বড় হারের আগে মাহমুদউল্লাহর ‘মান বাঁচানো’ সেঞ্চুরি

বিপর্যয়ের মুখে সেঞ্চুরি করেছেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদছবি: এএফপি

দক্ষিণ আফ্রিকা: ৫০ ওভারে ৩৮২/৫

বাংলাদেশ: ৪৬.৪ ওভারে ২৩৩

ফল: দক্ষিণ আফ্রিকা ১৪৯ রানে জয়ী

মাহমুদউল্লাহর সেঞ্চুরিটাই ‘সমস্যা’ করছে। এর আগপর্যন্ত তো মনে হচ্ছিল, ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়াম চার দিন আগের ম্যাচটারই রিপ্লে দেখছে! প্রথমে ব্যাটিং করে দক্ষিণ আফ্রিকার রানের পাহাড়। যেটির জবাব দিতে নেমে পরে ব্যাটিং করা দলের হুড়মুড় করে ভেঙে পড়া। এরপর শুধুই শেষের অপেক্ষা।

মাহমুদউল্লাহ রুখে দাঁড়ানোর আগে তো হুড়মুড় করেই ভেঙে পড়েছিল বাংলাদেশের ইনিংস। যখন নেমেছেন, স্কোরবোর্ডে ৪ উইকেটে ৪২ রান। কিছুক্ষণ পরই তা ৫ উইকেটে ৫৮। ৪৬তম ওভারে আউট হয়ে ফেরার সময় বাংলাদেশ ২২৭। নিজের নামের পাশে ১১১। ঠিক ১১১ বলেই। ১১টি চার আর ৪টি ছয়ে বিশ্বকাপে মাহমুদউল্লাহর তৃতীয় সেঞ্চুরি।

আরও পড়ুন

বিশ্বকাপে বাংলাদেশের হয়ে প্রথম সেঞ্চুরিও তাঁর। ২০১৫ বিশ্বকাপে অ্যাডিলেডের সেই সেঞ্চুরিতে বাংলাদেশ পেয়েছিল স্মরণীয় এক জয়। কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠার টিকিটও। এদিন বাংলাদেশের জয়ের কোনো প্রশ্নই নেই। প্রশ্নটা একটু মান বাঁচানোর। মাহমুদউল্লাহর ব্যক্তিগত চাওয়া হয়তো আরেকটু বেশিই ছিল। অনেক নাটকের পর বিশ্বকাপ দলে আসার যথার্থতা প্রমাণের সুযোগটা কাজে লাগানো। আগের দুই ম্যাচেও তা অনেকটাই প্রমাণ করেছেন। এদিন আরও বেশি। এ কারণেই হয়তো দলের পরাজয় নিশ্চিত জানার পরও সেঞ্চুরি করে অমন উদ্‌যাপন। যদিও কারও চোখে তা ব্যক্তিগত অর্জনকেই বড় করে দেখার দোষে দুষ্ট বলে মনে হতেই পারে।

ম্যাচের জয়-পরাজয়ের প্রশ্ন তো মাহমুদউল্লাহ নামার অনেক আগেই শেষ। আসলে আরও আগে। দক্ষিণ আফ্রিকার ইনিংস শেষেই। প্রথম ইনিংস শেষেই কোনো ওয়ানডে ম্যাচের জয়-পরাজয়ের মীমাংসা হয়ে গেলে সেই ম্যাচ দেখাটা একটু যন্ত্রণাদায়কই বটে। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচে এমন হয়েছে। এই ম্যাচে তো আরও বেশি। গত বিশ্বকাপে বাংলাদেশ প্রথম ম্যাচেই দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে দিয়েছিল। সেটিও আগে ব্যাট করে ৩৩০ রানের পাহাড় গড়ে। আর এখানে জিততে যা করতে হতো, তা তো বাংলাদেশের সাধ্যের বাইরে।

আউট হয়ে ফিরছেন লিটন দাস
ছবি: এএফপি

ব্যাটিং করতে নামার সময় তাহলে বাংলাদেশের চাওয়াটা কী ছিল? আগে পারিনি বলে এবারও পারব না—এমন ভাবার সাহস ছিল বলে মনে হয় না। চাওয়ার থাকতে পারে একটাই। এরপর আরও চারটি ম্যাচ আছে। যতটা সম্ভব ভালো ব্যাটিং করে সেই ম্যাচগুলোর জন্য একটু আত্মবিশ্বাস সঞ্চয়।

সেই সামান্য চাওয়া পূরণ হওয়াটাও কী কঠিন! ১৫ ওভার শেষ হতে না হতেই ৫ উইকেট নেই। ২২তম ওভারে ৬ উইকেটে ৮১। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় পরাজয়ের রেকর্ড নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি শুরু হয়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। মাহমুদউল্লাহর কারণেই যা আর আলোচনায় থাকল না।

আরও পড়ুন

এই ম্যাচের আগে বাকি সব ছাপিয়ে বড় হয়ে উঠেছিল টস। যেন টস হয়ে যাওয়ার আধঘণ্টা পর যে ম্যাচটা শুরু হবে, তা শুধু খেলার জন্যই খেলা। জয়-পরাজয় তো চূড়ান্ত হয়ে যাবে টসেই। টস জেতা-হারাটা যেহেতু কারও হাতে নেই, অধিনায়কেরা সাধারণত এটিকে বড় করে দেখাতে চান না। টসে না জিততে না পারলেই সর্বনাশ, এমন একটা আবহ তৈরি হয়ে গেলে তো বিপদ। টস হেরে গেলে তখন দলকে কী বলে উজ্জীবিত করবেন অধিনায়ক? সাকিব এসব জানেন না, তা নয়। তারপরও কথায় পিঠে বলে ফেলেছিলেন, ‘দোয়া করবেন, টসটা যেন জিততে পারি।’

দোয়া যদি কেউ করেও থাকেন, তাতে কাজ হয়নি। সাকিব টসে হেরেছেন। ম্যাচের প্রথম এক ঘণ্টায় অবশ্য মনে হচ্ছিল, শুধু শুধুই টসকে এত বড় করে দেখানো। মুম্বাইয়ে যতই গরম থাক, প্রথম ব্যাটিং না করলেই ম্যাচ জেতা যাবে না, এটা কোনো কথা নাকি!

দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে সেঞ্চুরি করেছেন কুইন্টন ডি কক
ছবি: এএফপি

প্রথম ১০ ওভারে দক্ষিণ আফ্রিকা করতে পেরেছে মাত্র ৪৪ রান। সেটির বিনিময়মূল্যও আবার ২ উইকেট। মেহেদী হাসান মিরাজের হাতে নতুন বল তুলে দেওয়াটাকে তখন মনে হচ্ছিল মাস্টার স্ট্রোক। পেস আর বাউন্সবান্ধব বলে পরিচিত ওয়াংখেড়ের উইকেট কি একটু মন বদলে স্পিনারদেরও ভালোবাসতে শুরু করল!

টানা ৭ ওভার বোলিং করে ২৫ রানে মিরাজের ১ উইকেট। এর আগেই প্রথম উইকেটটি তুলে নিয়ে শরীফুলের ওই উদ্‌যাপন। দিনটা হয়তো তাহলে বাংলাদেশেরই। নইলে কি আর ২১তম ওভারে গিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার ১০০ হয়! এই বিশ্বকাপে নিজেদের জন্য যে মানদণ্ড বেঁধে দিয়েছে তারা, সেই তুলনায় খুবই বাজে রান রেট। ৪০ ওভার পর্যন্ত ইনিংস অনেকটা এই তালেই এগিয়েছিল। তখন কল্পনাও করা যায়নি, বাংলাদেশকে এমন পাহাড় ডিঙানোর অসম্ভব এক চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেবে দক্ষিণ আফ্রিকা। প্রথম ১০ ওভারে ৪৪, আর শেষ ১০ ওভারে ১৪৪!

আরও পড়ুন

বলছি বটে, কল্পনাও করা যায়নি। তবে দক্ষিণ আফ্রিকান ব্যাটসম্যানরা হয়তো মনে মনে এমন কিছুই ভেবে রেখেছিলেন। ৩৬ রানে ২ উইকেট হারিয়ে ফেলার পর রণকৌশলটা একটু নতুন করে সাজিয়েছেন এই–যা। হাতে উইকেট রাখি, শেষে গিয়ে তো ঝড় তোলাই যাবে। ইংল্যান্ডের বিপক্ষেও তো শেষ ১০ ওভারে দক্ষিণ আফ্রিকা তুলেছে ১৪৩ রান, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ১২৭।

আধুনিক ক্রিকেট যে কত বদলে গেছে, সেটির প্রমাণ তো এখন বলতে গেলে প্রায় প্রতিদিনই পাওয়া যায়। সবচেয়ে বেশি বদলেছে সম্ভবত পাওয়ার হিটিংয়ে। এদিন কুইন্টন ডি কক আর হেনরিক ক্লাসেনের ব্যাটে যেটির ভয়ংকর সুন্দর এক প্রদর্শনী। ১০১ বলে এই বিশ্বকাপে নিজের তৃতীয় সেঞ্চুরি করার পর ডি ককের ব্যাট যেন খাপ খোলা তলোয়ার। পরের ৩৮ বলে ৭৪ রান, যার ৫৪-ই চার আর ছয় থেকে।

আরও পড়ুন

হেনরিক ক্লাসেন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে যেখানে শেষ করেছিলেন, এদিন যেন শুরু করলেন সেখান থেকেই। টানা দ্বিতীয় সেঞ্চুরিটা পেলেন না মাত্র ১০ রানের জন্য। ৪৯ বলে ৯০ রান, স্ট্রাইক রেট ১৮৩.৬৭।

বাংলাদেশ দলে কবে যে এমন ব্যাটসম্যান হবে!