‘চূড়া’র খোঁজে নেপালের ক্রিকেট-শেরপারা

গ্রাফিকস : প্রথম আলো

জাতে স্কটিশ ড্যানিয়েল রাইট শুধু শল্যবিদই ছিলেন না, লেখার হাতও ছিল। নেপালে ১০ বছর থেকে ‘হিস্ট্রি অব নেপাল’ নামে ১৮৭৭ সালে একটি বই প্রকাশ করেছিলেন। রাইট সেখানে লিখেছেন, ‘তরুণদের ক্রিকেট এবং অন্য খেলা শেখানোর অনেক চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু এসব বিনোদন অপমানের চোখে দেখা হতো।’

আরও পড়ুন

মেলবোর্নে টেস্ট ক্রিকেটের জন্মের বছর বইটির প্রকাশ। পৃথিবীর আরেক প্রান্ত নেপালে ক্রিকেট তখন অনাহূত। কিন্তু কথায় আছে, দ্বারে পড়ে থাকলে না খুলে পারে! অভিজাতদের হাত ধরে ক্রিকেটও তেমনি চাপা পড়ে ছিল নেপালে। ঘোমটা খুলেছে মহাকালের তোড়। ১৪৬ বছর পর এই ২০২৩ সালে এসে নেপালকে তাই দেখা যায় এশিয়া মহাদেশের শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই এশিয়া কাপে। প্রায় দেড় শতাব্দী ধরে নেপালের ক্রিকেট-শেরপারা খাড়া এক ‘পর্বতে’ উঠতে উঠতে এমন একটা ভিত পেয়ে গেছে, যেখান থেকে ‘চূড়া’টা দেখা যায়। নেপালের অধিনায়ক রোহিত পউদেল সেই চূড়া দেখেই সম্ভবত বলেছেন, ‘এটা কেবল শুরু। আমাদের যাত্রা কেবল শুরু হলো। আরও সাফল্য আসবে।’

রোহিত কথাটা বলেছিলেন গত মে মাসে। ঘরের মাঠে এসিসি প্রিমিয়ার কাপ জিতে এশিয়া কাপের টিকিট হাতে। জানতে চাওয়া হয়েছিল, এশিয়া কাপের গ্রুপ পর্বে বাবর আজম ও রোহিত শর্মার সঙ্গে তাঁর নামও উচ্চারিত হবে, কেমন লাগবে? রোহিত ‘ভালোই লাগবে’ বলে দায়িত্ব সেরেছিলেন, কারণ নজর তো সৌজন্যতায় নয়, চূড়ায়! নেপালের শেরপারা যেমন হয় আরকি, হাল ছাড়ে না।

পর্বত যত খাড়া আর কন্ডিশন (আবহাওয়া) যত প্রতিকূলই হোক, শেরপাদের জন্ম নাকি পর্বতে উঠতেই, এভারেস্ট বিজয়ী তেনজিং নোরগে থেকে রোহিতদের ‘পর্বত’ আলাদা হলেও লক্ষ্য একই—শিখরে ওঠা। সেটা রোহিত না পারলে অন্য কেউ এসে অন্য সময়ে পারবে, কিন্তু পারবেই। কারণ, ১৪৬ বছরের এই পথপরিক্রমায় নেপালে ক্রিকেট এখন সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা। ক্রিকেট যেহেতু অনাহূত থেকে এখন নেপালিদের হৃদয়ে, আর ইতিহাসও বলে নেপালিরা ভালোবেসে হারেনি। গোর্খারা যেমন যুদ্ধে, শেরপাদের প্রতিনিধি তেনজিং তেমনি এভারেস্ট বিজয়ে, ক্রিকেটে তাহলে কেন নয়?

আরও পড়ুন

পর্বতে উঠতে হোঁচট খেয়ে পিছিয়ে পড়তে হয়। ২০১৪ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলা নেপালের ক্রিকেট তারপর বেশি এগোয়নি। আরও বড় প্রশ্ন হতে পারে, যে নেপাল ক্রিকেট বোর্ডের জন্ম ব্রিটিশরা উপমহাদেশ ছাড়ার আগে (১৯৪৬), সেই তারা এখনো টেস্ট মর্যাদা পায়নি! ২০১৪ সালে এসে টি-টোয়েন্টি মর্যাদা পাওয়ার চার বছর পর ওয়ানডের মর্যাদা পায় নেপাল। এখনো খেলা হয়নি ওয়ানডে বিশ্বকাপ। টেস্ট ক্রিকেটের চূড়া আরও দূরের বাতিঘর। কিন্তু নেপালের ক্রিকেটে এসব হোঁচটে পিছিয়ে পড়েও উঠে দাঁড়িয়েছে। কারণ, শুধু ভালোবাসা নয়, দমও আছে; চূড়ায় উঠতে যেটা লাগে।

একদম গোড়া থেকে শুরু করা যাক। নেপালে ক্রিকেটের বীজ পোঁতা হয় রানাদের শাসনামলে। গত শতাব্দীর বিশের দশকে নেপালের মহারাজা চন্দ্র শুমশের জং বাহাদুর রানার ছেলে লেফটেন্যান্ট জেনারেল মদন শুমশের উচ্চশিক্ষার্থে ইংল্যান্ড থেকে ফিরে ক্রিকেটের প্রচলন করেন এবং এখানেও সেই একই গল্প। শুরুতে ক্রিকেট শুধু অভিজাতদের খেলা ছিল। শাসক রানা পরিবার এবং নেপালের আরও কয়েকটি অভিজাত পরিবারে খেলাটি সীমাবদ্ধ ছিল।

মদন শুমশের অভিজাতদের মধ্যে খেলাটি ছড়িয়ে দিতে নেপাল ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন গঠন করলেন। পাঁচ বছর পর বিপ্লবে পতন হলো রাজতন্ত্রের। গণতন্ত্র এসে ১৯৬১ সালে নেপাল ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনকে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের অধীন এনে ক্রিকেটকে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করল। মাঠ এবং অন্যান্য অসুবিধার জন্য আশির দশকেও কাঠমান্ডুর বাইরে খেলা হতো খুব কম।

আরও পড়ুন

পাল্টে যাওয়ার শুরু নব্বইয়ের দশক থেকে। জেলা ও আঞ্চলিক পর্যায় ও স্কুলে টুর্নামেন্ট চালু হলো। ১৯৯৪ সালে মিলল এসিসির সদস্যপদ। এর দুই বছর পর এল আইসিসির সহযোগী সদস্যপদও। সে বছরই ৬ সেপ্টেম্বর নেপাল জাতীয় দল খেলল প্রথম ম্যাচ, কুয়ালালামপুরে এসিসি ট্রফিতে। প্রথম ম্যাচে প্রতিপক্ষ? বাংলাদেশ!

সে ম্যাচে ‘নতুন মুখ’দের হারিয়ে পরে চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। পরের বছর আসে ওয়ানডে মর্যাদা এবং তিন বছর পর টেস্ট। নেপাল আইসিসি ও এসিসি ট্রফি খেলার গণ্ডি কাটাতে না পারলেও পাকা ফসল উঠছিল বয়সভিত্তিকে। ২০০২ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে হারায় সালমান বাটের পাকিস্তানকে। হেরেছিল বাংলাদেশও। চার বছর পর এই যুব বিশ্বকাপেই নেপাল প্লেট চ্যাম্পিয়ন। সেমিফাইনালে হারল ডিন এলগারের দক্ষিণ আফ্রিকা, প্লেট ফাইনালে মার্টিন গাপটিল, টিম সাউদি, কলিন মানরোদের নিউজিল্যান্ডও হারল পরশ খাড়কা-বসন্ত রেজমিদের হাতে। পরে তাঁরাই নেপালকে টেনে তুলেছেন।

২০০৮ ওয়ার্ল্ড ক্রিকেট লিগ ডিভিশন ফাইভের সেমিফাইনালে নেপালকে হারিয়ে দুই বছরের মধ্যে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলে আফগানিস্তান। নেপাল খেলেছে চার বছর পর বাংলাদেশের মাটিতে (২০১৪) বিশ্বকাপে। হংকং ও আফগানিস্তানকে হারিয়ে নেপাল বুঝিয়ে দিয়েছিল, দম আছে। চার বছর পর পাওয়া নেপালের ওয়ানডে মর্যাদা কোভিডের কারণে এক বছর বাড়িয়েছিল আইসিসি। এরপর নেপাল ওয়ানডে মর্যাদা ধরে রেখে নিজেদের প্রত্যাশাকেই ছাপিয়ে যায়। কীভাবে?

নেপালের বর্তমান কোচ মন্টি দেসাই গত ফেব্রুয়ারিতে যখন এলেন, ওয়ার্ল্ড কাপ সুপার লিগ ২ পয়েন্ট টেবিলে শেষ থেকে দ্বিতীয় দল ছিল নেপাল। ওয়ানডে বিশ্বকাপে খেলার কোয়ালিফায়ারে জায়গা পেতে শেষ ১২ ম্যাচে অন্তত ১১ জয় পেতে হতো নেপালকে। ওই যে বলা হলো শেরপাদের হাল না ছাড়া মানসিকতা, নেপাল কিন্তু রোমাঞ্চ ছড়িয়ে এই সমীকরণ অবিশ্বাস্যভাবে মিলিয়ে শুধু কোয়ালিফায়ারেই ওঠেনি, ওয়ানডে মর্যাদাও ধরে রাখে। প্রতিটি ম্যাচ এত রোমাঞ্চকর ও ‘ক্লোজ’ ছিল যে নেপালের কোচ দেসাই বলেছিলেন, ‘এই ১২টি ম্যাচ একেকটি পর্বে নেটফ্লিক্সে সিরিজ হতে পারে।’
একদম দম আটকে জেতা যে নেপাল জাতীয় দলের অভ্যাস, সেটা তাদের তকমাতেই পরিষ্কার—‘দ্য কার্ডিয়াক কিডস’।

আরও পড়ুন

কিন্তু জুনে জিম্বাবুয়েতে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে সুপার সিক্সে উঠতে না পেরে এই ছেলেরাই আবার নেপালিদের হৃদয় ভেঙেছে। তবু আশা থাকে, কারণ ২০১৪ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পর থেকে নেপালে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা তুঙ্গস্পর্শী। আইসিসির জরিপে সবচেয়ে অনুগত সমর্থকদেরও অন্যতম নেপালিরা। বোর্ড সেভাবে এগোতে পারেনি। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে ২০১৬ সালে নিষিদ্ধ হয়েছিল নেপাল ক্রিকেট বোর্ড। তিন বছর পর নিষেধাজ্ঞা ভেঙেছে। দুর্নীতির অভিযোগও হরহামেশা। কিন্তু একটি দেশে ক্রিকেটের ভিত গড়তে যে দুটি বিষয় আবশ্যিক—দর্শক-সমর্থক ও তারকা—এ দুটি পেয়ে গেছে নেপাল। আইপিএলসহ বিভিন্ন দেশে ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ খেলে নেপালের সবচেয়ে বড় তারকা হয়ে উঠেছেন সন্দীপ লামিচানে। ধর্ষণের অভিযোগে আদালতগত কারণে দলের সঙ্গে যেতে পারেননি। মামলার শুনানি পেছানোয় পরে ঠিকই দলে যোগ দিয়েছেন। এশিয়া কাপে নেপালিদের চোখও তাঁকেই খুঁজবে।

১৯৯৬ এসিসি ট্রফিতে খেলা নেপালের জাতীয় ক্রিকেট দল
ছবি : টুইটার

যেমনটা ১৯৮৬ এশিয়া কাপে বাংলাদেশের নজর ছিল গাজী আশরাফ হোসেন-মিনহাজুলদের ওপর। ওয়ানডে মর্যাদার আগে এই এশিয়া কাপেই প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছিল তখনকার সহযোগী সদস্য বাংলাদেশ। ১৮ বছর পর ২০০৪ এশিয়া কাপে আরও দুটি নতুন সহযোগী সদস্য দেখা গেল—হংকং ও আরব আমিরাত। আফগানিস্তান ২০১৪ এশিয়া কাপে সহযোগী সদস্য হিসেবে খেলার পর এবার পঞ্চম দল নেপাল।

বাংলাদেশ-আফগানিস্তান সহযোগী থেকে ‘পূর্ণ’ (ফুল মেম্বার) হয়ে খেলছে। নেপাল ঠিক এ জায়গাতেই ‘অপূর্ণ’। এশিয়া কাপে ভালো করতে পারলে কে জানে, এখান থেকেই পূর্ণতার যাত্রা শুরু হতে পারে। না হলেও সমস্যা নেই। শেরপারা কখনো হাল ছাড়ে না।

লামিচানে-গুলশান ঝা’রা জানেন, আজ না হলে কাল, তাঁরা না হলেও অন্যরা…‘কার্ডিয়াক কিডস’রা চূড়ার দেখা পাবেই।