নায়ক যখন খলনায়ক!

ক্ষোভে টিভি-সেট ভাঙছেন ভারতীয় সমর্থকেরা। ফাইল ছবি
ক্ষোভে টিভি-সেট ভাঙছেন ভারতীয় সমর্থকেরা। ফাইল ছবি

দুদিন আগেও যদি ভারতীয় সমর্থকদের মধ্যে জরিপ করা হতো, এ মুহূর্তে ভারতের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলোয়াড় কে? উত্তরে সবার ওপরে থাকত বিরাট কোহলির নাম। একের পর এক সেঞ্চুরি আর রান-বন্যায় রেকর্ড বই ওলট-পালট করে দিয়েছেন যিনি, তুমুল জনপ্রিয় তিনি হবেন সেটাই স্বাভাবিক। অথচ এই মুহূর্তে অমন জরিপ চালালে কী উত্তর মিলবে, সেটা নিশ্চয়ই অনুমিতই।

সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে (এমসিজি) অস্ট্রেলিয়ার কাছে শোচনীয় পরাজয়ের পর ভারতীয় সমর্থকদের কাছে রীতিমতো খলনায়কে পরিণত হয়েছেন কোহলি। দলের ব্যর্থতায় সবচেয়ে বড় কোপটা পড়েছে ভারতীয় ব্যাটিং সেনসেশনের ওপরই। শুধু তা-ই নয়, এ ব্যর্থতার দায়ভার চাপানো হচ্ছে তাঁর প্রেমিকা আনুশকা শর্মার ওপরও। যে কোহলিকে দুদিন আগেও মাথায় করে নেচেছেন সমর্থকেরা, তারাই কিনা তাঁকে আছড়ে ফেলেছেন মাটিতে!

দর্শক-সমর্থকদের এমন নির্মম রূপ আর কবে দেখেছেন কোহলি? কদিন আগে যখন এক ভারতীয় সাংবাদিককে গালিগালাজ করে সংবাদমাধ্যমে সমালোচনার বিষয়বস্তু হয়েছিলেন, তখন নাকি বেশ গর্বের সঙ্গেই বলেছিলেন, ‘আমার সঙ্গে দর্শক-সমর্থকেরা আছেন’! অথচ সেই দর্শক-সমর্থকেরা এখন তাঁর মুণ্ডুপাত করছেন! পুরো বিশ্বকাপে খুব যে ভালো খেলেছেন, তা নয়। এক পাকিস্তানের বিপক্ষে সেঞ্চুরি বাদে আর বলার মতো ইনিংস নেই। বিশেষ করে সেমিফাইনালে তাঁর কাণ্ডজ্ঞানহীন শট খেলে উইকেট ছুড়ে আসা কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না দর্শকেরা। কোহলি ভালোভাবেই টের পাচ্ছেন, একজন নন্দিত তারকা কীভাবে খলনায়কে পরিণত হন! বুঝতে পারছেন, দর্শকদের ক্ষোভের আগুন কতটা যন্ত্রণাদায়ক!


কোহলি অবশ্য সান্ত্বনা খুঁজতে পারেন পূর্বসূরিদের কাছেই। সুনীল গাভাস্কারের মতো কিংবদন্তিও নিস্তার পাননি দর্শকের ক্ষোভ থেকে। ১৯৮৩ সালের ডিসেম্বরে কলকাতার ইডেন গার্ডেনে দর্শকদের ক্ষোভের মুখে পড়েছিলেন। গালিগালাজ তো ছিলই, ছিল নানা কুরুচিকর মন্তব্যও। দর্শকদের সেই ক্ষোভের আগুনের আঁচ থেকে রেহাই মেলেনি তাঁর স্ত্রী মার্শেনিলেরও। গাভাস্কার তো সেবার রেগেমেগে ঘোষণাই দিয়েছিলেন, ‘আর খেলবই না এ মাঠে’!
২০০৭ বিশ্বকাপে প্রথম পর্বে ছিটকে যাওয়ায় ঢিল পড়েছিল মহেন্দ্র সিং ধোনির বাড়িতে। নানা কটূক্তি শুনতে হয়েছিল শচীন টেন্ডুলকার, রাহুল দ্রাবিড়দের মতো খেলোয়াড়দেরও। তখন টেন্ডুলকার-পুত্র অর্জুনকে নাকি তার এক স্কুলবন্ধু বলেই বসেছিল, ভারতীয় দলের বাজে অবস্থার জন্য তার বাবা দায়ী! এ মন্তব্য সহ্য করতে পারেনি অর্জুন। জবাবে ওই বন্ধুকে ঘুষি মেরে বসেছিল টেন্ডুলকার-পুত্র! ব্যর্থ হলে ঘরের মাঠ ওয়াংখেড়েতে পর্যন্ত টেন্ডুলকারের বিরুদ্ধে দুয়ো উঠেছে। অথচ ২০১১ বিশ্বকাপ জেতার পরই সেই ওয়াংখেড়েতেই ভালোবাসার পুষ্পবৃষ্টিতে ভেসেছেন লিটল জিনিয়াস।

গত বছর, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ফাইনালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে হারের পর ঢিল পড়েছিল ২০১১ বিশ্বকাপে টুর্নামেন্ট সেরা যুবরাজের সিংয়ের বাড়িতেও। এবারও খেলোয়াড়দের নিরাপত্তার ব্যাপারটি বেশ গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে প্রশাসন। এরই মধ্যে খবর এসেছে, ম্যাচের পরও রাঁচিতে ধোনির বাড়িতে জোরদার করা হয়েছে নিরাপত্তা।

দর্শকদের ক্ষোভের আগুন থেকে রেহাই পাননি বর্তমান ভারতীয় দলের পরিচালক রবি শাস্ত্রী, সাবেক অধিনায়ক আজহার উদ্দিনের মতো অনেক খেলোয়াড়ই। দর্শকদের তোপের মুখে পড়ার ঘটনা নিয়ে একটা কৌতুকও তো বেশ পরিচিত। ব্যর্থতার পর এক ভারতীয় খেলোয়াড় ছদ্মবেশে গিয়েছেন বাজার করতে। সেখানে তাঁকে চিনে ফেলল একজন। কীভাবে চিনল? কারণ, তিনিও যে ক্রিকেটার!

শুধু ভারতেই নয়। একই অবস্থা পাকিস্তানেও। ওয়াসিম আকরাম, ওয়াকার ইউনিস, শহীদ আফ্রিদিদের বাড়িতে কতবার ঢিল পড়ল, ঠিক আছে! এবারও খেলোয়াড়দের দেশে ফেরার সময় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছিল বিমানবন্দরে। তা ছাড়া গ্রুপ পর্বে ভারতের কাছে হার ও কোয়ার্টার ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে বিদায়ের পরই কুশপুত্তলিকা পোড়ানো তো ছিলই, সঙ্গে প্রতীকী শেষকৃত্যও করেছে ক্ষুব্ধ দর্শকেরা!

উপমহাদেশে ব্যতিক্রম শ্রীলঙ্কার দর্শকেরা। আবেগ থাকলেও ভীষণ বাস্তববাদী তারা। দলের ব্যর্থতায় খেলোয়াড়রা দর্শকদের ক্ষোভের আগুনে পড়েছেন, এমন দৃষ্টান্ত বিরল। বাংলাদেশের দর্শকেরা অবশ্য দলের ব্যর্থতায় সমালোচনার চাবুক ছোটালেও কখনো খেলোয়াড়দের আক্রান্ত করেননি। এ ক্ষেত্রে ভারত-পাকিস্তানের তুলনায় নিঃসন্দেহে এগিয়ে রাখা যায় বাংলাদেশি দর্শকদের।