বোলাররা ভুলিয়ে দিলেন সকালের দুঃস্বপ্ন

৪৭ রানে ৪ উইকেট নেন ইবাদত হোসেনছবি: প্রথম আলো

জোনাথন ট্রট কাল কথাটা বলেছিলেন ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি ঝুলিয়ে। হাসির অনুবাদ করে নেওয়াটা কঠিন কিছু ছিল না। ‘কাল (আজ) আমাদের লক্ষ্য থাকবে ১০ রানের মধ্যে বাংলাদেশের বাকি ৫ উইকেট ফেলে দেওয়া। এরপর ৫০০ রান করা...’—ট্রটের এই কথার সঙ্গে ওই হাসি মিলিয়ে ব্যাপারটা রসিকতাই ছিল আসলে।

আফগানিস্তান কোচের মুচকি হাসি মৃদু শব্দতরঙ্গ তুলে সংক্রমিত হয়েছিল সামনে বসা সাংবাদিকদের মধ্যে। বাংলাদেশের স্কোরবোর্ডে ৫ উইকেটে ৩৬২ রান। উইকেটে থাকা দুই ব্যাটসম্যান মুশফিকুর রহিম ও মেহেদী হাসান মিরাজ ফিফটির সুবাস নিতে নিতে মাঠ ছেড়েছেন। বাংলাদেশের এমন দিন শেষে ট্রটের ও রকম রসিকতার জবাবে সমস্বরে হেসে ওঠা ছাড়া আর কীই–বা করার ছিল!

কথাটা ট্রটেরও বিশ্বাস করে বলার কোনো কারণ ছিল কি! বিশেষ করে নিজেই যখন স্বীকার করে নিয়েছেন আফগানিস্তানের বোলিংটা ভালো হয়নি। এক রাত ঘুমিয়ে পরদিন সেই বোলাররাই তেড়েফুঁড়ে বোলিং করে ১০ রানের মধ্যে বাংলাদেশের বাকি ৫ উইকেট উপড়ে ফেলবেন, এটা কেবল কল্পলোকেই সম্ভব মনে হচ্ছিল।

কিন্তু আজ সকালে যখন মাত্র ৪৫ মিনিট ব্যাটিং করেই ১০ রানে না হোক, মাত্র ২০ রানে বাংলাদেশ তাদের প্রথম ইনিংসের শেষ ৫ উইকেট হারিয়ে ফেলল, আফগানিস্তান কোচও নিশ্চয়ই অবাক হয়ে ভেবেছেন, ‘আমার কথাটা এভাবে ফলে গেল!’

প্রথম ইনিংসে সেঞ্চুরি করা নাজমুল হোসেন দ্বিতীয় ইনিংসে ফিফটি করে অপরাজিত
ছবি: প্রথম আলো

অবশ্য সব কথাই যদি ফলে যাবে, তাহলে তো কোচের চেয়ে ট্রটের বড় পরিচয় হয়ে যায় ভবিষ্যৎদ্রষ্টা! ‘এরপর ৫০০ রান করা...’, কথাটা তাই আরও বড় রসিকতা হয়ে তাঁকে কোচই রেখে দিল। বাংলাদেশকে ৩৮২ রানে থামিয়ে আফগানিস্তান যে প্রথম ইনিংসে অলআউট মাত্র ১৪৬ রানে!

আরও পড়ুন

২৩৬ রানের লিড নিয়েও অবশ্য বাংলাদেশ আফগানিস্তানকে ফলোঅন করায়নি। দ্বিতীয় ইনিংস ব্যাট করতে নেমে দিন শেষ করেছে ১ উইকেটে ১৩৪ রান করে। তাতে লিড বেড়ে এখনই ৩৭০। ফিফটি করে অপরাজিত ওপেনার জাকির হাসান ও নাজমুল হোসেন।

শরীফুল নেন ২ উইকেট
ছবি: প্রথম আলো

আফগানদের আজই দ্বিতীয়বার ব্যাট করতে না ডাকার কারণটা সহজেই অনুমেয়। চতুর্থ ইনিংসে ব্যাট করার ঝুঁকি কেন নেবে বাংলাদেশ! টেস্টের তখনো তিন দিন আর প্রায় এক সেশন বাকি। ২৩৬ রানের লিডের সঙ্গে যদি আরও শ দুয়েক রানও যোগ হয়, চতুর্থ ইনিংসে আফগানিস্তানের জন্য সেটা হবে পাহাড়সম, ম্যাচ জেতাতে বাংলাদেশের বোলারদের কাজটাও হয়ে উঠবে সহজ। তা ছাড়া এ রকম ভ্যাপসা গরমে পরপর দুই ইনিংস বোলিং–ফিল্ডিং করাটাও কিছুটা ক্লান্তিকর হতো।

আরও পড়ুন

তার চেয়ে আফগানিস্তানকে ফলোঅন না করিয়ে তৃতীয় দিনেই টেস্ট জেতার চেষ্টা করাটাকেই ঠিক মনে করলেন বাংলাদেশ অধিনায়ক লিটন দাস। প্রতিপক্ষ আফগানিস্তান বলেই তাঁর এই সিদ্ধান্ত প্রেসবক্সের ভেতর–বাইরে বেশ সমর্থন পেল।

কিন্তু দ্বিতীয় দিনের শুরুটা যে রকম লন্ডভন্ড ব্যাটিং দিয়ে হয়েছিল, তাতে শেষটা এমন স্বস্তিতে না–ও হতে পারত। সকালে মাত্র ২০ রানে শেষ ৫ উইকেট হারিয়ে ফেলার নির্মম বাস্তবতার সঙ্গে শেষ বেলার যে এত অমিল, তার পুরো কৃতিত্বই দিতে হয় বাংলাদেশের বোলারদের। তবে সে প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে আফগান বোলিংয়ের কথাটাও একটু বলে নেওয়া উচিত, বিশেষ করে নিজাত মাসুদের কথা।

বাংলাদেশের তৃতীয় বোলার হিসেবে দেড় শ উইকেটের মাইলফলক স্পর্শ করেন মেহেদী হাসান মিরাজ
ছবি: প্রথম আলো

আমির হামজার পর মাত্র দ্বিতীয় আফগান বোলার হিসেবে অভিষেকেই ৫ উইকেট নিয়ে নিজাত মাসুদ এই টেস্টে এখন পর্যন্ত আফগানিস্তান দলের সবচেয়ে সফল ক্রিকেটার। কাল সকালে টেস্ট ক্রিকেটে নিজের প্রথম বলেই ফিরিয়েছেন বাংলাদেশ ওপেনার জাকিরকে। এরপর মুমিনুল হককেও কট বিহাইন্ড করা এই পেসার আজ নিয়েছেন মুশফিকুর রহিম, তাইজুল ইসলাম আর শরীফুল ইসলামের শেষ উইকেটটি।

আফগানিস্তানের নির্বিষ বোলিং আক্রমণের প্রতিনিধি হয়েও বেশ ব্যতিক্রম বলতে হয় নিজাতকে। বিশেষ করে ৪৭ রান করা মুশফিককে যে শর্ট বলটাতে কট বিহাইন্ড করেছেন, এই টেস্টে এখন পর্যন্ত ওটাকেই বলতে হবে সেরা বল।

আরও পড়ুন

অফ স্টাম্পের বাইরে বলটা লাফিয়ে উঠেছিল বেশ। মুশফিক বলটাকে নিচের দিকে নামিয়ে খেলার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। ব্যাটের হ্যান্ডল আর গ্লাভস ছুঁয়ে বল যায় সেকেন্ড স্লিপে দাঁড়ানো নাসির জামালের হাতে। ৪৭ রানে আউট হন মুশফিক। ফিফটির সুবাস পাওয়া আরেক ব্যাটসম্যান মিরাজও আউট হয়ে গেছেন ৫০–এর আগেই (৪৮)। মিরাজসহ দিনের বাকি ২ উইকেটই আরেক পেসার ইয়ামিন আহমেদজাইয়ের।

শরীফুলের ‘সিউ’ উদ্‌যাপন
ছবি: প্রথম আলো

সকালটা এমন বিপর্যয় দিয়ে শুরু হলেও বোলারদের হাত ধরে বাংলাদেশ ম্যাচে ফেরে দ্রুতই। কালও সবুজ থেকে যাওয়া উইকেটে দুই পেসার ইবাদত হোসেন আর শরীফুলের বাউন্সারের সামনে বেশ অস্বস্তিতেই ভুগতে হয়েছে আফগান ব্যাটসম্যানদের। মধ্যাহ্নবিরতির আগে স্কোরবোর্ডেও তার জ্বলজ্বলে প্রতিফলন, ৩৫ রানে নেই আফগানিস্তানের তিন টপ অর্ডার ব্যাটসম্যান।

সেই ধাক্কা থেকে পুরো ইনিংসেই আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি আফগানিস্তান। পরের সেশনে ৫ উইকেট হারিয়ে চা–বিরতির সময় স্কোর ১৪৪/৮। বাংলাদেশের দুই স্পিনার তাইজুল ইসলাম আর মিরাজ ২ উইকেট করে নিয়েছেন, তবে আফগানিস্তানকে ধসিয়ে দেওয়ার কৃতিত্বটা পেস বোলারদেরই দিতে হবে বেশি।

তাঁদের সৌজন্যে বাংলাদেশের ফিল্ডিংটা বেশির ভাগ সময়ই দেখা গেল উইকেটকিপার–স্লিপ–গালি মিলিয়ে কিছুটা অর্ধবৃত্ত সাজিয়ে।

এক পর্যায়ে স্লিপ কর্ডনে এমন ফিল্ডিংই সাজিয়েছিল বাংলাদেশ
ছবি: প্রথম আলো

ইবাদত হোসেনের কথা তো আলাদা করেই বলতে হবে। সামনে বল ফেলে ফেলে হঠাৎই বাউন্সার দিয়ে ‘সারপ্রাইজ’ দিতে চেয়েছেন ব্যাটসম্যানদের। সেটারই সুফল ৪৭ রানে ৪ উইকেট। তিন পেসারের মধ্যে চোট থেকে ফেরা এক তাসকিন আহমেদই ‘নো’ বল আর লাইন লেংথ মিলিয়ে কিছুটা অস্বস্তিতে ভুগেছেন বলে মনে হয়েছে।

আর অস্বস্তি ছিল ফিল্ডিং নিয়ে। রানআউট মিস হয়েছে, ক্যাচ পড়েছে একাধিক। দিন শেষে সেগুলোর দিকে বিশেষভাবে চোখ পড়ছে না; কারণ, দিনের শেষটা তৃপ্তি নিয়েই পার করেছে বাংলাদেশ। দ্বিতীয় ইনিংসের দ্বিতীয় ওভারেই ওপেনার মাহমুদুল হাসান ফিরে গেলেও আরেক ওপেনার জাকির এবং প্রথম ইনিংসের সেঞ্চুরিয়ান নাজমুল হোসেন দুজনই ৫৪ রানে অপরাজিত থেকে দিন শেষ করেছেন।

নাজমুল ও জাকির মাঠ ছেড়েছেন ফিফটি করে অপরাজিত থেকে
ছবি: প্রথম আলো

এখান থেকে কাল সকালে বাংলাদেশের লক্ষ্য কী হতে পারে, সেটা তো বোঝাই যাচ্ছে। আক্রমণাত্মক ব্যাটিংয়ে রানটাকে দ্রুতই আরও বাড়িয়ে নিয়ে আফগানদের ব্যাটিংয়ে আমন্ত্রণ জানানো। সকালের ও রকম দুঃস্বপ্নের পরও এভাবে দিন শেষ করতে পারাটা আসলে বোলারদের এনে দেওয়া উপহারই।