খরচ প্রায় ৪ কোটি টাকা, বাংলাদেশে আম্পায়ার টফেলের কাজ কী
বাংলাদেশে আম্পায়ারিংয়ের মান নিয়ে প্রশ্ন নতুন কিছু নয়। গত কয়েক বছরে এ বিষয়ে উন্নতিতে চেষ্টা করছে বিসিবি। এর মধ্যে শরফুদ্দৌলা ইবনে শহীদ জায়গা করে নিয়েছেন আইসিসির এলিট প্যানেলে—যার ফলে আম্পায়ারিংয়ের প্রতি মনোযোগ আরও বেড়েছে। তবে এর মধ্যেও সর্বশেষ ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে আম্পায়ারদের সঙ্গে ক্রিকেটারদের দ্বন্দ্ব ছিল বেশ আলোচনায়।
আম্পায়ারিং নিয়ে নানামুখী সমস্যা কাটিয়ে উঠতে এবার অস্ট্রেলিয়ার সাইমন টফেলের দ্বারস্থ হয়েছে বিসিবি। টানা পাঁচবারের আইসিসি বর্ষসেরা আম্পায়ারকে তিন বছরের চুক্তিতে পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে। অনেকেরই কৌতূহল, টফেল কি বাংলাদেশে আম্পায়ারিং শেখাতে আসছেন, তাঁর কাজ আসলে কী?
সাইমন টফেল কে, এত দিন কী করতেন
ছিলেন খেলোয়াড়। তবে পিঠের চোটের কারণে ক্রিকেটার হিসেবে পথচলা লম্বা হয়নি। টফেল মাত্র ২০ বছর বয়সেই আম্পায়ারিংয়ের দিকে হেলে পড়েন। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে।
১৯৯৯ সালের জানুয়ারিতে অস্ট্রেলিয়া–শ্রীলঙ্কা ওয়ানডে দিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আম্পায়ারিং শুরু, পরের বছর মাত্র ২৯ বছর বয়সে শুরু টেস্ট আম্পায়ারিং। ২০০৪ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত টানা ৫ বছর ছিলেন আইসিসির আম্পায়ার অব দ্য ইয়ার। অল্প বয়সেই অভিজ্ঞ হয়ে উঠলেও স্ত্রী ও পরিবারকে সময় দিতে ২০১২ সালে আম্পায়ারিং ক্যারিয়ারেরও ইতি টানেন ৪১ বছর বয়সে।
এরপর আইসিসির আম্পায়ার পারফরম্যান্স ও ট্রেনিং ম্যানেজার হিসেবে কিছুদিন কাজ করেন। আইসিসির দায়িত্ব ছাড়ার পর থেকে শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, আইপিএলসহ বিভিন্ন দেশের বোর্ড ও টুর্নামেন্টে পরামর্শক হিসেবে কাজ করেছেন টফেল। এ ছাড়া চলতি বছরের শুরুতে সংযুক্ত আরব আমিরাতে আইএল টি২০–তে আম্পায়ারিং এবং ম্যাচ রেফারিং দুটিই করেছেন।
বাংলাদেশে তিনি কী কাজ করবেন
সাইমন টফেল কেন আসছেন, তা বোঝা সহজ হবে বাংলাদেশের আম্পায়ারিং–কাঠামোর বিষয়ে ধারণা থাকলে। আম্পায়ার হতে আগ্রহীদের জন্য গত বছর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি বিজ্ঞপ্তি দিয়েছিল বিসিবি। এরপর আবেদনকারীদের একটি পরীক্ষা নেওয়া হয়, যেখানে উত্তীর্ণদের একটি কোর্স (কোয়ালিফাইং) করানো হয়। ওই কোর্সে উত্তীর্ণরা বিসিবির আম্পায়ার হিসেবে নিবন্ধিত হয়েছেন। তবে এর আগ্রহীদের কাছ থেকে আবেদন আর পরীক্ষার মাধ্যমে আম্পায়ার বাছাইয়ের রীতি সেভাবে ছিল না। জেলা ক্রীড়া সংস্থার সুপারিশই ছিল ক্রিকেটের বাইরের কারও আম্পায়ারিংয়ে যুক্ত হওয়ার একমাত্র মাধ্যম।
কাঠামো অনুসারে, কোয়ালিফাইং কোর্সে উত্তীর্ণ হওয়ার পর এই আম্পায়াররা ধীরে ধীরে বিসিবির বিভিন্ন পর্যায়ের ম্যাচ পরিচালনা করে ওপরের দিকে উঠে আসেন। ট্রেইনি থেকে শুরু করে মোট ছয়টি ধাপ আছে—ট্রেইনি, ডিস্ট্রিক্ট, রিজওনাল, ন্যাশনাল ও বিসিবি এলিট আম্পায়ার। এর ওপরে আছেন বাংলাদেশ থেকে জায়গা পাওয়া আইসিসির প্যানেল আম্পায়াররা। বাংলাদেশ ক্রিকেটে এখন প্রায় ১২ শর বেশি আম্পায়ার আছেন।
অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, টেস্ট মর্যাদা প্রাপ্তির ২৫ বছর পেরিয়ে গেলেও এত দিনেও দেশে আম্পায়ারদের পারফরম্যান্সের ভিত্তিতে উন্নতি অথবা অবনতির জন্য কোনো নির্দিষ্ট মানদণ্ড ছিল না। ম্যাচ রেফারির প্রতিবেদন ও ‘যাকে পছন্দ’ ভিত্তিতেই এত দিন আম্পায়ারদের পারফরম্যান্স মূল্যায়ন ও তাঁদের উন্নতি হতো। ২০১১ সালের পর আম্পায়ারদের আর কোনো গ্রেডিং পরীক্ষাই হয়নি।
টফেলের মূল কাজটা এখানেই। আম্পায়ারদের জন্য কেপিআই (কি পারফরম্যান্স ইন্ডিকেটর) তৈরি করবেন তিনি। আম্পায়ারদের গ্রেডিং এখন থেকে হবে সাইমন ও তাঁর এজেন্সির দেওয়া রিপোর্টের ভিত্তিতে। বিসিবির আশা, প্রথম বছরে গ্রেডিং সিস্টেম তৈরি করার পরের দুই বছর তাঁর অধীনেই তা হবে। এরপর ধীরে ধীরে এটি একটি প্রক্রিয়ার মধ্যে চলে আসবে।
আম্পায়ারিং ছাড়া আর কিছু?
আম্পায়ারদের সঙ্গে ম্যাচ রেফারির মূল্যায়নও হবে সাইমন টফেলের মাধ্যমে। সঙ্গে আম্পায়ারদের মূল্যায়ন করতে পারবেন, এমন বাংলাদেশিদেরও তৈরি করবেন। ম্যাচ অফিশিয়াল বিভাগের গঠনপ্রণালি, আম্পায়ারদের জন্য ট্রেনিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট গঠনপ্রণালি তৈরি এবং ভালো একটা সংস্কৃতি তৈরিতে কাজ করার সঙ্গে ম্যাচ রেফারিদের স্কিলের উন্নতিতেও কাজ করবেন। অস্ট্রেলিয়ান এই সাবেক আম্পায়ার কাজ করবেন স্কোরারদের নিয়েও।
টফেলকে নিয়ে আসার ভাবনা কীভাবে এল
আম্পায়ারিংকে পরের ধাপে নিয়ে যেতে আরও বছরখানেক আগেই বিভিন্ন জায়গায় যোগাযোগ শুরু করে বিসিবি। এ জন্য শুরুর দিকে ভাবনায় ছিলেন শ্রীলঙ্কার আম্পায়ার পিটার ম্যানুয়েল। কিন্তু আইসিসির দায়িত্ব নেওয়ায় তাঁকে আর পাওয়া যায়নি।
এরপর বিসিবির প্রোগ্রাম হেড ডেভিড মুরস ও শরফুদ্দৌলার পরামর্শে বিসিবি যোগাযোগ শুরু করে টফেলের সঙ্গে। বিভিন্ন দেশে কাছাকাছি ধরনের কাজ করায় তাঁর প্রতি আগ্রহ বাড়ে বিসিবির। এরপর গত বোর্ড সভায় তাঁকে নিয়োগ দেওয়ার বিষয়টি অনুমোদন পায়।
বাংলাদেশে কি কেউ নেই?
প্রশ্নটা করা হয়েছিল বিসিবির এক কর্মকর্তাকে। উত্তরে তিনি জানিয়েছেন, শরফুদ্দৌলা এখন আইসিসির এলিট প্যানেল আম্পায়ার। অথচ ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে আম্পায়ারিং করার পর ১২ দলের মধ্যে ৮ দলই তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়েছে। অর্থাৎ বাংলাদেশি কাউকে দায়িত্ব দিলে প্রভাব বিস্তার করার সুযোগ থাকবে। সেটি দিতে না চাওয়ার সঙ্গে একটা ভালো সিস্টেম দাঁড় করাতে চাইছেন তাঁরা। টফেলের মাধ্যমে সেটি সম্ভব হলে ভবিষ্যতে কাজ সহজ হয়ে যাবে বলে বিশ্বাস তাঁদের।
তাঁকে এনে কতটা কাজ হবে?
সায়মন টফেলকে নিয়ে বেশ আশাবাদী বিসিবি আম্পায়ার্স বিভাগের চেয়ারম্যান ইফতেখার রহমান। দীর্ঘদিন ধরে যে জটিলতায় বোর্ড ভুগছে, তা অনেকটা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে বলেও আশা তাঁর। প্রথম আলোকে ইফতেখার বলেছেন, ‘আমাদের আশা, তিনি এলে বাংলাদেশের আম্পায়ারিং অন্য পর্যায়ে উঠে যাবে। তিনি তো একটা ব্র্যান্ড। তাঁর আসার পর সিরিয়াসনেস বাড়বে। সবচেয়ে বড় যেটা আমাদের আশা—আম্পায়ারদের ওপর খেলোয়াড়দের আত্মবিশ্বাস বাড়বে। একটা আম্পায়ারের যখন গ্রেডিং থাকবে, তখন তাঁর বিরুদ্ধে যাওয়াও কঠিন হবে।’
যদিও বিসিবির আম্পায়ারিং বিভাগের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে যুক্ত এমন একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলছেন, টফেলকে আনা বেশ ভালো সিদ্ধান্ত, তবে বাংলাদেশে তিনি কাজ করার কতটা সুযোগ পাবেন—এ নিয়ে সন্দেহ আছে। এ ছাড়া প্রিমিয়ার লিগের মতো টুর্নামেন্টগুলোতে আম্পায়ারদের ওপর প্রভাব বিস্তার করে পক্ষে সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রবণতা না কমানো গেলে আম্পায়ারিংয়ে উন্নতি সম্ভব নয়।
কত টাকা নেবেন টফেল, কবে আসবেন
বিসিবির সঙ্গে কথাবার্তা পাকা হলেও চুক্তির ধরন এখনো ঠিক হয়নি। বিসিবি সূত্রে জানা গেছে, তিন বছরের চুক্তির জন্য ৩ লাখ ডলার (বাংলাদেশি টাকায় ৩ কোটি ৬০ লাখের বেশি) চেয়েছেন টফেল। তবে বোর্ডের আশা, আলোচনার পর তা আরও কমিয়ে আনা যাবে।
টফেল কবে বাংলাদেশে আসবেন, সেটিও এখনো চূড়ান্ত হয়নি। কবে এলে সুবিধা হবে, তা জানতে চেয়েছেন টফেল। আম্পায়ারদের মূল্যায়নের জন্য এনসিএল টি–টোয়েন্টি অথবা বিপিএলকে ভালো সুযোগ হিসেবে দেখছে বিসিবি। তাই সেপ্টেম্বরে ঢাকায় আসতে পারেন টফেল ও তাঁর দল।