লিওনেল মেসির নতমস্তক—২০১৪ বিশ্বকাপের ফাইনালে শেষ বাঁশি বাজার পর আর্জেন্টাইন অধিনায়কের এই ছবিটি দেখার পর ফুটবলে পুরোনো সেই আলোচনাটা শুরু হয়েছে আবার। অনেকেই বলছেন মেসির বিশ্বকাপ না জেতাটা হবে ফুটবলের অবিচার। এমন অবিচার হয়েছিল আরও অনেকের সঙ্গেই—ইয়োহান ক্রুইফ, ইউসেবিও, ফেরেঙ্ক পুসকাস বা জিকো-সক্রেটিসরা আছেন এই দলে। কিন্তু আলফ্রেডো ডি স্টেফানো, জর্জ বেস্টদের সঙ্গে তো এর চেয়েও বড় অবিচার হয়েছে! সময়ের অন্যতম সেরা ফুটবলার হয়েও বিশ্বকাপ খেলা হয়নি তাঁদের–

কেউ কথা রাখে না! কথা রাখেননি জর্জ বেস্ট। কথা রাখেননি বিলি বিংহ্যামও। তাই নিজের সময়ের অন্যতম সেরা ফুটবলার হয়েও বিশ্বকাপ খেলা হয়নি বেস্টের।
‘ম্যারাডোনা ভালো,’ ‘পেলে আরও ভালো,’ কিন্তু ‘জর্জ হচ্ছে বেস্ট (সেরা)’—ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড যখন ইউরোপের ফুটবলের ছড়ি ঘোরাচ্ছে, ইংল্যান্ডের ফুটবলের রাজদণ্ড তাদের হাতে; দম্ভ ভরে এই ব্যানারটি টানানো হয়েছিল ‘লাল দুর্গ’ ওল্ড ট্রাফোর্ডে।

ইউনাইটেডের সমর্থকসহ অনেকেই মনে করতেন সেই সময়ে তাদের সেরা তারকা পেলে-ম্যারাডোনার চেয়েও বড় কেউ। তর্কসাপেক্ষে পেলের পর সর্বকালের দ্বিতীয় সেরা ফুটবলার তাঁকেই বলা হয়!

কিন্তু কী এমন কথা দিয়েছিলেন বেস্ট, যেটা তিনি রাখতে পারেননি আর সে কারণে খেলা হয়নি বিশ্বকাপও! ১৯৮২ সাল, বাছাইপর্বের চৌকাঠ পেরিয়ে বিশ্বকাপের মূলমঞ্চে জায়গা করে নিয়েছে নর্দান আয়ারল্যান্ড। তারও বছর আটেক আগে মূলধারার ফুটবল প্রায় ছেড়ে দিয়েছিলেন দলটির সর্বকালের সেরা ফুটবলার বেস্ট।

আরও পড়ুন

ডি স্টেফানো যেন রোমিও, বিশ্বকাপ জুলিয়েট

আন্তর্জাতিক ফুটবলকে বিদায় জানিয়েছেন তা-ও হয়ে গেছে প্রায় চার বছর। কিন্তু দেশের সর্বকালের সেরার ক্যারিয়ারের একটা অপূর্ণতা পূরণ করতে চেয়েছিলেন সেই সময়ের নর্দান আইরিশ কোচ বিংহ্যাম। বিরাশির বিশ্বকাপ দলে বেস্টকে রাখতে চেয়েছিলেন।

একটা শর্ত অবশ্য জুড়ে দিয়েছিলেন বিংহ্যাম। উত্তর আমেরিকার লিগের দল সান হোসে আর্থকোয়াক ছেড়ে তাঁকে কিছুদিনের জন্য ফিরতে হবে মূলধারার ফুটবলে। দলও ঠিক করে দিয়েছিলেন বিংহ্যাম—ইংল্যান্ডের মিডলসবরো। ফিরব বলেও শেষ পর্যন্ত আর ফেরেননি বেস্ট। বিংহ্যামকে দেওয়া কথা রাখেননি। বিংহ্যামও তাই বেস্টকে দেওয়া কথা আর রাখেননি।

বেস্ট কথা অবশ্য কাকে দেওয়া কথা কবে রেখেছেন! কথা বা প্রতিশ্রুতি মানুষ কেবল সামনাসামনি দাঁড়িয়ে মুখে মুখেই দেয়! কবিদের কথাই ধরুন, কথা দেন ছন্দে ছন্দে, কবিতার ভাষায়। গীতিকারের কথা দেন গানের কথায়। বেস্ট তো তাঁর জন্মভূমি বেলফাস্টের রাস্তায় কথা দিয়েছিলেন পায়ের ভাষায়, টেনিস বলের ছন্দে! বেলফাস্টের জীর্ণ রাস্তায় টেনিস বল পায়ে সমানে ড্রিবলিং করে বেড়াত ১৫ বছরের এক কিশোর।

সেই বালকের অমন ড্রিবলিং দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন ইউনাইটেড কোচ ম্যাট বুসবির এক স্কাউট। বুসবিকে তিনি ফোন করে বলেছিলেন, ‘আমি চরম এক প্রতিভা আবিষ্কার করেছি।’

জর্জ বেস্ট
ফাইল ছবি

সেই প্রতিভা বেস্টের পায়ের জাদুকরি ছন্দ তখন নর্দান আইরিশদের কথা দিয়েছিল, একদিন বিশ্বকাপ খেলবেন তিনি! ইউনাইটেডের সমর্থকদের কথা দিয়েছিল, অন্তত বছর বিশেক ইংল্যান্ডও ইউরোপের ফুটবলে তাদের দলকে সের করে রাখবেন!

আর পরে তাঁর পায়ের কারুকাজ ভক্তদের কথা দিয়েছিল, একদিন বেস্ট হবেন সর্বকালের সেরা! কিন্তু কোনো কথাই রাখেননি বেস্ট। না পেরেছেন নর্দান আইরিশদের বিশ্বকাপ-স্বপ্ন পূরণ করতে, না পেরেছেন নিজে বিশ্বকাপ খেলতে, অনেকে মনে করলেও না পেরেছেন পেলে বা ম্যারাডোনাকে ছাপিয়ে যেতে।

বেস্ট সেটা পারবেন কী করে! মাত্র ২৬ বছর বয়সেই যে মূলধারার ফুটবল থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন অমিত প্রতিভার অধিকারী এই ফুটবলার। এর আগে কী এক ইন্দ্রজালে মোহিত করে রেখেছিলেন ইউনাইটেডের সমর্থক তথা পুরো বিশ্বের ফুটবলপ্রেমিকদের।

১৫ বছর বয়সে ১৯৬১ সালে ইউনাইটেডের যুব দলে অভিষেক। মূল দলে সুযোগ পেতে লেগেছে মাত্র দুই বছর। ১৯৬৩ সালে প্রথম খেলেন ইউনাইটেডের মূল দলে। পরের মৌসুমেই ১৯ বছর বয়সী এক ফুটবল জাদুকরের পায়ের জাদুতে আট বছরের মধ্যে প্রথম ইংল্যান্ডের শীর্ষ লিগ জেতে ইউনাইটেড। এক মৌসুম পর আবার। ১৯৬৮ সালে দলকে ইউরোপিয়ান কাপ জেতাতে মূল ভূমিকাও রাখেন বেস্ট।

জর্জ বেস্ট ও রায়ান গিগস
ফাইল ছবি

ইউরোপিয়ান কাপে সেবারের ফাইনালে এক ‘পঞ্চম বিটলস’কে আবিষ্কার করে ফুটবল বিশ্ব। সেই ম্যাচে বেনফিকার মাঝমাঠ আর রক্ষণের খেলোয়াড়দের এমন নাচন নাচিয়েছিলেন যেমন নাচন সাধারণত সেই সময়ে বিটলসের (জন লেনন, জর্জ হ্যারিসন, রিঙ্গো স্টার ও পল ম্যাকবার্টনি; এই চারজনে মিলে ছিল বিটলস ব্যান্ড) গান শুনেই নাচতেন সংগীতপ্রেমীরা।

ষাটের দশকটা বেস্টের ক্যারিয়ারের যেমন সেরা সময় ছিল, সত্তরের দশকের শুরুটা ছিল ঠিক তেমনই বাজে। ১৫ বছরের যে বালকটি ১৯৬১ সালে ওল্ড ট্রাফোর্ডে পা রেখেছিলেন, যুবক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি হয়ে ওঠেন রমণীমোহন। বিশ্বসুন্দরী থেকে যেকোনো সুন্দরী নারীকেই নিজের প্রেমের জালে ফাঁসাতে পটু হয়ে ওঠেন বেস্ট। একই সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠে অ্যালকোহলের সঙ্গে, যেটি পরে তাঁর অকালমৃত্যুরও কারণ ছিল।

নারী আর অ্যালকোহল—কত সাম্র্যাজ্যের পতনের কারণ! অমীয় প্রতিভাবান ফুটবলার জর্জ বেস্ট তো নস্যি! ধীরে ধীরে বেস্ট ফুটবল থেকে দূরে সরে যেতে থাকেন। নারী আর অ্যালকোহলই হয়ে ওঠে তাঁর প্রিয়। আর প্রিয়ের কাছে জলাঞ্জলি হয়েছে বেস্টের ফুটবল প্রতিভা, ইউনাইটেডের মতো ক্লাবে খেলা ও বিশ্বকাপ!

ব্যালন ডি’অরজয়ী একমাত্র আফ্রিকান ফুটবলার উইয়াহ এখন লাইবেরিয়ার প্রেসিডেন্ট
ফাইল ছবি

ম্যাট বুসবির পর ইউনাইটেডের কোচ হয়ে টমি ডোকার্টি। বেস্টের এসব উচ্ছৃঙ্খলা মোটেই পছন্দ ছিল না তাঁর। ১৯৭৪ সালে একবার পরপর দুদিন সময় মতো অনুশীলনে যেতে পারেননি বেস্ট। ডোকার্টির মনে হয়েছিল, বেস্ট নিশ্চয়ই আগের রাতে দ্রাক্ষারস আর নারীসঙ্গে ডুবে ছিলেন। পরের ম্যাচে তাঁকে বেঞ্চে বসিয়ে রাখেন। কিন্তু পরে অনেকবারই অনেক সাক্ষাৎকারে বেস্ট বলেছিলেন, ডোকার্টি ভুল ধারণা করেছিলেন। তবে তিনি যতই ভুল করে থাকেন, অভিমানী বেস্ট সেই অভিমানে ইউনাইটেড তো ছেড়েই যান, একই সঙ্গে ছাড়েন মূলধারার ফুটবলও।

কিন্তু বেস্টের বিশ্বকাপ খেলতে না পারার কারণ শুধুই কি ওই নারী আর অ্যালকোহলের সঙ্গ? এসবে ডুব দেওয়ার আগেই তো নর্দান আয়ারল্যান্ডকে বিশ্বকাপে তোলার চেষ্টা করেছেন তিনি, ক্যারিয়ার যখন তাঁর মধ্যগগনে। ১৯৬৬ বিশ্বকাপের বাছাইপর্বের কথাই ধরুন, হল্যান্ড (তখনো তারা শক্তিধর হয়ে ওঠেনি), শখের ফুটবল খেলা সুইজারল্যান্ড আর পুঁচকে আলবেনিয়ার গ্রুপে পড়েছিল তারা। শেষ ম্যাচে আলবেনিয়ার বিপক্ষে জিতলেই চলত। কিন্তু সতীর্থদের একের পর এক গোল মিসের মহড়ায় বেস্টের নর্দান আয়ারল্যান্ড ম্যাচটি ড্র করল ১-১ গোলে! ব্যস, বেস্টদের পেছনে ফেলে বিশ্বকাপের টিকিট পেল সুইসরা!

চার বছর পরও সেই একই করুণ কাহিনি। তুরস্কের বিপক্ষে টানা দুই জয়ে বাছাইপর্ব শুরু করেন বেস্টরা। কিন্তু সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপক্ষে একটি ড্র, আরেকটি ম্যাচ হেরে বিশ্বকাপ-স্বপ্ন শেষ তাদের। আসলে ফুটবল ১১ জনের খেলা, এখানে শুধু একজন ভালো খেললে কি হয়! বেস্টও বহুবার বলেছেন এমন কথা—নর্দান আয়ারল্যান্ডে তো তাঁর পাশে ইউনাইটেডের মতো একজন ববি চার্লটন বা নবি স্টাইলস ছিলেন না!

তাহলে উপসংহারে কী বলবেন? ভুল সময়ে ভুল জায়গায় জন্ম হয়েছিল একজন মহান ফুটবলারের! এ কারণেই খেলা হয়নি বিশ্বকাপ! নাকি নারী আর অ্যালকোহলের সঙ্গে সখ্য গড়ে না উঠলে ১৯৮২ সালেও হয়তো খেলতে পারতেন স্বপ্নের বিশ্বকাপে!
ভুল জায়গায় জন্ম তাঁদেরও তিনি এখন লাইবেরিয়ার প্রেসিডেন্ট।

জর্জ উইয়াহ: ছিলেন ফুটবলার, এখন লাইবেরিয়ার প্রেসিডেন্ট
ফাইল ছবি

কিন্তু দেশের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়েও একটি আক্ষেপ জর্জ উইয়াহ ভুলতে পেরেছেন? সময়ের অন্যতম সেরা ফুটবলার হয়েও বিশ্বকাপ খেলা হয়নি তাঁর! ভুল জায়গায় জন্ম নেওয়ার কারণেই তো সেটা হয়নি, তা-ই না? খেলোয়াড়ি জীবনে আফ্রিকার গণ্ডি পেরিয়ে তিনি প্রবেশ করেছিলেন ইউরোপের ফুটবলে। খেলেছেন ফ্রান্সের ক্লাব পিএসজি ও ইতালির একসময়ের পরাশক্তি এসি মিলানের হয়ে। একটি ফরাসি লিগ ওয়ান আর দুটি ইতালিয়ান সিরি ‘আ’ শিরোপা জিতেছেন। চেলসির হয়ে জিতেছেন এফএ কাপ। কিন্তু বিশ্বকাপে খেলা হয়নি উইয়াহর। সে তো তিনি ফুটবলের ‘পুঁচকে’ দলের হয়ে খেলার কারণেই!

১৯৯০ ও ২০০২ সালে উইয়াহর লাইবেরিয়া বিশ্বকাপের মূলমঞ্চের খুব কাছে গিয়েছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত অধরাই থেকে গেছে বিশ্বকাপ নামের সোনার হরিণ! ১৯৯০ বিশ্বকাপে ২ পয়েন্টের জন্য আফ্রিকা অঞ্চলের বাছাইপর্বের দ্বিতীয় রাউন্ড পেরিয়ে ফাইনাল রাউন্ডে যেতে পারেননি। আর ২০০২ সালে এক পয়েন্টের জন্য পেরোতে পারেনি ফাইনাল রাউন্ডের বৈতরণি!

‘পুঁচকে’ দলের এমন আরেকজন মহাতারকা আবেদি আইয়ু। আফ্রিকার ফুটবলে এই মহাতারকা তো নামই পেয়ে গিয়েছিলেন আবেদি পেলে বা আফ্রিকার পেলে। কিন্তু আসল পেলে ব্রাজিলের মহাতারকা তিনটি বিশ্বকাপ জিতলেও আবেদি পেলের একটি বিশ্বকাপই খেলা হয়নি। ১৯৮২ সালে ঘানাকে আফ্রিকান নেশনস কাপ জেতালেও বিশ্ব ফুটবলে তাঁর নামডাক ছড়িয়ে পড়ে নব্বইয়ের দশকে, ফ্রান্সের ক্লাব মার্শেইয়ের হয়ে খেলার সময়। ফরাসি দলটিকে তিনি দুটি ফরাসি লিগ ওয়ান শিরোপার সঙ্গে জিতিয়েছেন ১৯৯৩ সালের চ্যাম্পিয়নস লিগ।

ডেনিস ল, ববি চার্লটন ও জর্জ বেস্ট
ফাইল ছবি

তিনবারের আফ্রিকার বর্ষসেরা এই ফুটবলারের ক্যারিয়ারে তবু আক্ষেপ রয়ে গেছে—একটি বিশ্বকাপ যে খেলা হলো না! আবেদি পেলের দেশ ঘানা তিনটি বিশ্বকাপ খেলেছে। তিনটিই তাঁর অবসরের পর। আবেদি পেলে আন্তর্জাতিক ফুটবলকে বিদায় জানিয়েছেন ১৯৯৮ সালে। আর ঘানা বিশ্বকাপ খেলেছে ২০০৬, ২০১০ ও ২০১৪ সালে।
তাহলে কী বলবেন—ভুল সময়ে ভুল জায়গায় জন্ম নিয়েছিলেন আবেদি পেলের মতো একজন মহান ফুটবলার। যে কারণে কপালে জোটেনি বিশ্বকাপ খেলা!