বিশ্বকাপ থেকে পাকিস্তানের ক্রিকেটের যত নাটক

পাকিস্তানের অধিনায়কত্ব ছেড়েছেন বাবর আজমএএফপি

ক্রিকেট বিশ্লেষক হার্শা ভোগলেই বোধ হয় যথার্থ বলেছিলেন। অন্তত তিনি তাঁর কথায় পাকিস্তান ক্রিকেটের আসল চিত্রটা ফুটিয়ে তুলতে পেরেছিলেন। ভারত বিশ্বকাপ চলাকালে ক্রিকবাজে হার্শা বলেছিলেন, ‘পাকিস্তান ক্রিকেট যাঁরা পরিচালনা করেন, তাঁদের চেয়ে হাস্যরসাত্মক আর কিছু ক্রিকেট বিশ্বে নেই। সোম, বুধ ও শুক্রবার নাজাম শেঠি পিসিবির চেয়ারম্যান আর মঙ্গল, বৃহস্পতি ও শনিবার জাকা আশরাফ চেয়ারম্যান। রোববার বিতর্ক হয়, আগামী সপ্তাহে কার হওয়া উচিত?’

হার্শা যখন এই কথা বলেছিলেন, তখনো পাকিস্তান ক্রিকেটে এত রদবদল হয়নি। বিশ্বকাপের পর এত রদবদল নিয়ে মন্তব্য করলে, কী বলতেন কে জানে! অবশ্য তাঁর মন্তব্য করার সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে না। কারণ, পাকিস্তান ক্রিকেটে নাটক খুব শিগগির বোধ হয় থামছে না।

আরও পড়ুন

বিশ্বকাপের পর বাবর আজম সরে দাঁড়ালেন, নতুন কোচিং স্টাফ এল, এলেন নতুন নির্বাচক—তাতে পাকিস্তান ক্রিকেটের নাটক কতটুকু থেমেছে? পাকিস্তান ক্রিকেটে উদ্ভট কাণ্ড বরং চলছেই। যার সবশেষ সংযোজন সমালোচনার মুখে নিয়োগের এক দিন পরই সালমান বাটকে প্রধান নির্বাচকের পরামর্শকের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, এক দিন পরই যাঁকে সরাতে হলো, তাঁকে নিয়োগ দেওয়া হলো কেন? অবশ্য বিশ্বকাপকে কেন্দ্র করে পাকিস্তান ক্রিকেটে ঘটে যাওয়া ঘটনা আমলে নিলে এটাকে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়, পাকিস্তান ক্রিকেটের স্বাভাবিক চরিত্র বলেই মনে হতে পারে।

পাকিস্তান ক্রিকেটের নাটকের বিভিন্ন অধ্যায়গুলো দেখে নেওয়া যেতে পারে।

প্রধান নির্বাচক ইনজামাম-উল হকের পদত্যাগ

প্রথম দুই ম্যাচ জয়ের পর পাকিস্তান বিশ্বকাপে টানা হারতে শুরু করে। তাতে পুরো পাকিস্তানেই অধিনায়ক বাবরের সঙ্গে নির্বাচক ইনজামামেরও সমালোচনা শুরু হয়। দল নির্বাচনে আনা হয় স্বজনপ্রীতির অভিযোগ। এমন সমালোচনার মুখে টানা চার ম্যাচে হারের পর পাকিস্তান জাতীয় ক্রিকেট দলের প্রধান নির্বাচকের পদ থেকে সরে দাঁড়ান ইনজমাম। একই সঙ্গে জুনিয়র নির্বাচক কমিটি থেকেও পদত্যাগ করেন তিনি। পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের (পিসিবি) নিবন্ধিত একটি খেলোয়াড়দের ব্যবস্থাপনা কোম্পানিতে ইনজামামের শেয়ার আছে এবং সে কারণে দলে খেলোয়াড় নির্বাচনে স্বার্থের সংঘাত তৈরি হয়েছে—এমন অভিযোগ ওঠার পর পিসিবি একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল। সে কমিটিকে তাদের কাজ ‘স্বচ্ছভাবে’ করে দেওয়ার সুযোগ করে দিতেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বলে এক বিবৃতিতে বলেছিলেন ইনজামাম।

বাবরের বার্তা ফাঁস

বাবর আজমের সঙ্গে কোনো ঝামেলা নেই, এটা প্রমাণ করতে পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের (পিসিবি) প্রধান জাকা আশরাফ বাবরের ব্যক্তিগত হোয়াটসঅ্যাপ বার্তা ফাঁস করেন। সেই বার্তা দেখানো হয়েছে একটি টেলিভিশনে।

পাকিস্তানের সাবেক উইকেটকিপার রশিদ লতিফ বলেছিলেন, অধিনায়ক বাবর পিসিবির প্রধান জাকা আশরাফের সঙ্গে ভারত থেকে ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছেন। এমনকি ফোন না ধরায় তিনি জাকা আশরাফকে হোয়াটসঅ্যাপে বার্তাও পাঠিয়েছেন। কিন্তু জাকা আশরাফ সেটাতেও সাড়া দেননি। কথাটা যে ঠিক নয়, সেটা বোঝাতে পাকিস্তানের চিফ অপারেটিং অফিসার সালমান নাসেরের সঙ্গে বাবরের হোয়াটসঅ্যাপ বার্তা প্রকাশ করেন জাকা আশরাফ। যেখানে বাবরকে সালমান জিজ্ঞাসা করেছিলেন, তিনি পিসিবির প্রধানকে ফোন করেছিলেন কি না।

আরও পড়ুন

অধিনায়ক বাবর অধ্যায়ের সমাপ্তি
বিশ্বকাপ-ব্যর্থতার পর দেশে ফিরে টেস্ট, ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি—তিন সংস্করণ থেকেই পাকিস্তানের অধিনায়কত্ব ছেড়ে দেন বাবর। তাঁর জায়গায় টেস্ট অধিনায়কের দায়িত্ব পান বাঁহাতি ব্যাটসম্যান শান মাসুদ ও টি-টোয়েন্টি অধিনায়কত্ব পান শাহিন শাহ আফ্রিদি। ওয়ানডে অধিনায়কের নাম এখনো ঘোষণা করেনি পিসিবি।

মিকি আর্থার ও মরনে মরকেল কেউ পাকিস্তানের
ছবি: পিসিবি

কোচিং স্টাফদের সরিয়ে দেওয়া
সাবেক পিসিবি চেয়ারম্যান নাজাম শেঠি অদ্ভুত এক চুক্তিতে পাকিস্তান দলের পরিচালক করেছিলেন মিকি আর্থারকে। একসঙ্গে এই কোচ কাজ করেছেন ডার্বিশায়ার ও পাকিস্তানের হয়ে। নাজাম শেঠি গ্রান্ট ব্র্যাডবার্নকে দিয়েছিলেন প্রধান কোচের দায়িত্ব। তবে এক বিশ্বকাপ শেষেই এই দুজনের সঙ্গে পাকিস্তান জাতীয় দলের সম্পর্ক ছিন্ন হয়। পাকিস্তান বোর্ডের তরফ থেকে বলা হয়, তাঁদেরকে অন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। বরখাস্ত না করে অন্য দায়িত্ব কেন? কারণ, বোর্ড চাইলেই তাঁদেরকে বরখাস্ত করতে পারছে না। জাকা আশরাফের নেতৃত্বাধীন পিসিবি অন্তর্বতীকালীন দায়িত্বে আছে। তারা চাইলেও বড় কোনো পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। শোনা যায়, সে কারণেই কোচিং স্টাফদের বরখাস্ত করেনি পিসিবি।

আরও পড়ুন

নতুন কোচিং ও নির্বাচক প্যানেল

মিকি আর্থারের জায়গায় দলের পরিচালকের দায়িত্ব দেওয়া হয় মোহাম্মদ হাফিজকে। অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড সফরে ৪৩ বছর বয়সী হাফিজই থাকবেন পাকিস্তানের প্রধান কোচের ভূমিকায়। পেস বোলিং কোচের দায়িত্ব দেওয়া হয় উমর গুল ও স্পিন বোলিং কোচ সাঈদ আজমকে। নতুন প্রধান নির্বাচক হিসেবে দায়িত্ব নেন ওয়াহাব রিয়াজ। অথচ ওয়াহাব এখনো ক্রিকেটকে পুরোপুরি বিদায় বলেননি।

লাহোরে গতকাল সংবাদ সম্মেলন করেন ওয়াহাব রিয়াজ
পিসিবি

নির্বাচক প্যানেলে সালমান বাট ও তাঁকে সরিয়ে দেওয়া

শুক্রবার সালমান বাট, কামরান আকমল ও রাও ইফতিখার আনজুমকে প্রধান নির্বাচকের পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ দেয় পিসিবি। পাকিস্তানের দল নির্বাচনে এ তিনজন ওয়াহাবকে পরামর্শ দেবেন বলে উল্লেখ করা হয়। বাটকে নিয়োগ দেওয়ার পর থেকেই শুরু হয় সমালোচনা। কেন ফিক্সিং–কাণ্ডে শাস্তি পাওয়া একজনকে এমন দায়িত্ব দিল পিসিবি, এই প্রশ্ন ওঠে। তবে সমালোচনার মুখে নিয়োগের এক দিন পরই বাটকে প্রধান নির্বাচকের পরামর্শকের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।

নিয়োগের এক দিন পরই সালমান বাটকে প্রধান নির্বাচকের পরামর্শকের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে
ছবি : এএফপি

ইএসপিএনক্রিকইনফো জানিয়েছে, বাটকে নির্বাচকের পরামর্শক পদে নিয়োগ দেওয়ার ব্যাপারে পিসিবির ভেতর থেকেই আপত্তি ছিল। অন্তত একজন এ ব্যাপারে নিজের আপত্তি জানিয়ে পদত্যাগের হুমকিও দিয়েছেন। চারদিকে প্রবল সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে দ্রুতই শনিবার সংবাদ সম্মেলন ডাকেন ওয়াহাব। সেখানে নতুন সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন তিনি।

পাকিস্তান দল বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ায় আছে। ১৪ ডিসেম্বর পার্থ টেস্ট দিয়ে শুরু হবে তিন ম্যাচের সিরিজ। পাকিস্তান দল নতুন উদ্যমে মাঠে ফিরলেই যে সব নাটকের শেষ হবে, এমনটা ভাবার কোনো উপায় নেই। কারণ, অন্তর্বর্তীকালীন এই কমিটির মেয়াদ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। এরপর যিনিই দায়িত্বে আসুন না কেন, পরিবর্তন নিশ্চিত।

আরও পড়ুন