২০০৭ সালের ১৮ মার্চ পৃথিবী ছেড়ে গিয়েছিলেন ক্রিকেটের প্রথম ‘ল্যাপটপ কোচ’ হিসেবে খ্যাত বব উলমার। মৃত্যবার্ষিকীতে তাঁকে নিয়ে স্মৃতিচারণা উৎপল শুভ্রর।
বব উলমারের মৃত্যুসংবাদটা কখন, কোথায়, কীভাবে পেয়েছিলাম, এখনো তা স্পষ্ট মনে করতে পারি। সেই মৃত্যু এত আলোচিত যে কাউকেই বোধ হয় এটা মনে করিয়ে দেওয়ার দরকার নেই, উলমার মারা গিয়েছিলেন ২০০৭ বিশ্বকাপের সময়। উলমারের জীবনের অজানা শেষ অধ্যায়টা জ্যামাইকার কিংস্টনে। বিশ্বকাপ কাভার করতে যাওয়া আমি তখন ত্রিনিদাদের পোর্ট অব স্পেনে।
পোর্ট অব স্পেনে বাংলাদেশের বেশির ভাগ সাংবাদিকের ঠিকানা ছিল পাহাড়ের ওপর এক হোটেল। নাম অ্যালিসিয়া প্যালেস। যদিও মোটেই ‘প্যালেস’ জাতীয় কিছু নয়, নেহাতই মাঝারি মানের এক হোটেল। তবে সেই হোটেলে সুন্দর একটা জায়গা ছিল। খোলা চাতালমতো সেই জায়গাটায় চেয়ার-টেবিল বসানো। বেশির ভাগ সময় ওখানে বসেই লিখতাম। সেই সকালেও লিখতে লিখতেই খবরটা পেয়েছিলাম। আগের দিন বাংলাদেশ ভারতকে হারিয়ে বিশ্বকাপে মহা হইচই ফেলে দিয়েছে। সেই বীরত্বগাথা লিখছি। গায়ে ফুরফুরে হাওয়া লাগছে। বইছে মনেও। হঠাৎই বাংলাদেশের এক বন্ধু সাংবাদিক এসে ভয়াবহ দুঃসংবাদটা দিল। বব উলমার নাকি মারা গেছেন!
প্রথমে একটু বিরক্তই হয়েছিলাম, এটা আবার কেমন ফাজলামি! ফাজলামি যে নয়, ইন্টারনেটে সার্চ দিতেই তা পরিষ্কার হয়ে গেল। দুই দিন আগে যেখানে বসে মানজারুল ইসলাম রানার মৃত্যুসংবাদ পেয়েছিলাম, উলমারের চলে যাওয়ার খবরটাও পেলাম সেখানে বসেই। রানার চিরবিদায় কাঁদিয়েছিল আর হতভম্ব করে দিয়েছিল উলমারেরটা। রানা তো শুধুই বাংলাদেশের। তাঁর অকালমৃত্যুর শোক ছুঁয়েছিল শুধুই বাংলাদেশের খেলোয়াড়–সাংবাদিকদের। যেখানে বব উলমার বিশ্বজনীন। তাঁর মৃত্যু বিশ্বকাপ তো বটেই, বিশ্ব ক্রিকেটকেই তাই ঢেকে দিয়েছিল শোকের চাদরে।
সেই বিশ্বকাপেই একঝলক দেখা হয়েছে। মন্টিগো বেতে বিশ্বকাপ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আগের দিন। সেই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পরে জ্যামাইকায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ–পাকিস্তান উদ্বোধনী ম্যাচ কাভার করে বাংলাদেশ দলের পিছু পিছু আমি চলে গেছি ত্রিনিদাদে। সেখানে ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশের ওই হৃদয় উথালপাথাল করে দেওয়া জয়ের পরই জানলাম, এদিন আপসেট এই একটাই হয়নি। জ্যামাইকাতে পাকিস্তানকে হারিয়ে দিয়েছে আয়ারল্যান্ড। এর পরদিনই কিনা পাকিস্তানের কোচ উলমারের এভাবে চলে যাওয়ার খবর!
আগের দিনের আপসেট আর পাকিস্তান ক্রিকেটের ফিক্সিংয়ের ইতিহাস মিলিয়ে উলমারের মৃত্যু শুধু শোক হয়ে থাকেনি, তা নিয়ে শুরু হয়েছিল তুমুল বিতর্ক। কিংস্টনের পেগাসাস হোটেলের ৩৭৪ নম্বর রুমের বাথরুমে উলমারের মরদেহ আবিষ্কার করেছিলেন হোটেলের এক পরিচারিকা। স্বাভাবিক মৃত্যু, নাকি তাতে অন্য কারও ভূমিকা ছিল—স্বাভাবিকভাবেই এই প্রশ্নটা উঠে যায়। পাকিস্তান দলকে একরকম হোটেলে আটকে রেখে জেরা করা হয় খেলোয়াড়দের অনেককেই। পরের কয়েক দিন খেলা ছাপিয়ে বিশ্বকাপে সবচেয়ে আলোচিত হয়ে উঠেছিল উলমারের মৃত্যুরহস্য। বিশ্বকাপ শেষ হয়ে যাওয়ার পরও যা শেষ হয়নি। পুলিশ তো প্রথম দিন থেকেই দৃশ্যপটে, পরে তা গড়ায় আদালত পর্যন্তও। সুনির্দিষ্টভাবে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে না পারায় শেষ পর্যন্ত ধরে নেওয়া হয়, স্বাভাবিক মৃত্যুই হয়েছে উলমারের। কারণ সম্ভবত হার্ট অ্যাটাক।
এসব তো পরের কথা। অন্য মাধ্যম থেকে যা জেনেছি। তাঁর মৃত্যুসংবাদ পাওয়ার পর তাৎক্ষণিক অনুভূতির কথা তো আগেই একটু বলেছি। কখনো দেখা না হলে, কথা না হলেও অমন মৃত্যু বিমূঢ় করে দেওয়ার মতো। আর উলমারের সঙ্গে তো আমার অনেক স্মৃতি। সেসব মিলেমিশে একটা কোলাজ হয়ে যাচ্ছিল। মনে পড়ছিল প্রথম দেখার কথা। সেটিও একটি বিশ্বকাপে। ১৯৯৬ বিশ্বকাপ। উলমার তখন দক্ষিণ আফ্রিকা দলের কোচ। করাচি শহর থেকে অনেক দূরের ডিফেন্স স্টেডিয়ামে প্র্যাকটিস করছে দক্ষিণ আফ্রিকা। জীবনে প্রথম পাকিস্তানে গেছি। করাচি শহর থেকে অনেক দূরের সেই ডিফেন্স স্টেডিয়াম খুঁজে পেতে জীবন বেরিয়ে যাওয়ার দশা। তারপরও গেছি, কারণ উলমারের দক্ষিণ আফ্রিকা সেই বিশ্বকাপের হট ফেবারিট। গিয়ে দেখি, প্র্যাকটিসের চেয়ে মজাই বেশি হচ্ছে। সেটির বিচিত্র সব উপায়ও বের করে নিচ্ছেন দক্ষিণ আফ্রিকান ক্রিকেটাররা। ফাস্ট বোলাররা অগ্রণী ভূমিকায়। নেটে বোলিং করছেন আর পেছন থেকে টান দিয়ে একে অন্যের শর্টস নামিয়ে দিচ্ছেন। বোলিংয়ের মতো এ কাজেও নেতা অ্যালান ডোনাল্ড। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটাররা তখনো আমার কাছে দূর আকাশের তারা। সেই ‘তারা’দের এমন ছেলেমানুষিতে বড় মজা পেয়েছিলাম। বব উলমার মজা পাচ্ছিলেন আমার চেয়েও বেশি। তাঁর আনন্দ দেখে মনে হচ্ছিল, তিনিও এই খেলায় নেমে পড়তে চান। নেহাত কোচ বলে পারছেন না!
প্র্যাকটিস শেষ হয় হয়, এমন সময়ে ভীরু পায়ে তাঁর কাছে গিয়ে পরিচয় দিলাম। তাঁর হাস্যমুখ আর অনেক দিনের পরিচিতের মতো ব্যবহার মুহূর্তেই ঘুচিয়ে দিল জড়তা। সেদিন টুকটাক কথাবার্তাই হয়েছিল। ইন্টারভিউ করতে চেয়েছিলাম। হোটেলে ফেরার সময় হয়ে গেছে বলে পরে কোনো একসময় তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিদায় নিয়েছিলেন। সেই বিশ্বকাপে আর সময়-সুযোগ মেলেনি।
কাঙ্ক্ষিত সেই ইন্টারভিউটা হলো পরের বিশ্বকাপে। লিডসের হেডিংলিতে পরদিন অস্ট্রেলিয়া-দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচ। আমি যখন মাঠে পৌঁছেছি, দক্ষিণ আফ্রিকার ট্রেনিং প্রায় শেষ। মাঠে আছেন শুধু চারজন। এক কোণে জন্টি রোডস আর হার্শেল গিবস ফিল্ডিং প্র্যাকটিস করছেন। যা দেখে বুঝে ফেলেছি, মাঠে তাঁরা কীভাবে এমন অবিশ্বাস্য ফিল্ডিং করেন। মাঠের মাঝখানে সেই বিশ্বকাপের সেনসেশন ল্যান্স ক্লুজনারকে নিয়ে আলাদা ব্যাটিং প্র্যাকটিস করাচ্ছেন বব উলমার। অভিনব প্র্যাকটিস। উলমার কোমর-উচ্চতায় বল ছুড়ছেন আর ক্লুজনার ব্যাটটাকে গদা বানিয়ে সেগুলোকে উড়িয়ে ফেলছেন গ্যালারিতে। সেই বিশ্বকাপে ক্লুজনার যে ম্যাচের পর ম্যাচ বোলারদের আতঙ্কের প্রতিশব্দ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন, তা তো আর এমনি এমনি নয়।
ক্লুজনার-পর্ব শেষ করে মাঠ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় ধরলাম উলমারকে। ইন্টারভিউর কথা বলতেই রাজি। মাঠে দাঁড়িয়েই অনেকক্ষণ কথা বললেন। ক্রিকেটের সঙ্গে এত দিন জড়িয়ে থাকার পরও খেলাটা নিয়ে এমন আবেগভরে কথা বলতে আমি খুব কম লোককেই দেখেছি। আরেকটা জিনিসও মনে খুব দাগ কেটেছিল। ক্রিকেটের ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে গভীর বোধ। আবার যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে দখিন দুয়ারও খোলা। বলেছিলেন তাঁর স্বপ্নের কথাও। একটা একাডেমি করতে চান, যেখানে নিজের সব আইডিয়ার মেলবন্ধন ঘটানো যাবে। নতুন নতুন চিন্তার খেলোয়াড়েরা সব আসবেন ওখানে। রিভার্স সুইপ, ওভার দ্য টপ মারার নতুন কৌশল, ইন সুইং-আউট সুইং নিয়ে নতুন নতুন এক্সপেরিমেন্ট হবে।
এই নতুন নতুন চিন্তাই তাঁকে বাকি কোচদের চেয়ে আলাদা করে দিয়েছিল। এখন তো ল্যাপটপ ছাড়া কোনো ক্রিকেট কোচ এক দিনও কাজ করার কথা ভাবতেই পারবেন না। এখন স্বাভাবিক এই ব্যাপারটাই উলমার যখন প্রথম শুরু করেছিলেন, সেটি ছিল রীতিমতো বিপ্লব। তাঁর নামই হয়ে গিয়েছিল ‘ল্যাপটপ কোচ’। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৪ পর্যন্ত ইংলিশ কাউন্টি দল ওয়ারউইকশায়ারের কোচ হিসেবে ওয়ানডে খেলার ধরনই বদলে দেন অনেকটা। ক্রিকেট রোমান্টিক হয়েও যে কোনো এক্সপেরিমেন্টে ছিল চরম উৎসাহ। এ কারণেই উলমারের নেটে নিয়মিত রিভার্স সুইপের অনুশীলন হতো। এখন হয়তো আপনি বলবেন, ‘এ আর এমন কী!’ বললে আমি সময়টা মনে করিয়ে দেব। যখন রিভার্স সুইপ ক্রিকেটের রুটিন শটের তালিকায় ঢুকে পড়েনি। ১৯৯৯ বিশ্বকাপে হানসি ক্রনিয়েকে মাঠে কানে ইয়ারপিস দিয়ে নামিয়ে দিয়ে হইচই ফেলে দেওয়াও ওই উদ্ভাবনী চিন্তার প্রকাশ। উলমারের যুক্তি ছিল পরিষ্কার, খেলা চলাকালীন অধিনায়কের সঙ্গে কোচের যোগাযোগ থাকলে সমস্যা কী! আইনে তো কোনো নিষেধ নেই।
উলমার-ক্রনিয়ের ওই ঘটনার পর থেকে ‘নিষেধ’ থাকল। সেই বিশ্বকাপের আগে আগে একটা ম্যাগাজিনে ২০১০ সালের ক্রিকেট কেমন হবে, এর একটি কাল্পনিক বর্ণনা দিয়েছিলেন বব উলমার। ম্যাগাজিনটা হারিয়ে গেছে বলে সব মনে নেই। তবে এটা মনে আছে, তাতে ছিল বিচিত্র সব উদ্ভাবনী চিন্তার প্রকাশ। ব্যাট করতে নামার আগে প্র্যাকটিস করার জন্য ড্রেসিংরুমের পাশেই উইকেট থাকার সুপারিশের কথা মনে পড়ছে। আর মনে আছে নতুন শতকে উলমারের কল্পিত ব্যাটসম্যানের ছবিটা। নভোচারীর মতো পোশাক, কানে মাইক্রোফোন, হাতের ব্যাটটাও অন্য রকম। যা নিয়ে জিজ্ঞেস করায় বলেছিলেন, ‘এমনই যে হবে, আমি তা বলছি না। তবে এটা বলতে চাই, ক্রিকেটকে বেঁচে থাকতে হলে নতুন নতুন চিন্তা করতেই হবে।’ ইংল্যান্ডের পক্ষে ১৯টি টেস্ট খেলেছেন, ৬টি ওয়ানডে। টেস্টে ৩টি সেঞ্চুরিও আছে। তবে ক্রিকেটার বব উলমারের পরিচয় অনেকটাই ঢাকা পড়ে গিয়েছিল কোচ বব উলমারের আড়ালে।
লিখতে লিখতে হিসাব করে দেখছি, ১৯৯৬ থেকে ২০০৭ টানা চারটি বিশ্বকাপে উলমারের সঙ্গে দেখা হয়েছে। ২০০৩ বিশ্বকাপে এক দিনই। ডারবানে কানাডার বিপক্ষে বাংলাদেশের ম্যাচ। কিংসমিড স্টেডিয়ামে কাছাকাছি যেতেই দেখি, সামনে হেঁটে যাচ্ছেন উলমার। হাসতে হাসতে বললেন, ‘আজ কিন্তু আমি কানাডার পক্ষে।’ সেটিই স্বাভাবিক ছিল। সহযোগী সদস্য তিন দেশকে ওই বিশ্বকাপের জন্য প্রস্তুত করার দায়িত্ব ছিল উলমারের ওপর। সেই দায়িত্ব যে খুব ভালোভাবে পালন করেছেন, সেটির প্রমাণ তো কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই পেয়েছিলাম!
উলমার ম্যাচটা দেখেছিলেন প্রেসবক্সে বসে। বলেছিলেন, সুযোগ পেলে বাংলাদেশে যেতে চান। বাংলাদেশের কোচ হলে তিনি কী করতেন—এ প্রশ্নের উত্তর দিতে রাজি হননি। ‘আমি তো বাংলাদেশ সম্পর্কে কিছুই জানি না। গিয়ে দেখলে হয়তো বলতে পারতাম।’ বাংলাদেশে এসেছিলেন শেষ পর্যন্ত। নতুন সব চিন্তার কথা বলে যথারীতি অবাক করে দিয়েছিলেন বাংলাদেশের কোচ-খেলোয়াড়দের।
১৯৯৯ বিশ্বকাপের পর উলমারের সঙ্গে আবারও লম্বা সময় কথা বলার সুযোগ এসেছিল ২০০৬ সালে ভারত–পাকিস্তান সিরিজের সময়। ওই সিরিজের প্রায় দুই বছর আগে থেকেই বব উলমার পাকিস্তান দলের কোচ। ওই সিরিজের সময় তাঁর দুটি কথা আলাদাভাবে মনে আছে। বীরেন্দর শেবাগের ব্যতিক্রমী ব্যাটিং নিয়ে বলেছিলেন, ‘এমসিসির কোচিং ম্যানুয়াল নতুন করে লেখার সময় এসেছে।’ লাহোর টেস্টে হরভজন সিংয়ের এক ওভারের প্রথম চার বলেই শহীদ আফ্রিদির ছক্কা দেখার পর তাঁকে দিয়েছিলেন বিশাল এক স্বীকৃতি। জীবনে এত ব্যাটসম্যান দেখেছেন, শহীদ আফ্রিদির মতো হার্ডহিটার আর দেখেননি। আফ্রিদি তাঁর সহজাত খেলাটা খেলতে পেরেছিলেন বব উলমার তাঁকে সেই স্বাধীনতা দিয়েছিলেন বলেই। আত্মজীবনীতে আফ্রিদি যা কৃতজ্ঞতাভরে স্মরণ করেছেন।
কোচ হিসেবে যাঁদের সংস্পর্শে এসেছেন, সবার মনই এমন কোনো না কোনোভাবে ছুঁয়ে গেছেন বব উলমার। হোটেল রুমে তাঁর অমন নিঃসঙ্গ মৃত্যুটা তাই অমন সর্বজনীন শোক হয়ে এত মানুষকে কাঁদিয়েছিল। বছর ঘুরে যখন ওই দিনটা ফিরে আসে, তখনো হয়তো উলমারের স্মৃতি কারও না কারও চোখ ভিজিয়ে তোলে।