মায়ের দোয়া, বাবার কবর জিয়ারত ও কোহলির প্রেরণা—এই তিনে মিলেই সিরাজ

ওভাল টেস্ট জয়ের পদক ও ম্যাচের বল হাতে ম্যাচসেরা মোহাম্মদ সিরাজ। গতকাল ওভালেএএফপি

মোহাম্মদ সিরাজের বাবা মির্জা মোহাম্মদ গাউস ছিলেন অটোরিকশাচালক। ছেলের গায়ে ভারত জাতীয় ক্রিকেট দলের জার্সি তিনি দেখে যেতে পেরেছিলেন। ২০১৭ সালে টি–টোয়েন্টি সংস্করণে ভারতের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সিরাজের অভিষেক। চার বছর পর ২০২১ সালে সিরাজ অস্ট্রেলিয়া সফরে থাকতে ৫৩ বছর বয়সে মারা যান গাউস। বিশ্বে তখন করোনা মহামারি চলছিল, অস্ট্রেলিয়ায় কড়া কোয়ারেন্টিন নিয়মের কারণে বাবার শেষকৃত্যে থাকতে পারেননি সিরাজ।

আরও পড়ুন

বাবার মৃত্যুর পর থেকে একটি বিষয় সিরাজ মেনে চলেন। ভারতের সংবাদমাধ্যম টাইমস অব ইন্ডিয়া জানিয়েছে, যেকোনো সফরের আগে ও পরে সিরাজ তাঁর বাবার কবরে যান। সফরে যাওয়ার আগে বাবার কবরে গিয়ে দোয়া করার পাশাপাশি আশীর্বাদ প্রার্থনা করেন। সফর শেষে বিমানবন্দরে নেমে ঘরে ফেরার আগেও একবার বাবার কবরটা দেখে যান।

সংবাদমাধ্যমটি আরও জানিয়েছে, গত জুনে ইংল্যান্ড সফরে যাওয়ার আগে সিরাজ ব্যাগ গুছিয়ে তাঁর মাকে বলেছেন, ‘আম্মা, আমার জন্য দোয়া করবেন। আমি ভালো করতে চাই। ভারতকে জেতাতে চাই।’ এরপর সিরাজ বাবার কবরে গিয়ে দোয়া করে তারপর বিমানবন্দরের পথ ধরেন। টাইমস অব ইন্ডিয়াকে সিরাজের মা শাবানা বেগম আরও বলেছেন, ‘বাবাকে সে খুব ভালোবাসে। বাবাও তাকে খুব ভালোবাসতেন—তার (সিরাজ) জন্য তিনি যেকোনো কিছুই করতেন। সিরাজের জন্য সব সময় দোয়া করি। সৃষ্টিকর্তা আমার সন্তানের ওপর রহম করুন এবং সবকিছুতে সাফল্য দিন।’

ভারত–ইংল্যান্ড সিরিজে প্রায়ই দেখা গেছে সিরাজের উদ্‌যাপনের দৃশ্য। সর্বোচ্চ উইকেটও তাঁর
এএফপি

সিরাজের সব ম্যাচই তাঁর মা দেখেন। ভারতের ইংল্যান্ড সফরে পাঁচ টেস্টের সবগুলোতেই খেলেছেন সিরাজ এবং শাবানা সবগুলো ম্যাচই দেখেছেন। খেলা দেখার পাশাপাশি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে দোয়াও করেছেন। টাইমস অব ইন্ডিয়া জানিয়েছে, শাবানা এই সিরিজ চলাকালীন এক ওয়াক্ত নামাজও বাদ দেননি।

আরও পড়ুন

মায়ের দোয়ার ফলটা এতক্ষণে সবারই জানা। গতকাল ওভাল টেস্টের শেষ দিনে ইংল্যান্ডকে ৬ রানে হারিয়ে সিরিজ ২–২ এ ড্র করে ভারত। ওভাল টেস্টে মোট ৯ উইকেট নেওয়ার পথে ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় ইনিংসে ৫ উইকেট নেন সিরাজ। গোটা সিরিজে দুই দল মিলিয়ে সবচেয়ে বেশি বোলিং করে (১১১৩টি বৈধ ডেলিভারি বা ১৮৫.৩ ওভার) সর্বোচ্চ ২৩ উইকেটও নেন এই পেসার। ওভাল টেস্টে হয়েছেন ম্যাচসেরাও।
মায়ের প্রার্থনার কী শক্তি, সেই কথা বলেছেন সিরাজের বড় ভাই মোহাম্মদ ইসমাইল, ‘আম্মা সব সময় ভাইয়ের জন্য দোয়া করেন। মায়ের দোয়ায় কী না হয়! আমার বিশ্বাস, বাবা–মায়ের এই দোয়ার জন্যই সে ভারতের হয়ে ভালো করছে। দোয়া নিতে সে প্রতিদিন আম্মাকে ভিডিও কল করে। মা সব সময় তাকে বলেন “আরও ভালো করো, আমাদের গর্বিত করো।”’

সিরাজকে নিয়ে বাবার কী আশা ছিল, সেটাও বলেছেন ইসমাইল, ‘আব্বু বলতেন, “বাবা, একদিন তোমাকে অনেক নাম করতে হবে, ভারতের হয়ে খেলতে হবে।”’ অস্ট্রেলিয়া সফরে থাকতে বাবার মৃত্যুসংবাদ শুনে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন সিরাজ। মা তখন তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলেন, ‘যা ঘটার তা ঘটেছে। এখন খেলায় মন দাও।’

বাবা–মা ও ভাইয়ের সঙ্গে সিরাজ
সিরাজের ইনস্টাগ্রাম হ্যান্ডল

২০২১ সালের সেই অস্ট্রেলিয়া সফরে চার টেস্টের সিরিজ ২–১ এ জিতেছিল ভারত। সিরাজ এই সিরিজে ৩ টেস্ট খেলে ভারতের হয়ে সর্বোচ্চ ১৩ উইকেট নেন। ইনিংসে ৫ উইকেটও ছিল। ২০২০ সাল থেকে এ পর্যন্ত ভারতের হয়ে সিরাজই সবচেয়ে বেশি ৪১ টেস্ট খেলেছেন। জাতীয় দলের জন্য নিবেদিতপ্রাণ ৩১ বছর বয়সী এ পেসারকে নিয়মিত খেলতে অবশ্যই ফিটনেসের প্রতি বিশেষ যত্ন নিতে হয়। সিরাজ কীভাবে নিজের ফিটনেস ঠিক রাখেন, সেই গল্প বলেছেন তাঁর ভাই ইসমাইল।

আরও পড়ুন

ফিটনেস নিয়ে সিরাজ নিজের যে যত্ন নেন, সেটার মূল প্রেরণায় আসলে বিরাট কোহলি। ইসমাইলের ভাষায়, ‘সিরাজ সব সময় বলে, “বাবার জন্য খেলি, ওনার স্বপ্ন আমি পূরণ করব।” ফিটনেস নিয়ে সে এখন অন্য পর্যায়ে আছে। আর এসব কিছুর মূলে রয়েছেন বিরাট কোহলি। বিরাটই তার প্রেরণা। সে (কোহলি) তার বড় ভাইয়ের চেয়েও বেশি কিছু। বিরাটের কাছ থেকেই সে আগ্রাসন ও ভালো করার ক্ষুধাটা পেয়েছে।’

সিরাজের ক্যারিয়ারে কোহলির প্রভাব নিয়ে ইসমাইল বলেছেন, ২০১৮ আইপিএলে ভালো করতে না পারায় সিরাজকে নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল তখন। সমালোচনাও হচ্ছিল। কোহলি তখন সিরাজের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। ইসমাইলের ভাষায়, ‘সিরাজ একাধিকবার বলেছেন, নিজের ক্যারিয়ারের জন্য সে কোহলির কাছে ঋণী এবং এটা সর্বৈব সত্য। সে বিরিয়ানি পছন্দ করত, বিরাট ভাইয়ের কাছ থেকে কিছু কথা শোনার পর এখন এটা খুব কমই খায়।’

উইকেট নিয়ে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর মতো উদ্‌যাপন সিরাজের। গতকাল ওভালে
এএফপি

ফিটনেস ঠিক রাখতে সিরাজের খাদ্যাভ্যাস নিয়ে ইন্ডিয়া টুডেকে আরও খোলামেলা কথা বলেছেন ইসমাইল, ‘সে জাঙ্ক ফুড পরিহার করে বিধিসম্মত খাবার খায়। এমনকি হায়দরাবাদে থাকলেও সে বিরিয়ানি খায় খুব কম, মাঝেমধ্যে—সেটাও যদি ঘরে বানানো হয়। কিন্তু পিৎজা বা ফাস্ট ফুড খায় না—নিজের শরীর নিয়ে সে খুবই শৃঙ্খলাপরায়ণ।’

উইকেট নিয়ে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর মতো উদ্‌যাপন করেন সিরাজ। ওভাল টেস্টে ইংল্যান্ডের শেষ উইকেট গাস অ্যাটকিনসনকে আউট করে পর্তুগিজ ফুটবল কিংবদন্তির ‘সিউ’ উদ্‌যাপন করেছেন সিরাজ। শুধু তা–ই নয়, পঞ্চম ও শেষ দিনে ঘুম থেকে উঠে রোনালদো ও ‘বিলিভ’ লেখা একটি ওয়ালপেপার ফোনে সেভ করেন।

সিরাজ রোনালদোর কেমন ভক্ত সেটাও বলেছেন তাঁর ভাই, ‘তার কক্ষে রোনালদোর বড় পোস্টার আছে। এমনকি সে একটি মিনি থিয়েটারও বানিয়েছে রোনালদোর ম্যাচ দেখতে। একটি ম্যাচও মিস করে না। রোনালদোর খেলা থাকলে তার চিৎকার–চেঁচামেচি কানে আসে।’