বাংলা ভাষার তিন শত্রু

ঢাকা িবশ্ববিদ্যালয়ের সামনে ছাত্র–জনতার ১৪৪ ধারা ভাঙার প্রস্তুিত, ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২। ছবি: রফিকুল ইসলাম
ঢাকা িবশ্ববিদ্যালয়ের সামনে ছাত্র–জনতার ১৪৪ ধারা ভাঙার প্রস্তুিত, ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২। ছবি: রফিকুল ইসলাম

মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান সম্পাদিত (২০০০) মুহম্মদ আবদুল হাই স্মারকগ্রন্থ–তে নীলিমা ইব্রাহিমের ‘শ্রদ্ধাঞ্জলি’ নামের একটি প্রবন্ধ আছে। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সূত্র ধরে তিনি সেখানে আবদুল হাইয়ের ব্যক্তিত্ব ও কৃতিত্বের পরিচয় দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। এক জায়গায় প্রসঙ্গক্রমে লিখেছেন, ‘পাকিস্তানের ঐ সময়টায় যেমন বাংলার প্রতি জনসাধারণের আগ্রহ ও শ্রদ্ধাবোধ জন্মেছে, তেমনি তথাকথিত ভদ্রলোকেদের জন্মেছে অনীহা।’ যে সময়টার কথা তিনি বলেছেন, তখন ভাষা আন্দোলনের পরে বছর কয়েক গত হয়েছে। তখনো ঢাকার উচ্চবিত্ত শ্রেণি সুগঠিত হয়ে একটি আলাদা সমাজ হিসেবে গণ্য হওয়ার মতো লায়েক হয়ে ওঠেনি। তার মধ্যেই নীলিমা ইব্রাহিম লক্ষ করেছেন, ভদ্রলোক সমাজ বাংলার প্রতি অনীহ হয়ে উঠেছিলেন। ভাষা আন্দোলন বা অন্য যে কারণেই হোক, তিনি লিখতে পেরেছেন, দেশের জনসাধারণের বাংলার প্রতি শুধু আগ্রহ নয়, শ্রদ্ধাবোধও আছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার প্রায় পাঁচ দশক পরে এ ধরনের একটি বাক্য লেখা আর কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। এখন রাষ্ট্রীয় কাঠামোকে ব্যবহার করে রীতিমত বিপুলায়তন হয়ে ওঠা উচ্চশ্রেণির সঙ্গে বাংলার ব্যবহারিক কোনো সম্পর্কই নেই। আর মধ্যশ্রেণিরও বাংলার প্রতি কোনো আগ্রহ অবশিষ্ট নেই, শ্রদ্ধাবোধ তো দূরের কথা। 

বাংলাদেশের মতো গভীরতম উপনিবেশায়নের শিকার একটি দেশের উচ্চশ্রেণি যে স্থানীয় ভাষার ব্যাপারে উন্নাসিক হবে, তা অভাবনীয় নয়। উপনিবেশিত উচ্চশ্রেণি জনসাধারণের সঙ্গে দূরত্ব চায়; আর দূরত্ব রচনার জন্য ভাষার চেয়ে মোক্ষম অস্ত্র আর কীই–বা হতে পারে। কিন্তু মধ্যবিত্ত, যাদের দ্বিতীয় একটি ভাষা সম্যকরূপে রপ্ত করার মতো সময়, শ্রম আর অর্থের বেজায় ঘাটতি, তারা কেন এবং কীভাবে নিজেদের মধ্যে চালু ও নিজেদের জানা ভাষাটির ব্যাপারে এ রকম সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারল, তার জরিপ খুব জরুরি কাজ। বাংলাদেশের উচ্চশ্রেণির বিকাশ ও দৃষ্টিভঙ্গি ক্ল্যাসিক বা সাম্প্রতিক কোনো তালেই পড়ে না। তাদের এবং তাদের পরবর্তী প্রজন্মের ভবিষ্যৎ এ দেশে নেই, আছে বিদেশে। উচ্চমূল্যে শিক্ষা ক্রয় করে নিজেদের সক্ষমতা বাড়িয়ে তারা যে ছেলেমেয়েদের জন্য বিদেশে সুখী ভবিষ্যৎ গড়ছে, এমন কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। বরং এ ভবিষ্যৎ গঠিত হচ্ছে দেশে উপার্জিত বা অনুপার্জিত টাকার পাচারকৃত অংশ দিয়ে। বহু দশক হলো বাংলাদেশ থেকে পাচারকৃত টাকার যে হিসাব পাওয়া যাচ্ছে, তা আমাদের এ রকম সিদ্ধান্ত নিতেই প্ররোচিত করে। বলা যায়, উচ্চশ্রেণির জন্য ‘শিক্ষা’ জরুরি নয়, ‘ইংরেজি-শিক্ষা’ই যথেষ্ট। কিন্তু মধ্যশ্রেণির ভবিষ্যৎ নিহিত আছে অর্জিত শিক্ষা দেশে অথবা বিদেশে বিক্রি করার সুযোগের ওপর। তাদের জন্য শিক্ষাটা জরুরি। তা সত্ত্বেও এ শ্রেণিটা যে হরেদরে ‘শিক্ষা’র বদলে ঝুঁকল সেই ‘ইংরেজি-শিক্ষা’র দিকেই, তার কারণ নির্ণয় করা এত সহজ নয়। অথচ এ দৃষ্টিভঙ্গির সুলুক সন্ধানের ওপরই দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ গতিপ্রকৃতি। বস্তুত, বাংলাদেশে বাংলা ভাষাটা যে এতটা ঝুঁকিগ্রস্ত হয়ে উঠল, তার গোড়ায় আছে ভাষা ও শিক্ষা সম্পর্কে মধ্যবিত্তের এ দৃষ্টিভঙ্গির সর্বগ্রাসী প্রসার। তাই যেসব কারণে এ দৃষ্টিভঙ্গি মহামারীর মতো বিস্তার লাভ করেছে, সেগুলোকে বলতে পারি বাংলা ভাষার প্রধান শত্রু।

বাংলাদেশের বর্তমান ভাষা-পরিস্থিতির সাপেক্ষে বলতে পারি, বাংলা ভাষাপ্রশ্নে যুক্তির বদলে আবেগকে প্রশ্রয় দেওয়া, উপযোগিতার পরিবর্তে ঐতিহ্যের দোহাই ব্যবহার এবং সর্বাঙ্গীণ ব্যবহারের তুলনায় সাহিত্যিক এলিট রূপকে আলোচনা-পর্যালোচনায় প্রধান করে তোলা—এ তিনটিই ব্যবহারিক দুনিয়া থেকে বাংলা ভাষা দ্রুত অপসৃত হওয়ার কারণ। তিনটিরই এমন মুখচ্ছবি আছে যে সহসা এগুলোকে বাংলার পক্ষের উপাদান বলেই মনে হয়। এমনকি যারা সচেতনভাবে বাংলার পক্ষে প্রচারণা চালান, তাঁরাও অজ্ঞাতে এ তিন বালাইয়ের শিকার হন। এ কারণেই বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এগুলোকে চিনে নেওয়া দরকার।

গেল শতকের পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে পূর্ব বাংলায় যে জাতীয়তাবাদী চেতনা ও আন্দোলন ক্রমশ দানা বেঁধে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম সম্ভবপর করেছিল, তার অবলম্বন ছিল বাংলা ভাষা। ফলে বাংলা ভাষা ও সংশ্লিষ্ট সাংস্কৃতিক তৎপরতা বিস্তর আবেগ ও গালগল্পের জন্ম দিয়েছে। জাতিরাষ্ট্রের জন্মের উপাখ্যান হিসেবে তা মোটেই অন্যায্য নয়। কিন্তু জাতীয়তাবাদী আবেগ এক বস্তু, আর রাষ্ট্রের কাঠামোগত পরিগঠনে ভাষাকে কার্যকর গণতান্ত্রিক উপাদান হিসাবে ব্যবহারের পরিকল্পনা আরেক। আবেগকে যুক্তিকাঠামোয় রূপান্তরিত করতে না পারলে দ্বিতীয় কাজটি শুরু হয় না। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সুবিধাভোগী শ্রেণিটি, যেমনটা আগেই ইঙ্গিত দিয়েছি, বিদ্যমান কাঠামোকে অক্ষুণ রেখে শ্রেণিস্বার্থ রক্ষা করতে চায় এবং এ কাজে ব্যবহার করে জাতীয়তাবাদী আবেগ। দশকের পর দশক ওই আবেগের বিরামহীন উদ্‌গিরণ জনগোষ্ঠীকে নিশ্চয়ই বদ্ধমূল ধারণা দিয়েছে যে বাংলা ভাষার সঙ্গে যোগটা অতীতের, বর্তমান জীবনবাস্তবতা বা জীবনযুদ্ধের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। 

বাংলার সঙ্গে যে ইংরেজির একটা অতি অপ্রয়োজনীয় কিন্তু শক্তিশালী দ্বৈরথ সমাজে গভীরভাবে তৈরি হয়ে গেল, তার পেছনে তো বহু দশকের এই প্রচারণা প্রধানভাবে দায়ী যে ইংরেজির আছে উপযোগিতা আর বাংলার আছে জাতীয় ঐতিহ্য। দুনিয়ার সর্বত্র যেখানে প্রথম ভাষার সাথে দ্বিতীয় ভাষা, বা এমনকি তৃতীয় বা চতুর্থ ভাষা সহাবস্থান করে থাকে, সেখানে বাংলাদেশে দ্বিতীয় ভাষাটি প্রথমটিকে হটিয়ে দিয়ে জায়গা দখল করেছে। কাজটি হয়েছে উপযোগিতার যুক্তিতে। উন্নতির অভিলাষে। অথচ উন্নতি ও উপযোগিতার এ যুক্তি আসলে এক ভিত্তিহীন মিথ। দুনিয়ার কোথাও এর দৃষ্টান্ত নেই। ইউরোপের অল্প জনসংখ্যার ছোট দেশগুলোও নিজ নিজ ভাষায় শিক্ষাসহ সব ব্যবহারিক কাজ সম্পন্ন করে। পূর্ব এশিয়ার যে দেশগুলো প্রায় বাংলাদেশের সমকালে যাত্রা শুরু করে নিজেদের জীবনযাপনকে নিয়ে গেছে ঈর্ষণীয় উচ্চতায়, তার একটিও দ্বিতীয় ভাষাকে প্রথম ভাষা হিসাবে ব্যবহার করেনি। এরা প্রত্যেকেই ইংরেজি শিখেছে। এবং তথ্য-উপাত্ত বলছে, দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে ইংরেজিতে সক্ষমতার দিক থেকেও এ জনগোষ্ঠীগুলো বাংলাদেশ থেকে এগিয়ে আছে। তাহলে আমাদের এই ভয়াবহ ইংরেজি-উন্মাদনার উপযোগিতার দৃষ্টান্ত কই?

বাংলাদেশের মানুষেরা সাধারণভাবে তাদের ইংরেজিপ্রীতির সমধর্মী উদাহরণ হিসাবে ভারতের উল্লেখ করে থাকে। কিন্তু ভারত আসলে এমন এক উদাহরণ, যার সঙ্গে দুনিয়ার কোনো দেশের কোনো মিল নেই। ভারতে প্রধান ভাষার সংখ্যা অনেক। এক ভাষার আধিপত্য মেনে নিতে অন্য অনেক ভাষাভাষীর আপত্তি আছে। তা ছাড়া ভারতীয়দের একটা ছোট অংশের প্রথম ভাষা ইংরেজি। ফলে মধ্যশ্রেণি থেকে উচ্চশ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা ও অপরাপর কাজে ইংরেজির ব্যবহার ভারতে তুলনামূলক ভালো ফল দিয়েছে। কিন্তু দ্বিতীয় ভাষাকে প্রথম ভাষার বিকল্প হিসাবে ব্যবহারের সামাজিক পরিণতিও ভারতের সঙ্গী হয়েছে। ভারতে আছে দুনিয়ার সবচেয়ে শ্রেণিবিভক্ত সমাজের একটি, যার ইংরেজি ক্রয়ে অক্ষম বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ নিম্নশ্রেণির সঙ্গে শিক্ষিত নাগরিক শ্রেণির ব্যবধান বিশাল। সামাজিক অগ্রগতির যেকোনো সূচকে ভারতের শোচনীয় অবস্থা নিশ্চয়ই তার নানা রাষ্ট্রীয়-সামাজিক আচারেরই ফল। পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর বিপুল জনগণ যেভাবে জীবনযাত্রার মানের দিক থেকে সামগ্রিকভাবে উন্নতি করেছে, এমনকি ভিয়েতনাম-লাওসের মতো দেশগুলো যেভাবে তার পুরো জনগোষ্ঠীকে সম্পদে রূপান্তরিত করার ক্ষেত্রে ত্বরিত সাফল্য পেয়েছে, তার সাথে তুলনীয় কিছু তো ভারতে ঘটেনি। তাহলে ইংরেজির নামে উপযোগিতার যে বয়ান বাংলার বিপরীতে আমাদের জনসমাজে এত দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল, তার ভিত্তি কী?

আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনায় এ সংবাদ একেবারেই চাউর হয়নি যে প্রথম ভাষার সার্বিক ব্যবহার নিখাদ অর্থনৈতিক যুক্তিতেই অনেক বেশি কার্যকর। একটি প্রয়োজনীয় বই এক কোটি মানুষ দ্বিতীয় ভাষায় না পড়ে যদি প্রথম ভাষায় পড়তে পারে, তাহলে যে পরিমাণ সময় ও শ্রম বাঁচবে, তার আর্থিক মূল্য অনেক। চীন, জাপান, কোরিয়া বা ভিয়েতনামের ক্ষেত্রে তা–ই ঘটেছে। প্রযুক্তি বা কেজো জ্ঞান রপ্ত করার জন্য যে ইংরেজি আবশ্যিক নয়, তার প্রমাণ দুনিয়ার সর্বত্র দেখতে পাই। সেদিক থেকে ইংরেজির উপযোগিতার যে মিথের ভিত্তিতে আমরা আমাদের শিক্ষা ও অপরাপর কর্মকাণ্ড সাজিয়েছি, তার কোনো যুক্তি পাওয়া যায় না। বস্তুত, জনগোষ্ঠীকে সম্পদে পরিণত করার জন্য যে শিক্ষা পরিকল্পনা করা হয়, আমরা সে স্তরে প্রবেশই করিনি। আমরা ইংরেজি শিখতে চেয়েছি। আর এ ক্ষেত্রে আমাদের জন্য দুর্ভাগ্যজনক তথ্য এই যে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে ইংরেজিতে দক্ষ জনগোষ্ঠীর তালিকায়ও বাংলাদেশের স্থান বেশ নিচের দিকে। বোঝা যাচ্ছে, শিক্ষা তো বটেই, ভাষাশিক্ষা প্রশ্নেও আমাদের সংকট যতটা ভাবা যায়, তার চেয়ে গভীর। 

ওপরে বই পড়ার কথা বলেছি। এ বই সাহিত্যের নয়; প্রয়োজনীয় জ্ঞান, তথ্য-উপাত্ত আর প্রযুক্তির। আমাদের জনগোষ্ঠী বইয়ের জগতে সাহিত্যকে অতিরিক্ত প্রাধান্য দিতে অভ্যস্ত। বইয়ের মাধ্যমে, অনুবাদের মধ্য দিয়ে, ধরা যাক, প্রযুক্তিকে যে বিপুল মানুষের মধ্যে সঞ্চারিত করা যায়, সে বোধ এখানে খুব সুলভ নয়। অথচ পূর্ব এশিয়ার যে দেশগুলোকে প্রযুক্তিজ্ঞানের জন্য আমরা নিত্য ঈর্ষা করি, তারা অনুবাদের মাধ্যমেই তা অর্জন করেছে। ভাষার এই বৃহত্তর কেজো ব্যবহার আমাদের নজরের বাইরেই থেকে গেছে। এক বোধহীন সাহিত্যমনস্কতা এ জন্য মুখ্যত দায়ী। এ দৃষ্টিভঙ্গিকেই আমরা বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান শত্রু বলে চিহ্নিত করেছি। কথাটা আরেকটু বিশদ করা যাক।

উপনিবেশিত মধ্যবিত্তের কাছে সাহিত্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে এ কারণে যে বিদেশাগত ধ্যানধারণা জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রচারের জন্য সাহিত্যই সবচেয়ে কার্যকর মাধ্যম হিসাবে গণ্য হয়। রাষ্ট্রের মধ্য দিয়ে সমস্ত জনগোষ্ঠীকে নিয়ে প্রকল্প উপস্থাপনার সুযোগ উপনিবেশিত বুদ্ধিজীবী শ্রেণির থাকে না। উপনিবেশিত রাষ্ট্র পরিচালিত হয় কর্তার ভাষায়। দেশি ভাষাটা ব্যবহৃত হয় প্রধানত ভদ্রলোকদের বিদেশি আদব শেখানোর কাজে। ফলে সাহিত্যের ওপর জোর পড়ে। বাংলা অঞ্চলে উনিশ শতকে এ দৃষ্টিভঙ্গি প্রবল ছিল। বিশ শতক পেরিয়ে একুশ শতকে উপনীত হলেও এ দৃষ্টিভঙ্গির যে বিশেষ বদল হয়নি, তার প্রমাণ মেলে এখানকার ভাষা-সম্পর্কিত আলাপ-আলোচনায়। আমাদের ভাষা-আলোচনা মুখ্যত সাহিত্যনির্ভর। অথচ সাহিত্য একটি বিশেষ উপভাষা মাত্র, আর তা জনগোষ্ঠীর খুব ছোট্ট একটা অংশের সাথে যুক্ত। শিক্ষার কাজে, অফিস-আদালতে, আর বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর নিত্য ব্যবহারে ভাষার যে বিপুল ব্যবহার, তার দিকে আমাদের নজর সামান্যই গেছে। এর এক প্রমাণ এই যে প্রায় তিন দশক ধরে আমাদের ভাষা-আলোচনায় প্রাধান্য পেয়েছে প্রমিত বাংলার শুদ্ধতা রক্ষা। এই ফাঁকে আমাদের রাষ্ট্রভাষাটি কার্যত মাতৃভাষা হয়ে উঠল, আর শিক্ষার মূলধারা থেকে বাংলা আরও এক ধাপ বিচ্যুত হলো। 

প্রথম ভাষা দরকার হয় অংশগ্রহণমূলক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ার জন্য। শিক্ষায় প্রথম ভাষা দরকার হয় জনগোষ্ঠীকে জনশক্তিতে রূপান্তরিত করার জন্য। বাংলাদেশে আমরা এ দুটি কাজ কার্যকরভাবে শুরুই করিনি। ফলে বাংলা ভাষার উপযোগিতার আলাপও শুরু হয়নি। সে ধাপে পৌঁছানোর জন্য সমাজে এই বোধ সঞ্চারিত করা দরকার যে ইংরেজি বাংলার সঙ্গেই দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে সহাবস্থান করতে পারে, যেমন করে সারা দুনিয়ায়। এ কথাও প্রচার থাকা জরুরি, বাংলার সাথে জনগোষ্ঠীর সম্পর্ক আবেগের বা ঐতিহ্যের নয় কেবল, নিখাদ আর্থিক উপযোগিতা হবে ওই সম্ভাব্য কার্যকর সম্পর্কের ভিত্তি।