‘পিঞ্চহিটার’ কোচ জয়াসুরিয়ায় শ্রীলঙ্কার অন্য রূপ

কীভাবে শট খেলতে হয়, অনুশীলনে দেখাচ্ছেন সনাৎ জয়াসুরিয়া। এক সময় বোলারদের কচুকাটা করেছেন এই লঙ্কান কিংবদন্তিএএফপি

ওয়াই এ ইয়ামিলের সঙ্গে দেখা হয়েছিল গলে। টুকটুক চালক, গল স্টেডিয়াম থেকে এক রাতে হোটেল ফেরার পথে যাত্রী হয়েছিলাম তাঁর বাহনের। ক্রিকেটের সূত্রে শ্রীলঙ্কায় আসা শুনে ইয়ামিল খুশি হলেন বলে মনে হলো। শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটের সঙ্গে তাঁর নিবিড় যোগাযোগের বর্ণনা দিতে দিতে পৌঁছে দিলেন হোটেলে।

শেষ চমক তখনো বাকি। হোটেলে পৌঁছানোর পর ইয়ামিল ওয়ালেট থেকে বের করলেন একটু পুরোনো হয়ে যাওয়া তাঁর সাবেক আইডি কার্ড। যার পেছনে স্বয়ং সনাৎ জয়াসুরিয়ার স্বাক্ষর, সংসদ সদস্য জয়াসুরিয়া।

আরও পড়ুন

আইডি কার্ডটি সাক্ষ্য দিচ্ছে সাবেক শ্রীলঙ্কান অধিনায়ক জয়াসুরিয়া সংসদ সদস্য থাকার সময় ইয়ামিল ছিলেন তাঁর ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষী। হাতের ইশারায় দেখালেন ওই সময় তাঁর কাছে অস্ত্রও থাকত। এরপর মুঠোফোনের স্ক্রিনে আঙুল টেনে একের পর এক দেখাতে লাগলেন জয়াসুরিয়ার সঙ্গে তাঁর ছবিসমগ্র, সঙ্গে শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটের আরও অনেকের সঙ্গে সখ্যের প্রমাণ।

ভেবেছিলাম জয়াসুরিয়ার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হলে তাঁকে ইয়ামিলের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করব। ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষী থেকে ইয়ামিল কীভাবে টুকটুক চালক হয়ে গেলেন, সেটা জানতে চাইব। বাংলাদেশের তো একবার কোনো সংসদ সদস্যের ‘ব্যক্তিগত’ পদমর্যাদায় কেউ ঢুকতে পারলে জীবনে তাঁকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয় না। তাহলে ইয়ামিল কেন টুকটুক চালাচ্ছেন?

জয়াসুরিয়া সংসদ সদস্য থাকার সময় তাঁর ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষীর কাজ করা ইয়ামিলের সেই সময়ের পরিচয়পত্র
প্রথম আলো

কলম্বোয় আসার পর জয়াসুরিয়ার সঙ্গে গ্র্যান্ড সিনামন হোটেলে একদিন দেখাও হয়েছে। শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশ দলের ঠিকানা এই হোটেল। তবে হাত মিলিয়ে সৌজন্য বিনিময় শেষে কথা আর বেশি দূর এগোতে পারেনি। সঙ্গে থাকা শ্রীলঙ্কার ফিল্ডিং কোচ উপুল চন্দনা আর দলের নিরাপত্তা কর্মকর্তার সঙ্গে কী একটা নিয়ে জটিল আলোচনায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন শ্রীলঙ্কার কোচ জয়াসুরিয়া।

এ রকম পরিস্থিতিতে অন্যের কথার মধ্যে ঢুকতে হলে বাক্য বিরতিতে ঢুকতে হয়। কিন্তু ওই তিনজনের দুর্বোধ্য সিংহলিজ বাক্যালাপের কোথায় দাড়ি, কোথায় কমা পাশে দাঁড়িয়েও তা বুঝে উঠতে পারছিলাম না। ত্রিপক্ষীয় আলোচনাটি আমার কাছে জটিল থেকে আরও জটিলতর হয়ে যাচ্ছিল। এর মধ্যেই কার পোর্চে চলে এল তাঁদের নিতে আসা গাড়ি। ইয়ামিলকে নিয়েও আর কথা বলা হলো না।

কোচ হয়েও জয়াসুরিয়াই এ মুহূর্তে শ্রীলঙ্কা দলের সবচেয়ে বড় তারকা। ক্রিকেটের হিসেবে বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ার এর একটি কারণ তো বটেই, তবে অন্যতম কারণ অন্যটি। জয়াসুরিয়ার অধীন শ্রীলঙ্কা দল ওয়ানডেতে সোনালি সময় ফিরে পাবে, এই হলো এই দেশের ক্রিকেটের মূল আশা। দলটি সেটি পেতেও শুরু করেছে কিন্তু।

কালুভিতারানা ও জয়াসুরিয়া
আইল্যান্ড ক্রিকেট

১৯৯২ বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ড ওপেনার মার্ক গ্রেটব্যাচ বেসবলের পিঞ্চ হিটিংকে ক্রিকেটে নিয়ে এলেন। পরের বিশ্বকাপে সেটিকে অন্য মাত্রায় নিয়ে যান শ্রীলঙ্কার দুই ওপেনার—সনাৎ জয়াসুরিয়া আর রমেশ কালুভিতারানা।

এর পর থেকেই ওয়ানডের প্রচলিত ব্যাটিংয়ের ধারণা ধীরে ধীরে বদলে যেতে থাকে। মারকাটারি সব শটে দুই শ্রীলঙ্কান যে ঘরানার ব্যাটিং নিয়ে এসেছিলেন ওয়ানডেতে, আধুনিক ক্রিকেটে সেটি আরও বেশি প্রাসঙ্গিক। এখন তো মনে হয়, সেই সময়ের জয়াসুরিয়া-কালুভিতারানা চাইলে আজকের তিন শ পঞ্চাশোর্ধ ওয়ানডে, বেধড়ক ব্যাটিংয়ের টি-টোয়েন্টি আর ‘বাজবল’ টেস্টের মতো সবকিছুতেই মানানসই হতেন।

আরও পড়ুন

যা–ই হোক, সাদা বলের ব্যাটিংয়ে রীতিমতো বিপ্লব ঘটানো শ্রীলঙ্কাই এ বছরের চ্যাম্পিয়নস ট্রফি খেলতে পারেনি ২০২৩ বিশ্বকাপে নবম হওয়ায়। শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটের জন্য তা বড় এক আঘাত ছিল, যেটি উপশমের জন্য তারা ফিরে গেছে সেই ‘মাতারা হারিকেন’ জয়াসুরিয়ার কাছেই।

গত বছরের অক্টোবের জয়াসুরিয়াকে ২০২৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ পর্যন্ত শ্রীলঙ্কার প্রধান কোচের দায়িত্ব দেওয়া হয়। সাবেক বাঁহাতি ওপেনার অবশ্য গত বছরের জুলাই থেকেই দলটির অন্তর্বর্তী কোচের দায়িত্ব পালন করছিলেন। পূর্ণ মেয়াদে দায়িত্ব নেওয়ার আগেই তাঁর অধীন কলম্বোতে ভারতকে ২-০–তে ওয়ানডে সিরিজ হারায় শ্রীলঙ্কা, যেটি ছিল ২৭ বছরের মধ্যে ভারতের বিপক্ষে তাদের প্রথম দ্বিপক্ষীয় সিরিজ জয়। ঘরের মাঠে ওয়ানডে সিরিজ জিতেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, নিউজিল্যান্ড আর অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। এ সময়ের মধ্যে ওয়ানডেতে শ্রীলঙ্কার ব্যর্থতা বলতে গত জানুয়ারিতে নিউজিল্যান্ডে গিয়ে ২-১–এ সিরিজ হার। অন্য দুই সংস্করণে এখনো সম্ভবত জয়াসুরিয়ার প্রভাব দলে পড়তে শুরু করেনি। তারপরও ১০ বছর পর ইংল্যান্ডকে দেশের বাইরে হারানো, নিউজিল্যান্ডকে ঘরের মাঠে ধবলধোলাই টেস্টেও ছড়াচ্ছে নতুন সম্ভাবনার আলো।

জয়াসুরিয়া এখন শ্রীলঙ্কা দলের কোচ। অনুশীলনে অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুসের সঙ্গে আলাপচারিতায়
এএফপি

তবে এমন নয় যে এ পর্যায়ের ক্রিকেটে এসে জয়াসুরিয়া শ্রীলঙ্কার ব্যাটসম্যানদের পিঞ্চ হিটিং শেখাচ্ছেন। শ্রীলঙ্কা বাংলাদেশের মতো নয়, এখানে স্কুল আর বয়সভিত্তিক ক্রিকেট উঠতি বয়সেই ক্রিকেটারদের ভিত এত শক্ত করে দেয়, তাঁদের আর জাতীয়–আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এসে ব্যাট ধরা শিখতে হয় না। জয়াসুরিয়া তাহলে সাফল্যের কোন মন্ত্র পড়ে দিচ্ছেন শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটারদের কানে?

প্রথমবারের মতো পূর্ণাঙ্গ কোচের দায়িত্ব নেওয়ার পর জয়াসুরিয়া বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে সে সম্পর্ক ধারণাও দিয়েছেন। তাঁর মূল কোচিং-মন্ত্র দলে খেলোয়াড়দের স্বাধীনভাবে খেলতে দেওয়ার পরিবেশ তৈরি করা। শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটকে কাছ থেকে দেখা অনেকের পর্যবেক্ষণ, খেলোয়াড়েরাও কোচের এই প্রক্রিয়ায় প্রতি ইতিবাচক সাড়া দিচ্ছেন। দলের অনেকে বলছেন, একসময়ের প্রধান নির্বাচক জয়াসুরিয়া কোচ হয়ে কীভাবে দলের মানসিকতায় বদল নিয়ে আসছেন।

ওয়ানডে র‍্যাঙ্কিংয়ের চারে উঠে আসা শ্রীলঙ্কা দলকে বদলে ফেলায় জয়াসুরিয়ার আরেকটি সূত্র—খেলার একেবারে গোড়ায় ফিরে যাওয়ার চেষ্টা। ক্রিকেটারদের ফিটনেস, ফিল্ডিং আর রানিং বিটুইন দ্য উইকেটে বিশেষ দৃষ্টি দিচ্ছেন কোচ। এসব ছোটখাটো বিষয়ই গড়ে দিচ্ছে পার্থক্য। শ্রীলঙ্কা দলের অনুশীলনে নিখুঁত ফিল্ডিং ড্রিলও এখন নিয়মিত একটি পর্ব।

খেলোয়াড়দের স্বাধীনভাবে খেলার পরিবেশ তৈরি করেছেন জয়াসুরিয়া
এএফপি

জয়াসুরিয়ার দলে টপ অর্ডারে দলের কান্ডারি পাতুম নিসাঙ্কা। প্রথম লঙ্কান ব্যাটসম্যান হিসেবে ওয়ানডেতে ডাবল সেঞ্চুরির মালিক যেন ব্যাটিংটাকে এখন তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছেন। গল ও কলম্বোর দুই টেস্টেই সেঞ্চুরির পর এবার তিনি ওয়ানডে কাঁপানোর অপেক্ষায়। স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের ভাষ্য, কুমার সাঙ্গাকারার পর সব সংস্করণের জন্য এমন একজন পারফরমারই দরকার ছিল শ্রীলঙ্কার। নিসাঙ্কার মধ্যে ভালো কিছুর ক্ষুধা যেমন আছে, আছে সামর্থ্যও।

মিডল অর্ডারে আস্থার নাম চারিত আসালাঙ্কা। চাপের মুহূর্তে ম্যাচের পরিস্থিতি বদলে দিতে অধিনায়ক শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটে ‘রানাতুঙ্গার মতো ভরসা’ হিসেবে বিবেচিত হতে শুরু করেছেন। রানাতুঙ্গার মতোই ম্যাচ জেতানো ইনিংস খেলতে পারেন, যেটি দেখা গেছে রানাসিংহে প্রেমাদাসা স্টেডিয়ামে গত ফেব্রুয়ারিতে অস্ট্রেলিয়াকে ২-০–তে হারানো ওয়ানডে সিরিজে। দুই ম্যাচে আসালাঙ্কার রান ১২৭ ও অপরাজিত ৭৮।
হারের বৃত্তে ঘুরপাক খেতে থাকা শ্রীলঙ্কা আবারও ফিরে পাচ্ছে আত্মবিশ্বাস। প্রতিটি ম্যাচই যেন তাদের নতুন করে চেনাতে চায়। অস্বাভাবিক হবে না, যদি চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে খেলতে না পারার যন্ত্রণাটা ২০২৭ বিশ্বকাপে বড় কিছু করে ভুলতে চায় শ্রীলঙ্কা। আগামী বছরের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও নিশ্চয়ই দাগ কাটতে চাইবে ২০১৩-১৪–এর চ্যাম্পিয়নরা।

তারও আগে তিন ওয়ানডে আর তিন টি-টোয়েন্টির সিরিজ খেলতে তাদের সামনে এখন র‍্যাঙ্কিংয়ের দশে থাকা বাংলাদেশ, ওয়ানডে যাদের কাছে ভীষণই অগ্নিপরীক্ষা হয়ে দাঁড়িয়েছে ইদানীং। ওদিকে রানাসিংহে প্রেমাদাসা স্টেডিয়ামের স্পিনিং ট্র্যাক থেকে নাকি এবার রানের সুবাস আসছে। সে রকমই হলে পিঞ্চহিটার কোচের ব্যাটসম্যানরা নিশ্চয়ই গুরুকে দেখাতে চাইবেন, ‘হারিকেন’ তাঁরাও তুলতে পারেন।