ঠাকুরগাঁওয়ে প্রতিরোধযুদ্ধ

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে নিরীহ বাঙালি অসীম সাহসে মুখোমুখি হয়েছিল পাকিস্তানের প্রশিক্ষিত বাহিনীর বিরুদ্ধে। ছিনিয়ে এনেছিল বিজয়। বীরত্বপূর্ণ সেসব সম্মুখযুদ্ধ উজ্জ্বল হয়ে আছে স্বাধীনতার স্বপ্নে, আত্মত্যাগের মহিমায়। মুক্তিযুদ্ধের বহুল আলোচিত কয়েকটি যুদ্ধ নিয়ে প্রথম আলোর এ আয়োজন।

মীর্জা তসমিম-উল ইসলাম বাবলু

১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের পর পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা করায় ’৭১ সালের মার্চ থেকে পূর্ব পাকিস্তানে [বর্তমানে বাংলাদেশ] অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। এ সময় আমার বড় ভাই অবসরপ্রাপ্ত উইং কমান্ডার [মুক্তিযুদ্ধকালে যুব শিবিরের প্রধান] এস আর মীর্জা ঢাকা থেকে ঠাকুরগাঁওয়ে আসেন। এখানে যাঁরা আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন, তাঁরা প্রায় সবাই আমার বড় ভাইয়ের বন্ধু অথবা বন্ধুস্থানীয় ছিলেন। তিনি দেশের পরিস্থিতি আলোচনার জন্য স্থানীয় কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতাকে আমাদের বাসায় আমন্ত্রণ জানান। আমাদের বাসায় সেদিন এক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়। আলোচনার পর একটা সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতি গ্রহণের জন্যও সেদিন বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। এই আলোচনা হয়েছিল সম্ভবত ১৪ মার্চ অথবা ১৫ মার্চ সন্ধ্যায়।

বৈঠকে এমপি ফজলুল করিম, ঠাকুরগাঁও মহকুমা [বর্তমানে জেলা] আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল লতিফ, সহসভাপতি আবদুর রউফ, সাধারণ সম্পাদক আবদুর রশীদ মোক্তার প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়া আমার বড় ভাই এস আর মীর্জা ও আমি বৈঠকে উপস্থিত ছিলাম। বৈঠকে দেশের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার পর বেশ কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।

তখন দেশে অসহযোগ আন্দোলন চলছিল। আমি ব্যক্তিগতভাবে আওয়ামী লীগার ছিলাম না। আমাদের বাড়িতে যে সভা হলো, সেখানে বিভিন্ন সিদ্ধান্তের মধ্যে একটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য ঠাকুরগাঁওয়ে আর্মস ট্রেনিং শুরু করা হবে। সে সময় ঠাকুরগাঁও হাইস্কুলের স্কাউট টিচার ছিলেন ইউসুফ আলী সাহেব। ’৪৭ সালে পাকিস্তান আন্দোলনের সময়ও তিনি বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন। তাঁর নেতৃত্বেই ঠাকুরগাঁওয়ের যুবসমাজকে নিয়ে ট্রেনিং শুরু করা হয়। এই ট্রেনিংয়ে অস্ত্রের ব্যবহার শেখানো হতো। এই ট্রেনিংয়ের জন্য আমি গোলাগুলি দিয়ে সাহায্য করেছিলাম এবং এই ট্রেনিং শুরুর মধ্য দিয়ে ঠাকুরগাঁওয়ের আন্দোলন নতুন মাত্রা লাভ করে।

অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে আমার ভাই এস আর মীর্জা এবং ভগ্নিপতি পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে কর্মরত এ কে খন্দকারের [পরে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রধান, রাষ্ট্রদূত ও মন্ত্রী] কাছ থেকে আমি প্রচুর বন্দুকের গুলি এনেছিলাম। এ ছাড়া আমার কাছে পয়েন্ট টু-টু বোর রাইফেলের ১০ হাজারের মতো গুলি ছিল। সে সময় আমি খুব শিকার করতাম। আমার খুব নেশা ছিল পাখি শিকার করার। সে জন্য সব সময় আমার স্টকে যথেষ্ট গুলি থাকত। যাহোক, ঠাকুরগাঁওয়ে যে ট্রেনিং শুরু হয়েছিল, তার জন্য আমি ১ হাজার ১০০ থেকে ১ হাজার ২০০ বন্দুকের গুলি এবং পয়েন্ট টু-টু বোর রাইফেলের ৫ থেকে ৭ হাজারের মতো গুলি দিয়েছিলাম।

আর্মস ট্রেনিংয়ে ২৫০ থেকে ৩০০ ছেলে যোগ দেয়। তারা বিভিন্ন ক্যাটাগরির ছিল। কেউ ছাত্র, কেউ শ্রমিক। সাধারণ লোকজনও ছিল। আরও একটা বিষয় লক্ষণীয় ছিল যে এই ট্রেনিংয়ে সব মতের লোকই অংশগ্রহণ করেছিল, অর্থাৎ সেখানে বিশেষ কোনো দলের লোকই কেবল ছিল না, ট্রেনিংয়ের লিডারশিপ আওয়ামী লীগারদের হাতেই ছিল। কিন্তু কাজের ক্ষেত্রে সব দলমতের মানুষই ছিলেন। সে সময় ঠাকুরগাঁওয়ে একটা ব্যতিক্রমী ব্যাপার ছিল। সেটা অবশ্য এখন আর নেই। সে সময় যেকোনো বিষয়ই হোক না কেন, সেটা সংগ্রাম-আন্দোলনই হোক বা কোনো আত্মীয়তাতেই হোক বা বড় ধরনের খাওয়াদাওয়াতেই হোক, সেখানে জাতি-ধর্ম, দলমত-নির্বিশেষে আমরা সবাই একত্র হতাম এবং কাজ করতাম। তখন আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টির লোকজনসহ আমি নিজেও এর সঙ্গে জড়িত ছিলাম ঘনিষ্ঠভাবে। দলমত-নির্বিশেষে আমরা সবাই ছিলাম। এমনকি একজন সরকারি কর্মকর্তা, তার নাম আবদুর রেজা, ওয়াপদার ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন, তিনিও আমাদের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে কাজ করেন।

সে সময় ঘনিষ্ঠভাবে মুক্তিসংগ্রামের কাজের সঙ্গে যাঁরা যুক্ত ছিলেন, তাঁরা হলেন ফজলুল করিম এমপি, ঠাকুরগাঁও আওয়ামী লীগের সহসভাপতি এ রউফ ও জেনারেল সেক্রেটারি এ রশীদ মোক্তার, মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট পার্টির কামরুল ইসলাম কামু, ন্যাপের (ওয়ালী) অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ হোসেন, বলরাম গুহঠাকুরতা ও অ্যাডভোকেট নুরুল হক এবং মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর [বর্তমানে বিএনপির মহাসচিব]। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তখন ভাসানী ন্যাপ রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এ ছাড়া ছিলেন আওয়ামী লীগের মির্জা রফিকুল ইসলাম, আজগর হোসেন, ডা. ফরিদ, আকবর হোসেন এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত সৎ ও নিবেদিতপ্রাণ আওয়ামী লীগ নেতা আবুল হাসনাত ভোলা।

তখন শুধু পয়েন্ট টু-টু রাইফেল এবং বন্দুক দিয়ে ট্রেনিং দেওয়া হয়েছিল। কিছু ডামি রাইফেলও ছিল। এই ট্রেনিংটা ঠাকুরগাঁও স্কুলের মাঠে দেওয়া হয়েছিল। এটাকে লোকে টাউন ক্লাব মাঠও বলে। এই ট্রেনিংয়ের পাশাপাশি ঠাকুরগাঁওয়ে জনসভা এবং মিছিলও নিয়মিত হচ্ছিল। এই সময়টায় আন্দোলন-সংগ্রাম পরিচালনার জন্য একটা অ্যাকশন কমিটিও গঠন করা হয়েছিল। এই অ্যাকশন কমিটি তিন ভাগে বিভক্ত ছিল। যদি কোনো কারণে প্রথম গ্রুপ ক্র্যাশড হয়ে যায়, তবে দ্বিতীয় গ্রুপ এর নেতৃত্ব নেবে। যদি দ্বিতীয় গ্রুপ ক্র্যাশড হয়ে যায়, তবে তৃতীয় গ্রুপ এর নেতৃত্ব নেবে। আর তৃতীয় গ্রুপ ক্র্যাশড হয়ে গেলে, যা পারো তা-ই করো ব্যবস্থা ছিল। এই অ্যাকশন কমিটির বিভিন্ন গ্রুপে আমরা সব দলমতের লোকই ছিলাম।

অ্যাকশন কমিটির প্রথম গ্রুপে আমার যত দূর মনে পড়ে, আওয়ামী লীগ থেকে এমপি ফজলুল করিম, আবদুর রশীদ মোক্তার, অ্যাডভোকেট আবদুর রউফ প্রমুখ। ন্যাপ ওয়ালী থেকে অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ হোসেন ও অ্যাডভোকেট বলরাম গুহঠাকুরতা। কমিউনিস্ট পার্টি থেকে কামরুল হাসান কামু এবং আওয়ামী লীগের নিবেদিতপ্রাণ নেতা আবুল হাসনাত ভোলাও ছিলেন। এ ছাড়া ইঞ্জিনিয়ার আহমদ রেজা ও আমি ছিলাম। আমরা এ কজনই ছিলাম প্রথম গ্রুপে। দ্বিতীয় গ্রুপে ও তৃতীয় গ্রুপে কারা কারা ছিলেন, সেটা এখন আর আমার মনে নেই।

অ্যাকশন গ্রুপ প্রকাশ্যে কোনো সভা করেনি। তবে আমরা নিয়মিত সকাল-বিকেল বৈঠকে বসতাম। ঠাকুরগাঁও চৌরাস্তার পাশেই সংগ্রাম কমিটির অফিস ছিল। এখন যেটা আওয়ামী লীগ অফিস, সেখানে আমরা নিয়মিত বসতাম। মিটিং মিছিলের আয়োজন করা হতো। অ্যাকশন কমিটির সভা গোপনে হতো। কোনো দিন আমার বাসায়, কোনো দিন সংগ্রাম কমিটির অফিসে, কোনো দিন ফজলুল করিম এমপি সাহেবের বাসায়। আবার কোনো দিন খাদেমুল ইসলাম সাহেবের বাসায় হতো। অ্যাকশন কমিটির যে তিনটি কমিটি করা হয়েছিল-সেসব খাদেমুল ইসলাম সাহেবের বাসাতে মিটিং করেই করা হয়েছিল। খাদেমুল ইসলাম সাহেব মারা গেছেন। তিনি একজন ভালো আওয়ামী লীগ নেতা ছিলেন। এমপি হয়েছেন কয়েকবার। মানুষ হিসেবেও বেশ ভালো ছিলেন।

যাহোক, ২৫ মার্চের রাতের ঘটনার খবর আমরা পাই ঠাকুরগাঁওয়ের পুলিশের কাছ থেকে। সেই রাতেই তাদের কাছ থেকে আমরা জানতে পারি যে রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আক্রমণ করেছে। ঠাকুরগাঁওয়ের পুলিশ খবরটা ওয়্যারলেসের মাধ্যমেই পেয়েছিল। এ ছাড়া এখানে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের একটা উইং ছিল। সেই উইং হেডকোয়ার্টারেও ওয়্যারলেসের মাধ্যমে ইপিআর হেডকোয়ার্টার থেকে ঢাকার খবর এসেছিল। তাদের কাছ থেকেও আমরা ঢাকাতে পাকিস্তান আর্মির আক্রমণের খবর পাই। পরদিন রেডিও মারফতও শুনতে পাই।

ক্র্যাকডাউনের খবর জানার পর ২৬ তারিখে ঠাকুরগাঁওয়ে প্রচণ্ড বিক্ষোভ হয়। শহরের বাইরে সুগার মিলের পাশে শ্রমিকশ্রেণির লোকের বসবাস বেশি ছিল। খুব সকালে কয়েকজন সেখানে যায়। গিয়ে শ্রমিকদের সংগঠিত করে। এরপর একটা বড় মিছিল বের করে শহরে ফিরে আসে। খুব বড় মিছিল ছিল। সেই মিছিল শহরে এলে তাতে সাধারণ মানুষও স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগ দেয়। শহরের হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। এই মিছিলটা লিড করেন ফজলুল করিম সাহেব। এ ছাড়া আবদুল জব্বার ও মোহাম্মদ হোসেন এবং কয়েকজন ছাত্রনেতা সেই মিছিলের সামনে ছিল। মিছিল প্রথমে ঠাকুরগাঁও থানায় যায়। কয়েকজন থানার পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের প্রথম পতাকা, বাংলাদেশের মানচিত্র দিয়ে প্রথম যে পতাকা তৈরি করা হয়েছিল, সেই পতাকা ওড়ায়। ঠাকুরগাঁও থানার তখন ওসি ছিলেন সাত্তার নামের একজন।

পরে সেই মিছিল যায় ইপিআর ক্যাম্পের দিকে। মিছিলের জনতা ঠাকুরগাঁও ইপিআর ক্যাম্পের চারদিকে অবস্থান নেয়। হাজার হাজার মানুষ সেখানে স্লোগান দিতে থাকে। মিছিলকারী অনেকের হাতে লাঠিসোঁটাসহ বন্দুকও ছিল। ইপিআররা দুপুর পর্যন্ত ক্যাম্পের ভেতরে ছিল। তখন পর্যন্ত তারা কিছু করেনি। দুপুরের পর তারা ক্যাম্প থেকে বের হয় গাড়ি নিয়ে। জনতা রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়েছিল। ইপিআররা ব্যারিকেড সরিয়ে ক্রমে সামনে এগোতে থাকে। কোথাও কোথাও ফাঁকা গুলি করে। তখন জনতার মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। একপর্যায়ে ইপিআরদের গুলিতে একজন রিকশাচালক নিহত এবং কয়েকজন আহত হয়। তখন লোকজন ভীষণ উত্তেজিত হয়ে পড়ে। এরপর ইপিআররা শহরে কারফিউ জারি করে শহরের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নেয়। ঠাকুরগাঁও ইপিআরের কমান্ডার ছিল একজন পাকিস্তানি।

ঠাকুরগাঁও জেলা

সম্ভবত ২৭ মার্চ তারিখের দিকে এখানকার বাঙালি ইপিআররা রিভোল্ট করে। ঠাকুরগাঁও ইপিআর ক্যাম্পের পশ্চিম পাকিস্তানি ও অবাঙালি ইপিআররা নাকি বাঙালি সুবেদার কাজিমউদ্দীনকে অ্যারেস্ট করতে চেয়েছিল। সুবেদার কাজিমউদ্দীন আগে থেকেই বাঙালি ইপিআর সৈনিকদের বলে রেখেছিল, যদি এ রকম কোনো ঘটনা ঘটার উপক্রম হয়, তাহলে তিনি সিগন্যাল দেবেন এবং তখন যেন বাঙালি ইপিআর সবাই রিভোল্ট করে।

ঠাকুরগাঁও ইপিআর উইংয়ে সিনিয়র সুবেদার ছিলেন কাজিমউদ্দীন। তাঁর সাথে আমার যোগাযোগ ছিল। তিনিও আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। তাঁর সঙ্গে ২৫ মার্চের আগে যখনই দেখা বা যোগাযোগ হয়েছে, তখনই তিনি বলতেন, আপনারা এমন কিছু করবেন না, যাতে পাকিস্তানিরা পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণ করে। কিন্তু বাঙালির এ সংগ্রামের প্রতি তাঁর সমর্থন ছিল। ২৫ মার্চের আগে ঠাকুরগাঁওয়ে বেশ কয়েকটা বড় সভা-সমাবেশ এবং মিছিল হয়েছিল। আমাদের মিছিল করতে ইপিআররা সে সময় বাধা দিত। আমার ঠিক তারিখটা মনে নেই, সেদিনও ইপিআর বাহিনী মিছিল করতে বাধা দিয়েছিল এবং শেষ পর্যন্ত সেই মিছিলে তারা গুলি চালিয়েছিল। সেদিন গুলিতে দুজন নিহত হয়েছিল। এটা ২৫ মার্চের আগের ঘটনা হতে পারে।

২৭ মার্চ রাত ১০টা কি সাড়ে ১০টা হবে, আমি বাসাতেই ছিলাম। আরও কয়েকজন আমার বাসাতে ছিল। এমপি ফজলুল করিমের স্ত্রীও সেদিন আমার বাসায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। আমরা আলোচনা করছিলাম যে দেশের এই পরিস্থিতিতে এখন কী করা যায়। ঠাকুরগাঁও শহরের রাস্তাঘাটের বিভিন্ন স্থানে আমরা ব্যারিকেড দিয়ে রেখেছিলাম। আমরা সবাই চিন্তাভাবনা করছিলাম কী করা যায়। এমন সময় স্লোগানের শব্দ আমাদের কানে আসে। শব্দটা অনেক দূর থেকে আসছিল। এই শব্দ শুনে আমি বাইরে বেরোনোর সিদ্ধান্ত নিলাম। তারপর বের হয়েছি এমন সময় আমাদের বাড়িতে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আসে। তখন আমার হাতে একটা স্টেনগান। সেটা আমারই। লাইসেন্স করা ছিল। আমার কোমরে-বুকে গুলির বেল্ট আর মাথায় একটা হেলমেট। আমি বের হচ্ছি, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এল। তার সঙ্গে আরও দুজন ছিল। তারা এসে বলল, ‘আমাদের সঙ্গে একজন ইপিআরের দেখা হয়েছিল। ওই ইপিআর আমাদের বলল, তারা বিদ্রোহ করেছে। আপনারা বেরিয়ে আসুন।’ তার কথা শুনে আমরা তিনজন কোনো কিছু না ভেবেই সঙ্গে সঙ্গে রাস্তায় নেমে দৌড় দিয়ে এদিকে আসতে থাকি আর চিৎকার করে বলতে থাকি, ‘ভাইসব, আপনারা সবাই বেরিয়ে আসুন, বাঙালি ইপিআররা বিদ্রোহ করেছে। আসুন, বেরিয়ে আসুন।’

আমি তাদের বললাম, আমার সঙ্গে বাঙালি ইপিআরদের কথা হয়েছে। তারা বিদ্রোহ করেছে। আমাদের সবাইকে বেরিয়ে তাদের সমর্থন দিতে হবে। আমাদের রাস্তায় নামতে হবে। তাদের সঙ্গে কথা বলার সময় ওখানে আরও কয়েকজন লোক এল। রাস্তাতেও তখন কিছু লোক বেরিয়েছে।

তারপর বের হয়েছি এমন সময় আমাদের বাড়িতে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আসে। তখন আমার হাতে একটা স্টেনগান। সেটা আমারই। লাইসেন্স করা ছিল। আমার কোমরে-বুকে গুলির বেল্ট আর মাথায় একটা হেলমেট। আমি বের হচ্ছি, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এল। তার সঙ্গে আরও দুজন ছিল। তারা এসে বলল, ‘আমাদের সঙ্গে একজন ইপিআরের দেখা হয়েছিল। ওই ইপিআর আমাদের বলল, তারা বিদ্রোহ করেছে। আপনারা বেরিয়ে আসুন।’ তার কথা শুনে আমরা তিনজন কোনো কিছু না ভেবেই সঙ্গে সঙ্গে রাস্তায় নেমে দৌড় দিয়ে এদিকে আসতে থাকি আর চিৎকার করে বলতে থাকি, ‘ভাইসব, আপনারা সবাই বেরিয়ে আসুন, বাঙালি ইপিআররা বিদ্রোহ করেছে। আসুন, বেরিয়ে আসুন।’

ইপিআর রিভোল্ট করেছে জেনে আমরা সঙ্গে সঙ্গে তাদের সাপোর্ট দিলাম। তারপর ইপিআররা ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে এল। ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে এসে তারা ওয়াপদা অফিসের কাছে ক্যাম্প করল। এটা ইপিআর ক্যাম্পের পাশেই। সেখানে ওয়াপদার একটা ওয়ার্কশপ ছিল। সেই ওয়ার্কশপেই তারা ক্যাম্প করে। যে রাতে তারা রিভোল্ট করে, সেই রাতেই আড়াইটা-তিনটার দিকে ইপিআরের কয়েকজন সদস্য আমাদের বাসায় আসে। সুবেদার কাজিমউদ্দীন, সুবেদার মতি এবং আরও কয়েকজন এসে আমার বড় ভাই এস আর মীর্জার কথা জিজ্ঞাসা করল। আমি বললাম, তিনি তো এখানে নেই। তখন ওরা আমাকে বলল, ‘আপনি এখানকার কমান্ড নেন।’ তখন আমি কাজিমউদ্দীনকে বললাম, ‘দেখেন, কাজিমউদ্দীন সাহেব, আপনি আমাকে চেনেন, কিন্তু আপনার সব সোলজার তো আমাকে চেনে না। তারা আমার কমান্ড মানবে কেন? আপনারা আপনাদের কাজ করেন, আমরা আমাদের কাজ করি। এখন বলেন আমাদের কী করতে হবে, সেটা আমরা করছি।’ তখন কাজিমউদ্দীন বললেন, ‘আজকের রাতেই আপনি ঠাকুরগাঁও-ঢাকা রাস্তায় ব্যারিকেড দেওয়ার ব্যবস্থা করেন, যাতে সৈয়দপুর থেকে পাকিস্তান আর্মি না আসতে পারে।’ এরপর ওরা চলে গেল। রাতভর ইপিআর ক্যাম্পে গোলাগুলি চলল। সকালে গোলাগুলি কমে গেল। বাঙালি ইপিআররা পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পর চলে গেল বিওপিগুলো দখল করার জন্য। অধিকাংশ বিওপিতে পশ্চিম পাকিস্তানি এবং বাঙালি সোলজার একত্রে ছিল। তবে বাঙালিদের সংখ্যা বেশি ছিল। বিওপিগুলো বাঙালি ইপিআররা দখল করে। তখন দিনাজপুর জেলার অন্তর্গত ঠাকুরগাঁও মহকুমা ও পঞ্চগড় সম্পূর্ণ মুক্ত ছিল।

তখন কাজিমউদ্দীন বললেন, ‘আজকের রাতেই আপনি ঠাকুরগাঁও-ঢাকা রাস্তায় ব্যারিকেড দেওয়ার ব্যবস্থা করেন, যাতে সৈয়দপুর থেকে পাকিস্তান আর্মি না আসতে পারে।’ এরপর ওরা চলে গেল। রাতভর ইপিআর ক্যাম্পে গোলাগুলি চলল। সকালে গোলাগুলি কমে গেল। বাঙালি ইপিআররা পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পর চলে গেল বিওপিগুলো দখল করার জন্য। অধিকাংশ বিওপিতে পশ্চিম পাকিস্তানি এবং বাঙালি সোলজার একত্রে ছিল। তবে বাঙালিদের সংখ্যা বেশি ছিল। বিওপিগুলো বাঙালি ইপিআররা দখল করে। তখন দিনাজপুর জেলার অন্তর্গত ঠাকুরগাঁও মহকুমা ও পঞ্চগড় সম্পূর্ণ মুক্ত ছিল।

ঠাকুরগাঁওয়ের ইপিআর বাহিনী রিভোল্ট করল এবং যে প্রতিরোধ গড়ে উঠল, তাতে আমাদের তেমন লিডারশিপ ছিল না। তবে সংগ্রাম কমিটি ছিল। কিন্তু প্রকৃত ক্ষমতা বা লিডারশিপ যেটা ছিল, সেটা ইপিআর সুবেদার কাজিমউদ্দীন সাহেবের হাতে। কোনো পলিটিক্যাল লিডারশিপ ঠিক সেই মুহূর্তে ছিল না। ওই সময়টাতে মূলত ইপিআর জেসিও কাজিমউদ্দীনের নেতৃত্বেই ঠাকুরগাঁওয়ে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। পাকিস্তান আর্মি যেদিন ক্র্যাকডাউন করে, সেদিন রাতেই কাজিমউদ্দীন আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। আগে থেকেই তাঁর সঙ্গে আমার যোগাযোগ ছিল। কাজিমউদ্দীন ছাড়াও তাদের আরও কয়েকজনের সঙ্গেও আমার যোগাযোগ ছিল।

তখন আমাদের ঘাঁটি ছিল ১০ মাইলে। সৈয়দপুর থেকে ঠাকুরগাঁওয়ে যেন পাকিস্তানি আর্মি না আসতে পারে, সে জন্য ঠাকুরগাঁও-দিনাজপুর-রংপুর-ঢাকা মহাসড়কে ১০ মাইল বলে একটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গা আছে, সেই জায়গা পর্যন্ত, অর্থাৎ ঠাকুরগাঁও থেকে ১০ মাইল পর্যন্ত আমরা প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলাম। ইপিআর সৈনিকেরা ওখানে পজিশন নেয়। তাদের সঙ্গে ছিল শত শত মানুষ। ঠাকুরগাঁও এবং দিনাজপুর থেকে যেসব বাঙালি ইপিআর এসেছিল, তারা ওখানটায় পজিশনে ছিল। ঠাকুরগাঁও কন্ট্রোল রুম থেকে আমরা তাদের সব রকম সহযোগিতা করতাম। বিশেষ করে তাদের খাবার এবং অন্যান্য জিনিসপত্র সরবরাহ করতাম। খুব বেশি অস্ত্রশস্ত্র ইপিআরদের কাছে ছিল না। শুধু রাইফেল আর লাইট মেশিনগান ইত্যাদি ছিল।

১৪ এপ্রিল পর্যন্ত ঠাকুরগাঁও মুক্ত ছিল। ১৫ এপ্রিল ঠাকুরগাঁওয়ের পতন হয়।

মীর্জা তসমিম-উল ইসলাম বাবলু: বাবলু মীর্জা নামে বেশি পরিচিত। ২০০৮ সালের ১ নভেম্বর মারা গেছেন। মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্রের ‘মুক্তিযুদ্ধে দিনাজপুর: অংশগ্রহণকারী ও প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ’ গ্রন্থ থেকে তাঁর এ বক্তব্য সংগৃহীত।