ভবিষ্যতে বড় খাদ্যসংকটের কোনো ঝুঁকি দেখি না: কে এ এস মুরশিদ

>
কে এ এস মুরশিদ। ছবি: প্রথম আলো
কে এ এস মুরশিদ। ছবি: প্রথম আলো
বাংলাদেশের খাদ্য পরিস্থিতি নিয়ে প্রথম আলোর মুখোমুখি হয়েছেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক কে এ এস মুরশিদ। তিনি কথা বলেছেন শস্যের উৎপাদন, বাজার ও কৃষকের অবস্থা, আমিষজাত খাদ্যের প্রাপ্তি, পুষ্টির অবস্থা ও নিরাপদ খাদ্য নিয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মশিউল আলম

প্রথম আলো: বাংলাদেশের জনঘনত্ব ও অর্থনৈতিক অবস্থার বিবেচনায় এই মুহূর্তে আমাদের খাদ্য পরিস্থিতি কেমন?
কে এ এস মুরশিদ: দেশের খাদ্য পরিস্থিতি বলতে আমরা মূলত চালের কথা বোঝাই। কারণ, চালই আমাদের প্রধান খাদ্য। চালের ঘাটতি না থাকলে বলা হয়, দেশে খাদ্যঘাটতি নেই। দেশের মোট চাহিদা পূরণের জন্য প্রয়োজনীয় পরিমাণ চাল উৎপন্ন হলে বলা হয় আমরা খাদ্যে স্বনির্ভর হয়েছি। অর্থাৎ আমাদের খাদ্যচিন্তা ঐতিহ্যগতভাবে চালকেন্দ্রিক; খাদ্যসম্পর্কিত নীতি ও প্রতিষ্ঠানগুলো চালকেন্দ্রিক। এই প্রাতিষ্ঠানিক দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো প্রয়োজন। অনেকে বুঝতে পারছেন যে এটা প্রয়োজন; কিন্তু এখনো সেটা ঘটেনি।

প্রথম আলো: আপাতত যদি শুধু চালের কথাই ধরি, এতে কি আমরা আসলেই স্বয়ংসম্পূর্ণ?
কে এ এস মুরশিদ: গড়পড়তা স্বয়ংসম্পূর্ণ। তবে কোনো কোনো বছর ঘাটতি হয়, আবার কোনো কোনো বছর কিছু উদ্বৃত্তও থাকে। যখন উদ্বৃত্ত থাকে, তখন দুঃখজনকভাবে ধানের দাম ভীষণভাবে কমে যায়; ধানচাষিদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দেয়। এটা ঘটে এ কারণে যে আমাদের এই উদ্বৃত্ত চাল কাজে লাগানোর সামর্থ্য নেই। আবার যখন ঘাটতি দেখা দেয়, তখন আরেক ধরনের ক্ষোভ সৃষ্টি হয়।

প্রথম আলো: আমরা কি চাল উৎপাদনে চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেছি?
কে এ এস মুরশিদ: সামান্য উদ্বৃত্ত হলেই ধানের বাজারে ধস নামে, এটা তো তারই একটা ইঙ্গিত। আমাদের চালের চাহিদা আগে যেভাবে বাড়ছিল, এখন আর সেভাবে বাড়ছে না। এর কারণ, মানুষের আয় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য খাবারের চাহিদা বাড়ছে; ভাত খাওয়া একটু একটু করে কমে যাচ্ছে, অন্যান্য খাবার খাওয়া বাড়ছে। ভবিষ্যতে এই প্রবণতা আরও বাড়বে। তাই যে পরিমাণ চাল আমাদের দরকার, তা তো উৎপাদন করতেই হবে, উপরন্তু মাঝেমধ্যে যখন ঘাটতি হয় বা উদ্বৃত্ত থাকে, তখন সে পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক সামর্থ্যও বাড়াতে হবে।

প্রথম আলো: আমাদের লোকসংখ্যা এখনো বছরে প্রায় ২০ লাখ করে বাড়ছে; কৃষিজমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। ভবিষ্যতে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার ঝুঁকি আছে কি না, যখন বিপুলসংখ্যক মানুষের খাদ্যপ্রাপ্তি অনিশ্চিত হয়ে উঠতে পারে?
কে এ এস মুরশিদ: খাদ্যপ্রাপ্তি বলতে যদি শুধু চাল বোঝানো হয়, তাহলে আমি সে রকম বড় কোনো ঝুঁকি দেখছি না। কারণ, আমাদের কৃষি উৎপাদনের হার এখনো জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের চেয়ে বেশি। এখন আমাদের প্রজনন হার ২.২, আর কৃষি প্রবৃদ্ধির হার ৩ বা সাড়ে ৩ শতাংশ। কৃষির প্রবৃদ্ধি আরও বেশি ছিল, এখন একটু কমে এসেছে। কিন্তু সে জন্য ভবিষ্যতে বড় খাদ্যসংকটের কোনো ঝুঁকি আমি দেখি না। তবে কৃষিতে আরও বিনিয়োগের প্রয়োজন আছে।

প্রথম আলো: আমাদের ধান উৎপাদন বেশি হলে দাম পড়ে যায়, ধানচাষির লোকসান হয়। ভিয়েতনামেও একসময় এ রকম হতো। সে জন্য ভিয়েতনাম সরকার একটা চালনীতি করেছে। তারা উন্নত জাতের ধান উৎপাদন করে চাল রপ্তানি করে। এ জন্য তারা ধানচাষিদের প্রণোদনা দেয়। আমরা কেন সেই পথে যাই না?
কে এ এস মুরশিদ: আসলে চাল উৎপাদনে আমাদের খুব বেশি উদ্বৃত্ত থাকে না। মাঝেমধ্যে যেটুকু উদ্বৃত্ত হয়, তা দিয়ে রপ্তানি বাজার পাওয়া সম্ভব নয়। যদি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে উদ্বৃত্ত থাকত, যদি সে রকম বাস্তব সম্ভাবনা থাকত, তাহলে রপ্তানিমুখী হওয়ার চেষ্টা করা যেত; যেটা ভিয়েতনামের আছে, কম্বোডিয়ার আছে। কারণ, তাদের লোকসংখ্যার তুলনায় পর্যাপ্ত জমি আছে। চাল রপ্তানির ক্ষেত্রে আমাদের তুলনামূলক সুবিধাপূর্ণ অবস্থান কেমন, এটা দেখার জন্য কিছু গবেষণা করা হয়েছিল। তাতে দেখা গেছে, আমাদের স্থানীয় উৎপাদনের হিসাবে আমাদের তুলনামূলক সুবিধা আছে, কিন্তু রপ্তানির জন্য নেই।

আমাদের কৃষি উৎপাদনের হার এখনো জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের চেয়ে বেশি। ছবি: হাসান রাজা
আমাদের কৃষি উৎপাদনের হার এখনো জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের চেয়ে বেশি। ছবি: হাসান রাজা

প্রথম আলো: আলু, টমেটো, শসা—এ রকম অনেক ফসল প্রচুর উৎপাদিত হলে দাম কমে যায়, কৃষক দাম না পেয়ে রাস্তায় ফেলে দেন কিংবা গরুকে খাওয়ান। এসব আমরা রপ্তানি করতে পারি না?
কে এ এস মুরশিদ: দেখুন, কৃষিপণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে আমরা তো সেসব পণ্যের মান নিশ্চিত করতে পারি না। চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম যুক্তরাজ্যে রপ্তানির খুব চেষ্টা করা হয়েছিল। ঠিক হয়েছিল যে আমাদের আম যুক্তরাজ্যের সুপারমার্কেটে বিক্রি হবে; সব উদ্যোগই নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু শেষমেশ সেটা সম্ভব হয়নি। কেন, জানেন?

প্রথম আলো: কেন?
কে এ এস মুরশিদ: কোনো রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার করা হয়নি, বাগান ঢেকে রাখা হয়েছে, সবকিছু ঠিকমতো করা হয়েছে। কিন্তু আমগাছগুলো মাটি থেকে যে পানি শুষে নেয়, সেই পানিই তো দূষিত, সেখানেই কেমিক্যাল আছে। এটা যুক্তরাজ্যে ধরা পড়েছে। ফলে আমাদের আম আর তারা নেয়নি। আমাদের মাটি, পানি, বাতাস যে মাত্রায় দূষিত হয়ে গেছে, তাতে সব ধরনের কৃষিপণ্যেই দূষিত উপাদান থাকবে। আলু রপ্তানির ক্ষেত্রেও এটা দেখা গেছে। সুতরাং এই মাত্রার দূষণযুক্ত কৃষিপণ্য দিয়ে আমাদের পক্ষে রপ্তানি বাজার পাওয়া কঠিন, বিশেষত ইউরোপ–আমেরিকায়। তবে একেবারেই যে অসম্ভব নয়, তা কিন্তু ব্র্যাক দেখিয়েছে।

প্রথম আলো: আমরা যখন খাদ্য নিয়ে কথা বলি, তখন মানুষ পর্যাপ্ত খাবার পাচ্ছে না, কখনো খাদ্যসংকট দেখা দিতে পারে কি না, এসব নিয়েই কথা বলি। খাদ্যনিরাপত্তা বলতে বোঝানোই হয় একজন মানুষের খাদ্যপ্রাপ্তির নিশ্চয়তা আছে কি না। কিন্তু মানুষ যে খাদ্য পাচ্ছে, তা তার স্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ কি না এবং সেই খাদ্য থেকে তার প্রয়োজনীয় পুষ্টির চাহিদা মিটছে কি না—এই বিষয় দুটো ‘খাদ্যনিরাপত্তা’র ভাবনাটির মধ্যে নেই। আপনার মন্তব্য কী?
কে এ এস মুরশিদ: আপনি ঠিকই বলেছেন। খাদ্য নিয়ে চিন্তাভাবনা, নীতি ও কর্মের ক্ষেত্রে এ পর্যন্ত খাদ্যপ্রাপ্তির ওপরেই প্রধান গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। আর প্রধান চিন্তা বা মনোযোগ চালের দিকেই। কারণ, চাল আমাদের প্রধান খাদ্য। এখন এই অবস্থান থেকে সরে আসার সময় হয়েছে। চালসংকটের বড় কোনো ঝুঁকি আমি দেখি না। খাদ্যবিষয়ক চিন্তাভাবনা, নীতি প্রণয়ন, প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ গ্রহণ ও কর্মকাণ্ড পরিচালনার ক্ষেত্রে আমি প্রধানত দুটি দিকে গুরুত্ব দিতে চাই। প্রথমত, ভাত খেয়ে বেঁচে থাকা, অর্থাৎ চালকেন্দ্রিক চিন্তার পরিবর্তন প্রয়োজন। খাদ্যের সঙ্গে সম্পর্ক পুষ্টির। সেই পুষ্টি শুধু চাল থেকে আসে না। বাংলাদেশের বিপুলসংখ্যক মানুষের মোট আমিষের চাহিদার সিংহভাগ পূরণ হয় চাল থেকে। কিন্তু চালের আমিষ সুষম আমিষ নয়; শাকসবজি, ডাল ইত্যাদি ভেষজ আমিষও পূর্ণাঙ্গ আমিষ নয়। দুধ, ডিম, মাছ, মাংস ইত্যাদি প্রাণিজ আমিষও প্রয়োজন। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছে প্রাণিজ আমিষ সহজলভ্য নয়।

প্রথম আলো: এ কারণেই কি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পুষ্টিগত অবস্থা ভালো নয়?
কে এ এস মুরশিদ: নিশ্চয়ই। প্রাণিজ আমিষের প্রাপ্তির সঙ্গে আর্থিক সামর্থ্যের সম্পর্ক নিবিড়। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর নারী ও শিশুদের দিকে বিশেষভাবে দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। বিশেষত শিশু ও মায়েরা যেন ভেষজ ও প্রাণিজ উভয় ধরনের আমিষ পায়, সেটা দেখতে হবে। শিশুদের পুষ্টির ওপর খুব বেশি গুরুত্ব দিতে চাই এ জন্য যে তারাই আমাদের ভবিষ্যৎ, কিন্তু তাদের পুষ্টিগত অবস্থা এখন যে পর্যায়ে আছে, তা গ্রহণযোগ্য নয়। এখনো খর্বকায় ও কৃশকায় শিশুর সংখ্যা অনেক বেশি। পুষ্টিহীন মায়ের সংখ্যাও অনেক বেশি। মা অপুষ্টিতে ভুগলে শিশু পুষ্টি পায় না। অনেক অগ্রগতি সত্ত্বেও আমাদের মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর হার এখনো অনেক বেশি। এই অবস্থার উত্তরণ ঘটাতে হবে, সে জন্য নারী ও শিশুদের খাদ্যমান ও পুষ্টির দিকে বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে।

প্রথম আলো: আপনার দৃষ্টিতে দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা কী?
কে এ এস মুরশিদ: সেটা হলো খাদ্যের স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তা। আমরা যেসব খাবার খাচ্ছি, আমাদের শিশুরা ও মায়েরা যেসব খাবার খাচ্ছে, সেগুলো কতটা নিরাপদ। আমি খাদ্যনিরাপত্তা বলতে শুধু খাদ্যপ্রাপ্তির নিশ্চয়তা বুঝি না, খাদ্য স্বাস্থ্যের জন্য কতটা নিরাপদ, সেটাও বুঝি। এ ক্ষেত্রে আমরা অত্যন্ত উদ্বেগজনক অবস্থায় আছি। আমাদের সব ধরনের খাদ্যে দূষিত ও ক্ষতিকর উপাদানের মাত্রা বিপজ্জনকভাবে বেড়ে গেছে। কৃষি উৎপাদন থেকে শুরু করে কৃষিপণ্য সংরক্ষণ, সরবরাহ ও বিপণন পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থের ব্যবহারের ফলে আমাদের সব খাদ্য দূষিত, অনিরাপদ ও ক্ষতিকর হয়ে পড়েছে।

প্রথম আলো: এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায় কী?
কে এ এস মুরশিদ: দেখুন, কৃষক বাজারে বিক্রি করার জন্য যে ফসল ফলান, সেই ফসলে কীটনাশক ইত্যাদি ব্যবহার করেন। কিন্তু যেটা তিনি নিজে খান, সেই ফসলে কীটনাশক দেন না। এ থেকে বুঝতে হবে, আমাদের বাজার নিজে থেকে এই গুরুতর সমস্যার সমাধানে এগিয়ে আসবে না। কারণ, বাজারের বা উৎপাদকের সেই প্রণোদনা নেই। প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় বা সরকারি হস্তক্ষেপ: নীতিনির্ধারণ থেকে শুরু করে বাজারে পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ পর্যন্ত অনেক কিছু করতে হবে।

প্রথম আলো: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
কে এ এস মুরশিদ: আপনাকেও ধন্যবাদ।