যে চাকরিতে ভালো না করলেও বেতন বাড়ে
নাজমুল হোসেনের মুখটা মলিনই ছিল।
কিছুক্ষণ আগে জিম্বাবুয়ের কাছে দল হেরেছে। সেই হারের ব্যবচ্ছেদ চলছিল সংবাদ সম্মেলনের একেকটি প্রশ্নে। হতাশ নাজমুল ‘আমরা খুব বাজে ক্রিকেট খেলেছি’ বলে এরই মধ্যে দায়ও নিয়েছেন। এরপরই এল প্রশ্নটা। এক সাংবাদিক প্রশ্ন করতে শুরু করলেন—‘আপনাদের ম্যাচ ফি বাড়ানো হয়েছে। বেতনও বেড়েছে। চাহিদার তুলনায় সুযোগ-সুবিধাও ভালো আছে মনে করেন। কোচিং স্টাফও যেমন চাইছে, তেমন পাচ্ছেন। আর কী কী করলে টেস্টে এগোনো সম্ভব?’
লম্বা প্রশ্নের খণ্ড খণ্ড বাক্য শুনতে শুনতেই মুখটা কঠিন হয়ে উঠল নাজমুলের। চেহারায় কাঠিন্য রেখেই পাল্টা প্রশ্ন করলেন, ‘বেতন বাড়ানোয় মনে হয় আপনারা খুশি না...।’ স্পষ্টতই বিরক্তির প্রকাশ। যার অনুবাদ অনেকটা ‘মাঠে ভালো করতে পারিনি বলে বেতন বৃদ্ধির খোঁটা দিচ্ছেন!’
জিম্বাবুয়ের কাছে টেস্ট হারের বিস্বাদ তখনো চোখে-মুখে। এমন সময়ে কেউ বেতন বেড়েছে মনে করিয়ে দিলে সেটাকে ‘খোঁটা’ মনে হতেই পারে। যদিও মাঠের ব্যর্থতার সঙ্গে পারিশ্রমিক প্রাপ্তির প্রসঙ্গ টানা কেউ সরাসরি তাঁদের বেতন দেন না। জনগণের পরোক্ষ করে ক্রিকেট বোর্ড চলে না, নাজমুলদের বেতনও তাই জনগণ দেয় না। কিন্তু...
কিন্তু সরাসরি পকেট থেকে টাকা না গেলেও যে আনন্দের জন্য মানুষ নাজমুলদের খেলা দেখেন, যে দেখাটাই আবার ক্রিকেট বোর্ডের আয়ের পথ করে দেয়; বৃহত্তর অর্থে নাজমুলদের বেতনের সংস্থানও করে—সেই মানুষের তো ক্রিকেটারদের কাছে ভালো কিছুর প্রত্যাশা থাকেই। সেই প্রত্যাশা থেকে উদ্ভব হয় সুযোগ-সুবিধা আর মাঠ থেকে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসাব মেলানোর প্রশ্ন। বিপুল বৈপরীত্য দেখলে আসে তুলনা টানা জিজ্ঞাসাও। তবে এ দেশের আরও অনেক ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠানের মতো নাজমুলদেরও হয়তো এসব জিজ্ঞাসার মুখোমুখি হতে ভালো লাগে না। আর ‘খোঁটা’ ‘খোঁটা’ মনে হলে তো প্রশ্নই আসে না।
ক্রিকেটারদের বেতন ও ম্যাচ ফি কত বেড়েছে, সেটি বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেনি। তবে মার্চে বিসিবির সাধারণ সভায় ক্রিকেটারদের পারিশ্রমিক–সংক্রান্ত যে সিদ্ধান্ত হয়েছে, সেটি বিভিন্ন সূত্রে সংবাদমাধ্যমে খবর হয়েছে। গ্রেডিং অনুসারে, তিন সংস্করণের বিবেচনার হিসাবে বেতন নির্ধারণ হয়। তবে এ বছর উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে ম্যাচ ফি।
আগে একটা টেস্ট খেললে ম্যাচ ফি ছিল ৬ লাখ টাকা, ওয়ানডেতে ৩ লাখ। এ বছর সেটি বাড়িয়ে টেস্টে ৮ লাখ আর ৪ লাখ করা হয়েছে। বিসিবির ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগ থেকে ম্যাচ ফি বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতেই। অন্যতম যুক্তি ছিল ২০২০ সালের পর আর ফি বাড়েনি। তবে নাজমুল হাসানের নেতৃত্বাধীন বিসিবির বোর্ড সভায় প্রস্তাবটি শেষ পর্যন্ত অনুমোদন পায়নি। শুধু পারফরম্যান্স বোনাসের সিদ্ধান্ত হয়েছিল।
জিম্বাবুয়ের কাছে হারের প্রসঙ্গ টেনে বেতনের কথা তোলাও হয়তো রূঢ় মনে হতে পারে। কিন্তু যখন আরও দূরে তাকাবেন, দেখবেন ঘরের মাঠে টানা ৬ টেস্টে হার, দেশের মাটিতে সর্বশেষ ৯ ইনিংসের ছয়বারই দুই শর নিচে অলআউট, তখন কেউ যদি ‘ডুয়িং নাথিং টেকিং মানি’ মনে করিয়ে দেয়, খুব কি ‘খোঁটা’ হয়ে যায় তা?
২০২০ সালের পর ২০২৫—ম্যাচ ফি বেড়েছে পাঁচ বছর পর। প্রতি বছর যেহেতু বাড়েনি, মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় টাকার অংক বাড়াটা অস্বাভাবিকও নয়। কিন্তু কেউ যদি প্রশ্ন করে বসেন, এই পাঁচ বছরে দেশের ক্রিকেটে সাফল্য কতটা বেড়েছে? কিংবা এর আগের পাঁচ বছরে যেখানে ছিল, সেটাও কি আছে?
নিশ্চিতভাবেই ইতিবাচক কোনো জবাব নেই। মানুষ দেখছে এমন বাস্তবতা যে, পারফরম্যান্সে কোনো উন্নতি না থাকলে সুযোগ-সুবিধার গ্রাফ উর্ধ্বমুখী। সিলেট আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামে জিম্বাবুয়ের কাছে যে দলটি ৩ উইকেটে হেরেছে, সেটির প্রত্যেক ক্রিকেটারও পাচ্ছেন ৮ লাখ টাকা করে।
ক্রিকেট ম্যাচে সব দল সব ম্যাচ জেতে না, সব খেলোয়াড় প্রতি ম্যাচে রান করেন না বা উইকেট পান না। এই এক ম্যাচের দুই ইনিংসে একবারও তিন শ না করতে পারা বা পুরো ম্যাচে মাত্র তিনটি ফিফটি ও জিম্বাবুয়ের কাছে হারের প্রসঙ্গ টেনে বেতনের কথা তোলাও হয়তো রূঢ় মনে হতে পারে। কিন্তু যখন আরও দূরে তাকাবেন, দেখবেন ঘরের মাঠে টানা ৬ টেস্টে হার, দেশের মাটিতে সর্বশেষ ৯ ইনিংসের ছয়বারই দুই শর নিচে অলআউট, তখন কেউ যদি ‘ডুয়িং নাথিং টেকিং মানি’ মনে করিয়ে দেয়, খুব কি ‘খোঁটা’ হয়ে যায় তা?
আর সেটা বুঝতে পেরেই হয়তো কঠিন মুখে ‘মনে হয় আপনারা খুশি না’ বলার কিছুক্ষণ পরই মুখে হাসি নিয়ে এলেন নাজমুল। একটা উত্তরও দেওয়ার চেষ্টা করলেন, ‘আর কী করলে ভালো করব, জিনিসটা এমন নয়। ভালো ক্রিকেট খেলা অনেক জরুরি। দায়িত্ব নিয়ে খেলাটা খুব জরুরি। আমরা যেমন ক্রিকেট খেলছি, আমাদের অবশ্যই সেই দায়িত্বটা নিতে হবে যে আমরা ভালো করতে পারছি না।’
বড় স্বপ্ন দেখার কাজটাই যা ধারাবাহিকভাবে হচ্ছে, পাকিস্তানের মাটিতে টেস্ট সিরিজ কিংবা ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে টি-টোয়েন্টি সিরিজ জয়ের মতো ঘটনা ঘটছে অনিয়মিতভাবে। বিচ্ছিন্ন সেসব সাফল্য ছাপিয়ে বড় হয়ে ওঠে তাই ব্যর্থতার ছবিগুলোই। চার বছর ধরে টেস্ট না জেতা জিম্বাবুয়ের কাছে ঘরের মাঠে হার, যা কাটা গায়ে নুনের ছিটার ওপর মরিচের গুঁড়ার যন্ত্রণাময় অনুভূতি দেয় সমর্থকদের।
দায় স্বীকারের সংস্কৃতি যে দেশে খুব জোরালো নয়, সে দেশে মুখে ‘দায় ও দায়িত্ব’ কবুল করা ভালো লক্ষণ। কিন্তু নাজমুলদের দলে এটাও এখন নিয়মিত ঘটনা। যেমন গত বছর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে উঠতে না পারার পর বলেছিলেন, ‘আমরা সবাইকে হতাশ করেছি, পুরো দলের পক্ষ থেকে ক্ষমা চাইছি’, সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে ভারত সফরের সব ম্যাচ হেরে আসার পর বলেছিলেন, ‘আমরা সেরা ক্রিকেট খেলিনি।’
আর এ বছরেরই ফেব্রুয়ারিতে ‘চ্যাম্পিয়ন হতে যাচ্ছি’ আওয়াজ দিয়ে চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে যাওয়ার পর দুই ম্যাচে ১৫০–র বেশি ডট বল আর একবারও ২৫০ রান করতে না পেরে বিদায়ের পরও ছিল আত্মসমর্পণের সুর, ‘ফলাফল হয়নি। কিন্তু আমাদের দলে আমরা যারা আছি, সব সময় স্বপ্নটা বড় দেখার চেষ্টা করি।‘
বড় স্বপ্ন দেখার কাজটাই যা ধারাবাহিকভাবে হচ্ছে, পাকিস্তানের মাটিতে টেস্ট সিরিজ কিংবা ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে টি-টোয়েন্টি সিরিজ জয়ের মতো ঘটনা ঘটছে অনিয়মিতভাবে। বিচ্ছিন্ন সেসব সাফল্য ছাপিয়ে বড় হয়ে ওঠে তাই ব্যর্থতার ছবিগুলোই। চার বছর ধরে টেস্ট না জেতা জিম্বাবুয়ের কাছে ঘরের মাঠে হার, যা কাটা গায়ে নুনের ছিটার ওপর মরিচের গুঁড়ার যন্ত্রণাময় অনুভূতি দেয় সমর্থকদের।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাই প্রশ্ন ওঠে, বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা কেন পারেন না। সাংবাদিকেরা প্রশ্ন করেন, বোর্ড থেকে আর কী সুযোগ-সুবিধা দরকার ভালো করার জন্য।
সবাই অবশ্য প্রশ্ন করেন না। কেউ বিদ্রূপও করেন, রসিকতা করেন, টিপ্পনী কাটেন। যেমন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একজন কুইজ দিয়েছেন, বলুন তো পৃথিবীর কোন জায়গায় পারফরম্যান্স খারাপ করলেও বেতন বাড়ে?
কেউ আবার রসিকতা, হাসিঠাট্টার মধ্যেই নেই। সোজাসাপটা দাবি, এদের বেতন, ম্যাচ ফি কমিয়ে দাও।
দাবিটার আরও বাস্তবসম্মত পদ্ধতিও আছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের ‘কাজের বিনিময়ে খাদ্য’ কিংবা বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের ‘কাজ নাই, মজুরি নাই’ ধরনের চাকরি আরকি!
কিন্তু নাজমুলরা কি সেটা মানবেন?