পাকিস্তানি ওপেনার থেকে বলিউড অভিনেতা: এখনো যা ভোলেননি মহসিন খান
ক্রিকেট মাঠে লর্ডসের ডাবল সেঞ্চুরি, বলিউডে ধর্মেন্দ্র-বিনোদের পাশে অভিনয়—মহসিন খানের স্মৃতিচারণা যেন দুই মঞ্চের গল্প।
ক্রিকেট, বলিউড—ভিন্ন দুই জগতের কত স্মৃতি মহসিন খানের। পাকিস্তানের সাবেক ক্রিকেটার প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়াকে (পিটিআই) দেওয়া সাক্ষাৎকারে স্মৃতির ঝাঁপি খুলে দিয়েছিলেন। সেসব স্মৃতির বড় অংশজুড়েই ক্রিকেট মাঠ—যেখানে তিনি সামলেছেন সময়ের সবচেয়ে ভয়ংকর ফাস্ট বোলারদের, খেলেছেন ৪৮ টেস্ট ও ৭৫ ওয়ানডে। আরেক দিকে মুম্বাইয়ের ফিল্ম স্টুডিও—যেখানে এক ডজন ছবিতে অভিনয় করেছেন বলিউডের বড় তারকাদের পাশে।
মহসিন খান যখন খেলতেন, ক্রিকেট মাঠে নিয়মিতই দেখা হতো দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারত ও পাকিস্তানের। ১৯৮২ থেকে ১৯৮৪—এই তিন বছরেই ভারতের বিপক্ষে ১১টি টেস্ট খেলেছেন পাকিস্তানি ওপেনার। ভারতের সঙ্গে খেলার অনুভূতি কেমন ছিল সেটিই সবার আগে বললেন মহসিন, ‘ভারতের বিপক্ষে দেশে ও দেশের বাইরে খেলাটা দারুণ মজার ছিল। জিমির (মহিন্দর অমরনাথ) সঙ্গে খুব ভালো বন্ধুত্ব হয়েছিল। আমাদের সময়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঝাঁজ ছিল, কিন্তু কেউ অভব্য আচরণ করত না।’
১৯৭৯ সালে প্রথম ভারত সফর করেন মহসিন। যদিও সেই সফরে কোনো ম্যাচ খেলা হয়নি তাঁর। ভারতে সেই সফরেই সিনেমায় অভিনয়ের প্রস্তাব পেতে শুরু করেন মহসিন। তবে তখন ক্রিকেটেই পুরোপুরি মনোযোগী থাকার কথা বললেন মহসিন, ‘মানুষ বলত, ২০ দিন থেকে যান, আপনার অংশের শুটিং শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু আমার সব মনোযোগ ছিল ক্রিকেটে।’
১৯৮২ সালে প্রথম পাকিস্তানি ব্যাটসম্যান হিসেবে এক পঞ্জিকাবর্ষে ১ হাজার রান করেছিলেন। সেই বছরই লর্ডসে করেছিলেন ডাবল সেঞ্চুরি।
ক্যারিয়ার শুরুর কয়েক বছরের মধ্যেই সাফল্যের শিখরে পৌঁছে যান মহসিন। ১৯৮২ সালে প্রথম পাকিস্তানি ব্যাটসম্যান হিসেবে এক পঞ্জিকাবর্ষে ১ হাজার রান করেছিলেন। সেই বছরই লর্ডসে করেছিলেন ডাবল সেঞ্চুরি। সেই বছরের কথা আলাদা করেই বললেন মহসিন, ‘পাকিস্তানের প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে লর্ডসে ডাবল সেঞ্চুরি পাওয়াটা তো বিশেষ কিছুই ছিল।’
দুবছর পর অ্যাডিলেড ও মেলবোর্নে পরপর সেঞ্চুরি করেছিলেন ডেনিস লিলির মতো বোলারের বিপক্ষে খেলে। ‘ওই সেঞ্চুরিগুলো আলাদা করে মনে পড়ে। সময়ের সেরা পেসারের বিপক্ষে সফল হতে পেরেছিলাম। আমার মনে হয় আমি সেই সময়ে অন্য সব পাকিস্তানি ব্যাটসম্যানের চেয়ে বাউন্সি উইকেটে ভালো খেলতাম’—মনে করিয়ে দিলেন মহসিন।
১৯৮২ সালে ভারতের বিপক্ষে লাহোর টেস্টের এক ইনিংস তাঁর স্মৃতিতে এখনো টাটকা। প্রথম ইনিংসে করেছিলেন ৯৪, পরে দ্বিতীয় ইনিংসে পাকিস্তানের ১৩৫/১ স্কোরের ১০১ রানই এসেছিল তাঁর ব্যাট থেকে! মহসিন বললেন, ‘ওটা আমার প্রিয় ম্যাচগুলোর একটি।’
নিজের সময়ের প্রিয় খেলোয়াড় কারা ছিলেন সেটিও জানিয়েছেন মহসিন, ‘বোলারদের মধ্যে ইমরান খান, ডেনিস লিলি, রিচার্ড হ্যাডলি, ম্যালকম মার্শাল ও কপিল দেবকে ভালো লাগত। আর ব্যাটসম্যানদের মধ্যে সুনীল গাভাস্কার, মাজিদ খান, ভিভ রিচার্ডস ও গ্রেগ চ্যাপেলের খেলায় মুগ্ধ হতাম।’
ক্রিকেট ছিল তাঁর প্রথম প্রেম, তবে বলিউড হলো অপ্রত্যাশিত দ্বিতীয় ইনিংস। খেলা ছাড়ার পর আশির দশকের মাঝামাঝি মুম্বাই তাঁর জীবনের কেন্দ্র হয়ে ওঠে। বলিউডের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ অবশ্য ১৯৮৩ সাল থেকেই ছিল। সে বছর তিনি বিয়ে করেন ভারতীয় অভিনেত্রী রীনা রায়কে।
১৯৮৯ সালে প্রথম সিনেমা ‘বাঁটোয়ারা’ মুক্তি পায়। ‘বাঁটোয়ারা’য় তাঁর সহকর্মী ছিলেন ধর্মেন্দ্র ও বিনোদ খান্নার মতো অভিনেতা। বিনোদ খান্নার সঙ্গে তো পরে বন্ধুত্বই হয়ে যায় মহসিনের।
‘বাঁটোয়ারা’র একটি দৃশ্যে খুব আবেগঘন হওয়ার প্রয়োজন ছিল। পরিচালক জে পি দত্ত কীভাবে বিশেষ কৌশলে তাঁর কাছ থেকে অভিনয়টা আদায় করে নিয়েছিলেন সেটি বললেন মহসিন খান, ‘‘‘দত্তি বললেন, ধরো তুমি সেঞ্চুরি করেছ, কিন্তু পাকিস্তান হেরেছে। কেমন লাগবে?’’ এভাবেই তিনি আবেগটা বের করে আনতে বললেন।’
‘বাঁটোয়ারা’ তাঁকে এনে দিয়েছিল ফিল্মফেয়ার পুরস্কারের মনোনয়ন। ‘নানা পাটেকর, অনুপম খেরদের সঙ্গে একই বিভাগে মনোনয়ন পাওয়া একজন অনভিজ্ঞ অভিনেতার জন্য দারুণ ব্যাপার’ গর্বের সঙ্গে বললেন মহসিন।
মহেশ ভাটের সঙ্গে ‘সাথি’ ছবিতে কাজ করতে গিয়েও ভালো অভিজ্ঞতা হয় মহসিন খানের। সেই ছবিরই অমর গান ‘জিন্দেগি কে তালাশ মে হম’ আজও শোনা হয়। মহেশ ভাটের কথা বলতে গিয়ে একটু আবেগপ্রবণই হলেন মহসিন খান, ‘ভাট সাহেব একেবারেই অন্য রকম মানুষ। তাঁর সঙ্গে বসলে জীবনের দর্শন শিখতে পারতেন।’
নব্বইয়ের দশকে অভিনেত্রী রীনা রায়ের সঙ্গে বিচ্ছেদ হয় মহসিন খানের। সাক্ষাৎকারে রীনা রায়ের সঙ্গে বিয়ে-বিচ্ছেদ প্রসঙ্গ তিনি এড়িয়ে গেলেও মেয়েকে নিয়ে কথা বলেছেন। মেয়ে অবশ্য এখন থাকে মায়ের সঙ্গেই, জানালেন মহসিন খান, ‘ওর পড়াশোনা শেষ হয়েছে। মুম্বাইতেই মায়ের সঙ্গে থাকে, আমি যোগাযোগ রাখি। পাকিস্তানে স্কুলে পড়েছে, পরে উচ্চশিক্ষা নিয়েছে মুম্বাইয়ে।’