তালেবানের ভয় কাটাতে পারছেন না রশিদ–নাভিন

আফগানিস্তানের লেগ স্পিনার রশিদ খানফাইল ছবি: এএফপি

বন্দুকের গুলির আওয়াজ—আফগানিস্তানে নতুন কিছু নয়। তালেবান এখন দেশটির ক্ষমতায়, বন্দুক, গুলি, বিস্ফোরণ—এসব আরও সয়ে আসার কথা।

এর মধ্যে অন্যরকম এক আওয়াজ ভেসে আসছে কাবুল স্টেডিয়াম থেকে—ব্যাট–বলে সংঘর্ষ। ঠাস! ঠাস! জাতীয় দল প্রস্তুতি নিচ্ছে পরবর্তী সফরের।

মৃত্যুপুরীর মতো নীরব কাবুল স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল অনুশীলনের শব্দ। প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি পলাতক, বেশ কয়েক দিন হয়ে গেল ক্ষমতা দখল করেছে তালেবান।

কাবুল স্টেডিয়াম থেকে কয়েক কিলোমিটার উত্তরে কাবুল বিমানবন্দরের দৃশ্যটা সম্পূর্ণ আলাদা। দেশ ছাড়তে মানুষ সেখানে মরিয়া। বিমানে ওঠার চেষ্টা করছেন হাজারো মানুষ। হুড়োহুড়িতে মৃত্যু হয়েছে আরও কিছু মানুষের।

তালেবান ক্ষমতা দখলের পর আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে এটা আফগানিস্তানের সবচেয়ে পরিচিত দৃশ্য।

ক্রিকেট–পাগল দেশটির জাতীয় দলের কিছু খেলোয়াড়ও নিজেদের কাজে মনোযোগ দিতে পারছেন না নতুন এই রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে। ‘ভয়টা ওদের চোখেমুখে স্পষ্ট। কথায় এমনকি খুদে বার্তায়ও বোঝা যায়’—জাতীয় দল সতীর্থদের নিয়ে বিবিসি রেডিওতে সাক্ষাৎকারে কথা বলেন আফগানিস্তান পেসার নাভিন–উল–হক। তাঁর ওয়ানডে ও টি–টোয়েন্টি অভিষেক বাংলাদেশের বিপক্ষে।

ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লিগে (সিপিএল) খেলতে এখন ওয়েস্ট ইন্ডিজে রয়েছেন নাভিন–উল–হক। সেখান থেকেই বললেন, ‘কোনো ক্রীড়াবিদের সমস্যা হবে না বলে জানিয়েছে তালেবান। কিন্তু কিছু তো বলা যায় না!’

আসলে এটাই মূল পরিস্থিতি—কী হয় তা তো বলা যায় না! তালেবান দেশটির ক্ষমতা পুনর্দখলের পর এটাই দেশটির সাধারণ মানুষের মনের শঙ্কা। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তালেবান শাসনে প্রথম মেয়াদের দুঃসহ স্মৃতি তো অনেকেই ভুলতে পারেননি। বেশির ভাগ খেলা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।

সবার সামনে সাধারণ মানুষকে হত্যা করতে স্টেডিয়ামগুলো ব্যবহার করা হতো। খেলাধুলার বিষয়টি তালেবান শাসকগোষ্ঠী কঠোর হাতে নিয়ন্ত্রণ করত এবং শুধু ছেলেরাই খেলাধুলার সুযোগ পেয়েছে।

ক্রিকেট নিয়ে তালেবান শাসকগোষ্ঠীর কোনো সমস্যা নেই। খেলাটা জন্ম ইংল্যান্ডে হলেও তালেবান যোদ্ধাদের কাছে তা জনপ্রিয়। কিন্তু ক্রিকেটারদের কাছে বর্তমান পরিস্থিতির গুরুত্ব সম্পূর্ণ ভিন্ন।

এই খেলার চেয়ে দেশের শাসনক্ষমতা তালেবানের নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়া বেশি ভাবাচ্ছে তাঁদের। কাবুলের পতনের কয়েক দিন আগে টুইট করেছিলেন আফগানিস্তান ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক মোহাম্মদ নবী, ‘বিশ্বনেতাদের কাছে অনুরোধ করছি, আফগানিস্তানকে আবারও অস্থিতিশীল হতে দেবেন না। আপনাদের সমর্থন প্রয়োজন। আমরা শান্তি চাই।’

একুশ শতক শুরুর আগেও ক্রিকেট সেভাবে জনপ্রিয় ছিল না আফগানিস্তানে। পাকিস্তানে আশ্রয় নেওয়া আফগান শরণার্থীদের কাছে খেলাটা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। তাঁদের সঙ্গে দেশে ফেরার সঙ্গে ক্রিকেটের শিকড়ও প্রোথিত হয় আফগানিস্তানে। এরপর ধীরে ধীরে আন্তর্জাতিক ময়দানে উঠে আসে আফগানিস্তান ক্রিকেট দল।

আফগানিস্তানের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর এক হওয়ার পেছনেও বড় ভূমিকা রয়েছে ক্রিকেটের। ‘ইতিবাচক খবর খুঁজতে চাইলে, সেখানকার সবাইকে খুশি দেখতে চাই—সেটা শুধু ক্রিকেটই পারে। আফগানিস্তানে এটা এতটাই গুরুত্বপূর্ণ। আফগানিস্তানের মানুষের কাছে খেলার চেয়েও বেশি কিছু এটা’—বিবিসিকে বলেন নাভিন–উল–হক।

তালেবান যোদ্ধারা ১৫ আগস্ট কাবুল দখল করে। আফগানিস্তান অলরাউন্ডার সামিউল্লাহ শেনওয়ারি এদিন টুইট করেন, ‘আফগানরা যেদিন তাদের দেশ হারাল, আর বিশ্ব তাকিয়ে দেখল।’

এই পরিস্থিতির মধ্যে আফগান জাতীয় দলের ক্রিকেটাররাও দুশ্চিন্তায় রয়েছেন তাঁদের পরিবার নিয়ে। জাতীয় দলের কিছু ক্রিকেটার পরিবার দেশে রেখে খেলার জন্য বাইরে রয়েছেন। এর মধ্যে দেশ তালেবান শাসনের অধীনে চলে আসায় পরিবার নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়াই স্বাভাবিক। রশিদ খানের পরিবার যেমন দেশ ছাড়তে পারেনি। এই তারকা লেগ স্পিনার নিজের দুশ্চিন্তার কথা জানিয়েছেন সাবেক ইংল্যান্ড ব্যাটসম্যান কেভিন পিটারসেনের কাছে, ‘আমরা এ নিয়ে দীর্ঘ আলাপ করেছি। সে দুশ্চিন্তায় রয়েছে পরিবার নিয়ে।’

তবে ইতিবাচক খবরও আছে। গতকাল নতুন সভাপতির ছবি পোস্ট করে আফগানিস্তান ক্রিকেট বোর্ড। সবকিছু যে আগের মতোই রয়েছে, তা বুঝিয়ে দিয়েছে তারা। পাকিস্তানের বিপক্ষে আসন্ন সিরিজও হওয়ার সম্ভাবনা জেগেছে। কিন্তু আফগানিস্তানে কোনো বাণিজ্যিক ফ্লাইট ওঠা–নামা করছে না। বোর্ডের এক অফিশিয়ালের কাছ থেকে সংবাদমাধ্যম জেনেছে, জাতীয় দল সড়কপথে পাকিস্তান গিয়ে সেখান থেকে বিমানে উঠবে।

কিন্তু নাভিন–উল–হকের মতো অনেক ক্রিকেটারই দুশ্চিন্তায় রয়েছেন দেশ নিয়ে। কিছুক্ষণের জন্য হয়তো খেলায় মনোযোগ দিতে পারছেন কিন্তু ঘুরেফিরে তালেবানের শাসনক্ষমতা নেওয়ার বিষয়টিই ঘুরপাক খাচ্ছে তাদের মনে। ‘এক–দুই মিনিটের জন্য হয়তো ভুলে থাকা যায়। কিন্তু ঘুরেফিরে আবারও ভাবনাটা ফিরে আসে। ক্রিকেটে কতটা মনোযোগ দিতে পারব বলতে পারছি না, কারণ দেশের এই পরিস্থিতি হলে তা সম্ভব হয় না’—বলেন নাভিন–উল–হক।