ডমিছিল। সে সময় শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। কে কার আগে গেট দিয়ে বের হবেন, তা নিয়ে যেন প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। প্রথম ১০ জনের খণ্ডমিছিলে ছিলেন মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান (পরবর্তীকালে প্রধান বিচারপতি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা)। দ্বিতীয় দলে ছিলেন ইব্রাহিম তাহা ও আবদুস সামাদ আজাদ। তৃতীয় দলে ছিলেন আনোয়ারুল হক খান ও আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ। চতুর্থ দলের নেতৃত্বে ছিলেন মেয়েরা। শাফিয়া খাতুন, সুফিয়া ইব্রাহিম, শামসুন্নাহার প্রমুখ ছিলেন এই মিছিলে।

এভাবে একের পর এক মিছিল বের হয়। তাতে ছিলেন শামসুল হক, আনোয়ারুল আজিম, সাইয়ীদ আতীকুল্লাহ, সৈয়দ ফজলে আলী প্রমুখ।

শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ

এখন যেখানে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ডিসপেনসারি আছে, সে জায়গাটিতে ছিল শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ।
এখন যেখানে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ডিসপেনসারি আছে, সে জায়গাটিতে ছিল শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ।

মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা এই স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করেছিলেন। ২২ ফেব্রুয়ারি যে বিশাল মিছিল বের হয়েছিল, সেই মিছিলেই প্রথম স্লোগান ওঠে, ‘শহীদ স্মৃতি অমর হোক’। সে কথা মনে রেখেই মেডিকেল কলেজের ভিপি গোলাম মাওলাসহ এক দল ছাত্র যখন কথা বলছিলেন, তখন কেউ একজন একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করার প্রস্তাব দেন। গোলাম মাওলা ডেকে আনেন বদরুল আলমকে। তিনি তখন ক্লান্ত হয়ে ঘুমাচ্ছিলেন। তাঁকে নকশা করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। বদরুল প্রথমে যে নকশা করেন, সেটি ঈষৎ পরিবর্তন করতে বলা হয়। তখন সাঈদ হায়দার তাঁকে কিছুটা সাহায্য করেন। সেই নকশা অনুযায়ী ২৩ ফেব্রুয়ারি রাত থেকে শুরু হয় শহীদ মিনার নির্মাণের কাজ। মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এই মিনার তৈরি করেন। সিমেন্ট ছিল না; মেডিকেল কলেজে যে নির্মাণকাজ হচ্ছিল, তার সাব-কন্ট্রাক্ট পেয়েছিলেন পিয়ারু সরদার। আহমদ রফিক ও আলি আসগর যান পিয়ারু সরদারের কাছে। সিমেন্ট চাইলে তিনি বিনা দ্বিধায় চাবি দিয়ে দেন। শুধু বলেন, কাজ শেষ হলে চাবিটি ফেরত দিও। ২৪ ফেব্রুয়ারি তৈরি হয়ে যায় স্মৃতিস্তম্ভ। এরপরই হাজার হাজার মানুষ স্মৃতিস্তম্ভ তথা শহীদ মিনারে আসতে থাকেন। ২৪ তারিখে শহীদ শফিউর রহমানের বাবাকে দিয়ে এই মিনার উদ্বোধন করানো হয়। এরপর ২৬ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয়বার এটির উদ্বোধন করেন আবুল কালাম শামসুদ্দীন। সেদিনই বিকেলের দিকে পুলিশ এই মিনার গুঁড়িয়ে দেয়।

পরিষদ ভবন

পরিষদ ভবন এখন আর নেই। সেখানে আছে শুধু তিনটি সিঁড়ি, যা ভবনটির স্মৃতি ধরে রেখেছে।
পরিষদ ভবন এখন আর নেই। সেখানে আছে শুধু তিনটি সিঁড়ি, যা ভবনটির স্মৃতি ধরে রেখেছে।

বর্তমান জগন্নাথ হলের যে জায়গায় প্রাদেশিক পরিষদ ভবন ছিল, তা এখন আর নেই। ১৯৮৫ সালে সেটি ধসে পড়েছিল। বর্তমান শহীদ মিনারের দিক থেকে ছাত্ররা এই পরিষদ ভবনের দিকে আসতে চাইছিলেন। ছাত্ররা রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি জানাতে চাইছিলেন পরিষদ সদস্যদের কাছে, যেন তাঁরা বাজেট অধিবেশনে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব তোলেন। প্রাদেশিক পরিষদ ভবনে যাওয়ার পথে সেক্রেটারিয়েট রোডে ফুলার রোডের সংযোগস্থলে পুলিশ ব্যারিকেড দিয়ে রেখেছিল, এদিকে শিক্ষার্থীরা ছিল, ওদিকে পুলিশ।

বেলা ৩টা ২০ মিনিটে গুলি চলার পর ছাত্রদের মধ্যে উত্তেজনার সৃষ্টি হয় এবং তার উত্তাপ গিয়ে লাগে পরিষদ ভবনে। বিধানসভার বাজেট অধিবেশন মূলত শুরু হয়েছিল ২০ ফেব্রুয়ারি। সেদিনই প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী নুরুল আমিন ১৯৫২–৫৩ অর্থবছরের বাজেট পেশ করেছিলেন। একুশে ফেব্রুয়ারি বেলা সাড়ে তিনটায় অধিবেশন শুরু হলে স্পিকার ছাড়া নয়জন মন্ত্রী ও ৮৩ জন সদস্য উপস্থিত ছিলেন। মাওলানা খন্দকার আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, মনোরঞ্জন ধর, বসন্ত কুমার দাস গুলি চালানোর প্রতিবাদে বক্তব্য দেন।

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির ঘটনাক্রম অনুসারে ইনফোগ্রাফিকস করেছেন মনিরুল ইসলাম