মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রহরে কুষ্টিয়ায় প্রতিরোধযুদ্ধ

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে নিরীহ বাঙালি অসীম সাহসে মুখোমুখি হয়েছিল পাকিস্তানের প্রশিক্ষিত বাহিনীর বিরুদ্ধে। ছিনিয়ে এনেছিল বিজয়। বীরত্বপূর্ণ সেসব সম্মুখযুদ্ধ উজ্জ্বল হয়ে আছে স্বাধীনতার স্বপ্নে, আত্মত্যাগের মহিমায়। মুক্তিযুদ্ধের বহুল আলোচিত কয়েকটি যুদ্ধ নিয়ে প্রথম আলোর এ আয়োজন।

আবু ওসমান চৌধুরী

১৯৭১ সালের প্রথমার্ধে আমি ইপিআর বাহিনীর চতুর্থ উইংয়ে যোগদান করি। এর অবস্থান ছিল চুয়াডাঙ্গায়। আমি দায়িত্বভার গ্রহণ করার আগে থেকেই ওখানে দুজন সহকারী উইং কমান্ডার কর্মরত ছিলেন। তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন বাঙালি। তাঁর নাম ক্যাপ্টেন এ আর আজম চৌধুরী (বীর বিক্রম, পরে লে. কর্নেল), দ্বিতীয় জন অবাঙালি, তাঁর নাম ক্যাপ্টেন মো. সাদেক। চুয়াডাঙ্গায় যোগ দেওয়ার আগে আমি পশ্চিম পাকিস্তানে (বর্তমান পাকিস্তান) কর্মরত ছিলাম।

চুয়াডাঙ্গা উইংয়ের অধীনে ছিল পাঁচটি কোম্পানি। একটি কোম্পানি ছিল চুয়াডাঙ্গা হেডকোয়ার্টারে। অন্য চারটি ছিল সীমান্ত এলাকায়। উইংয়ের সীমান্ত এলাকা ছিল দক্ষিণে মাসলিয়া বিওপি (মেহেরপুর জেলা) থেকে উত্তরে মহেশকুণ্ডি বিওপি (কুষ্টিয়া জেলা) পর্যন্ত প্রসারিত। প্রতিটি কোম্পানির কমান্ডার ছিল সুবেদার পদমর্যাদার সামরিক ব্যক্তি। মোট সেনাসংখ্যা ছিল প্রায় ৮৫০। তার মধ্যে অবাঙালি সেনার সংখ্যা ছিল আনুমানিক ১৫০।

১৯৭১ সালের ২০ মার্চ। চট্টগ্রাম থেকে আমার ব্যক্তিগত গাড়িটি সড়কপথে চুয়াডাঙ্গায় এসে পৌঁছায়। গাড়িটি পশ্চিম পাকিস্তান থেকে জাহাজে সেখানে পৌঁছায়। ২৪ মার্চ সকাল ১০টায় ওই গাড়িতে করেই আমার স্ত্রী-কন্যাদের নিয়ে মেহেরপুরের পথে কুষ্টিয়া রওনা হই। আমার পরনে ছিল ইপিআরের পোশাক। একটি ইপিআর জিপে চড়ে চারজন সশস্ত্র সেনাও আমার সঙ্গে যায়। উদ্দেশ্য ছিল, আমার সরকারি বাড়ি মেরামত করার খরচ হিসেবে কুষ্টিয়ার ডিসির কাছ থেকে পাঁচ হাজার টাকা সংগ্রহ করা। ইচ্ছা ছিল, ওই দিনই কাজ সেরে কুষ্টিয়ায় রাত যাপন করার পর ২৫ মার্চের পূর্বাহ্নে চুয়াডাঙ্গায় ফেরত আসার। কিন্তু মেহেরপুরে গিয়েই আমার গাড়ি নষ্ট হয়ে গেল।

কিছুতেই গাড়িটির সমস্যা খুঁজে পেলাম না। জিপ ফেরত পাঠিয়ে চুয়াডাঙ্গা থেকে মেকানিকস নিয়ে আসা হলো। গাড়ি ঠিক হতে হতে বেলা তিনটা বেজে গেল। আবার রওনা হলাম কুষ্টিয়া অভিমুখে। আরও ১৫ মাইল যাওয়ার পর আবারও গাড়ি খারাপ হয়ে গেল। বাধ্য হয়ে আশপাশের বাড়ি থেকে পাটের রশি সংগ্রহ করে জিপের পেছনে গাড়িকে বেঁধে কুষ্টিয়া পৌঁছালাম। উঠলাম কুষ্টিয়া সার্কিট হাউসে।

পরদিন ২৫ মার্চ সকাল সাড়ে নয়টায় ডেপুটি কমিশনার সাহেবের অফিসে গেলাম। ডেপুটি কমিশনার ছিলেন শামসুল হক। তাঁর অফিস ও বাসস্থান ছিল একই প্রাঙ্গণে।

তিনি এলেন, কথাবার্তা হলো, চায়ের পর্ব শেষ হলো। তারপর পিয়নের মারফত ডাকলেন ল্যান্ড অ্যাকুইজিশন অফিসারকে (এলএও)। এলএও সাহেব এলেন, সব শুনলেন, তারপর গেলেন অফিসে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও চেকবুক আনার জন্য। অসহযোগ আন্দোলনের প্রতিবন্ধকতা সেরে আমাকে চেক ইস্যু করতে করতে বেলা দেড়টা বেজে গেল। তখন ব্যাংকের লেনদেন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় টাকা আর ওঠানো গেল না। চুয়াডাঙ্গায় এমন কোনো জরুরি অবস্থা ছিল না, তাই টাকা সঙ্গে করে নিয়ে যাব মনে করেই ২৫ মার্চ রাতেও কুষ্টিয়া সার্কিট হাউসেই রয়ে গেলাম।

২৬ মার্চ সকাল ছয়টায় ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় গিয়ে দেখতে পেলাম, অল্প দূরেই রাস্তার ওপর মিলিটারি জিপে করে পাকিস্তানি সেনারা টহল দিচ্ছে আর জানিয়ে দিচ্ছে ৩০ ঘণ্টার জন্য কারফিউ জারি করা হয়েছে। কুষ্টিয়ার জনসাধারণ ঘরে বসেই দরজা-জানালা দিয়ে উঁকি মেরে পাকিস্তানি সেনাদের দেখছে। ব্যাপারটা আমার কাছে কেন যেন ঘোলাটে মনে হলো। ডিসিকে টেলিফোন করে জেনে নিতে চাইলাম, ব্যাপার কী? কিন্তু টেলিফোন উঠিয়ে কোনো সাড়াই পেলাম না। বুঝতে পারলাম, লাইন কাটা বা ডেড। পেছনে চেয়ে দেখলাম, পাকিস্তানি সেনারা সার্কিট হাউসের ঠিক পেছনেই জিলা স্কুলে তাদের সদর দপ্তর স্থাপন করেছে। কী করব, বুঝতে পারলাম না। এই বিভ্রান্তিকর অবস্থাতেই কেটে গেল তিন ঘণ্টা। রেডিও চালু ছিল বলে ঢাকা বেতারের নিয়মিত প্রোগ্রামটা শুনে যাচ্ছিলাম। তা থেকে শুভাশুভ কিছুই বুঝতে পারলাম না। সাড়ে আটটা কি নয়টার দিকে হঠাৎ ঘোষণা করা হলো নতুন নতুন ‘মার্শাল ল’ আইন। তখন বুঝতে পারলাম, বোধ হয় আমাদের সেই চরম ও পরম পরীক্ষার দিন এসেছে। আর একমুহূর্তও কুষ্টিয়ায় থাকা সমীচীন মনে করলাম না। জিপের পেছনে আবার গাড়িটাকে বেঁধে এবার উল্টো দিকে, অর্থাৎ ঝিনাইদহের দিকে যথাসম্ভব তীব্র গতিতে গাড়ি চালিয়ে দিলাম। ভাগ্য ভালো যে কুষ্টিয়া সার্কিট হাউস ছিল শহরের দক্ষিণ প্রান্তে। কাজেই কুষ্টিয়া শহরের সীমা অতিক্রম করতে আমাদের এক মিনিটের বেশি সময় লাগেনি। দূর থেকে ইপিআরের পোশাক পরা অবস্থায় আমাকে দেখেও ওরা কিছুই বলেনি। কেন বলেনি, সেটা পরে যতবার ভেবেছি, ততবারই ওদের বোকামি ছাড়া আর কিছুই মনে করতে পারিনি। তবে আমি মনে করি, এটা বোধ হয় আল্লাহরই মহিমা। বেলা ১১টায় ঝিনাইদহ পৌঁছে দেখি লোকে লোকারণ্য। আমার জিপকে আসতে দেখে তারা রাস্তা ছেড়ে দিল। এখানে একটু বলে রাখা ভালো, চুয়াডাঙ্গার ইপিআরের চতুর্থ উইংয়ের ইতিহাসে আমি ছিলাম প্রথম বাঙালি কমান্ডার। আমার বা আমার সঙ্গে থাকা ইপিআর সেনাদের গায়ের রং দেখে স্থানীয় লোকজন প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারেনি যে আমরা বাঙালি। সেখানে কিছু ঘটনা ঘটে, যার বিবরণ এখানে তুলে ধরছি।

আনুমানিক বেলা একটায় চুয়াডাঙ্গায় আমার সদর দপ্তরের সামনের রাস্তায় পৌঁছালাম। গাড়ি দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গেই আমার বাঙালি উইং হাবিলদার মেজর মজিবর রহমান এসে অভিবাদন করে ঢাকার ঘটনার আনুপূর্বিক বিবরণ দিল। সে আরও জানাল, ক্যাপ্টেন এ আর আজম চৌধুরীর কোনো রকম নির্দেশ ছাড়াই উইং হেডকোয়ার্টারের সব অবাঙালি সেনাকে তারা আটক এবং অস্ত্রাগার থেকে সব অস্ত্রশস্ত্র সরিয়ে নিরাপদ স্থানে লুকিয়ে রেখেছে। হাবিলদার মেজর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটা দুরভিসন্ধির খবরও আমাকে জানাল। সেটা হলো, ২৫ মার্চ বিকেলবেলা হঠাৎ করে যশোর থেকে তৎকালীন ইপিআর সেক্টরের উপ-অধিনায়ক অবাঙালি মেজর সরদার আবদুল কাদের চুয়াডাঙ্গায় এসেছিল একটা অত্যন্ত জরুরি মিটিংয়ের অজুহাতে আমাকে যশোরে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু যখন শুনল আমি চুয়াডাঙ্গায় নেই, তখন সে ক্যাপ্টেন সাদেকের বাসায় রাত যাপন করে ২৬ মার্চ ভোর চারটার সময় ক্যাপ্টেন সাদেক ও তার পরিবার নিয়ে যশোরে চলে যায়।

যা-ই হোক, হাবিলদার মেজরের কাছ থেকে পুরো ঘটনা জানতে পেরে আমি মনে মনে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারলাম। তাদের সর্বতোভাবে তৈরি থাকার নির্দেশ দিয়ে আমি আমার বাসভবনে চলে গেলাম। সেখানে গিয়েই আমি ক্যাপ্টেন আজম চৌধুরী, আওয়ামী লীগের স্থানীয় সভাপতি ও এমপিএ (মেম্বার প্রভিনশিয়াল অ্যাসেম্বলি বা প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য) ডা. আসহাব-উল-হক জোয়ার্দারসহ স্থানীয় পুলিশ ও বেসামরিক কর্মকর্তাদের কাছে জরুরিভাবে খবর পাঠালাম। ডা. আসহাব-উল-হক বোধ হয় তৈরিই ছিলেন আমার অপেক্ষায়। খবর পেয়ে পাঁচ মিনিটের মধ্যে তিনি উপস্থিত হলেন। অন্যান্য সবাই আসার পর আমি তাঁদের নিয়ে একটা রুদ্ধদ্বার বৈঠক করলাম।

কুষ্টিয়া শহর শত্রুমুক্ত হওয়ার পর টহলরত মুক্তিযোদ্ধারা

২৫ মার্চ রাত ১২টার পর থেকে তখন পর্যন্ত ঢাকা এবং অন্যান্য জায়গার আনুপূর্বিক সব ঘটনা ও দুর্ঘটনা নিয়ে আলোচনা করলাম। সর্বসম্মতিক্রমে স্থির করা হলো, এ অন্যায় আমরা সইব না। শপথ নিলাম, আমরা এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করব, যুদ্ধ করব এবং যেমন করেই হোক, নিজের প্রাণের বিনিময়ে হলেও মাতৃভূমিকে এই পশুশক্তির কালো থাবা থেকে রক্ষা করব। সবাই আমাকে সব সামরিক কর্মকাণ্ডের প্রধান বলে মেনে নিলেন।

আমি নির্দেশ জারি করলাম যে আমার নির্দেশমতো সবাইকে আপন আপন কাজ সমাধা করতে হবে। সব সিদ্ধান্তের পর আমি সামরিক, বেসামরিক সব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে নিয়ে আমার উইংয়ের কোয়ার্টার গার্ডে বাংলাদেশের তখনকার পতাকা (মানচিত্র-খচিত) সসম্মানে উত্তোলন করে ওটাকে জাতীয় অভিবাদন জানালাম। এটা যে জীবনের কত বড় ঝুঁকি, বিশেষ করে যখন সব রকম সংযোগবিহীন অবস্থায় বিনা নির্দেশে এবং আর কেউ বিদ্রোহ করেছে কি না, সেটা না জেনেই সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত চেতনা থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মতো বিরাট ও শক্তিশালী বাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা যে কত বড় চ্যালেঞ্জ, বিজ্ঞজনমাত্রই তা অনুভব করতে পারবেন। তারপর আমি আমার সেনা ও ভারী অস্ত্রশস্ত্র নানা গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় মোতায়েন এবং গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ব্যারিকেড সৃষ্টি করা ইত্যাদি সামরিক ও বেসামরিক নির্দেশ দিতে গিয়ে প্রায় অর্ধেক রাত অতিবাহিত করি। ইতিমধ্যে ওয়্যারলেস মারফত সীমান্ত এলাকায় অবস্থানরত ইপিআর সেনাদের পরিস্থিতি বর্ণনা করে সজাগ থাকার নির্দেশ দিই।

এদিকে আমি চুয়াডাঙ্গায় পৌঁছার আগেই ডা. আসহাব-উল-হক জোয়ার্দার ঢাকায় সংঘটিত গণহত্যার সংবাদ পাওয়ার পর দলের স্থানীয় নেতা-কর্মীকে সংগঠিত করতে শুরু করেন। তিনি ও তাঁর দলীয় সহকর্মী মহকুমা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও চুয়াডাঙ্গা-২ আসনে নির্বাচিত প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য (এমপিএ) অ্যাডভোকেট মো. ইউনুস আলীর নেতৃত্বে ২৬ মার্চ সকাল আনুমানিক নয়টায় থানার সামনে বড়বাজার চৌরাস্তায় এক চটজলদি জনসভার আয়োজন করেন। এতে সভাপতিত্ব করেন আসহাব-উল-হক। সভায় চুয়াডাঙ্গা শহর এবং নিকটবর্তী বিভিন্ন গ্রামের কয়েক হাজার নেতা-কর্মী ও সাধারণ মানুষের উপস্থিতিতে স্থানীয় সংগ্রাম কমিটির পক্ষ থেকে শুধু ওই দুজন প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য বক্তব্য দেন। সভা শেষে একটি বিক্ষুব্ধ মিছিল শহর প্রদক্ষিণ করে। একপর্যায়ে মিছিলটি চুয়াডাঙ্গা রেলবাজারে পৌঁছালে সেখানে নিকটবর্তী ইপিআর উইংয়ের বাঙালি সেনাদের একটি অংশ মিছিলের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে। এভাবে চুয়াডাঙ্গায় অতিবাহিত হয় ২৬ মার্চ।

২৭ মার্চ ডা. আসহাব-উল-হককে খবর দিলাম। দুই কমরেড মিলে ছক আঁকলাম-কুষ্টিয়া আমাদের পুনরুদ্ধার করতেই হবে। সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর যুদ্ধ-পরিকল্পনা তৈরি করার নির্দেশ দিলাম। দুই কমরেড মিলে ওই এলাকার নামকরণ করলাম-‘সাউথ-ওয়েস্টার্ন কমান্ড’ বা দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গন। এই রণাঙ্গনের কমান্ডার হলাম আমি। বেসামরিক বিষয়ে নেতৃত্বের দায়িত্বে থাকলেন ডা. আসহাব-উল-হক জোয়ার্দার।
এখানে কুষ্টিয়ার শত্রুপক্ষের সেনাসংখ্যা ও তাদের শক্তির ওপর কিছুটা আলোকপাত করা দরকার। যশোর ব্রিগেড থেকে ২৭ বালুচ রেজিমেন্ট তথা রেকি ও সাপোর্ট ব্যাটালিয়নের এক কোম্পানি, অর্থাৎ প্রায় ২০০ সেনা কুষ্টিয়া অধিকার করে ২৫-২৬ মার্চ রাত দেড়টায়। তাদের সঙ্গে ছিল জিপে স্থাপিত ১০৬ এমএম রিকোয়েললেস রাইফেল (আরআর), পর্যাপ্তসংখ্যক চীনা এইচএমজি, এলএমজি, এসএমজি ও অটোমেটিক রাইফেল। তার সঙ্গে প্রচুর পরিমাণে গোলাবারুদ, গাড়ি ও বেতারযন্ত্র ছিল। তুলনামূলকভাবে রেকি ও সাপোর্ট কোম্পানির ফায়ার পাওয়ার একটা সাধারণ ইনফ্যানট্রি ব্যাটালিয়নের প্রায় সমপরিমাণ—এই তথ্য আমার ভালো করেই জানা ছিল। আমি আরও জানতাম, যুদ্ধের প্রচলিত নিয়ম অনুসারে তিন গুণের কমসংখ্যক সেনা নিয়ে শত্রুকে আমি আক্রমণ করতে পারি না। কুষ্টিয়ার শত্রুদের অধিনায়ক ছিলেন মেজর শোয়েব। তাঁর সঙ্গে উপ-অধিনায়ক ছিলেন যথাক্রমে ক্যাপ্টেন শাকিল, ক্যাপ্টেন সামাদ ও লে. আতাউল্লাহ শাহ।

আমাদের মোট সেনা ছিল প্রায় ৭০০ জন ইপিআর। তাদের অস্ত্র বলতে ছিল ৩০৩ রাইফেল, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ৩০৩ এলএমজি, এমজি এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের মরচে পড়া চারটা ৩.৫ রকেট লঞ্চার। গোলাবারুদের সংখ্যা একেবারেই ছিল অপর্যাপ্ত।

তদুপরি ছিল আধুনিক যুদ্ধে অনভিজ্ঞ ও অপ্রশিক্ষিত লোকজন। অফিসার বলতে আমার সঙ্গে ছিল একমাত্র ক্যাপ্টেন আজম চৌধুরী। তবে ভরসা ছিল এই যে আমার সঙ্গে ছিল সর্বস্তরের সাধারণ মানুষ। তবু পরিকল্পনা অনুযায়ী আমি কিছুসংখ্যক আনসার ও মুজাহিদকে এক দিনের ট্রেনিংয়ের পর আমার বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করি। স্থানীয় পুলিশ ও আনসারদের অন্তর্ভুক্ত করে ৩০৩ রাইফেল দ্বারা এই বাহিনীকে সজ্জিত করি। আমার কাছে কোনো রকম ফিল্ড ওয়্যারলেস বা ফিল্ড টেলিফোন কমিউনিকেশনের ব্যবস্থা ছিল না। তাই টেলিফোন বিভাগের সাহায্যে পোড়াদহের খোলা প্রান্তরে ফিল্ড এক্সচেঞ্জ লাগিয়ে দেওয়া হয়। ডা. আসহাব-উল-হকের সাহায্যে ফিল্ড চিকিৎসাকেন্দ্র, ডাক্তার ও ওষুধের ব্যবস্থা করা হয়।

রণাঙ্গনে আহত প্রতিরোধযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য গঠন করা হয় মেডিকেল টিম। ডা. আসহাব-উল-হক, জনাব করিম, আলী আশরাফ, মোজাম্মেল হক, আকিলউদ্দীন, সাইদুর রহমান জোয়ার্দার, শামসুজ্জোহা কোরেশী প্রমুখ চিকিৎসক টিমের দায়িত্ব নেন। চুয়াডাঙ্গার শ্রীমন্ত টাউন হলে খোলা হয় মূল কন্ট্রোল রুম। আরেকটি কন্ট্রোল রুম করা হয় মতিরাম আগরওয়ালার বাড়ির নিচতলায়। সেনাবাহিনীর মতো খাদ্য সরবরাহের কোনো রকম নিয়মিত পদ্ধতি না থাকায় ভলান্টিয়ার গ্রুপের কিছু লোককে কুষ্টিয়ায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক দলের গণ্যমান্যদের সাহায্যে আমাদের সব বাহিনীর খাদ্যের ব্যবস্থা করা হয়। আরও ব্যবস্থা করা হয় স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীকে প্রয়োজনমতো যথাস্থানে ব্যবহার করার। স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর হাতিয়ার বলতে ছিল বাঁশের লাঠি।

২৭ মার্চ আমি ইপিআরের ফিলিপনগর কোম্পানিকে একটা নির্দিষ্ট সময়ে কুষ্টিয়া শহরের একটা নির্দিষ্ট স্থানে সমবেত হওয়ার পর পরবর্তী আদেশের জন্য অপেক্ষা করার নির্দেশ দিলাম। এই কোম্পানির কমান্ডার ছিলেন সুবেদার মুজাফফর আহমেদ (পরে অনারারি লেফটেন্যান্ট)। ২৮ মার্চ দুপুর ১২টার মধ্যে সীমান্তের সব কোম্পানিকে আমি চুয়াডাঙ্গায় সমবেত করি। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী এক কোম্পানি সেনা আমি ঝিনাইদহে পাঠিয়ে দিই এবং যশোর-ঝিনাইদহ রাস্তা অবরোধ করে রাখি, যাতে শত্রুপক্ষ যশোর থেকে কোনো সেনা বা অস্ত্র কুষ্টিয়ায় সরবরাহ করতে না পারে।

আরেক কোম্পানি সেনাকে ওই দিন বিকেলবেলা ক্যাপ্টেন আজম চৌধুরীর নেতৃত্বে চুয়াডাঙ্গা-পোড়াদহ কাঁচা রাস্তা দিয়ে আমি পোড়াদহে পাঠিয়ে দিই। ক্যাপ্টেন আজমের প্রতি নির্দেশ ছিল তার গন্তব্য স্থানে পৌঁছানোর পরই সে যেন সুবেদার মুজাফফরের কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করে আমাকে রিপোর্ট দেয়। পরিকল্পনা ছিল, সুবেদার মুজাফফরের কোম্পানি কুষ্টিয়ার পুলিশ লাইনসের দিক দিয়ে আক্রমণ করবে, ক্যাপ্টেন আজম চৌধুরীর কোম্পানি শহরের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে, অর্থাৎ সার্কিট হাউসের দিক দিয়ে আক্রমণ করবে এবং একটা প্লাটুন ও স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর কিছুসংখ্যক লোক পূর্ব দিক থেকে মোহিনী মিল ও ওয়্যারলেস স্টেশনের ওপর আক্রমণ চালাবে। আক্রমণ হবে সংযুক্তভাবে একই সময়ে তিন দিক থেকে।

আক্রমণের সময় ও তারিখ ছিল ২৯ মার্চ ভোর চারটা। পরিকল্পনায় এটাও ঠিক করে রাখা হয়েছিল যে আক্রমণ শুরু হওয়ার প্রাক্কালে আমার বাহিনীর পশ্চাদ্ভাগে যেন কমপক্ষে পাঁচ হাজার বেসামরিক লোক আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গেই জয়ধ্বনি দিতে দিতে আক্রমণকারী বাহিনীকে অনুসরণ করে। এসব বেসামরিক ব্যবস্থার ভার ছিল ডা. আসহাব-উল-হকের ওপর, যিনি তাঁর দলীয় লোক, স্থানীয় ছাত্র ও স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সাহায্যে খুব সুষ্ঠুভাবেই এ কাজ সম্পন্ন করেছিলেন। আক্রমণের সব আয়োজন সম্পূর্ণ, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল, চলাচল-ব্যবস্থার অসুবিধার জন্য ও একটা গাড়ি দুর্ঘটনার কবলে পতিত হওয়ার দরুন সুবেদার মুজাফফরের কোম্পানি নির্দিষ্ট স্থানে নির্দিষ্ট সময়ে পৌঁছাতে পারেনি। তাই বাধ্য হয়ে আমি আক্রমণের দিন ও সময় ২৪ ঘণ্টা পিছিয়ে দিই, অর্থাৎ আক্রমণের নতুন দিন ও সময় স্থির করি ৩০ মার্চ ভোর চারটা।

কুষ্টিয়া শহরে প্রতিরোধযুদ্ধ এলাকার নকশা

২৮ মার্চ রাত থেকে ২৯ মার্চ রাত পর্যন্ত অত্যন্ত গোপনীয়ভাবে আমাদের সেনাদের কুষ্টিয়া শহর থেকে অদূরে মাঠে-ময়দানে ও জঙ্গলে অবস্থান করতে হয়। সুবেদার মুজাফফরের কোম্পানি নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছাতে সক্ষম হয় ২৯ মার্চ ভোরবেলা। যোগাযোগ করে তাদের আক্রমণের পরিকল্পনা সুষ্ঠুভাবে বুঝিয়ে দেওয়া হয় এবং যথারীতি সরবরাহ করা হয় অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ, ওষুধপত্র ও বেসামরিক লোকজন।

পরিকল্পনা অনুযায়ী ৩০ মার্চ ভোর চারটায় আকস্মিকভাবে তিন দিক থেকে কুষ্টিয়া আক্রমণ করি। আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে অনুসরণকারী জনগণের গগনবিদারী জয়ধ্বনিতে বোধ হয় শত্রুপক্ষের মনোবল ভেঙে যায়। ঘণ্টাখানেক তুমুল যুদ্ধের পর আমাদের সেনারা পুলিশ লাইনস ও ওয়্যারলেস কেন্দ্রের ভেতরে ঢুকে পড়ে শত্রু হনন করতে থাকে। উপায়ান্তর না দেখে সামান্যসংখ্যক শত্রুসৈন্য তাদের অস্ত্রশস্ত্র ফেলে দিয়ে দ্রুতগতিতে তাদের সদর দপ্তরের দিকে পালিয়ে যায়। পালানোর সময়ও অনেকে নিহত হয়। পুরো দিনের যুদ্ধে একমাত্র তাদের সদর দপ্তর ও পার্শ্ববর্তী এলাকা ছাড়া সব শহরই আমাদের হস্তগত হয়। আমার সেনারা শত্রুদের ৩০ মার্চ সারা রাত চারদিক থেকে ঘিরে রেখে মুহুর্মুহু জয়ধ্বনি-সহকারে গোলাবর্ষণ করতে থাকে। শত্রুরা ওয়্যারলেসে যশোরের কাছে আরও সেনা পাঠানোর আবেদন জানিয়েও ব্যর্থ হয়।

আমাদের ওয়্যারলেস সেটের মারফত শত্রুপক্ষের ওয়্যারলেস আবেদন মনিটর করে যশোরের দেওয়া প্রত্যুত্তর আমাদের হস্তগত হয়। যশোরের প্রত্যুত্তর ছিল, ‘জনবল বৃদ্ধি সম্ভব নয়। নিজে থেকে সমস্যার সমাধান করো।’

পরদিন, অর্থাৎ ৩১ মার্চ ভোরবেলা আমাদের আক্রমণ পুরোপুরি সফল হতে পারেনি। তুমুল গোলাগুলির সাহায্যে শত্রুপক্ষ আমাদের মাথা নিচু করে রাখতে বাধ্য করে। সারা দিনের যুদ্ধের পর আনুমানিক জীবিত শত্রুর সংখ্যা ছিল ৪০-৪৫। তার মধ্যে অফিসারদের সবাই জীবিত ছিল। গত্যন্তর না দেখে রাতের অন্ধকারে তারা দুটি জিপ ও একটি ডজ গাড়িতে আরোহণ করে আমাদের ব্যূহ ভেদ করে তীব্র গতিতে ঝিনাইদহের দিকে পালিয়ে যেতে চেষ্টা করে। আমার সেনারা সঙ্গে সঙ্গেই তাদের অনুসরণ করে।

শত্রুদের ভাগ্য মন্দ। শৈলকুপার পুলের গোড়ায় আমরা গর্ত খনন করে তা পলিথিন দিয়ে সেই গর্তকে ঢেকে রেখেছিলাম। সেটা তারা জানত না। তাদের প্রথম দুটি জিপ উপর্যুপরি গর্তে পড়ে গিয়ে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেখানে মেজর শোয়েব ও কয়েকজন শত্রুসেনার ভবলীলা সাঙ্গ হয়। বাকিরা আশপাশের গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে, কিন্তু সজাগ মুক্তিযোদ্ধা, স্বেচ্ছাসেবক ও জনগণের হাত থেকে একজন শত্রুসৈন্যও বাঁচতে পারেনি। আমার নির্দেশে উৎসাহিত হয়ে তারা একেকজনকে হত্যা করে তাদের হাতিয়ার এনে আমার সদর দপ্তরে জমা দেয়। এমনও হয়েছে, একটি ছেলে একটা একনলা শটগান দিয়ে একজন এলএমজিধারী শত্রুসৈন্যকে হত্যা করে তার হাতের একটি আঙুল এবং তার এলএমজি আমার সদর দপ্তরে জমা করে। এই ছেলেটির বয়স ছিল ১৮-২০ বছর। নাম তার সুলতান আলী জোয়ারদার। যুদ্ধের প্রচণ্ডতা ও হইহুল্লোড়ে ছেলেটির সঙ্গে দেখা করা আমার পক্ষে আর সম্ভব হয়নি। সেই রাতেই লে. আতাউল্লাহ শাহ ধরা পড়ে। তাকে ঝিনাইদহে পাঠানো হয়। চিকিৎসার পর ২ এপ্রিল বিকেলের দিকে আমার সদর দপ্তরে আনা হয় তাকে।

১ এপ্রিল কুষ্টিয়া সম্পূর্ণরূপে শত্রুমুক্ত হয়। এরপর অল্পসংখ্যক সেনা কুষ্টিয়ায় রেখে বাকি সেনাদের আমি ঝিনাইদহের দিকে পাঠিয়ে দিই। কিছুসংখ্যক সেনা মাগুরা, কিছুসংখ্যক ঝিনাইদহের দক্ষিণে বিশাখালী ও কিছুসংখ্যক সেনা কোটচাঁদপুরে অবস্থান করে। উদ্দেশ্য, যশোর থেকে উত্তর দিকে শত্রুদের অগ্রসর হওয়ার সব পথ অবরোধ করে রাখা।

এদিকে ২৮ মার্চই কলকাতা হয়ে বহির্বিশ্বের সঙ্গে টেলিফোন যোগাযোগ স্থাপন করা হয়। ডা. আসহাব-উল-হক ও আমি পালাক্রমে কলকাতার বিভিন্ন পত্রিকার কাছে যুদ্ধের খবরাখবর সরবরাহ করতাম।

কুষ্টিয়া-চুয়াডাঙ্গার বিশিষ্ট ব্যক্তিরা তথা ইউনুস আলী এমপিএ, ব্যারিস্টার বাদল রশিদ (আবু আহাম্মদ আফজালুর রশীদ) এমএনএ, প্রিন্সিপাল ফুলে হোসেন, ইঞ্জিনিয়ার সাইফ উদ্দিন, মীর্জা সুলতান রাজাসহ অন্যদের নানা বেসামরিক সংযোগ, অভ্যর্থনা, সাহায্য গ্রহণ ইত্যাদি কাজকর্মে নিয়োগ করা হয়েছিল। স্থানীয় জনসাধারণ ও ছাত্র-যুবসমাজ প্রত্যেকেই আপন আপন সামর্থ্য ও সাধ্য অনুযায়ী এই যুদ্ধের আয়োজন ও সরঞ্জাম সংগ্রহে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দিন-রাত সাহায্য করেছিল।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ‘কুষ্টিয়ার যুদ্ধ’ পাকিস্তানি বাহিনীর শ্রেষ্ঠত্ব ধুলায় লুটিয়ে দেওয়া তথা পরাজয়ের প্রথম উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত, যা নিয়ে সাংবাদিক ড্যান কগিন বিশ্বখ্যাত টাইম ম্যাগাজিনের ১৯৭১ সালের ১৯ এপ্রিল সংখ্যার প্রচ্ছদকাহিনি রচনা করেন।

আবু ওসমান চৌধুরী: জন্ম ১ জানুয়ারি ১৯৩৫, চাঁদপুর। পৈতৃক নিবাস ফরিদগঞ্জ উপজেলায়। বিএ পাস করে ১৯৫৮ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কমিশন পান।

১৯৭১ সালে মেজর এবং ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস-ইপিআর (স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ রাইফেলস-বিডিআর, বর্তমানে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবি)-এর ৪ উইংয়ের উইং কমান্ডার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে ৮ নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার (আগস্ট পর্যন্ত) ছিলেন। রচিত গ্রন্থ ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’, ‘সময়ের অভিব্যক্তি’, ‘সোনালী ভোরের প্রত্যাশা’, ‘শতাব্দীর মহানায়ক’।

সূত্র: সম্মুখযুদ্ধ ১৯৭১, মুক্তিযোদ্ধাদের কলমে, প্রথমা প্রকাশন ২০২০, পৃষ্ঠা ৪৭-৫৬