১
তিনটি প্রশ্ন দিয়ে শুরু করি। ধরে নিন, কুইজের প্রশ্ন—
আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে সেরা বোলিংয়ের রেকর্ডটা কার? দ্রুততম সেঞ্চুরির? ম্যাচে সবচেয়ে ইকোনমিক্যাল বোলিংয়ের?
কী বলছেন, তিনটি প্রশ্নের উত্তরই আপনার জানা! যদি তা-ই হয়ে থাকে, তাহলে আপনাকে হাজারো সেলাম। কেন, সালাম কেন? কারণ, এই তিনটি প্রশ্নের উত্তর দেওয়া খুবই কঠিন। কেন, কঠিন কেন?
এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে একটু ভূমিকা সেরে নিই। কিছুদিন আগে টেস্ট ক্রিকেটের ‘অমর’ ১০ রেকর্ড নিয়ে একটা লেখা লিখেছিলাম। টেস্টের পর ওয়ানডের এমন ১০টি রেকর্ড নিয়েও। ‘অমর’ মানে যে রেকর্ডগুলো হয়তো কোনো দিন ভাঙবে না বলে আমার ধারণা। ভাবলাম, টেস্ট-ওয়ানডে যেহেতু হয়েছে, তাহলে টি-টোয়েন্টি আর বাদ থাকে কেন! টি-টোয়েন্টিও তো এখন ক্রিকেটের ঘোর বাস্তবতা। শুধু টি-টোয়েন্টি বললে অবশ্য ভুল বোঝার অবকাশ থাকে। বরং বলে নেওয়া ভালো, কথা হচ্ছে আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি নিয়ে। যেটির রেকর্ড নিয়ে কথা বলতে একটু ভয়ই লাগে। কেন, ভয় লাগবে কেন? একটু অপেক্ষা করুন, বুঝিয়ে বলছি। এর আগে চলুন একটু ইতিহাসে ঘুরে আসি।
আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টির শুরুটা কি আপনাদের মনে আছে? ২০০৫ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি অকল্যান্ডে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড খেলতে নেমেছিল ইতিহাসের প্রথম আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ম্যাচ। ক্রিকেট ম্যাচই ছিল, তবে পুরোটাই ছিল ফান। কোনো দলই ম্যাচটাকে সিরিয়াসলি নেয়নি। নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেটাররা সত্তরের দশকের রেট্রো জার্সি পরে মাঠে নেমেছিলেন। অনেকের মাথায় ছিল পরচুলা, নাকের নিচে নকল গোঁফ। দেখে মনে হচ্ছিল, যেন ‘যেমন খুশি তেমন সাজো’ প্রতিযোগিতায় নেমেছেন তাঁরা।
ওই ম্যাচে মজার অনেক ঘটনা আছে। তার একটিই না বলি। ২ বলে নিউজিল্যান্ডের যখন ৪৬ রান দরকার, গ্লেন ম্যাকগ্রা আন্ডারআর্ম বোলিং করার ভান করেন। ১৯৮১ সালে ট্রেভর চ্যাপেলের সেই আন্ডারআর্ম কেলেঙ্কারিকে মনে করিয়ে দেওয়া আরকি! তো গ্লেন ম্যাকগ্রা আন্ডারআর্ম বোলিং করার ভান করায় আম্পায়ার বিলি বাউডেন করলেন কী, তাঁকে লাল কার্ড দেখিয়ে দিলেন। ক্রিকেট মাঠে আম্পায়ারের পকেটে কেন লাল কার্ড থাকবে? ওই যে বলছিলাম, ওই ম্যাচটাতে মজা করতেই মাঠে নেমেছিলেন সবাই। বিলি বাউডেনের লাল কার্ড নিয়ে নামাও সে কারণেই।
সেই ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক রিকি পন্টিং খেলা শেষ হওয়ার পর যা বলেছিলেন, এখন তা মনে করিয়ে দিলে তিনি হয়তো লজ্জার একটা হাসি দেবেন। তা কী বলেছিলেন পন্টিং? বলেছিলেন, ‘এটা সিরিয়াসলি খেলা কঠিন। এই খেলাটা নিয়মিত হলে মজাটা চলে যাবে।’ তখন পন্টিং দূর কল্পনাতেও ভাবেননি, কেউই আসলে ভাবেনি, দুই বছরের মধ্যে টি-টোয়েন্টির একটা বিশ্বকাপ হয়ে যাবে, এটা পরিণত হবে সিরিয়াস ব্যাপারে।
২
আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে সবচেয়ে বড় বাঁকবদলের ঘটনাটি ঘটে ২০১৮ সালের এপ্রিলে। যেদিন আইসিসি ঘোষণা করে, ২০১৯ সালের ১ জানুয়ারি থেকে আইসিসির পূর্ণ সদস্য দেশগুলো তো বটেই, সহযোগী সদস্য দেশগুলোও একে অন্যের সঙ্গে টি-টোয়েন্টি খেললেই তা আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টির স্বীকৃতি পাবে। যে কারণে আইসিসির টি–টোয়েন্টি র্যাঙ্কিংয়ে দলের সংখ্যা প্রায়ই ১০০ ছাড়িয়ে যায়।
এই ১০০ বা কখনো কখনো তারও বেশি দেশ পরস্পরের সঙ্গে খেললেই যদি তা আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি হয়ে যায়, তার মানেটা কি বুঝতে পারছেন! মানে হলো প্রতিদিনই বিশ্বের নানা প্রান্তে অসংখ্য আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ম্যাচ হচ্ছে। যে কারণে আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টির বয়স ২১ বছর হওয়ার আগেই এরই মধ্যে সাড়ে তিন হাজারের মতো ম্যাচ হয়ে গেছে। এত দেশ খেলে আর এত খেলা হয় যে টি-টোয়েন্টির রেকর্ড নিয়ে কথা বলায় বড় ঝুঁকি। দেখা গেল, এই লেখাটা লিখতে লিখতেই হয়তো কোথাও কোনো রেকর্ড ভেঙে যাচ্ছে। সেটাও হয়তো করেছেন জিব্রাল্টারের কোনো ক্রিকেটার, প্রতিপক্ষ হয়তো মাল্টা বা কেইম্যান আইল্যান্ড।
টি-টোয়েন্টির ‘অমর’ রেকর্ড নিয়ে যে ভয়ের কথা বলছিলাম, সেটি এ কারণেই। আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টির রেকর্ড সেকশনে গেলেই আমার এই কথার মর্মার্থ বুঝতে পারবেন। একটা উপকারও অবশ্য হবে। ভূগোল নিয়ে আপনার ভালো পড়াশোনা হয়ে যাবে। বিচিত্র সব দেশের নাম জানতে পারবেন। দেখবেন, এমন সব ক্রিকেটার বিশ্ব রেকর্ড করে রেখেছেন, যাঁদের নামই হয়তো আপনি আগে শোনেননি। এমন সব দেশের হয়ে, যে দেশগুলো ক্রিকেট খেলে, এটাই হয়তো আপনি জানতেন না।
ম্যাচে সেরা বোলিংয়ের রেকর্ডের কথাই ধরুন। শুরুতেই এই প্রশ্নটা করেছিলাম। আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে সেরা বোলিংয়ের রেকর্ডটি যাঁর, আমি তাঁর নাম জানতাম না। লেখাটা শুরু করার আগে দেখে নিয়েছি।
আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে সেরা বোলিংয়ের রেকর্ড ৮ রানে ৭ উইকেট। রেকর্ডটা যাঁর, তাঁর নাম সিয়াজরুল ইদ্রুস। মালয়েশিয়ার ডানহাতি মিডিয়াম পেসার। ৪ ওভারে ৮ রান দিয়ে তাঁর ৭ উইকেট নেওয়ার কীর্তি কোন দেশের বিপক্ষে? চীন!
আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে ২৭ বার ৬ উইকেট নেওয়ার কীর্তি আছে। এর মধ্যে একজনই শুধু দুবার ম্যাচে ৬ উইকেট নিতে পেরেছেন। এই বোলারকে আপনি হয়তো চিনবেন—শ্রীলঙ্কার রহস্য স্পিনার অজন্তা মেন্ডিস। টেস্ট খেলুড়ে দেশের মধ্যে শ্রীলঙ্কা ছাড়া ভারতের দুজন বোলার ৬ উইকেট নিয়েছেন; বাংলাদেশ, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও অস্ট্রেলিয়ার একজন বোলার। বাংলাদেশের কোন বোলার, নামটা জানতে ইচ্ছা করতেই পারে। আপনার অনুমান হয়তো এ ক্ষেত্রে মিলেও যাবে—মোস্তাফিজুর রহমান।
শ্রীলঙ্কা-ভারত ছাড়া ম্যাচে একাধিকবার ম্যাচে ৬ উইকেট নিয়েছেন আর দুটি দেশের বোলার—সেই দুটি দেশের নাম নামিবিয়া ও নাইজেরিয়া।
চমকে গেছেন? চমকের এখনো অনেক বাকি। এদের বাইরে ম্যাচে ৬ উইকেট নিয়েছেন যেসব দেশের বোলাররা, সেই দেশগুলোর নামে একটু চোখ বুলিয়ে নিন তাহলে—সিঙ্গাপুর, নাইজেরিয়া, উগান্ডা, মালাউয়ি, বাহরাইন, নামিবিয়া, নেপাল, হংকং, মেক্সিকো, ভানুয়াতু, বেলিজ, কেনিয়া, আর্জেন্টিনা, লেসোথো, ফ্রান্স, জাপান, স্পেন।
তো কী বুঝলেন?
৩
খেলাটা যখন টি-টোয়েন্টি, এখানে দ্রুততম সেঞ্চুরির রেকর্ডটার আলাদা একটা গ্ল্যামার আছে। এই রেকর্ডটা কার বলতে পারবেন?
ব্যাটসম্যানের নাম সাহিল চৌহান। নাম শোনেননি? তাহলে বলেই দিই, সাহিল চৌহান এস্তোনিয়ার এক ব্যাটসম্যান। যিনি ২০২৪ সালের জুনে ২৭ বলে সেঞ্চুরি করে টি-টোয়েন্টিতে দ্রুততম সেঞ্চুরির রেকর্ড গড়েছেন। সেটি কোন দলের বিপক্ষে? সাইপ্রাস।
আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে দ্রুততম সেঞ্চুরির তালিকায় প্রথম তিনটি নামই এমন অপরিচিত। মোহাম্মদ ফাহাদ ২৯ বলে সেঞ্চুরি করে টি-টোয়েন্টিতে দ্রুততম সেঞ্চুরির তালিকার ২ নম্বরে। এই ফাহাদ কোন দেশের ব্যাটসম্যান, অনুমান করতে পারেন? তুরস্কের। ২০২৫ সালের জুলাইয়ে ফাহাদের এই সেঞ্চুরি বুলগেরিয়ার বিপক্ষে। এর পরের নামটা নামিবিয়ার ইয়ান নিকোল লফটি-ইটন। যাঁর ৩১ বলে সেঞ্চুরি নেপালের বিপক্ষে।
একসময় নেপালেরই এক ব্যাটসম্যানের ছিল এই রেকর্ডটা। তাঁর নাম কুশল মাল্লা। আরেকটু যদি পেছনে যাই, তাহলে এত অচেনা–অজানা নামের ভিড়ে আপনি চেনা এমন একজনের নাম পাবেন। ডেভিড মিলার—দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাটসম্যান। ২০১৭ সালে এই ডেভিড মিলার ৩৫ বলে সেঞ্চুরি করে টি-টোয়েন্টিতে দ্রুততম সেঞ্চুরির রেকর্ড গড়েছিলেন। সেটি আবার ছিল বাংলাদেশের বিপক্ষে। মাস দুয়েক পর ভারতের রোহিত শর্মাও শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৩৫ বলে সেঞ্চুরি করে এই রেকর্ডে মিলারের পাশে বসে যান। ২০১৯ সালে চেক রিপাবলিকের সুদেশ বিক্রমাসেকারাও। মানে মিলার, রোহিত শর্মা, বিক্রমাসেকারা—এই তিনজনেরই সেঞ্চুরি ছিল ৩৫ বলে।
তাঁদের সবার রেকর্ড ভাঙেন কুশল মাল্লা। সেটি ঠিক ১ বল কম খেলে সেঞ্চুরি করে। ২০২৩ হাংঝু এশিয়ান গেমসে সেই সেঞ্চুরি মঙ্গোলিয়ার বিপক্ষে। ২০২৪ ফেব্রুয়ারিতে মাল্লার রেকর্ড ভাঙেন ইয়ান নিকোল লফটি-ইটন। সে বছরই, মানে ২০২৪ সালের জুনে ইটনের রেকর্ড ভাঙেন সাহিল চৌহান। এখনো, মানে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত যা তাঁরই আছে।
৪
দ্রুততম সেঞ্চুরির রেকর্ডের কথা যখন বললাম, দ্রুততম হাফ সেঞ্চুরিই–বা বাদ থাকে কেন? অনেক বছর এই রেকর্ডটা ছিল যুবরাজ সিংয়ের। যুবরাজের মাত্র ১২ বলে হাফ সেঞ্চুরির রেকর্ডটা হয়তো আপনার মনে আছে ৬ বলে ছক্কার কারণে। ২০০৭ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের স্টুয়ার্ট ব্রডের ১ ওভারের ৬ বলে ৬ ছক্কা মারার ইনিংসেই যুবরাজের ১২ বলে হাফ সেঞ্চুরি।
এই রেকর্ডটা ভাঙা কঠিন ছিল বলেই প্রায় ১৬ বছর তা টিকে ছিল। এটি ভেঙেছেন নেপালের দীপেন্দ্র সিং ঐরী—২০২৩ হাংঝু এশিয়ান গেমসে মঙ্গোলিয়ার বিপক্ষে মাত্র ৯ বলে হাফ সেঞ্চুরি করেন। বুঝতে পেরেছেন তো কোন ম্যাচের কথা বলছি? একটু আগে যে ম্যাচটার কথা বললাম, যেটিতে কুশল মাল্লার ৩৪ বলে সেঞ্চুরি। ওই ম্যাচেই প্রথম আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে কোনো দল তিন শতাধিক রান করে। নেপাল করেছিল ৩ উইকেটে ৩১৪।
কিন্তু ৯ বলে হাফ সেঞ্চুরি করা কীভাবে সম্ভব?
কেন, ৯ বলে ৯ ছক্কা মারলেই তো ৫৪ রান হয়ে যায়। দীপেন্দ্র সিং ঐরী এর কাছাকাছি কিছুই করেছিলেন। যে ৯ বল খেলেছেন, তার ৮টিতেই ছক্কা মেরেছেন। ২ ওভারে টানা ৬ বলে ৬টা ছক্কা মারার পর পরের বলে ২ রান নিয়েছেন, পরের ২ বলে আবার ছক্কা মেরে করে ফেলেছেন হাফ সেঞ্চুরি।
৫
এবার আরেকটা কুইজের প্রশ্ন। টেস্ট অভিষেকে প্রথম সেঞ্চুরি অস্ট্রেলিয়ার চার্লস ব্যানারম্যানের। সেটি ইতিহাসের প্রথম টেস্টেই। ওয়ানডেতে অভিষেকেই সেঞ্চুরি করার প্রথম কীর্তি ইংল্যান্ডের ডেনিস অ্যামিসের। এবার বলুন তো আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে অভিষেকেই কে প্রথম সেঞ্চুরি করেছেন? আপনি নামটা বলার চেষ্টা করতে থাকুন। আমি এর মধ্যে আরেকটা ইতিহাস বলে নিই।
আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে অভিষেকেই সেঞ্চুরির যে কীর্তির কথা বলছি, ইতিহাসের প্রথম আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতেই রিকি পন্টিং তা করে ফেলেছিলেন প্রায়। পারেননি ২ রানের জন্য, অপরাজিত ছিলেন ৯৮ রানে। সেই ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার ইনিংসের ২ ওভার বাকি থাকতে পন্টিংয়ের রান ছিল ৬৩। সেঞ্চুরির কথা কেউ ভাবেনইনি। কিন্তু ড্যারিল টাফির পরের ওভারেই ৩০ রান নিয়ে পন্টিং যখন ৯৩ রানে পৌঁছে গেলেন, তখন মনে হচ্ছিল, সেঞ্চুরি খুবই সম্ভব। সমস্যা ছিল একটাই, শেষ ওভারে স্ট্রাইকে ছিলেন মাইক হাসি। সেটাও সমস্যা থাকল না, যখন প্রথম বলেই সিঙ্গেল নিয়ে হাসি পন্টিংকে স্ট্রাইক দিয়ে দিলেন। স্ট্রাইক পেয়েই ৪ মারলেন পন্টিং, পৌঁছে গেলেন ৯৭ রানে। পরের বলে লেগ বাই থেকে ২, তার মানে স্ট্রাইক ধরে রাখলেন পন্টিং। কিন্তু পরের বলে সিঙ্গেল নিয়েই ঝামেলাটা হলো। পন্টিং আর স্ট্রাইকই পেলেন না। ৯৮ রানে অপরাজিত থেকেই ফিরতে হলো তাঁকে।
এবার তাহলে ওই প্রশ্নে আসি। আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে অভিষেকে প্রথম সেঞ্চুরি করেছেন কে? সঠিক উত্তর হলো কানাডার রবীন্দরপাল সিং। ২০১৯ সালে টি-টোয়েন্টি অভিষেকেই রবীন্দরপালের সেঞ্চুরি, সেটি কোন দলের বিপক্ষে? কেইম্যান আইল্যান্ড।
বলছিলাম না, আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি রেকর্ড নিয়ে কথা বললে আপনার অনেক অজানা-অচেনা বা সামান্য চেনা অনেক দেশের সঙ্গে পরিচয় হবে।
টি-টোয়েন্টি অভিষেকেই প্রথম সেঞ্চুরি করা রবীন্দরপাল সিং নামটার সঙ্গে আগেই পরিচয় থাকলে আপনি ভাই নমস্য ব্যক্তি। বাকি তিনজনকে চিনলে তো আরও। টি-টোয়েন্টিতে অভিষেকেই সেঞ্চুরি করা বাকি তিনজনের নাম জ্যঁ–পিয়েরে কোতজে, লেসলি ডানবার ও ম্যাথু স্পুরস।
টি-টোয়েন্টি অভিষেকেই প্রথম সেঞ্চুরি করা রবীন্দরপাল সিং নামটার সঙ্গে আগেই পরিচয় থাকলে আপনি ভাই নমস্য ব্যক্তি। বাকি তিনজনকে চিনলে তো আরও। টি-টোয়েন্টিতে অভিষেকেই সেঞ্চুরি করা বাকি তিনজনের নাম জ্যঁ–পিয়েরে কোতজে, লেসলি ডানবার ও ম্যাথু স্পুরস। রবীন্দরপাল সিংয়ের মতো স্পুরসও কানাডার। কোতজে নামিবিয়ার আর ডানবার নোভাক জোকোভিচের দেশের লোক, মানে সার্বিয়ার। রবীন্দরপাল সিংয়ের অভিষেকের সেঞ্চুরির দুই দিন পরই নামিবিয়ার কোতজে বতসোয়ানার বিপক্ষে তাঁর প্রথম ম্যাচেই সেঞ্চুরি করে ফেলেন। এর দেড় মাস পর সার্বিয়ার লেসলি ডানবার যা করেন বুলগেরিয়ার বিপক্ষে। সর্বশেষ ২০২২ সালে কানাডার ম্যাথু স্পুরস অভিষেকেই সেঞ্চুরি করেছেন ফিলিপাইনের বিপক্ষে।
৬
একটা কথা অবশ্য আগেই বলে নেওয়া উচিত ছিল। তাতে এত অজানা-অচেনা নামের ভিড়ে দমবন্ধ অবস্থায় একটু শ্বাস ফেলতে পারতেন।
টি-টোয়েন্টিতে সবচেয়ে বেশি রান আর উইকেটের রেকর্ডে আপনি পরিচিত নাম পাবেন। এই দুটি রেকর্ডে এখনো টেস্ট প্লেয়িং দেশগুলোর ক্রিকেটাররাই ওপরে। বোলিংয়ে সবার ওপরে রশিদ খান। বাংলাদেশের বাঁহাতি পেসার মোস্তাফিজুর রহমান আছেন ৩ নম্বরে। সাকিব আল হাসান একসময় শীর্ষে ছিলেন, এখন তিনি ৫ নম্বরে। রশিদ খান আর সাকিব আল হাসানের মাঝখানে যে তিনজন, তাঁদের একজন বাংলাদেশের ফিজ, বাকি দুজনই নিউজিল্যান্ডের—টিম সাউদি ও ইশ সোধি।
সবচেয়ে বেশি রানের রেকর্ডে যদি যান, ৪ হাজারের বেশি রান পাবেন তিনজনের—রোহিত শর্মা, বাবর আজম ও বিরাট কোহলির। তাঁদের মধ্যে রোহিত আর কোহলি আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি থেকে অবসর নিয়ে ফেলেছেন, বাবর আজম অনেক দিন পাকিস্তানের টি-টোয়েন্টি দলের বাইরে থাকার পর ফিরেছেন সম্প্রতি। আর বাবর আজমের ফেরা মানেই টি–টোয়েন্টিতে সবচেয়ে বেশি রানের রেকর্ডটা তাঁর হয়ে যাওয়া। প্রত্যাবর্তনের সময় রোহিত শর্মাকে টপকাতে যে মাত্রই ৯ রান লাগত তাঁর।
ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ স্কোরের রেকর্ডেও আপনি পরিচিত নাম পাবেন। আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে সর্বোচ্চ তিনটি স্কোরের দুটিই অস্ট্রেলিয়ার অ্যারন ফিঞ্চের। ফিঞ্চের ১৭২ ও ১৫৬ রানের মাঝখানে আছেন আফগানিস্তানের হজরতউল্লাহ জাজাই। ১৫০ বা এর বেশি রান আছে আর একজনেরই। যাঁর নামটা আপনি বলতে পারবেন বলে মনে হয় না।
টি-টোয়েন্টি আসলেই গ্লোবাল গেম! দেখুন না, কেইম্যান আইল্যান্ডের এক ব্যাটসম্যান রেকর্ড বুকে জায়গা করে নিচ্ছেন ব্রাজিলের বিপক্ষে ম্যাচে, সেই ম্যাচটি আবার হয়েছে আর্জেন্টিনায়।
ইয়েরন সাচার ডি অলউইস সেনেভেরত্নে।
বাপ রে বাপ, কত বড় নাম! যে নামটা শুনেই হয়তো বুঝতে পারছেন তিনি শ্রীলঙ্কান বংশোদ্ভূত। তবে সেনেভেরত্নে খেলেন কেইম্যান আইল্যান্ডের হয়ে। ২০২৪ সালের জুলাইয়ে সেনেভেরত্নের অপরাজিত ১৫০ রানের ওই ইনিংসটি ব্রাজিলের বিপক্ষে, ম্যাচটা হয়েছিল আবার আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস এইরেসে। টি-টোয়েন্টি আসলেই গ্লোবাল গেম! দেখুন না, কেইম্যান আইল্যান্ডের এক ব্যাটসম্যান রেকর্ড বুকে জায়গা করে নিচ্ছেন ব্রাজিলের বিপক্ষে ম্যাচে, সেই ম্যাচটি আবার হয়েছে আর্জেন্টিনায়। কী ম্যাচ সেটি? ২০২৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আমেরিকা অঞ্চলের সাব–রিজিওনাল কোয়ালিফায়ারের অংশ।
৭
এবার আসি ওভারের ৬ বলেই ৬ ছক্কার রেকর্ডে। আপনাকে যদি প্রশ্ন করি, এই রেকর্ডটা কার? যুবরাজ সিংয়ের নামটা হয়তো ঠোঁটের আগায় এসে গেছে আপনার। ২০০৭ সালে প্রথম টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে যুবরাজ সিং ইংল্যান্ডের পেস বোলার স্টুয়ার্ট ব্রডের ১ ওভারের ৬ বলেই ৬ ছক্কা মেরেছিলেন। হ্যাঁ, যুবরাজ সিংই প্রথম। এরপর যিনি তা করেছেন, সেই কাইরন পোলার্ডের নামটাও হয়তো বলে ফেলতে পারেন আপনি। ২০২১ সালে পোলার্ড ওভারের ৬ বলেই ৬ ছক্কা মেরেছিলেন শ্রীলঙ্কান স্পিনার আকিলা ধনাঞ্জয়াকে।
যুবরাজ-পোলার্ডের নাম না হয় বললেন, কিন্তু আপনি কি জানেন, মানান বশিরও তা মেরেছেন। এখন প্রশ্ন করতেই পারেন, এই মানান বশিরটা কে? বলছি। মানান বশির বুলগেরিয়ার এক ব্যাটসম্যান। বেশি দিন আগে নয়, ২০২৫ সালের ১৩ জুলাই সোফিয়াতে মানান বশির জিব্রাল্টারের এক অফ স্পিনারের ১ ওভারের ৬ বলেই ৬ ছক্কা মেরেছেন। বোলারের নামটা খুব ইন্টারেস্টিং—কবির মিরপুরি।
যা জানার পর থেকেই মনে হচ্ছে, এই বোলারকে যেভাবেই হোক মিরপুরে অন্তত একটা ম্যাচ খেলার সুযোগ দেওয়া উচিত। যাঁর নামে মিরপুরি আছে, মিরপুরে খেলার অধিকার তাঁর চেয়ে বেশি আর কার আছে, বলুন!
আরেকজনের নামও বলতে হচ্ছে। যে নামটা এর আগেই বলা হয়েছে। একটু আগে আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে দ্রুততম হাফ সেঞ্চুরির রেকর্ডটা নিয়ে কথা বলেছিলাম, মনে আছে? ওই রেকর্ডটা নেপালের দীপেন্দ্র সিং ঐরীর। এই ঐরীরই যুবরাজ-পোলার্ড ও মানান বশিরের মতো ওভারের ৬ বলেই ছক্কা মারার কীর্তি আছে। সেটি ২০২৪ সালে কাতারের বিপক্ষে ম্যাচে। বোলারের নাম কামরান খান।
৮
এতক্ষণ যা লিখলাম, তা একটা কথা বোঝাতেই—টি-টোয়েন্টি মানেই রেকর্ড ভাঙা-গড়ার খেলা। তাই বলে টেস্ট আর ওয়ানডেতে যেমন অমর ১০টি রেকর্ড বেছে নিয়েছিলাম, টি-টোয়েন্টিতে কি অমর বলতে পারি, এমন একটা রেকর্ডও নেই? একটা মনে হয় আছে। ম্যাচে সেরা ইকোনমি রেটের রেকর্ড।
আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে তিনজন বোলার ম্যাচে ৪ ওভারের পুরো কোটা বোলিং করে কোনো রানই দেননি। মানে ৪ ওভারই মেডেন পেয়েছেন। এই রেকর্ডটাকে অমর বলায় কোনো ঝুঁকি নেই। কারণ, কারও পক্ষে এই রেকর্ড ভাঙা সম্ভব নয়। বড়জোর কেউ এই রেকর্ডের পুনরাবৃত্তি করতে পারেন। তা টি-টোয়েন্টির একমাত্র নিশ্চিত অমর রেকর্ডটা কাদের?
৪ ওভার বোলিং করে কোনো রান না দেওয়ার প্রথম কীর্তিটা সাদ বিন জাফরের। কানাডার এই বোলার ২০২১ সালের নভেম্বরে পানামার বিপক্ষে এই কিপটে বোলিংয়ের এই রেকর্ড গড়েন। পরে যেটির পুনরাবৃত্তি করেন নিউজিল্যান্ডের লকি ফার্গুসন, ২০২৪ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে পাপুয়া নিউগিনির বিপক্ষে। সে বছরই আগস্টে হংকংয়ের আয়ুশ শুক্লা মঙ্গোলিয়ার বিপক্ষে ৪ ওভার বোলিং করে ৪টিই মেডেন নেন।
লেখাটা এখানেই শেষ করি। আপনি যদি পুরো লেখা পড়ে থাকেন, আপনাকে একটা অনুরোধ করা জরুরি বলে মনে হচ্ছে। এখনই টি-টোয়েন্টির রেকর্ড সেকশনটা একটু চেক করে দেখুন প্লিজ। কে জানে, যে রেকর্ডগুলোর কথা বলেছি, এই লেখা লিখতে লিখতেই তার কোনোটি ভেঙে গেল কি না!
