সরফরাজের হাতে দেশের হয়ে অভিষেকের টুপি, বাবার চোখে জল

টেস্ট অভিষেকের টুপি মাথায় সরফরাজ, কাঁদছেন বাবাএএফপি

ক্রিকেট শুধু খেলা নয়। এই কথায় যাঁরা বিশ্বাস করেন, হয়তো তাঁদের জন্যই আজকের সকাল। হয়তো তাঁদের জন্যই রাজকোট টেস্ট শুরুর আগের কয়েক ঘণ্টা। ছেলে দেশের হয়ে আন্তর্জাতিক অভিষেকের টুপি নিচ্ছেন, পাশে কাঁদছেন বাবা। অভিষিক্ত সেই ক্রিকেটারের স্ত্রীর চোখও জলে টলমল। বাবা শার্টে মুখ গুঁজে কান্না লুকানোর চেষ্টা করলেন। নিষ্ফল প্রয়াস!

আবেগের স্রোত যে বাধ মানছিল না। ছেলের হাতে ভারতের হয়ে টেস্ট অভিষেকের টুপিটা দেখার পর বাবাও আর আবেগ সংবরণের চেষ্টা করেননি। ছেলের আগেই নিজে গিয়ে অভিষেকের টুপিতে চুমু খেলেন। অথচ লোকের কথা হলো, ক্রিকেট শুধুই একটা খেলা!

রাজকোট টেস্টে ভারতের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষিক্ত সরফরাজ খানকে ঘিরে আজ এমন দৃশ্যের অবতারণা হয়েছিল। সরফরাজের লড়াইয়ের কথা কে না জানে! কে না জানে, দিনের পর দিন ঘরোয়ায় পারফর্ম করার পরও শুধু অপেক্ষায় সান্ত্বনা পেতে হয়েছে এই ব্যাটসম্যানকে। সরফরাজের বাবা নওশাদ খানের লড়াইয়ের কথাও অনেকেই জানেন। শুধু বাবা–ছেলে নন, সরফরাজের পুরো পরিবারেরই তো আজ অপেক্ষার অবসান হলো!

নওশাদ খানের লড়াইয়ের একটি চিত্র ফুটে উঠেছে ভারতের সংবাদকর্মী ভরত সুন্দারেসানের ‘এক্স’ পোস্টে। মাঠে বাবা-ছেলের এমন আবেগঘন দৃশ্য দেখে তিনি লিখেছেন, ‘আপনি যদি ২০১০ সাল থেকে মুম্বাইয়ের ক্রিকেট কাভার করে থাকেন, আপনি নিশ্চিতভাবেই নওশাদ খানের আতিথেয়তার সঙ্গে পরিচিত। সরফরাজ খানের ভারতের হয়ে খেলা নিশ্চিত করতে যে পরিমাণ ত্যাগ তিনি ও তাঁর পরিবার করেছে, সে গল্প শুনেছেন। এই টেস্ট অভিষেক ছেলে ও তাঁর ত্যাগী পিতার।’

দলে যখন সরফরাজ ডাক পাচ্ছিলেন না, তখন সব সময়ই প্রতিবাদ করেছেন ভারতের সাবেক অলরাউন্ডার ইরফান পাঠান। সরফরাজ এবার ডাক পাওয়ার পর এক্স–এ লিখেছেন, ‘ঘরোয়া ক্রিকেটের উইকেটে অগণিত ঘণ্টা পার করা থেকে জাতীয় দলে ডাক পাওয়া, সরফরাজ ও তার পরিবারের স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। ভারত দলে প্রথমবার ডাক পাওয়ায় তোমাকে অভিনন্দন।’

আরও পড়ুন

সরফরাজের বাবা নওশাদের সোয়েটারের পেছনের লেখাতেও তাঁর লড়াইয়ের সারমর্ম খুঁজে পাওয়া যায়। সেখানে যা লেখা, তার বাংলা অর্থ—ক্রিকেট শুধু ভদ্রলোকের খেলা নয়, সবার খেলা। মোটাদাগে ‘জেন্টলম্যান’ কথাটা কেটে দেওয়া। ঘরোয়া ক্রিকেটে একবার শতক করে নির্বাচকদের প্রতি আক্রমণাত্মক অঙ্গভঙ্গি করেছিলেন সরফরাজ। সেটি পারফর্ম করার পরও দলে ডাক না পাওয়ার জন্য। কে জানে, হয়তো সেই ঘটনার জন্যই ওই কথাটা কি না!

তবে সরফরাজ ভারতের জাতীয় দলে কেন ডাক পান না, তা নিয়ে অনেক দিন ধরেই সরব ছিলেন সাবেক ক্রিকেটাররা। গত বছর অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে সরফরাজ জাতীয় দলে ডাক না পাওয়ার পর ভারতের সাবেক ক্রিকেটার ও বিশ্লেষক আকাশ চোপড়া নিজের ইউটিউব চ্যানেলে বলেছিলেন, ‘সরফরাজের নামটা টেস্ট দলে নেই। সে ভাবতেই পারে, তার সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে। তার দলে থাকা উচিত ছিল।’

সরফরাজের ফিটনেস নিয়েও কথা উঠেছিল। জবাব দিয়েছিলেন ভারতেরই কিংবদন্তি সুনীল গাভাস্কার। গত বছর জানুয়ারিতে বলেছিলেন, ‘তোমরা যদি ছিপছিপে খেলোয়াড়দের (দলে) নিতে চাও, তাহলে ফ্যাশন শোতে যাও।’

আরও পড়ুন

২০০৯ সালে মাত্র ১২ বছর বয়সে ভারতের হ্যারিস শিল্ড আন্তস্কুল টুর্নামেন্টে ৪৩৯ রানের ইনিংস খেলে আলোচনায় আসেন সরফরাজ। ভারতের ঘরোয়া ক্রিকেটে ২০১৯ সাল থেকে অবিশ্বাস্য পারফর্মও করছেন। ২০১৯-২০ ও ২০২১-২০২২ টানা দুই মৌসুমে রঞ্জি ট্রফিতে তিনি করেছেন ৯০০-এর বেশি রান। ঘরোয়া ক্রিকেটে ৬৬ ইনিংসে তাঁর গড় ৬৯.৮৫, যা ক্রিকেটের ইতিহাসেই চতুর্থ সর্বোচ্চ। সর্বোচ্চ গড় ৯৫.১৪ স্যার ডন ব্রাডম্যানের।

‘ক্রিকেট শুধু ভদ্রলোকের খেলা নয়, সবার খেলা’
এক্স

২০২০ সালের পর প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে সরফরাজ ২০০০-এর বেশি রান করেছেন, গড় ৮২.৪৬। এ সময়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে এমন গড়ে এত রান বিশ্বের আর কোনো ক্রিকেটার করতে পারেননি। সরফরাজ তাই সেই ২০২০ সাল থেকেই জাতীয় দলে ডাক পাওয়া প্রহর গুনছিলেন। এমনকি গত বছরের জানুয়ারিতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্ট সিরিজের দলে তাঁর আগে বিবেচিত হয়েছেন টি-টোয়েন্টি সেনসেশন সূর্যকুমার যাদব।

বাবার সঙ্গে দুই ভাই সরফরাজ খান (বাঁয়ে) ও মুশির খান (ডানে)
এক্স

সরফরাজের অপেক্ষার প্রহর শেষ হয়েছে। কিন্তু তাঁর বাবা নওশাদ খানের শেষ হয়নি। ক্রিকেটার ছেলে যে আছেন আরও একজন। বাবা নিশ্চয়ই একটি ছেলেকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে পারেন না! আর সেই ছেলেও যদি হয় পারফর্মার, তাহলে তো কথাই নেই। সম্প্রতি শেষ হওয়া অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপে খেলেছেন মুশির খান। ৭ ম্যাচে তিনি ৬০ গড়ে রান করেছেন ৩৬০, যা টুর্নামেন্টে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। এখন তিনি কবে জাতীয় দলের হয়ে খেলবেন, নওশাদের সেই অপেক্ষার পালাও শুরু হলো!

রাজকোট টেস্টের প্রথম দিনে এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত ৩ উইকেটে ৯৩ রান তুলে প্রথম সেশনের খেলা শেষ করেছে ভারত।

আরও পড়ুন