বিদায় ডেভিড ‘গোলিয়াথ’ ওয়ার্নার

টেস্ট ক্যারিয়ারে শেষবারের মতো ব্যাটিং করতে নামছেন ওয়ার্নার। এই ছবিটি স্মরণীয় হয়ে থাকবে অনেকের মনেইএএফপি

জশ হ্যাজলউড-প্যাট কামিন্সদের দিকে তাকিয়ে বলতে পারেন লোকটার উচ্চতা মাত্র ৫ ফুট ৫ ইঞ্চি। কিন্তু শরীরটা গাট্টাগোট্টা। ক্রিকেট মাঠে সে শরীরের ভাষাও পাল্টে যায়। মনে হয়, গাট্টাগোট্টা শরীরের কোনো মুষ্টিযোদ্ধা! অহর্নিশ প্রতিপক্ষকে পাঞ্চ করছেন। ছোটখাটো শরীরটা দেখে তাঁকে কেউ কেউ বাইবেলের ডেভিডকেও স্মরণ করতে পারেন। কিন্তু ব্যাট হাতে ওয়ার্নার তো আসলে ওই ছোট শরীরের মধ্যে লুকিয়ে থাকা এক গোলিয়াথ—দৈত্য!

আমার পরিবারটা দারুণ, তাদের সঙ্গে প্রতিটি মুহূর্ত আমি উপভোগ করি। তাদের আমৃত্যু ভালোবাসি এবং আমি এটা নিয়ে বেশি কথা বলব না, আবেগতাড়িত হয়ে পড়ব। তবে ক্যানডিসকে ধন্যবাদ, আমার জন্য যা করেছে! তুমিই আমার জগৎ।’
ডেভিড ওয়ার্নার

সেই ‘দৈত্য’রই আজ বুকটা নিশ্চয়ই ভারী হয়ে এসেছিল? ধারাভাষ্যকার মার্ক হাওয়ার্ডের সঙ্গে মাঠে কথা শেষ করার পর বাঁ হাত দিয়ে বাঁ চোখের কোনা একটু মুছলেন ওয়ার্নার। তাঁকে জিজ্ঞাসা করলে হয়তো বলতেন, চোখের কোণে কী যেন পড়েছে! ওই যে চিরায়ত অস্ট্রেলিয়ান মানসিকতা আরকি—ভাঙবে তবু মচকাবে না, কাঁদবে তবু স্বীকার করবে না!

অথচ সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে কিছুক্ষণ আগেই জয় পেয়েছে অস্ট্রেলিয়া। পাকিস্তানকে ৮ উইকেটে হারিয়ে সিরিজও জিতেছে ৩-০ ব্যবধানে। ৫৭ রান করে ওয়ার্নার নিজেও অবদান রেখেছেন অস্ট্রেলিয়ার সিডনি টেস্ট জয়ে। তবু ম্যাচ শেষে ওয়ার্নারের কণ্ঠ শুনেই বোঝা গেছে গলাটা যেন একটু ধরে আসছিল। সেটাই স্বাভাবিক। ২০১১ সালের ডিসেম্বরে শুরু হওয়া দারুণ এক অভিযাত্রার যে সমাপ্তি ঘটল আজ—টেস্ট ক্রিকেটের আঙিনা থেকে সরে দাঁড়ালেন ডেভিড ‘গোলিয়াথ’ ওয়ার্নার!

মাঠে নামার পর পেয়েছেন পাকিস্তানের ক্রিকেটারদের বিদায়ী অভিবাদনও
এএফপি

ওয়ার্নারের টেস্ট রেকর্ড প্রায় সবারই জানা। ১১২ ম্যাচে ২০৫ ইনিংসে ৪৪.৫৯ গড়ে ৮৭৮৬ রান। ২৬ শতক ও ৩৭টি অর্ধশতক। অস্ট্রেলিয়ার টেস্ট ইতিহাসে রানের হিসাবে পঞ্চম ওয়ার্নার। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার ওপেনারদের মধ্যে আর কেউ টেস্টে ওয়ার্নারের মতো এত রান করতে পারেননি। চাইলে তাঁর এমন আরও অনেক রেকর্ডই বের করা যায় কিংবা বের হবে। তবে আজকের দিনটি সেসবের লগ্ন ছিল না।

আজকের দিনটি ছিল প্রস্থানের লগ্ন, যখন ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে সবকিছু দিয়ে দিতে ইচ্ছে করে! আর তাই ক্যারিয়ারের শেষ টেস্টে আউট হয়ে ফেরার পথে নিজের গ্লাভস ও হেলমেট ওয়ার্নার তুলে দিয়েছেন এক খুদে ভক্তের হাতে। অদৃশ্য পরম্পরা? উত্তরটা সময়ের হাতে তোলা রইলেও হাত বদল তো বলাই যায়!

আরও পড়ুন

আর সেই হাত বদলে এসসিজির দু-একজন দর্শকও চোখ মুছেছেন, দাঁড়িয়ে সম্মান জানিয়েছেন। গ্যালারিতে বসে থাকা ওয়ার্নারের স্ত্রী ক্যানডিস ওয়ার্নার সন্তানদের সামলাতেই ব্যস্ত ছিলেন। একটু পর সবাইকে নিয়ে তিনিও মাঠে নেমে এলেন। সন্তানদের জড়িয়ে ধরেন ওয়ার্নার। কাজটা বাসায় হয়তো তিনি নিয়মিতই করেন। কিন্তু আজ সন্তানদের জড়িয়ে ধরার মধ্যে পরিবারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানোর একটা বার্তা ছিল—ওয়ার্নার সেটাই বলেছেন হাওয়ার্ডকে, ‘তাদের সাহায্য ছাড়া আমি যেটা করি, সেটা করতে পারতাম না। মা–বাবার অবদানও কম নয়, তাঁরা আমার সুন্দর বেড়ে ওঠা নিশ্চিত করেছেন। ভাই স্টিভ, আমি তার পদাঙ্ক অনুসরণ করেছি। এরপর ক্যানডিস এল আমার জীবনে।’

ওয়ার্নার এরপর বাকি কথাগুলো বলতে গিয়ে যেন আবেগতাড়িত হয়ে পড়লেন। পাথর–চোয়াল মুখেও ব্যথার দাগগুলো কেমন স্পষ্ট হয়ে উঠছিল!

গ্রাফিক্‌স : মাহাফুজার রহমান

আবেগমাখা সেই কথাগুলো শুনুন ওয়ার্নারের মুখেই, ‘আমার পরিবারটা দারুণ, তাদের সঙ্গে প্রতিটি মুহূর্ত আমি উপভোগ করি। তাদের আমৃত্যু ভালোবাসি এবং আমি এটা নিয়ে বেশি কথা বলব না, আবেগতাড়িত হয়ে পড়ব। তবে ক্যানডিসকে ধন্যবাদ, সে আমার জন্য যা করেছে! তুমিই আমার জগৎ।’ ওয়ার্নার এ কথাগুলো বলার সময় মাঠে একটু দূরেই দাঁড়িয়ে ছিলেন অস্ট্রেলিয়ার খেলোয়াড়েরা। মাঠেও দর্শকদের নেমে আসার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। পিলপিল করে মাঠে ঢুকতে দর্শকেরাও কার্পণ্য করেননি। টেস্টের আঙিনা থেকে এই সংস্করণেরই অন্যতম সেরা এক খেলোয়াড়ের বিদায়টা দর্শকেরা যত কাছ থেকে সম্ভব দেখতে চেয়েছেন।

রোমাঞ্চকর ও বিনোদনদায়ী। যেভাবে খেলেছি তাতে লোকের মুখে হাসি ফোটাতে পেরেছি বলে বিশ্বাস করি এবং আশা করি তরুণেরাও আমাকে অনুসরণ করবে।
ডেভিড ওয়ার্নার

আর ওয়ার্নার তখন দেখছিলেন সতীর্থদের। হয়তো মনে মনে ব্যথাটা তখন টের পাচ্ছিলেন—সাদা পোশাকের এই মিলনমেলায় আমি আর থাকব না! ওয়ার্নার তাঁদের দিকে তাকিয়েই বললেন, ‘আমার মনে হয় যখন তাদের মাঠে নামতে দেখব কিন্তু আমি খেলব না, তখন একটু আবেগতাড়িতই হব। তবে যেটা বলেছি, এই দলটা দারুণ। আমাদের বেশির ভাগের বয়সই ত্রিশের ওপাশে। তাই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমরা আরও তরুণ না হলেও এই দলটা কর্মক্ষম, বিশ্বমানের এবং অসাধারণ।’

ওয়ার্নার নিজে এই দলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাস তাঁকে মনে রাখবে, ভুলতে পারবেন না অস্ট্রেলিয়া থেকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা তাঁর ভক্তরাও। কিন্তু ওয়ার্নারের নিজের তো একটা চাওয়া আছে! তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, লোকে তাঁকে কীভাবে মনে রাখবে, এ ব্যাপারে তাঁর নিজের কী প্রত্যাশা? উত্তরে বলেছেন, ‘রোমাঞ্চকর ও বিনোদনদায়ী। যেভাবে খেলেছি, তাতে লোকের মুখে হাসি ফোটাতে পেরেছি বলে বিশ্বাস করি এবং আশা করি তরুণেরাও আমাকে অনুসরণ করবে। সাদা বল থেকে টেস্ট ক্রিকেট—এটাই আমাদের খেলার শীর্ষবিন্দু। তাই কঠোর পরিশ্রম করো এবং লাল বলের ক্রিকেট খেলো; কারণ, এটাও মজার।’

ওয়ার্নার কথাগুলো বলার সময় তাঁর মুখ দেখে মনে হয়নি মজা পাচ্ছেন। বাঁ চোখটা মোছার সময় বোঝা যাচ্ছিল, ভেতরে-ভেতরে কোথাও নাড়িছেঁড়া ব্যথা হচ্ছে! মাথা নিচু করে চলে যাওয়ার সময় নিশ্চিত হওয়া গেল, সাদা রঙের সেই ‘বাঁধন’ আর নেই। ছিঁড়ে গেছে!

আরও পড়ুন