‘শুভাকাঙ্ক্ষী’ থেকে আবার ‘নাগিন ডার্বি’তে বাংলাদেশ

এশিয়া কাপের সুপার ফোরে উঠেছে বাংলাদেশ দলএএফপি

এশিয়া কাপে বাংলাদেশ দলের সুপার ফোরে ওঠা দেখে কারও সামাজিক ড্রামানির্ভর অ্যাকশন সিনেমার মতো মনে হতে পারে। প্রবল পুরোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা ভুলে এক ম্যাচের জন্য বাংলাদেশ দলের শ্রীলঙ্কার ‘শুভাকাঙ্ক্ষী’ হয়ে ওঠা, দুই দলের ম্যাচেও টান টান ‘ত্রিমুখী’ উত্তেজনা এবং মর্মান্তিক এক ঘটনা শেষে একে অন্যের পাশে দাঁড়ানো।

‘ত্রিমুখী’ কথাটা ভেঙে বলা প্রয়োজন। ‘বি’ গ্রুপ থেকে সুপার ফোরে ওঠার সমীকরণ আটকে ছিল তিনটি দলের মধ্যে—শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তান। পরশুর ওই এক ম্যাচেই সব হিসাব চূড়ান্ত হয়ে গেছে। আবুধাবির শ্রীলঙ্কা–আফগানিস্তান ম্যাচকে ‘ত্রিমুখী’ লড়াই বললে তাই বাড়িয়ে বলা হয় না।

সামাজিক অ্যাকশন–ড্রামা সিনেমাগুলো লড়াই, সহমর্মিতা, সহযোগিতা এবং কখনো কখনো শত্রুতার মোড়কে এগোয়। পরশুর ম্যাচের হিসাবটাও একটু অন্যভাবে ভেবে দেখুন—সুপার ফোরে উঠতে বাংলাদেশ অপেক্ষায় ছিল শ্রীলঙ্কার জয়ের। সেই শ্রীলঙ্কা যাদের সঙ্গে বাংলাদেশের ম্যাচের অপর নাম এখন ‘নাগিন ডার্বি’। এমন নামকরণের পেছনে থাকা পুরোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং কিছু কিছু সময়ে দুই পক্ষের অযাচিত ‘শত্রুতা’র কথাও সবার জানা। কিন্তু জীবন আমাদের যেমন কখনো কখনো চরম শত্রুরও মুখাপেক্ষী হতে শেখায়, ক্রিকেটও তেমনি বাংলাদেশকে এমন বাস্তবতাই শেখাল এশিয়া কাপের এই ম্যাচে।

শ্রীলঙ্কা অলরাউন্ডার দাসুন শানাকা
এএফপি

মজার বিষয়, আফগানিস্তানের মুখোমুখি হওয়ার আগে শ্রীলঙ্কার অলরাউন্ডার দাসুন শানাকা ভরসা দিয়েছিলেন বাংলাদেশের সমর্থকদের। সেই শানাকা, ২০২২ এশিয়া কাপে যিনি বাংলাদেশকে আফগানিস্তানের চেয়ে সহজ প্রতিপক্ষ বলেছিলেন। সাকিব আল হাসান ও মোস্তাফিজুর রহমান ছাড়া বাংলাদেশ দলে কোনো বিশ্বমানের বোলার না দেখার কথা বলে ‘নাগিন ডার্বি’র ইতিহাসে ঘৃতাহুতি দিয়েছিলেন শানাকা। কিন্তু ক্রিকেট কী রসিক, তিন বছর পর আরেকটি এশিয়া কাপেই আফগানিস্তান ম্যাচের আগে শানাকার মুখ দিয়ে বের হলো, ‘বাংলাদেশের সমর্থকেরা আমাদের জয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। আমরাও আফগানিস্তানকে হারাতে চাই।’

আরও পড়ুন

শানাকা ক্রিকেটীয় দৃষ্টিকোণ থেকে কথাটা বললেও বাংলাদেশের সমর্থকদের জন্য তা অন্য অর্থে ভরসাই ছিল। তিনটি দলের মধ্যে শ্রীলঙ্কা ক্রিকেটীয় ঐতিহ্যে কুলীন। বাংলাদেশের সঙ্গে আফগানিস্তানের প্রতিদ্বন্দ্বিতা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে কে দ্রুত পায়ের তলায় মাটি শক্ত করতে পারে তা নিয়ে। সাম্প্রতিক সময়ের পারফরম্যান্সে ইঙ্গিত ছিল আফগানিস্তান কিছুটা এগিয়ে, যদিও বাংলাদেশ এই আঙিনায় বয়সে তাদের চেয়ে ‘সিনিয়র সিটিজেন’। কিন্তু শুধু বয়স বাড়লেই তো হয় না, সামর্থ্যও দেখাতে হয়। সেখানেই খানিকটা খাটো হয়ে এশিয়া কাপে বাংলাদেশ দাঁড়িয়ে ছিল খাদের কিনারে। আর (আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের তুলনায়) ‘জুনিয়র সিটিজেন’ আফগানিস্তানের ভাগ্যটা ছিল তাদের নিজেদের হাতেই।

বাংলাদেশ ও আফগানিস্তানের মধ্যে দ্বৈরথও পুরোনো
প্রথম আলো

পরশুর ম্যাচে বাংলাদেশ তাই শ্রীলঙ্কার অদৃশ্য গ্যালারিতে বসে প্রতিপক্ষ হয়ে গেল আফগানদের। এশিয়া কাপের ‘জমিনে’ টিকে থাকা নিয়ে যাদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় একটু কোণঠাসা ছিল বাংলাদেশ। সেই ‘জমিনে’ একটু শক্তিশালী প্রতিবেশী পুরোনো ‘শত্রুতা’ ভুলে ‘সহযোগিতা’র হাত বাড়িয়ে দেওয়ায় পায়ের তলায় মাটি পেল বাংলাদেশ। পরশু আফগানিস্তানের ১৬৯ তাড়া করতে নেমে ১০১ রান করলেই সুপার ফোর নিশ্চিত হতো শ্রীলঙ্কার। সেই পথটা পেরিয়ে আসার পর না জিতলেও চলতো তাদের। অবশ্যই নিজেদের ক্রিকেটীয় গৌরব ধরে রাখতে জয়ের জন্যই খেলেছে শ্রীলঙ্কা। কিন্তু অন্য অর্থে সেটা যে বাংলাদেশের জন্য ‘সহযোগিতা’—তা কি অস্বীকার করা যায়?

আরও পড়ুন

শ্রীলঙ্কা জিতলেও এই ম্যাচ শেষে পৃথিবীর সবচেয়ে দুঃখী মানুষ তাদের স্পিনার দুনিত ভেল্লালাগে। আফগানিস্তানের ইনিংসের শেষ ওভারে ভেল্লালাগে পাঁচ ছক্কাসহ মোট ৩২ রান দিলেন। বাংলাদেশের দর্শকেরা তখন নিশ্চয়ই তাঁকে শাপ–শাপান্ত করেছেন। কেউ কেউ হয়তো ষড়যন্ত্র–তত্ত্বও খুঁজে পেয়েছিলেন। সিনেমায় যেমন হয় আর কী!

যেকোনো একটি চরিত্রকে লোকে ভুল বোঝে। তাঁকে অনেক কষ্ট সইতে হয়। শ্রীলঙ্কার জয়ের পর ভেল্লালাগের মুখে হাসি ফোটার কথা। কিন্তু কাল তাঁর অংশটুকু ছিল ‘ট্র্যাজিক’। জয়ের পরপরই জানতে পারেন তিনি মাঠে থাকাকালীন তাঁর বাবা মারা গেছেন।

মর্মান্তিক ঘটনায় সিনেমায় সবাই যেমন এক হয়ে যায়, তেমনি ভেল্লালাগের বাবার খবরটা ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে যেন অবসান ঘটে সব প্রতিদ্বন্দ্বিতার। যে মোহাম্মদ নবী ভেল্লালাগেকে পাঁচ ছক্কা মেরে আফগানিস্তানকে জেতাতে চেয়েছিলেন, খবরটা শুনে তিনি প্রায় স্তব্ধ হয়ে যান। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁর হতবাক চাহনির ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে।

আরও পড়ুন

নবীও সেই একই প্ল্যাটফর্মে ভেল্লালাগের পাশে দাঁড়িয়ে লিখেছেন, ‘শক্ত থাকো ভাই।’ বাংলাদেশের লিটন দাস, তাওহিদ হৃদয়রাও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করে ভেল্লালাগের পাশে দাঁড়িয়েছেন। ‘আমি তোমার বাবার মতোই তোমার পাশে থাকব’ বলে পাশে দাঁড়িয়েছেন শ্রীলঙ্কার কোচ সনাৎ জয়াসুরিয়াও।

শেষের গ্রুপ ছবিতে যখন সবাই পাশাপাশি দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন, তখন জনাথন ট্রটই বা আর বাইরে থাকেন কেন! সুপার ফোরে ওঠায় বাংলাদেশকে শুভেচ্ছা জানিয়ে আফগানিস্তান কোচ বলেছেন, ‘পুরো কৃতিত্ব বাংলাদেশের, শ্রীলঙ্কার সঙ্গে তারাও উঠল (সুপার ফোরে)।’

ট্রটের কথার মধ্যে থাকা তাড়াটা কি ধরতে পারল বাংলাদেশ? তার মানে বাংলাদেশের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা ভুলে শ্রীলঙ্কাকে ‘শুভাকাঙ্ক্ষী’ ভাবার সময়টা শেষ। সুপার ফোরে আজই তো আবার সেই ‘নাগিন ডার্বি’।