আনন্দের দিনে বেদনার স্পর্শ

মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির ইতিহাসের মহাঘটনা। কোটি মানুষের স্বপ্নে, ত্যাগে, বীরত্বে রচিত হয়েছে এর ইতিহাস। কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শীর মুখে মুক্তিযুদ্ধের কিছু অবিস্মরণীয় মুহূর্ত। আজ প্রথম পর্বে প্রয়াত কবি ও নারী আন্দোলনের অগ্রণী নেত্রী সুফিয়া কামালের বিজয় দিবসের স্মৃতিকথা।

সুফিয়া কামাল

যুদ্ধের নয় মাস এ বাড়িতেই ছিলাম। তখন বাড়িটায় এ রকম গাছগাছালিও ছিল না, দেয়ালও ছিল না। খোলামেলা ছিল। বাড়িতে ছোট্ট একটা রেডিও ছিল। রেডিও খুলে কোনো খবরাখবর শোনার মনমানসিকতা ছিল না। ভুলেই গেছিলাম রেডিওটার কথা। ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের খবর শুনলাম রাস্তায়। বাড়ির সামনের রাস্তাটা দিয়েই লোকজন ঢোলঢক্কর নিয়ে আনন্দ করতে করতে যাচ্ছিল। ওই কোলাহল থেকে কানে এল—আমাদের বিজয় হয়েছে...। আমরা স্বাধীন...।

যুদ্ধের সময়টাতে বাড়িতেই ছিলাম। একা নয়, সঙ্গে ছিলেন আমার স্বামী ও বড় ছেলে। আর এ এলাকাটার চারদিকেই ছিল পাকসেনাদের আস্তানা। এ বাড়িটার একটু কাছেই আমার দেবরের বাড়ি। ওর বাড়িটার দোতলায় এক পাকিস্তানি মহিলা থাকত। আর ওখানেই পাক হানাদারদের আড্ডাখানা। শুনেছি, সেখানে নাকি একদিন নিয়াজিও এসেছিল। আমাকে দেখতে যখনই যে আসত, তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হতো। কোনো রিকশা থামলে রিকশাওয়ালাকে পর্যন্ত জিজ্ঞাসাবাদ করত। আর এমনিতে তো ফোন করে করে সব সময়ই পাকসেনারা হুমকি দিত। জিজ্ঞেস করত ছেলেমেয়েদের কোথায় পাঠিয়েছি ইত্যাদি ইত্যাদি। সব সময় উত্তেজনার মধ্যে, উৎকণ্ঠার মধ্যে থেকে থেকে, ঠিক বিজয়ের কথাটি কানে এল হইহুল্লোড় থেকে। বুঝতে পারছিলাম না কী করব।

একটু পরই, তখন বেলা প্রায় ১০টা হবে, বেগম মুজিব এলেন আমার বাড়িতে। খুব দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে এসে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। দু-একটা কথা বলে তাড়াতাড়ি চলে গেলেন। আমার সঙ্গে দেখা করতে হবে বলে। এদিকে রাস্তায় আনন্দ-উল্লাস। মনে পড়ল বাচ্চাদের কথা, যুদ্ধে পাঠিয়েছি ওদের। একরকম যুদ্ধই তো বটে। হাসপাতালে কাজ করার জন্য। যেখানে যুদ্ধাহতরাই আসত। প্রথমে পাঠিয়েছি আমার দুই মেয়েকে। সাঈদা কামাল ও সুলতানা কামালকে। প্রথমে ওরা ছিল আগরতলায়। ওখানেই হাসপাতালের কাজ। ওরা যাওয়ার পর আরও অনেক মেয়েই গিয়েছে যুদ্ধে। ওদের মতোই। এখনো মনে আছে, ওদের মধ্যে ছিল ডালিয়া, সালমা, মিনু আরও অনেকে। ডা. আক্তারের সঙ্গে আমিই সবাইকে একসঙ্গে করে পাঠিয়েছি।

যুদ্ধ শেষ—খবরটা যখন শুনলাম, তখন মনে মনে আল্লাহর শোকরানা আদায় করেছি। যতটা উচ্ছ্বসিত হওয়া উচিত ছিল, যতটা আনন্দ করা যেত, ততটা করতে পারিনি।

‘যুদ্ধ শেষ’ কথাটা শুনলেই থেকে থেকে মনে পড়ছিল মেয়েদের কথা। মায়ের মন তো...। কেবলি মনে হচ্ছিল, ওরা কেমন আছে, কোথায় আছে...? কখন ওদের দেখব। ‘আমরা বিজয় লাভ করেছি’—খবরটা ছড়িয়ে যাওয়ার পরপরই রাস্তা থেকে যেমন আনন্দোল্লাস শোনা যাচ্ছিল, তেমন গুলির আওয়াজও। হেরে গিয়ে পাকিস্তানি সেনারা দুমদাম করে গুলি ছুড়তে ছুড়তে যাচ্ছিল এ রাস্তা দিয়েই। আবার সঙ্গে সঙ্গে ভাঙচুর। এ বাড়ির জানালা, ও বাড়ির দরজা, এটা–সেটা ভাঙতে ভাঙতে, আর এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে ছুড়তে যাচ্ছে। ইঞ্জিনিয়ার হাতেম আলী সাহেবের বাসা আমাদের বাসার কাছেই। খুব ভালো ছিলেন ভদ্রলোক। পাকসেনাদের একটা গোলার আঘাত লেগেছিল ওদের রান্নাঘরের দেয়ালে। বোধ করি ওই গোলার আঘাত লাগার চিহ্নটা এখনো আছে।

বেগম মুজিব আমার সঙ্গে দেখা করে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরই কে একজন এসে খবর দিল, চলুন, হাতেম আলী সাহেবের শ্যালিকার মাথায় গুলি লেগেছে, লাশ নিয়ে এসেছে। খবরটা শুনে কিছু ভাবতে পারলাম না। মেয়েটির নাম ছিল ‘ডোরা’। ও ছিল ডাক্তার। বেগম মুজিবের সঙ্গে দেখা করার জন্য ওনার গাড়ির পেছন পেছনে গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছিল ও। পাকিস্তানিদের এলোপাতাড়ি গুলির একটি ভেদ করেছিল ওর মাথা। এমনিতেই তখন মেয়েরা ছিলই না। তা–ও যারা ছিল, তারা ততক্ষণে বিজয়ের আনন্দে।

বেলা ১১টা হবে। আমি দৌড়ে গেলাম লাশের ওখানে। কী রক্ত...।

থাকলাম ওখানেই। দাফন-কাফন, গোসল—সবকিছুর ব্যবস্থা করার জন্য। আমার শাড়িতে রক্ত। দুপুরের দিকে রেডিও-টেলিভিশন থেকে লোক এল। আমাকে যেতে হবে। কিছু একটা বলতে হবে। কিছুক্ষণের জন্য গেলাম। ওই কাপড়েই। রেডিও-টেলিভিশনে তখন কী কী বলেছি মনে নেই। একটা কথা কেবল মনে আছে। বলেছিলাম, দেশ আজ স্বাধীন, আর যেন আমাদের এ ধরনের রক্তপাত দেখতে না হয়। রেডিও-টিভি থেকে গিয়েছি আবার ওই বাড়িতে। ডোরার লাশের দিকে চেয়ে চেয়ে কেবল মনে হলো, দেশের সম্পদ, একজন ডাক্তার, ...শেষ মুহূর্তেও রেহাই পেল না। চারদিকে বিজয়ের আনন্দোল্লাস আর কানে পৌঁছেনি। বহু আকাঙ্ক্ষিত এ আনন্দের দিনটিতেও একটি মৃত্যু নিয়ে শোকবিহ্বল ছিলাম। সারা দিন কাটল ওই লাশের ওখানে। ডোরার লাশের গোসল দিলাম। দোকানপাট সব তো বন্ধ তখন। কী হবে...অনেক কষ্টে কাফন-দাফন শেষ করে আমি বাড়ি ফিরলাম সন্ধ্যায়। আর পারি না...। কাপড় পাল্টে বিছানায় পড়লাম। শক্তি নেই ওঠার। সন্ধ্যায় কারা কারা যেন এল। ‘খালাম্মা চলুন..., যেতে হবে...।’ আমার আর শক্তি নেই। মেয়েদের কথা ভাবি, ভাবি ডোরার মৃত্যুর কথা..., বিজয়ের আনন্দ একমুহূর্তেও মনে আসেনি। আনন্দ আমার ভাগ্যে আসেনি। সেদিন আর উঠতে পারিনি। পরের দিন ভোরে আবারও গেছি ডোরার বাসায়। ওই এলোপাতাড়ি গুলিতে সেদিন একটা ছোট্ট বাচ্চা ছেলেও নিহত হয়েছে। তো পরের দিন ওদের একটু খোঁজখবর করলাম। ও... সেদিনই তো নিয়াজি আত্মসমর্পণ করল।

সারা দিন ডোরার লাশের কাছেই ছিলাম। তবে একটুক্ষণের জন্য রেসকোর্সে গিয়েছিলাম। দুপুরের দিকে হেমায়েত এসে বলল, ‘খালাম্মা একটু চলেন, যাই। দেখে আসি।’ হেমায়েতের সঙ্গে গেলাম রেসকোর্সে। লোকে লোকারণ্য। ভেতরে ঢোকার কোনো উপায় নেই। ভিড় ভেঙে আর ঢোকার চেষ্টাও করলাম না। দূর থেকেই দেখলাম নিয়াজির আত্মসমর্পণ। বেশিক্ষণ থাকিনি। চলে এসেছি। এসেছি হাতেম আলী সাহেবের বাসায়। লাশ দাফন করে শেষে ফিরেছি বাসায়। তারপর তো ওই...। ভীষণ ক্লান্ত আমি। উঠতে পারিনি বিছানা ছেড়ে। বিজয় মিছিলে যাওয়ার জন্য অনেকে এসে ডাকাডাকি করেছে। উঠতে পারিনি। উঠেছি পরের দিন সকালে। ১৬ ডিসেম্বরের পর থেকে আমার বাসায় সাংবাদিকদের ভিড়। বিদেশি সাংবাদিকেরা এসে ছবি তুলছে, ইন্টারভিউ নিচ্ছে...। মেয়েদের কথা জানতে চাচ্ছে। এ রকম চলল অনেক দিন। বিজয়ের পর যে আনন্দ, সেটা তখনই উপলব্ধি করতে পারিনি। পারিনি কেবল মেয়েদের কথা ভেবে। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ওরা আগরতলা থেকে চলে গিয়েছিল কলকাতায়। শুধু এটুকু জানি। কোথায় আছে, কেমন আছে, জানি না। ১৬ ডিসেম্বরের পর অবশ্য কলকাতা থেকে ‘টুলু’ একদিন ফোন করেছিল। তারপর একটু আশ্বস্ত হয়েছিলাম। টুলু, লুলুরা ফিরেছে ১৪ জানুয়ারি ’৭২। এর আগে একদিন বাসায় এসেছিল খালেদ মোশাররফ। এসে বলল, ‘কিচ্ছু চিন্তা করবেন না খালাম্মা, ওরা ভালো আছে। আসবে, খুব তাড়াতাড়িই আসবে। আপনি আমার কপালে একটু হাত বুলিয়ে দেন।’ ওর কপালে তখন গুলি লাগার ক্ষতটা ছিল। হাত বুলিয়ে দিলাম।

খালেদ মোশাররফই মেয়েদের সব খবর দিল। তখন একটু ভালো লাগল। মেয়েরা ফেরার পর বিজয়ের আনন্দ ফিরে পেলাম। বিজয়ের আনন্দ বিজয়ের দিনটিতে উপভোগ করতে পারিনি। ১৬ ডিসেম্বর ’৭১-এ বিজয়ের আনন্দ বোধ করার সৌভাগ্য আসেনি আমার জীবনে। দিনটি কেটেছে বেদনায়, কষ্টে।


সুফিয়া কামাল: কবি, নারী আন্দোলনের নেত্রী

সূত্র: বিজয়ের মুহূর্ত: ১৯৭১, সম্পাদক: মতিউর রহমান, প্রথমা প্রকাশন, ২০১৯