যেখানে অসহায় ক্রিকেটারদের রুটি–রুজি, হার মানে ক্রিকেট
মিরপুরে বিসিবির কার্যালয়ের দোতলার একেবারে পূর্ব প্রান্তে ক্রিকেট কমিটি অব ঢাকা মেট্রোপলিস (সিসিডিএম) কার্যালয়। নিচে ফার্নিচারের দোকান, সারাক্ষণই সেখানে ভিড়ভাট্টা আর কোলাহল। ওপরে চার রুমের সিসিডিএম কার্যালয় প্রায় সারা বছরই ফাঁকা পড়ে থাকে। দু–একজন আসেন, সেটাও গল্পে–আড্ডা মেতে উঠতে।
সেই নীরব–নিস্তব্ধ সিসিডিএম অফিসই প্রতিবছর ব্যস্ত হয়ে ওঠে দলবদলের সময়। দেশের নানা প্রান্ত থেকে ক্রিকেটাররা আসেন, তাঁদের বেশির ভাগের মুখেই লেপ্টে থাকে চওড়া হাসি। কারও প্রথমবার ঢাকার লিগে খেলার আনন্দ, কারও মোটা অঙ্কের চুক্তিতে বছরজুড়ে চলার মতো উপার্জনের তৃপ্তি।
গত দুই দিন সিসিডিএম কার্যালয়ে ছিল ঘরোয়া মৌসুম শুরুর আগের সেই আবহ। তবে ক্রিকেটারদের পদচারণে যতটা মুখর হয়ে থাকার কথা ছিল সিসিডিএম কার্যালয়, তা হয়নি। প্রথম বিভাগ ক্রিকেটের খেলোয়াড়েরা দলবদল করলেও তাঁদের মধ্যে ছিল না সেই রোমাঞ্চ।
কেউ বারান্দায় পায়চারি করছেন, কেউ মলিন মুখে গিয়ে সারছেন দলবদলের আনুষ্ঠানিকতা। যতসংখ্যক ক্রিকেটার আসার কথা ছিল, আসেননি। কারণ, বিসিবির সঙ্গে দ্বন্দ্বে প্রথম বিভাগ লিগের ২০টি ক্লাবের মধ্যে ৮টি ক্লাবই এবার খেলবে না। তাতে অনিশ্চিত হয়ে গেছে ১২০ ক্রিকেটারের ভবিষ্যৎ।
তেমনই একজন আশিক উজ জামান। প্রথম বিভাগ লিগের গত আসরে খেলেছেন ওয়ারিয়েন্ট ক্লাবে। সেই ক্লাব এবার দলবদলেই অংশ নিচ্ছে না। বিসিবির বারান্দায় তাঁকে উদ্দেশ্যহীন পায়চারি করতে দেখে এই প্রতিবেদক প্রশ্ন করেন, ‘ক্লাব এখনো ঠিক হয়নি?’ দুশ্চিন্তায় ঢেকে থাকা মুখে আশিক কেবল বললেন এটুকুই, ‘নাহ…।’
অনিশ্চয়তা সঙ্গী করেই ৬০০ টাকা খরচ করে তিনি দলবদলের জন্য টোকেন তুলে রেখেছেন নিজের খরচে। যদি কেউ পরে দলে নিতে চায়, তখন যেন সুযোগ থাকে—এটাই আশা।
তাঁর সঙ্গে দু–চার বাক্যের কথোপকথনের সময়েই মনে পড়ল মাসখানেক আগের একটা দৃশ্য। ঢাকা লিগের বিভিন্ন ক্লাবের অনেক কর্মকর্তা বসে আছেন সংবাদ সম্মেলনের মঞ্চে। তাঁদের মুখে বিসিবির ‘পাতানো’ নির্বাচন না মানার কথা ছিল। প্রায় সব বক্তার কথারই সারাংশ করা গেছে দুটি শব্দে, ‘ক্রিকেটের স্বার্থ’। এটা করুন, ক্রিকেটের স্বার্থে; ওটা করুন, ক্রিকেটের স্বার্থে। অথচ সেদিনই কিনা তাঁরা ঘোষণা দিলেন ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় ‘স্বার্থ’ মাঠের ক্রিকেট বন্ধ করে দেওয়ার!
ক্ষমতার লড়াইয়ে হেরে গিয়ে ক্লাব কর্মকর্তারা ক্রিকেটকেই সেদিন হারিয়ে দিতে চাইছিলেন যেন। যে সিদ্ধান্তে শেষ পর্যন্ত অটল থেকেই প্রথম বিভাগ ক্রিকেটে ৮টি ক্লাব দলবদলে অংশ নেয়নি। ‘ক্রিকেটের স্বার্থ’ দেখাদের এমন সিদ্ধান্তে অনিশ্চিত হয়ে গেছে অনেক ক্রিকেটারেরই ভবিষ্যৎ।
ঢাকার ক্লাব কর্তারা বরাবরই বিশ্বাস করেন, তাঁদের ছাড়া ক্রিকেট অচল। সেই ক্ষমতার জোর দেখাতেই না খেলে দেশের ক্রিকেটকে ‘অচল’ করার সিদ্ধান্ত। তারা তো এ–ও বলেন, ‘আমরা যদি টাকা না ঢালতাম, তাহলে তো (আমিনুল ইসলাম) বুলবুল ক্রিকেটারই হতে পারত না, সভাপতি তো বহুদূর…!’
আবার বিসিবির কর্মকর্তাদের ‘ইগো’ও বিদ্রোহীপক্ষের চেয়ে কম নয়। না খেলার হুমকি দেওয়া চিঠির জবাব বিসিবি তাই দিয়ে দেয় কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই। তাতে সমঝোতার পথ নয়, বরং থাকে হুমকি—না খেললে তোমাদের অবনমিত করে দেব! অভিভাবকের কাজ যে সমঝোতার পথ দেখানো, তা এই বোর্ডও উপলব্ধি করতে পারেনি। মজার ব্যাপার হলো, ক্লাব কর্মকর্তা কিন্তু এই পক্ষেও আছে।
শেষ পর্যন্ত ‘ক্রিকেটের স্বার্থ’ দেখা এসব ক্লাব কর্মকর্তাদের ‘ইগো’র লড়াইয়ের কাছে অসহায় হয়ে পড়ল ক্রিকেটারদের রুটি–রুজি, হার মানল ক্রিকেট।