নির্মাণশ্রমিকের কাজ করে যুব গেমসের দ্রুততম মানব পায় ৪৫০ টাকা
গেমসের সব কটি ইভেন্ট শেষে ততক্ষণে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে বনানী আর্মি স্টেডিয়ামে। কণ্ঠশিল্পীদের সুরের মূর্ছনায় গেমসের খেলোয়াড়েরাও নাচতে শুরু করেছে। কিন্তু হন্তদন্ত হয়ে ছুটতে ছুটতে মিডিয়া সেলের কাছে এল নাইম শেখ। একটু আগেই যুব গেমসের দ্রুততম মানব হয়েছে খুলনার এই স্প্রিন্টার। গেমসের পদক পেলেও সার্টিফিকেট তখনো হাতে পায়নি।
মিডিয়া সেলে এসে বারবার বলতে লাগল, ‘স্যার আমার আসল নাম ইকরামুল হোসেন। আমাকে ডাকনাম নাইম শেখ দিয়েই গেমসে নিবন্ধন করা হয়েছে বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থা থেকে।’ সার্টিফিকেটে সঠিক নামটি লেখার জন্য অনুরোধ করছিল ইকরামুল।
ইলেকট্রনিকস টাইমিংয়ে ইকরামুল ১০.৮০ সেকেন্ড সময় দৌড়ে জিতেছে সোনা। কতটা কাঠখড় পুড়িয়ে এখানে আসতে হয়েছে, সেই গল্পটা বলছিল ইকরামুল, ‘আমি খুবই দরিদ্র পরিবারের ছেলে। নিয়মিত দৌড়ের অনুশীলনের জন্য অনেক পুষ্টিকর খাবার লাগে। মাসে অন্তত ১৫ হাজার টাকা প্রয়োজন। কিন্তু আমার মা এসব জোগাড় করতে পারেন না।’
নিজের অনুশীলনের খরচ জোগাতে খুলনা শহরে নির্মাণশ্রমিকের কাজ করতে হয় ইকরামুলকে। সোনা জয়ের পর আক্ষেপ করে ইকরামুল বলছিল, ‘মাঝেমধ্যে মনে হয় খেলাধুলা ছেড়ে দিই। ট্রেনিং করলে পর্যাপ্ত খাবার খাওয়া লাগে। কিন্তু আমি সেই পুষ্টিকর খাবার জোগাড় করতে পারি না। অনেক সময় তিন বেলা খাবারও জোগাড় করতে পারি না। এভাবে চলা যায় না। রাজমিস্ত্রির জোগালির কাজ করে প্রতিদিন পাই ৪৫০ টাকা। এভাবে মাসে কিছুদিন কাজ করলে হাতখরচ উঠে যায় আমার।’
প্রায় ১২ বছর আগে বাবাকে হারিয়েছে ইকরামুল। ভারতে যাওয়ার কথা বলে সেই যে বাড়ি ছেড়েছিলেন ইকরামুলের বাবা, আজও বাড়ি ফেরেননি। বাবা বেঁচে আছে নাকি মারা গেছেন, সেই তথ্যও অজানা। বাবার প্রসঙ্গ উঠতেই চোখে পানি চলে আসে ইকরামুলের, ‘অনেকের বাবা অনেক কিছু কিনে দেয়। আমারও তখন ইচ্ছা করে বাবার হাত থেকে উপহার নিতে। বাবার কথা খুব মনে পড়ে আমার।’
যুব গেমসে খেলতে আসার আগে খুলনা বিএল কলেজের একজন শিক্ষকের কাছ থেকে এক হাজার টাকা নিয়ে কেডস কিনেছে ইকরামুল। এটাই এখন অনুশীলনের ভরসা। ২০১৭ সালে জাতীয় স্কুল ও মাদ্রাসা ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় ১০০, ২০০ ও ৪০০ মিটারে এবং রিলেতে সোনা জিতেছিল সে। ওই বছর মোহাম্মদপুর শারীরিক শিক্ষা কলেজ মাঠে শুধু ক্রেস্ট পেয়েছিল পুরস্কার হিসেবে। কিন্তু কোনো অর্থ পুরস্কার পায়নি বলে আফসোস তার।
চার বোন ও দুই ভাইয়ের বড় পরিবার ইকরামুলদের। বড় ভাই মুঠোফোনে টাকা রিচার্জের দোকান চালিয়ে কোনোরকমে সংসার চালান। বোনদের বিয়ে হয়ে গেছে। ইকরামুল ভাইয়ের কাছ থেকে অল্প কিছু খরচ নেয়। কিন্তু স্প্রিন্টার ইকরামুল সার্ভিসেস সংস্থায় চাকরির আশায় দিন গুনছে, ‘আমার যদি একটা চাকরি হতো তাহলে আরও ভালোভাবে অনুশীলন করতে পারতাম। অনেকে আগ্রহ দেখায়। কিন্তু যাওয়ার পর বলে আমার উচ্চতা কম। আমার চেয়েও অনেক খাটো অ্যাথলেট চাকরি করছে বিভিন্ন সংস্থায়। আমারও যদি এমন একটা চাকরি জুটত।’
বাংলাদেশে প্রতিভার মূল্যায়ন হওয়ার নজির খুব বেশি নয়। কে জানে হয়তো পরবর্তী যুব গেমস শুরু হলে হারিয়েই যাবে স্প্রিন্টার ইকরামুল!