‘ফিনিশার’ জাকের বড় টুর্নামেন্টে কি নিজেই ‘ফিনিশড’ হয়ে যান
নুরুল হাসান আউট হন ইনিংসের ১১.৪ ওভারে। ১৩৫ রান তাড়া করতে নেমে বাংলাদেশের রান তখন ৫ উইকেটে ৬৩। ইএসপিএনক্রিকইনফোর লাইভ কমেন্ট্রিতে জানানো হলো, ম্যাচের ফরকাস্টারে এই প্রথম এগিয়ে গেল পাকিস্তান। তখন ক্রিজে এলেন জাকের আলী। তাঁকে দেখে বাংলাদেশের ক্রিকেটের সমর্থকেরা নিশ্চয়ই ক্রিকেট পোর্টালটির মতো ভাবেননি।
জাকের কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশ দলের ‘ফিনিশার’। অন্তত কিছু ম্যাচে তাঁর পারফরম্যান্স ও পরিসংখ্যান দেখে কথাটা বিশ্বাস করাই যায়। কিন্তু এ বিশ্বাসটা বড় মঞ্চে যে আসলে ‘শুভংকরের ফাঁকি’, সেটাও বেরিয়ে এল এবারের এশিয়া কাপে।
গতকাল পাকিস্তানের বিপক্ষে অলিখিত সেমিফাইনালের কথাই ধরুন। জাকের মাঠে নামার সময় ৫০ বলে ৭৩ রান দরকার ছিল বাংলাদেশের। অন্য প্রান্তে তাঁর সঙ্গী ছিলেন শামীম হোসেন। এখান থেকে অতীতেও ম্যাচ জিতিয়েছেন জাকের। কিন্তু কাল টিকলেন ৯ বল, করলেন ৫ রান। ক্রিকেটে এমন হতেই পারে—কথাটা যেমন সঠিক, তেমনি এটাও সত্য, জাতীয় দলে দুই বছরে ৪১টি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলে ফেলার পর এবং অধিনায়ক হিসেবে সবাই তাঁর কাছ থেকে আরও দায়িত্বশীলতা আশা করে। তখন প্রতিটি ‘ডট’ বলই ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ। জাকের তাঁর ৯ বলের ইনিংসে ‘ডট’ দেন ৫টি। এই ডট বল খেলার চাপে পড়েই কিছুক্ষণ পরই হলেন আত্মঘাতী।
১৩.৫ ওভারে সাইম আইয়ুবের বলটি ছিল অফ স্টাম্পের বাইরে। ঝুলিয়ে করায় মারার আমন্ত্রণ ছিল। ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে গিয়ে জাকের সাইমের নিমন্ত্রণ রক্ষা করলেন ঠিকই, কিন্তু প্রস্তুতি ছিল না। আগেই ভেবে রেখেছিলেন টেনে লেগে মারবেন, সে কারণে শট খেলার জন্য শরীরের ‘ওয়েট’ চলে যায় লেগ সাইডে। স্বাভাবিকভাবেই ব্যাট চালিয়ে বলটা আর জোরে মারতে পারেননি। ক্যাচআউট হন। অথচ ওই ডেলিভারিতে ‘ইনসাইড আউট’ খেলাটা সহজ ছিল। চাইলে সোজা ব্যাটে স্ট্রেটেও মারা যেত। কিন্তু কোন দিকে শট খেলবেন, তা আগে থেকেই ঠিক করে ফেলার মাশুল গুনতে হয়।
আরেকটি কারণ হতে পারে জাকেরের স্ট্যান্স। মারার মানসিকতায় তাঁর ক্রিজে দাঁড়ানোর ধরনেই লেগ সাইডে খেলার মানসিকতা ফুটে ওঠে। অবশ্য অতীতে এভাবে কিছু ম্যাচে রানও বের করেছেন। কিন্তু গতকাল বাঁচা–মরার ম্যাচে খেলাটা শেষ পর্যন্ত টেনে নেওয়ার জন্য কাউকে থাকতে হতো। চোট পাওয়া লিটন দাসের অনুপস্থিতিতে অধিনায়কত্ব পাওয়া জাকের নিজেই তা পারেননি। পারেননি ভারতের বিপক্ষে সুপার ফোরের ম্যাচেও।
প্রায় দুই বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের হয়ে দুটি বড় আসর পেয়েছেন জাকের। গত বছর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ও এশিয়া কাপ। জাকেরের টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ার এবং এ দুটি আসরে তাঁর পরিসংখ্যান পাশাপাশি রাখলে বিস্মিত হতে পারেন অনেকে। সর্বশেষ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ এবং এবারের এশিয়া কাপে জাকের একটি ছক্কাও মারতে পারেননি!
গত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ৪ ইনিংসে ব্যাটিংয়ে নেমে ৪৬ বল খেলে ১১.৬৬ গড়ে ৩৫ রান। ৩টি চার, ছক্কা নেই। এবার এশিয়া কাপে ৬ ইনিংসে ৬৬ বলে করেছেন ৭১ রান। ৫টি চার আছে, ছক্কা নেই। অথচ এই জাকেরই প্রায় দুই বছরের আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারে ৪২ ম্যাচে ৩৮টি ছক্কা মেরেছেন। যা বাংলাদেশের হয়ে বেশি ছক্কার তালিকায় যৌথভাবে সপ্তম। তাঁর মতো ৩৮ ছক্কা মেরেছেন যে ব্যাটসম্যান, সেই আফিফ হোসেনকে খেলতে হয়েছে ৭০ ম্যাচ।
তাহলে কি ব্যাপারটা বড় আসরের চাপ নিতে না পারা? সবচেয়ে বড় কথা, কাল অলিখিত সেমিফাইনালে জাকেরকে সম্ভবত ছক্কা মারার চেষ্টা না করলেও চলত। দাঁড়িয়ে থাকতে হতো শেষ পর্যন্ত। অধিনায়ক সেটাও পারেননি। কাল হারের পর পুরস্কার বিতরণী মঞ্চে জাকেরের কথায় অবশ্য ‘দল’কে পাওয়া গেল না। পাওয়া গেল দুটো ‘ইউনিট’—মানে বিভাগ, ‘ব্যাটিং ইউনিট হিসেবে শেষ দুই ম্যাচে আমরা হেরেছি। বোলিং ইউনিট হিসেবে আমরা খুব ভালো করেছি। ছেলেরা খুব ভালো করেছে। গতকাল (ভারতের বিপক্ষে) ব্যাটিংয়ের কারণে (হেরেছি), আজও তা–ই।’
ব্যাটিংয়ের কারণে হারটা জাকের স্বীকার করলেন ঠিকই, কিন্তু বিদায় নেওয়ার পর বাংলাদেশের অতীতের সব অধিনায়কের মতো টুর্নামেন্ট থেকে ইতিবাচক কিছু তুলে নেওয়ার কথাও ঝরল জাকেরের কণ্ঠে, ‘রিশাদ ও সাইফ (গর্বিত করেছে)। ব্যাটার হিসেবে সাইফ পুরো টুর্নামেন্টেই ভালো করেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমরা তাকে সমর্থন দিতে পারিনি। কিন্তু বোলিং ইউনিট হিসেবে আমরা সত্যিই ভালো করেছি।’
বড় টুর্নামেন্টে বাজে খেলে বিদায় নেওয়ার পর দলের যেকোনো এক ‘ইউনিট’–এর পারফরম্যান্সে তৃপ্তি ঝরানোর বিষয়টি বাংলাদেশের অধিনায়কদের মুখে একটু বেশি বেশিই শোনা যায়। জাকেরও এর ব্যতিক্রম নন।