দুনিয়া কাঁপানোর উপায় জানালেন খুশদিল

ব্যাট হাতে ১৯৭.১২ স্ট্রাইক রেটে ২৭৪ রান আর এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ ২৩ ছক্কা, বল হাতে ১১ উইকেট। বিপিএলে তৃতীয় আসর খেলতে এসে নিজেকে যেন নতুন করে চেনাচ্ছেন রংপুর রাইডার্সের পাকিস্তানী ক্রিকেটার খুশদিল শাহ। স্বীকৃত টি–টোয়েন্টিতে পাকিস্তানের ব্যাটসম্যানদের মধ্যে দ্রুততম সেঞ্চুরিয়ানের কাছে যেকোনো বোলিংয়ের সামনেই ব্যাটে ঝড় তোলাটা যেন ডালভাত! গতকাল বিকালে চট্টগ্রামে রংপুর রাইডার্সের টিম হোটেল রেডিসন ব্লু’র লবিতে বসে দেওয়া সাক্ষাৎকারে খুশদিল শুনিয়েছেন তাঁর মারকাটারি ব্যাটসম্যান হয়ে ওঠার গল্প—

প্রথম আলো:

বিপিএলে এবার এখন পর্যন্ত ১৯৭–এর বেশি স্ট্রাইক রেটে আর সর্বোচ্চ ২৩ ছক্কায় ২৭৪ রান করেছেন, সঙ্গে ১১ উইকেট। আপনার সেরা বিপিএল এটাই। খুব ভালো সময় কাটছে বলবেন নিশ্চয়ই?

খুশদিল শাহ: তিন–চার বছর ধরে এই টুর্নামেন্টে খেলছি। কুমিল্লার পক্ষেও খেলেছি। রংপুরের হয়ে ভালো খেলতে পারার বড় কারণ, তারা আমাকে পাঁচে ব্যাট করাচ্ছে। বড় ইনিংস খেলার সুযোগ বেড়েছে তাতে। ৯–১০–১১ ওভারের মধ্যেই আমাকে ব্যাটিংয়ে নামতে হচ্ছে। আমিও চেষ্টা করছি সুযোগটা কাজে লাগাতে এবং দলকে ভালো রান এনে দিতে। আগের বিপিএলগুলোতে আমি ৬–৭ নম্বরে ব্যাট করেছি। সে জন্য ইনিংস বড় করার সুযোগও কম পেয়েছি।

প্রথম আলো:

যেভাবে এগোচ্ছেন, ম্যান অব দ্য টুর্নামেন্ট হওয়ার ব্যাপারে কতটা আশাবাদী?


খুশদিল: ব্যাটিং–বোলিং দুটোই তো ভালো যাচ্ছে। দেখা যাক শেষ পর্যন্ত এটা ধরে রাখতে পারি কি না। ম্যান অব দ্য টুর্নামেন্ট হওয়া নিয়ে ভাবি না। আমার চেষ্টা হলো দলকে কীভাবে জেতানো যায়।

এবারের বিপিএলে এ পর্যন্ত ২৭৪ রান করেছেন খুশদিল শাহ
শামসুল হক
প্রথম আলো:

কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ানসে দুই মৌসুমে খেলার পর এবার রংপুর রাইডার্সে। দুটি ফ্র্যাঞ্চাইজিতে খেলার অভিজ্ঞতায় পার্থক্য কী রকম?

খুশদিল: তুলনা করাটা কঠিন। কারণ, কুমিল্লাও খুব ভালো ফ্র্যাঞ্চাইজি ছিল। দুই বছর সেখানে খেলেছি। তারা কোনো ঘাটতি রাখেনি। রংপুরের হয়ে গায়ানায় জিএসএলে খেলার পর এখন বাংলাদেশে খেলছি। তারাও কুমিল্লার মতোই ভালো ফ্র্যাঞ্চাইজি। সব ধরনের সুযোগ–সুবিধা দিচ্ছে। আমার কাছে দুটো একই রকম।

প্রথম আলো:

রংপুরের হয়ে পুরো টুর্নামেন্টেই খেলবেন শুনলাম। ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটে এখন যে সংস্কৃতি, খেলোয়াড়েরা আগের রাতে এসে পরের দিনই ম্যাচ খেলতে নেমে যাচ্ছে। এটাকে কীভাবে দেখেন?

খুশদিল: এবার পুরো মৌসুম খেলার জন্যই রংপুর রাইডার্সের সঙ্গে চুক্তি করেছি। যদি কোনো কারণে জাতীয় দলে নাম এসে যায়, তখন হয়তো যেতে হবে। অন্য যে বিষয়টা বললেন, আসলে এখন একসঙ্গে তিনটি লিগ চলছে। এখানে এনওসির (বোর্ডের অনাপত্তিপত্র) একটা বিষয় থাকে। খেলোয়াড়েরা তাই কোথায়, কখন খেললে সুবিধা হবে; সেভাবে চুক্তি করছে। এক জায়গায় খেলে আরেক জায়গায় চলে যাচ্ছে।

প্রথম আলো:

বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের টি–টোয়েন্টি সামর্থ্য নিয়ে কী বলবেন?

খুশদিল: আমি মনে করি, ব্যাটসম্যানরা যদি স্ট্রাইক রেট বাড়ানোর ব্যাপারে তাদের চিন্তাভাবনাটা একটু বদলায়, তাহলে তাদের জন্য ভালো হবে। যাদের এখন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ ক্রিকেটার মনে করা হচ্ছে, তারা একটি চার বা ছক্কা মেরেই সিঙ্গেল নেওয়ার দিকে চলে যায়। টি–টোয়েন্টি ক্রিকেটে আপনি যদি দুনিয়াকে হারাতে চান, আপনার মধ্যে ইচ্ছাশক্তি থাকতে হবে।

যদি প্রথম পাঁচটা বলই বাউন্ডারির মতো হয়, তাহলে বাউন্ডারিই মারতে হবে। যদি সে রকম বল না পান, তাহলে বলগুলোকে অন্যভাবে কাজে লাগাতে হবে। চেষ্টা করতে হবে যেন পাঁচ বলে ৮–১০ রান আসে। কিন্তু মারার বল পেলে মারতে থাকতে হবে। আধুনিক ক্রিকেটে দুনিয়া কাঁপানোর এটাই একমাত্র উপায়।

ওরা যেভাবে স্ট্রাইক রোটেট করে সেটা ওয়ানডেতে দেখতে ভালো লাগে, টি–টোয়েন্টিতে নয়। টি–টোয়েন্টি অনেক তেজি ক্রিকেট। একটা বাউন্ডারি মেরে পরের বলে সিঙ্গেল নেওয়ার চেষ্টা করলে হবে না। টি–টোয়েন্টিতে ওপরে যেতে চাইলে তাদের ইন্টেন্ট বদলাতে হবে, বড় শট খেলার ইচ্ছাশক্তি বাড়াতে হবে।

৬ ইনিংসে ২৩টি ছক্কা মেরেছেন খুশদিল শাহ
প্রথম আলো
প্রথম আলো:

বিপিএলকে আরও ভালো করার জন্য কী করা যেতে পারে?

খুশদিল: বড় বড় খেলোয়াড় আনতে হবে। বড় ক্রিকেটার থাকলে ড্রেসিংরুমে তাদের কাছ থেকে শেখার সুযোগ পায় জুনিয়র খেলোয়াড়েরা। আরেকটা বিষয়, বিপিএলে এ বছর যে রকম উইকেট হয়েছে, এটা সেরা। এখন আবহাওয়া ভালো, উইকেট ভালো। সিলেটে ছোট বাউন্ডারি নিয়ে কথা হয়েছে। কিন্তু সেটা তো দুই দলের জন্যই ছোট ছিল।

ছোট–বড় বাউন্ডারি ব্যাপার নয়, ব্যাপার হলো উইকেট, দল, কারা টুর্নামেন্টটা খেলছে—এসব। এ রকম উইকেটই সব সময় থাকা উচিত বিপিএলে। হ্যাঁ, প্রতিদিন ২০০ রান হবে না। কিন্তু এ রকম উইকেটেও ১৫০–১৬০ করে ম্যাচ জেতা যায়, যেটা আমরা কাল (পরশু) করেছি। কম রান করে জেতাটাও ক্রিকেটের একটা সৌন্দর্য। এসব ম্যাচে জুনিয়র ক্রিকেটাররা চাপ সামলানো শিখতে পারে।

প্রথম আলো:

২০১৭ সালে ইমার্জিং ক্রিকেটার হিসেবে পেশোয়ার জালমিতে আপনার ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট শুরু। সেখান থেকে পরের যাত্রাটা কেমন ছিল?

খুশদিল: পেশোয়ারে পেশোয়ার জালমি একটা টুর্নামেন্ট করেছিল। আমি তাতে প্লেয়ার অব দ্য টুর্নামেন্ট হই। কোচ মোহাম্মদ আকরামের আমার খেলা পছন্দ হয়, তিনি আমাকে দলে নেন। ওখানে দুই বছর খেলে পরের বছর আমি ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট খেলিনি। এরপর মুলতান আমাকে নেয়, তাদের হয়ে ছয় মৌসুম খেলছি।

আরও পড়ুন
প্রথম আলো:

পিএসএল, বিপিএলের পাশাপাশি গ্লোবাল টি–টোয়েন্টিতে খেলেছেন। আরও তো ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ আছে। সেখান থেকে ডাক আসে না?

খুশদিল: প্রস্তাব তো আসেই, কিন্তু বিদেশি লিগে খেলতে হলে পুরো বছরে দুটো এনওসি নিতে হয়। কাজেই আমাদের চিন্তা করতে হয় কোথায় খেললে চুক্তিটা ভালো হবে। সে অনুযায়ী চুক্তি করি। এখন তো টি–টোয়েন্টির মতো টি–টেন টুর্নামেন্টও অনেক বেড়েছে। যেহেতু দুটো এনওসিই পাওয়া যাবে বছরে, তাই ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়ে খেলতে হয়। চুক্তি ভালো না হলে তো খেলে লাভ নেই।

প্রথম আলো:

ন্যাশনাল টি–টোয়েন্টি কাপে ৩৫ বলে সেঞ্চুরি করে টি–টোয়েন্টিতে আপনি পাকিস্তানের দ্রুততম সেঞ্চুরিয়ান। সে অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?

খুশদিল: দ্রুততম সেঞ্চুরিটা কিন্তু আমি রান তাড়া করে করেছি। ২১৭ রানের লক্ষ্য ছিল, আমি পাঁচে নামার আগে ৪ উইকেট পড়ে গিয়েছিল। তখন নাকি ধারাভাষ্যকারও বলছিলেন, আমরা অল্প সময়ের মধ্যে অলআউট হয়ে ব্যাগ গুছিয়ে বাড়ি চলে যাব।

কিন্তু এক–দুটি ভালো শট খেলার পর আমি ভাবলাম, একটা বোলারকে ঠিক করে ধরতে পারলে ম্যাচটাই একদম বদলে দেব। যে রকম ভাবছিলাম, আল্লাহ এর চেয়ে ভালো কিছু্ই আমাকে দিয়েছিলেন। বল এমনভাবে ব্যাটে লাগতে শুরু করল যে কয়েক বল বাকি থাকতেই আমরা ম্যাচ শেষ করে দিই।

রংপুর রাইডার্সে খেলছেন খুশদিল শাহর পাকিস্তানি সতীর্থ ইফতিখার আহমেদও
প্রধম আলো
প্রথম আলো:

টি–টোয়েন্টিতে মিডল অর্ডারে নেমেও সেঞ্চুরি করাটা তাহলে কঠিন নয়, কী বলেন?

খুশদিল: আপনার হাতে যদি বড় শট থাকে, আপনি যদি প্রয়োজনে সিঙ্গেলও নিতে পারেন, বোলার এবং পরিস্থিতি বুঝে খেলতে পারেন; তাহলে এটা অসম্ভব নয়। হ্যাঁ, একটু তো সময় পেতে হবে। হাতে ৮–১০ ওভার থাকলে এটা সম্ভব। তবে আপনি যদি শেষ দিকে ২–৩ ওভারের জন্য যান তাহলে ৫–৬ ইনিংসের মধ্যে এক–দুটিতেই ভালো করতে পারবেন হয়তো। ওভার একটু বেশি থাকলে সম্ভাবনা বাড়ে। সামর্থ্যের বিষয়ও আছে। বড় শট খেলতে জানতে হবে, যেকোনো বোলারকে ওভারে ৩–৪টা ছক্কা মারতে পারতে হবে। এ ধরনের ইনিংস ম্যাচটাকেও রোমাঞ্চকর করে তোলে।

প্রথম আলো:

পাওয়ার হিটিংয়ের জন্য বিশেষ কোনো অনুশীলন কি করেন?

খুশদিল: অবশ্যই করি। খোলা মাঠে, খোলা উইকেটে অনুশীলন করি; কোনো নেট থাকে না। বল করার জন্য আমার মতো করে বোলার নিয়ে আসি। ভালো ডানহাতি, বাঁহাতি পেসার, অফ স্পিনার, বাঁহাতি স্পিনার, লেগ স্পিনার, চায়নাম্যান—এ রকম বোলার জোগাড় করে তাদের বলে ব্যাটিং অনুশীলন করি। এতে অনেক উপকার হয়, বিভিন্ন বলে নিজের মার সম্পর্কে ভালো ধারণা চলে আসে। খোলা মাঠ বলে কোন বলে আমাকে কী রকম শক্তিতে খেলতে হবে; কী রকম শক্তি আমি পাচ্ছি, তা বুঝতে পারি। নেটেও পাওয়ার হিটিংয়ের অনুশীলন করি, আলাদা করে সিঙ্গেল–ডাবলের অনুশীলন করি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে নিচে চলে আসার পর আমি এই জিনিসগুলো ঠিক করতে থাকি। আমার মনে হয়েছে, দুনিয়ায় টিকে থাকতে হলে, নাম করতে হলে এই কাজগুলো করতেই হবে।

আরও পড়ুন
প্রথম আলো:

একটা সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ডেভিড মিলার আর এউইন মরগানের অনুশীলন থেকেও নাকি অনেক কিছু শিখেছেন। এ ব্যাপারে বিস্তারিত বলবেন?

খুশদিল: দুজনের সঙ্গেই আমি ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট খেলেছি। পেশোয়ার জালমিতে মরগান ছিল, মুলতানে মিলারের সঙ্গে খেলেছি দুই বছর। মিলারও আমার মতো ৫–৬ নম্বরে খেলে। আমি এটা বোঝার চেষ্টা করেছি, ৫–৬ নম্বরে ব্যাটিংয়ের জন্য সে কী ধরনের অনুশীলন করে। তারা তখন সেরা সময়ে ছিল। আমি দেখার চেষ্টা করতাম কী কাজ করে তারা এত ভালোভাবে ম্যাচ শেষ করছে, এত ভালো ইনিংস খেলছে; কী ধরনের অনুশীলন করে তারা এ রকম খেলছে। তাদের যে জিনিসগুলো আমার ভালো লাগত, চেষ্টা করেছি নিজের মধ্যে সেগুলো আনতে।

আমি যে সময় ব্যাটিংয়ে যাই, খুব কম ওভারই হাতে পাই। আমি এটা দেখি না এই বলটা ভালো, এটা খারাপ। নিজের শক্তিটা শুধু দেখি। যদি আমার জায়গায় আমার শক্তি অনুযায়ী বল আসে, আমি মেরে দিই।
খুশদিল শাহ
প্রথম আলো:

টি–টোয়েন্টিতে ব্যাটিং করতে নামার পর কী চিন্তা থাকে আপনার?

দিলখুশ: আমি যে সময় ব্যাটিংয়ে যাই, খুব কম ওভারই হাতে পাই। আমি এটা দেখি না এই বলটা ভালো, এটা খারাপ। নিজের শক্তিটা শুধু দেখি। যদি আমার জায়গায় আমার শক্তি অনুযায়ী বল আসে, আমি মেরে দিই। কে কীভাবে বল করে, সেটা দেখি না। সব বলের জন্য প্রস্তুত থাকি। বল যে রকমই হোক, মারার সামর্থ্য থাকলে আমি ওটাতে মারব। আউট হয়ে যাওয়ার চিন্তা করি না। ওটা মাথা থেকে সরিয়ে সামনের দিকে ভাবি।

পাকিস্তানের জার্সিতে খুশদিল শাহ
এএফপি
প্রথম আলো:

শেষ প্রশ্ন, পাকিস্তানের হয়ে ১০টি ওয়ানডে আর ২৭টি টি-টোয়েন্টি খেলে থেমে গেলেন। দুই বছরের বেশি হলো জাতীয় দলে নেই। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আবার ফেরার ব্যাপারে কতটা আশাবাদী?

খুশদিল: আশা তো করি আবার ফিরতে পারব, ইনশা আল্লাহ।