মাঝপথে ফিরে দেখা

শাহীন দিল রিয়াজ l ছবি: লেখকের সৌজন্যে
শাহীন দিল রিয়াজ l ছবি: লেখকের সৌজন্যে

জীবনের ছেচল্লিশটা বছর পার করে ফেললাম। অর্ধেকটা কেটেছে বাংলাদেশে, বাকিটা এই জার্মানিতে। চলচ্চিত্রনির্মাতা হিসেবে জার্মান মহলে পরিচয় ২০০৮ সালে মুক্তি পাওয়া লোহাখোর ছবির মাধ্যমে। তারও আগে, সেই ২০০২ সালের ঘটনা, ফিল্ম স্কুলের পড়াশোনার শেষ দিকে আমার গ্র্যাজুয়েশন ফিল্ম জীবন জলে বেলে সবার বেশ মনোযোগ আকর্ষণ করে। এ পর্যন্ত মুক্তি পাওয়া আটটি ছবির স্বীকৃতির তালিকা বলতে গেলে বেশ লম্বা—১০টি শ্রেষ্ঠ ছবির পুরস্কার, সব মিলিয়ে আন্তর্জাতিক পুরস্কার আছে ১৯টি৷ ঝুলিতে জার্মানির নির্মাতাদের জন্য সবচেয়ে সম্মানিত পুরস্কার ‘গ্রিমে-প্রাইজ’ আছে দুটি। কিন্তু পুরস্কার ছবিগুলোকে পাল্টে দেয়নি। ওগুলো যা ছিল তা–ই থাকল। পুরস্কারের আগে আসে ছবি, তারও আগে আসে ছবির সঙ্গে জড়িত মানুষগুলো। সেই মানুষ আর তার কাজের পেছনে আনন্দ–বেদনার লম্বা ইতিহাস থাকে। সে ক্ষেত্রে আমার শুরুটা কোথায়? এক কথায় এর উত্তর দেওয়া কঠিন।
ছবির প্রতি আগ্রহ, ছবি নির্মাণকে নেশা হিসেবে নিতে চাওয়া আর সেই চাওয়াকে পাওয়া মনে করে স্বপ্নলোকে ঘুরে বেড়ানো, অবশেষে নেশাকেই পেশা করে নিয়ে জীবনযাপন করতে পারা—ইতিহাসটা বেশ লম্বা৷ ডায়েরির পাতায় লিপিবদ্ধ করার কথা কখনো ভাবিনি৷ তবে এটুকু বলতে পারি, আমার জীবনের যা কিছু ভালো–মন্দ ঘটেছে, তাতে ভূমিকা রেখেছেন কিছু গুরুত্বপূর্ণ মানুষ আর অনেক ঘটনা।
ওই ঘটনাগুলো না ঘটলে, মানুষগুলো আমার জীবনে জড়িয়ে না পড়লে কিংবা আমাদের মাঝে পারস্পরিক বিশ্বাস না থাকলে আমার জীবনের নদী হয়তো আজ অন্য পথে প্রবাহিত হতো৷ তার সঙ্গে নিজের ব্যক্তিগত শারীরিক ও মানসিক পরিশ্রম যে ছিল, সেটাও সবিনয়ে স্বীকার করব৷
আমার জন্ম এমন এক পরিবারে, যেখানে শিল্প-সংস্কৃতিকে পেশা হিসেবে নেওয়ার অনুপ্রেরণা খুব একটা পাইনি। বাবা আমিরুল ইসলাম পেশায় পুরকৌশলী, মানে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার৷ মায়ের নাম দিল আফরোজ, উনি গৃহিণী৷ বাবার কাজপাগল জীবন আমাদের পরিবারে সব সময় সমালোচিত হয়ে এসেছে। অথচ বাবার সেই জীবনটাই এখন আমার ওপর ভর করেছে৷ মা বই পড়তে, ছবি দেখতে ভালোবাসেন৷ এই সময়টাতে মায়ের সঙ্গে সঙ্গে থাকতাম আমি। বাবা শিল্প–সংস্কৃতির সঙ্গে ছিলেন না কখনো, তাঁকে একটা গান শুনতেও দেখিনি৷ পড়ার ভেতর একমাত্র দৈনিক পত্রিকা আর পেশাগত বই ছাড়া আর কিছু তাঁর হাতে কখনো ওঠেনি।

ক্যামেরায় পড়াশোনা শুরু করেছিলাম, শিক্ষকেরা টের পেলেন আমার আগ্রহ আসলে ছবি পরিচালনায়৷ ফিল্ম স্কুলে থাকা অবস্থাতেই ছোট ছোট বেশ কয়েকটি ফিকশন, নন-ফিকশন ছবি বানাই, যেগুলো সিনেমাটোগ্রাফার-ডিরেক্টরের দ্বৈত পেশায় দক্ষতা অর্জন করতে সাহায্য করে

উনসত্তরের ফেব্রুয়ারিতে আমার জন্ম। সে সময় আমরা ছিলাম নরসিংদীর ঘোড়াশালে। বছর দুই পরেই শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। সে সময় সপরিবারে কয়েক বছরের জন্য ফেনীর পৈতৃক ভিটেতে ফিরে যাই। শৈশবের সেই সময়টা কেটেছে গ্রামে৷ বাকি অংশ পুরোনো ঢাকার নবাবপুরের বংশাল চৌরাস্তায়। তৎকালীন ‘নিশাদ’ সিনেমা হলের (পরে ‘মানসী’ নামে পরিচিত হয়) খুব কাছেই৷ কৈশোরে পা দেওয়ামাত্র বাবা-মা ঠিক করলেন তাঁদের ছেলেকে সেনা কর্মকর্তা বানাতে হবে৷ পাঠিয়ে দিলেন কুমিল্লা ক্যাডেট কলেজে। অনেকগুলো বছর কড়া নিয়মকানুন আর ড্রিল-প্যারেডের চাপে থেকেও স্বপ্নিল মন আমার বদলায়নি। তবুও সৈনিকের জীবনটা একরকম বাধা হয়েই দাঁড়িয়েছিল। ভাগ্যদেবী সুপ্রসন্ন হয়েছিলেন বটে। সে সময় সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার সর্বনিম্ন উচ্চতা ছিল পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি৷ কিন্তু বয়স ১৮ পেরোনোর পরও সে উচ্চতা আমার ছিল না, এক ইঞ্চির জন্য বেঁচে গেলাম৷
চলচ্চিত্রে আগ্রহটা আসে ক্যাডেট কলেজে থাকার সময়েই। কলেজজীবন শেষে ঢাকায় এসে পড়লাম আশির দশকের কবি-গল্পকারদের আড্ডায়৷ সাজ্জাদ শরিফ, মাসুদ খান, সোয়েব সাদাব, সেলিম মোর্শেদ, শান্তনু চৌধুরী—সৃজনশীল অগ্রজদের মাঝে থাকতে আমার ভালো লাগত, যদিও নিজে কখনো কবিতা লেখার চেষ্টা করার সাহস করিনি, অন্তত প্রকাশ্যে।
এই অগ্রজদের হাত ধরেই পরিচয় হয় মুহম্মদ খসরু, তারেক মাসুদ, তানভির মোকাম্মেল, মোরশেদুল ইসলাম, জাহিদুর রহিম অঞ্জনসহ সেই সময়ের আরও অনেক তরুণ চলচ্চিত্র সংসদকর্মী আর নির্মার্তাদের সঙ্গে৷ আশির দশকের শেষের দিকে চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের পাশাপাশি স্বল্পদৈর্ঘ চলচ্চিত্র আন্দোলন তখন ঢাকায় বেশ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে৷ এই প্রথম মনে হলো ঠিক এদের জন্যই যেন আমার এত দিনের অপেক্ষা৷ এদেরই হাত ধরে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগোতে শুরু করলাম, সৃজনশীল চলচ্চিত্র মাধ্যমটি ভালোভাবে জানার ও বোঝার জন্য৷

লোহাখোর ছবির একটি দৃশ্য
লোহাখোর ছবির একটি দৃশ্য

বিদেশি ভাষায় আগ্রহ ছিল, সেই সূত্রে জার্মান শেখা৷ কিন্তু সেটা শিখতে গিয়ে যে একসময় জার্মান চলচ্চিত্রের প্রেমে পড়ে যাব—ভুলেও ভাবিনি। নব্বইয়ের প্রথম দিকে যখন ঢাকার গ্যেটে ইনস্টিটিউটে জার্মান ভাষা শিক্ষায় বিশেষ পারদর্শিতার জন্য পাওয়া বৃত্তি নিয়ে বার্লিনে আসা, তত দিনে পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানির পুনর্মিলনের রোমান্টিক আবেশ সবে মুছতে শুরু করেছে৷ পূর্ব ইউরোপের মানুষের চাপ এই সময় বার্লিনে সর্বত্র৷ একই সঙ্গে শহরটি নানা জাতির সমাগমে রঙিন হতে শুরুর করেছে৷ দুই মাসের বৃত্তি শেষে ঢাকায় ফিরে যাই, মাস ছয় পরে ছাত্র হয়ে আবার ফিরে আসা।
পূর্ব ইউরোপিয়ানরা যেখানে জার্মানিতে পা দিয়ে এক-দুই অক্ষর করে জার্মান শিখছে, আমি সে সময় অনর্গল জার্মান বলতে পারতাম। খুব ইচ্ছা চলচ্চিত্র নিয়ে পড়ার৷ তারপরও সরাসরি ফিল্ম স্কুলে চেষ্টা করার সাহস করিনি। বুঝলাম, আগে শিল্পকলার ইতিহাস পড়তে হবে, তারপর চলচ্চিত্র। ১৯৯৬ সালে বার্লিনের ফ্রেই ইউনিভার্সিটি বার্লিনে আর্ট হিস্ট্রি শেষে করে এইচএফএফ কনার্ড–উলফ ফিল্ম স্কুলে সিনেমাটোগ্রাফিতে ভর্তি৷ প্রথমবারেই ফিল্ম স্কুলের পরীক্ষায় টিকব তা কখনো আশা করিনি। প্রতিটি বিষয়ে মাত্র আটটি আসনের জন্য সারা ইউরোপ থেকে শতাধিক পরীক্ষার্থী যোগ দেয়৷ তিনটি আলাদা আলাদা ধাপে পরীক্ষার পর ৩০০ পরীক্ষার্থীর মাঝ থেকে এই আটজনকে বেছে নেওয়া হয়৷ সেই সময় আমাদের ফিল্ম স্কুলে বাঙালি বা ভারতীয় দূরের কথা, একটা এশীয় ছাত্রও খুঁজে পাওয়া যেত না।
২০০২ সালে পেশাজীবন শুরু করার আগে জীবন জলে বেলে ছবিটি মুক্তি পেল। পরবর্তী কাজের দিকনির্দেশনা পেয়েছি এই ছবি থেকেই। সিনেমাটোগ্রাফিতে পড়াশোনা করলেও পেলাম নির্মাতার নতুন পরিচয়৷ একটি বাদ দিলে বাকিগুলো বাংলাদেশ নিয়ে। তাহলে আমি কি বাংলাদেশি নির্মাতা? মাঝে মাঝে মনে প্রশ্ন জাগে। আমি কোন দেশি, এটা আসলে গুরুত্বপূর্ণ নয়৷ আমি আমার ছবিতে মানুষের গল্প বলার চেষ্টা করি৷ এ পর্যন্ত আমি সেই মানুষগুলোর কথাই বেশি বলেছি, যাদের আমি কাছ থেকে চিনি৷ যেহেতু ছবিগুলো ইউরোপের জন্য তৈরি, সে জন্য আমার বেশির ভাগ ছবির দর্শক–শ্রোতা বাংলাদেশের বাইরের৷ তারপরও দু–একটা ছবি এমনভাবে করার চেষ্টা করেছি, যাতে তার আবেদন পৃথিবীর যেকোনো মানুষের কাছে থাকে৷ বাংলাদেশে তথ্যচিত্র দেখানোর সুযোগ চলচ্চিত্র উত্সবের বাইরে নেই৷ সে জন্যই এ ছবিগুলো মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারে না৷ এতগুলো চ্যানেল থাকা সত্ত্বেও কেউ তথ্যচিত্র দেখানোতে খুব একটা আগ্রহী না।
ক্যামেরায় পড়াশোনা শুরু করেছিলাম, শিক্ষকেরা টের পেলেন আমার আগ্রহ আসলে ছবি পরিচালনায়৷ ফিল্ম স্কুলে থাকা অবস্থাতেই ছোট ছোট বেশ কয়েকটি ফিকশন, নন-ফিকশন ছবি বানাই, যেগুলো সিনেমাটোগ্রাফার-ডিরেক্টরের দ্বৈত পেশায় দক্ষতা অর্জন করতে সাহায্য করে৷ গত ২০ বছরে জীবন জলে বেলে থেকে শুরু করে সাম্প্রতিকতম ছবি দেশান্তর (ডিসট্যান্ট ফরচুন) পর্যন্ত, প্রতিটি ছবির পেছনেই একটি বিশেষ গল্প আছে, যা দর্শককে মানুষের কাছে নিয়ে আসে৷ জীবন জলে বেলে করতে গিয়ে যমুনার চরে থেকেছি মাসের পর মাস৷ সে ছবির ৩৫ ঘণ্টার ফুটেজ প্রায় দুই বছর ধরে জার্মান সম্পাদকের সঙ্গে বসে সম্পাদনা করেছি। যিনি এক শব্দও বাংলা জানতেন না, আমার সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে বাংলা প্রায় শিখেই ফেললেন৷
দ্য হ্যাপিয়েস্ট পিপল ইন দ্য ওয়ার্ল্ড অর্থাৎ আমার দ্বিতীয় ছবি শিল্প শহর স্বপ্নলোক-এ ঢাকা শহরের চারজন মানুষের জীবনের মধ্য দিয়ে পুরো দেশ আর সমাজটা তুলে আনার চেষ্টা ছিল। কবির সুমনের নব্বইয়ের দশকে গাওয়া তিনটি গান এই ছবিকে আমাদের জটিল নাগরিক জীবনের আরও গভীরে নিয়ে যায়৷ জার্মান আর্মির সঙ্গে শুটিং করেছি আফগানিস্তানের ঝুঁকিপূর্ণ কুন্দুস, মাজার-ই-শরিফ ও কাবুলে৷ গিয়েছি রুয়ান্ডায়, তরুণ চলচ্চিত্র কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিতে৷ চট্টগ্রামের জাহাজভাঙা শ্রমিকদের জীবন নিয়ে তৈরি তৃতীয় ছবি লোহাখোর (আয়রন ইটারস)। এ ছবি যে শুধু পুরস্কার এনে দিয়েছে তা–ই নয়৷ ২০০৯ সালে প্রায় তিন মাস জার্মানির ১০টি শহরের বিভিন্ন সিনেমা হলে চলেছে লোহাখোর৷ বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়ে ২০টিরও বেশি ইউরোপীয় টেলিভিশন চ্যানেলে দেখানো হয়৷ ২০০৮ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর তত্কালীন ইউরোপিয়ান এনভায়রনমেন্ট কমিশনার স্তাভরস দিমাসের উপস্থিতিতে ইউরোপিয়ান সংসদে লোহাখোর দেখানো হয়৷ তার কিছুদিন পরই ইউরোপিয়ান জাহাজভাঙা শিল্পের নীতিমালা–বিষয়ক একটি বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করা হয়। বাংলাদেশেও ছবিটি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যখন বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্ট লইয়ারস অ্যাসোসিয়েশন (বেলা) জাহাজভাঙাশিল্পের বিরুদ্ধে পরিবেশদূষণের মামলা করে৷
ছবি কি তাহলে আদৌ কোনো পরিবর্তন আনতে পারে? শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি মানুষের জন্য পরিবর্তনের প্রেক্ষাপট তৈরি করে দিতে পারে কিন্তু পরিবর্তন করতে হবে মানুষকে নিজেই৷ জাহাজ ভাঙতে গিয়ে কিংবা তৈরি পোশাকশিল্পে কাজ করতে গিয়ে পুড়ে মরুক, কিংবা র্যাং গস ভবন ভাঙতে গিয়ে লাশ হয়ে দিনের পর দিন ঝুলে থাকুক—আমি এর ভেতর কোনো পার্থক্য দেখি না৷ জাহাজভাঙাশিল্প বলেন আর তৈরি পোশাকশিল্প বলেন, শ্রমিকদের জীবনের কোনো পরিবর্তন হবে না যত দিন না এই মানুষগুলোর প্রতি আমাদের—সচ্ছল মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্তের দৃষ্টিভঙ্গি না বদলায়৷ ইউরোপীয়দের মুনাফালোভী প্রবণতা অবশ্যই এতে ভূমিকা রাখছে কিন্তু অন্যকে দোষ দেওয়ার আগে আয়নায় নিজের চেহারাটাও তো দেখা জরুরি। তবে এটাও সত্যি, সারা বিশ্বেই পরিস্থিতি অনেক জটিল আকার ধারণ করেছে৷ এর জন্য একা কাউকে দায়ী করা উচিত হবে না৷ আমার ব্যক্তিগত ধারণা, পুঁজিবাদের পাগলা ঘোড়ার লাগাম মানুষের হাতে আর নেই৷ একে আবার নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারলে মানবসভ্যতা খুব দ্রুত ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাবে৷
প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা হিসেবে পরিচিত হলেও ফিকশন নির্মাণেও আমার প্রবল ইচ্ছা। ছবিতে আসলে গল্পটাই আসল৷ গল্প বলার আর শোনার আগ্রহ মানুষের প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে চলে এসেছে৷ একই গল্প হাজার রকম করে বলা যায়৷ আমি ডকুমেন্টারি ফুটেজ দিয়ে গল্প বলার চেষ্টা করি৷ যদি আর্থিক জোগান থাকে, একই বিষয় নিয়ে ফিকশন করতেও আমার কোনো অসুবিধা নেই৷ কিন্তু ফিকশনের জন্য যে পরিমাণ লোক–লস্কর আর টাকাপয়সা লাগে, সেটার কথা ভাবলেই গায়ে জ্বর এসে যায়৷ খোদ ইউরোপেই খুব কম নির্মাতা আছেন, যাঁরা শুধু ফিকশন বানিয়ে বেঁচেবর্তে থাকতে পারেন, যদি তিনি টিভি সিরিয়াল করতে না চান৷ তবে সেখানেও আজকাল অনেক ভালো কাজ হচ্ছে৷ আমি ফিকশনের জন্য লিখতে শুরু করেছি৷ দেখা যাক কী হয়!
মাঝেমধ্যে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে কাজ করি। সময় কম থাকলেও মাঝে মাঝে লিখি। জার্মান ভাষায় Der Spiegel-এর মতো পত্রিকায় লেখা ছাপা হচ্ছে। আমার কাজ নিয়েও বিস্তারিত আলোচনা হচ্ছে। মজার ব্যাপার, আমার জীবন ও কাজের ওপর করিন মায়ার নামের এক সুইস নাট্যপরিচালক ২০১৩ সালে একটি নাটক মঞ্চস্থ করেন৷ সুইজারল্যান্ড, জার্মানি, ফ্রান্স, হাঙ্গেরি, স্লোভেনিয়াতে ২৬ বার মঞ্চস্থ হয় নাটকটি৷ ৩ ও ৪ নভেম্বর নাটকটি মিউনিখের ‘কামার স্পিল’ থিয়েটারে আবার মঞ্চস্থ হয়েছে নাটকটি। এত কিছু একসঙ্গে খুব বেশি দিন করা সম্ভব না, তাই ভাবছি ছবি করার দিকেই বেশি মনোযোগী হব। মেঘে মেঘে বেলা যে অনেক হয়ে এল৷ সময় বোধ হয় আর খুব বেশি নেই। কখন যে নিজের বেলা শেষ হয়ে আসে তার কি ঠিক আছে!
দূর থেকে হলেও দেশকে দেখি। দেশের ছবি নির্মাণ, ছবির জগৎ নিয়ে ভাবি। এখানে আরামদায়াক একটা জায়গা থেকে বাংলাদেশের সহকর্মীদের ওপর কোনো মন্তব্য করা ঠিক হবে না৷ তবে ইউরোপের পরিস্থিতিটা প্রায় একই৷ মূলধারার শিল্পকে মধ্যবিত্ত নাক সিটকায়। সরকারি অনুদান আর পাবলিক টেলিভিশন না থাকলে ইউরোপীয় চলচ্চিত্র আর আমাদের মতো স্বনির্ভর নির্মাতারা বহু আগে ভেসে যেত৷ মার্কিন ছবি না থাকলে এখানে কটা সিনেমা হল টিকত তা বলা মুশকিল৷ ইন্টারনেট, মোবাইল ফোন—এই সব নতুন মাধ্যমের চাপে পরিস্থিতি পাল্টে যাচ্ছে৷ ভবিষ্যতে কজন মধ্যবিত্ত আদৌ সিনেমা হলে যাবেন জানি না৷ অন্যদিকে ইন্টারনেট, মোবাইল ফোন নতুন সম্ভাবনা নিয়ে আসছে৷ সত্যিকারের নতুন সিনেমা আক্ষরিক অর্থেই আমাদের হাতের মুঠোয় আসতে আর বেশি দেরি নেই, কিছুটা এরই মধ্যে চলে এসেছে৷ এই সিনেমা প্রায় কবিতা লেখার মতো৷
বাংলাদেশে এখনো অনেক মানুষ সিনেমা হলে যায়৷ গ্রামগঞ্জে মানুষ এই মাধ্যমটার জাদুকরী ক্ষমতাতে আজও বিশ্বাস করে৷ কিন্তু আমাদের মতো নির্মাতারা তাতে আর বোধ করি বিশ্বাস করেন না কিংবা চাইলেও তাতে বিশ্বাস আনতে পারেন না৷ তা না হলে আমার মতো মানুষ বিদেশে পড়ে থাকত না৷ এ প্রসঙ্গে আল মাহমুদের খড়ের গম্বুজ কবিতার কয়েকটা লাইন প্রায়ই মনে পড়ে—
সোনালি খড়ের স্তূপে বসতে গিয়ে—প্রত্যাগত পূরুষ সে-জন
কী মুস্কিল দেখলো যে নগরের নিভাঁজ পোশাক
খামচে ধরেছে হাঁটু৷ উরতের পেশী থেকে সোজা
অতদূর কোমর অবধি
সম্পূর্ণ যুবক যেনো বন্দি হয়ে আছে এক নির্মম সেলাইয়ে৷
যা কিনা এখন তাকে স্বজনের সাহচার্য, আর
দেশের মাটির বুকে, অনায়াসে
বসতেই দেবে না৷
জীবনের অনেকগুলো বছর একাই ছিলাম। গত বছর রুখসানা কাকনের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছি। রুখসানা নেশায় কবি, দুটি কাব্যগ্রন্থ বেরিয়েছে তাঁর৷ পেশায় টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থাপক, জার্মানিতে মার্কিন মিলিটারি বেইজে কাজ করেন প্রায় ১১ বছর হয়ে গেল৷ আগের সম্পর্কের ১৩ বছরের একটি ছেলে আছে আমার, নাম ইআন সিদ্ধার্থ দিল-রিয়াজ৷ ইআন তার পোলিশ মায়ের সঙ্গে ওয়ারশতে থাকে৷ রুখসানারও আগের সম্পর্কের ১৬ বছরের একটি মেয়ে আছে, নাম কান্তম৷ তিনজনের সংসার এখন ফ্রাঙ্কফুর্টের কাছে ভিজবাডেন নামে একটি ছোট্ট শহরে৷ কিন্তু কাজের কারণে বারবারই বার্লিন যেতে হয়৷ ২৩ বছর বার্লিন থাকার পর আমি বার্লিন ছেড়ে এলেও মনে হচ্ছে বার্লিন আমাকে কখনো ছাড়বে না!

লেখক পরিচিতি
শাহীন দিল রিয়াজ চলচ্চিত্র নির্মতা। জন্ম ১৯৬৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি, ঢাকায়। চলচ্চিত্র নিয়ে পড়তে নব্বইয়ের দশকে যান জার্মানিতে। বর্তমানে নেশা ও পেশা দুটোই চলচ্চিত্র নির্মাণ। লোহাখোর সিনেমার জন্য পেয়েছেন আন্তর্জাতিক খ্যাতি। মোট মুক্তি পাওয়া ছবির সংখ্যা ৮। ১০টি শ্রেষ্ঠ ছবির পুরস্কারসহ ১৯টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার আছে তাঁর ঝুলিতে। জার্মান নির্মাতাদের জন্য সবচেয়ে সম্মানিত পুরস্কার ‘গ্রিমে-প্রাইজ’ পেয়েছেন দুইবার।


সেসব কীর্তিগাথা শোনাচ্ছেন দেশের মুখ উজ্জ্বল করা কয়েকজন প্রবাসী: