ধোনি কেন আইপিএল ছাড়তে পারছেন না: পেছনে হাজার কোটি টাকার খেলা
বয়স ৪৪, শরীরও আর আগের মতো চলছে না। তবু মহেন্দ্র সিং ধোনি আইপিএল ছাড়েননি। সর্বশেষ মৌসুমে খেলেছেন, শোনা যাচ্ছে, পরের মৌসুমেও খেলবেন। অথচ তাঁর মাঠের পারফরম্যান্স বলছে, সময় ফুরিয়েছে। তবু তিনি খেলে যাচ্ছেন কেন? ক্রিকেট ছাড়তে পারছেন না তাই? নাকি খ্যাতির মোহ? সত্যিটা এসবের চেয়েও বড়—ধোনি এখন শুধুই একজন ক্রিকেটার নন, তিনি একটি বিশাল অর্থনৈতিক ইকোসিস্টেমের মূল স্তম্ভ, যাঁর বিদায় মানে অনেক কিছুর ধস।
চলুন দেখা যাক, কীভাবে ধোনির একটুখানি মাঠে থাকা বদলে দেয় বিশাল অঙ্কের হিসাব।
২৩ কোটি ৫০ লাখ ডলারের ব্র্যান্ড ভ্যালু
২০২৫ আইপিএল ছিল চেন্নাই সুপার কিংসের (সিএসকে) জন্য ফ্র্যাঞ্চাইজিটির ইতিহাসেই সবচেয়ে বাজে মৌসুম। পয়েন্ট তালিকায় একেবারে তলানিতে থেকে মৌসুম শেষ করেছে তারা। কিন্তু অবাক হওয়ার মতো ব্যাপার, এর কোনো প্রভাবই পড়েনি সিএসকের ব্র্যান্ড ভ্যালুতে; বরং সামান্য বেড়েছে!
হুলিহ্যান লোকির ‘আইপিএল ব্র্যান্ড ভ্যালুয়েশন স্টাডি ২০২৫’ প্রতিবেদন বলছে, ২০২৫ সালে সিএসকের ব্র্যান্ড ভ্যালু বেড়ে হয়েছে ২৩ কোটি ৫০ লাখ ডলার, যা ২০২৪ সালে ছিল ২৩ কোটি ১০ লাখ ডলার। যদিও আইপিএলের সবচেয়ে দামি ফ্র্যাঞ্চাইজির র্যাঙ্কিংয়ে চেন্নাই ১ নম্বর থেকে তিনে নেমে গেছে, কিন্তু সেটা পুরোপুরি মাঠের পারফরম্যান্সের কারণে নয়।
তুলনা করে দেখা যাক—রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরু (আরসিবি) প্রথমবার আইপিএল জেতায় তাদের ব্র্যান্ড ভ্যালু দাঁড়িয়েছে ২৬ কোটি ৯০ লাখ ডলারে, উঠে এসেছে ১ নম্বরে। অথচ সিএসকে কিছু না করেই সেরা তিনে আছে শুধু একজনের জন্য—ঠিক ধরেছেন, এম এস ধোনি!
দর্শকসংখ্যায় ‘ধোনি ইফেক্ট’
২০২৩ আইপিএলের একটি মুহূর্তই বলে দেয়, ধোনির উপস্থিতি কতটা গুরুত্বপূর্ণ। লক্ষ্ণৌ সুপার জায়ান্টসের বিপক্ষে মাত্র ৩ বল খেলেছিলেন ধোনি, করেছিলেন ১২ রান। তাতেই ওটিটি প্ল্যাটফর্মে ভিউয়ারশিপ পৌঁছায় ১ কোটি ৭০ লাখে, যা ছিল সে মৌসুমের সর্বোচ্চ। এমনকি টুর্নামেন্টের উদ্বোধনী ম্যাচের ১ কোটি ৬০ লাখ ভিউয়ারকেও ছাপিয়ে গিয়েছিল ধোনির সেই ৩ বল স্থায়ী ইনিংসটা!
টিএএম মিডিয়া রিসার্চ বলছে, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নেওয়ার পরও ধোনি দিনে গড়ে বিভিন্ন প্লাটফর্মে ১৪ ঘণ্টা স্ক্রিন টাইম ধরে রেখেছেন। ২০২৪ সালে তিনি ৪২টি ব্র্যান্ডের বিজ্ঞাপন করেছেন, যা অমিতাভ বচ্চন (৪১) ও শাহরুখ খানের (৩৪) চেয়েও বেশি।
কম বেতনে কোটি টাকার হিসাব
২০২৫ আইপিএল নিলামের আগে ধোনিকে রেখে দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল সিএসকে। সেটাও তাঁর পারফরম্যান্সের কারণে নয়, অন্য কারণে। ধোনি নিজেই তাঁর বেতন ৬৭ শতাংশ কমিয়ে দিয়েছিলেন—১২ কোটি টাকা থেকে নামিয়ে এনেছিলেন ৪ কোটিতে। ওদিকে সিএসকে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডকে (বিসিসিআই) অনুরোধ করেছিল আনক্যাপড প্লেয়ারের নিয়মটি ফিরিয়ে আনার জন্য, যে নিয়মে অবসরপ্রাপ্ত আন্তর্জাতিক খেলোয়াড়দের কম খরচে ধরে রাখার সুযোগ আছে। প্রশ্ন হচ্ছে, যে খেলোয়াড় তাঁর সেরা সময় পেছনে ফেলে এসেছেন, তাঁর জন্য এত চেষ্টা কেন? এটা নিছকই চেন্নাইয়ের প্রতি ধোনির এত দিনের আনুগত্যের প্রতিদান বা কোনো ক্রিকেটীয় কারণে নয়; বরং এটা ওরা করেছে একটা সুচিন্তিত অর্থনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবে।
ধোনির এক সাবেক সিএসকে সতীর্থ সম্প্রতি বলেছেন, ‘মাঠে সে যতটুকুই থাকে, সেইটুকু সময়ের জন্যই মানুষ (বিজ্ঞাপনদাতা থেকে শুরু করে দর্শক) পয়সা দিতে রাজি। ওর মতো কেউ যখন খেলা ছেড়ে দেবে, তখন দলটার প্রতি এমনকি খেলাটার প্রতিও আকর্ষণ কমে যেতে পারে।’
ধোনিই চেন্নাইয়ের বাণিজ্যিক মেরুদণ্ড
২০২৪ মৌসুমে সিএসকে শুধু স্পনসরশিপ থেকেই আয় করেছে ১ কোটি ৭০ লাখ ডলারের বেশি। স্পনসরদের তালিকায় ছিল টিভিএস ইউরোগ্রিপ, গালফ অয়েল, ইতিহাদ এয়ারওয়েজের মতো বড় বড় ব্র্যান্ড। আর ধোনির একার ব্র্যান্ড ভ্যালু ছিল প্রায় ৯ কোটি ৫০ লাখ ডলার। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে তাঁর হাজার কোটি টাকার ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য—গারুদা অ্যারোস্পেস, ব্লু স্মার্ট মোবিলিটি, সেভেন স্পোর্টসওয়্যারের মতো নানা বিনিয়োগ।
সিদ্ধান্ত শুধু ধোনির একার নয়
২০২৫ আইপিএলে রুতুরাজ গায়কোয়াড় চোট পেয়ে ছিটকে পড়ার পর সিএসকে আবার ধোনিকেই অধিনায়ক বানিয়েছিল। বয়স ৪৪ হলেও দলের কাছে তিনিই এখনো ‘ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট বক্স’। হুলিহ্যান লোকির রিপোর্টও বলছে, সিএসকের খুবই হতাশাজনক পারফরম্যান্স সত্ত্বেও দলে ধোনির প্রভাব অনস্বীকার্য ও অপরিসীম। তার মানে ধোনি চাইলেই আইপিএল ছেড়ে অবসরে যেতে পারবেন না, সিএসকে এত সহজে তাঁকে ছাড়বেই না।