ভারত-পাকিস্তান নতুন সংঘাত: আইসিসি ও এসিসির সামনে কী অপেক্ষা করছে

অদূর ভবিষ্যতে বৈশ্বিক ও মহাদেশীয় টুর্নামেন্টেও ভারত–পাকিস্তান ম্যাচ আর নাও দেখা যেতে পারেছবি: এএফপি

এক ব্যথা না সারতেই আরেক ব্যথা এসে হাজির! ভারত-পাকিস্তানের মধ্যকার রেষারেষি অনেক দিন ধরেই যেন এমন।

রাজনৈতিক বৈরিতার কারণে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দুই দেশের সংঘাত লেগেই থাকে। গত মঙ্গলবার ভারত–নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে বন্দুকধারীদের হামলায় ২৬ জন নিহত হওয়ার ঘটনায় নতুন করে যুদ্ধের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, যা আবারও খেলাধুলার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে; বিশেষ করে ক্রিকেটে।

দ্বন্দ্বের কারণেই ২০১৩ সালের পর থেকে ভারত-পাকিস্তান দ্বিপক্ষীয় সিরিজ খেলে না। এক দেশ আরেক দেশে ক্রিকেট দল পাঠানোও বন্ধ করে দিয়েছে। তবে ভবিষ্যতে নিরপেক্ষ ভেন্যুতে হলেও দ্বিপক্ষীয় সিরিজ চালু করতে আলোচনা অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছিল।

কাশ্মীরের পেহেলগামে মঙ্গলবার বন্দুকধারীদের হামলায় ২৬ জন নিহত হন
ছবি: রয়টার্স

কিন্তু পেহেলগামে হামলার ঘটনা দুই দেশের সব ধরনের ক্রিকেটীয় আলোচনা থামিয়ে দিয়েছে তো বটেই; ভবিষ্যতে আইসিসি ও এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিল (এসিসি) আয়োজিত আসরের গ্রুপ পর্বেও যেন পাকিস্তানের মুখোমুখি হতে না হয়, সেটি নিশ্চিত করতে বিশ্ব ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে চিঠি লিখে অনুরোধ জানিয়েছে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড (বিসিসিআই)।

ভারত সরকারের দাবি, পেহেলগামে হামলার ঘটনায় পাকিস্তানের মদদ আছে। এরই মধ্যে হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে বিদ্রোহী গ্রুপ দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট (টিআরএফ), যাদের পাকিস্তানি জঙ্গিগোষ্ঠী লস্কর-ই-তাইয়েবার একটি শাখা মনে করে ভারত সরকার।

আরও পড়ুন

আইসিসির কোনো টুর্নামেন্টে এ বছর ভারত-পাকিস্তানকে অন্তত একবার মুখোমুখি হতেই হবে। সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে ভারতে বসবে মেয়েদের ওয়ানডে বিশ্বকাপ। সম্প্রতি বাছাইপর্বে চ্যাম্পিয়ন হয়ে মূল পর্বে জায়গা করে নিয়েছে পাকিস্তানের মেয়েরা। রাউন্ড রবিন পদ্ধতিতে সেই বিশ্বকাপ হতে চলায় ৮ দলের সবাইকে সবার সঙ্গে একবার করে খেলতে হবে। সেই হিসেবে নকআউট পর্বের আগেই ভারত-পাকিস্তান একবার মুখোমুখি হবে।

পেহেলগামের হত্যাকাণ্ডে পাকিস্তানকে দোষারোপ করছে ভারত
ছবি: রয়টার্স

কিন্তু গত ডিসেম্বরে বিসিসিআই ও পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের (পিসিবি) করা চুক্তি অনুযায়ী, ভারত যেহেতু চ্যাম্পিয়নস ট্রফি খেলতে পাকিস্তানে দল পাঠায়নি, তাই পাকিস্তানও মেয়েদের বিশ্বকাপ খেলতে ভারতে যাবে না

সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে ছেলেদের এশিয়া কাপও ভারতে হওয়ার কথা। ধারণা করা হচ্ছে, মে মাসে টুর্নামেন্টের গ্রুপ পর্বের ড্র অনুষ্ঠিত হবে। যদিও কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে খসড়া সূচির বিষয়টি উঠে এসেছে। সেখানে ভারত-পাকিস্তানকে একই গ্রুপে রাখা হয়েছে। কিন্তু কাশ্মীর ইস্যুতে ভারত গ্রুপ পর্বে আর পাকিস্তানের বিপক্ষে খেলতে চাইবে না বলেই মনে হচ্ছে।

বিসিসিআইয়ের সহসভাপতি রাজীব শুক্লা এরই মধ্যে স্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে আছি। সরকারের সিদ্ধান্তই আমাদের অবস্থান। আমরা পাকিস্তানের বিপক্ষে দ্বিপক্ষীয় সিরিজ খেলি না এবং (অদূর ভবিষ্যতেও) খেলব না। কারণ, এটা সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত।’ বিসিসিআইয়ের আরেক শীর্ষ কর্মকর্তা ক্রিকবাজকে জানিয়েছেন, তাঁরা বিরাজমান জাতীয় পরিস্থিতির প্রতি সংবেদনশীল।

ওয়ানডে বিশ্বকাপ খেলতে ভারতে যাবে না পাকিস্তান নারী দল
ছবি: পিসিবি

নতুন করে সংঘাতের কারণে শেষ পর্যন্ত ভারত-পাকিস্তান বৈশ্বিক ও মহাদেশীয় টুর্নামেন্টের গ্রুপ পর্বে মুখোমুখি হতে না চাইলে আইসিসি ও এসিসি যে অর্থনৈতিক দিক থেকে বড় লোকসানের মুখে পড়বে, সেটা না বললেও চলছে।

সব দিক দিয়ে লাভবান হওয়ার আশায় আইসিসি ও এসিসি অনেকটা ঘোষণা দিয়ে ভারত-পাকিস্তানকে তাদের টুর্নামেন্টে একই গ্রুপে রাখে। কিন্তু দুই দল গ্রুপ পর্বে মুখোমুখি না হওয়ার অর্থ, টুর্নামেন্ট থেকে একটি ‘হাই ভোল্টেজ’ ম্যাচ কমে যাওয়া।

আরও পড়ুন

দুই দল যে নকআউট পর্বে মুখোমুখি হবে, তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। কারণ, কোনো একটি দল অথবা দুই দলই গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় নিতে পারে। আবার দুই দল নকআউট পর্বে উঠলেও ভিন্ন প্রতিপক্ষ পেতে পারে।

এমনটা হলে টুর্নামেন্ট নিয়ে দর্শকদের আগ্রহ কমে যাবে। এতে সম্প্রচারকারী প্রতিষ্ঠান ও পৃষ্ঠপোষকেরাও মুখ ফিরিয়ে নেবে, যা আইসিসি ও এসিসির প্রত্যাশিত রাজস্বে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

পাকিস্তানের বিপক্ষে আর খেলতেই চাইছে না ভারত
ছবি: এএফপি

এবারের এশিয়া কাপ শেষ পর্যন্ত ভারতে না হলে সংযুক্ত আরব আমিরাত বা শ্রীলঙ্কায় হতে পারে। এতে ভেন্যু নিয়ে জটিলতা হয়তো সহজেই কাটবে। কিন্তু টুর্নামেন্টের গ্রুপিং এসিসি কর্তৃপক্ষের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলবে। এশিয়া মহাদেশীয় ক্রিকেটের এই নিয়ন্ত্রক সংস্থা এরই মধ্যে ১৭ কোটি মার্কিন ডলারে (২ হাজার ৭১ কোটি টাকা) আগামী চার এশিয়া কাপের সম্প্রচারস্বত্ব সনি স্পোর্টস নেটওয়ার্কের কাছে বিক্রি করেছে।

স্বত্ব বিক্রির সময় একটি অনানুষ্ঠানিক সমঝোতাও হয়েছিল যে প্রতিটি আসরে অন্তত দুটি ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ থাকবে। দল দুটি যদি ফাইনালে ওঠে, তাহলে তিনবার মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনাও থাকবে।

ক্রিকবাজ জানিয়েছে, ২০২৫ এশিয়া কাপ আয়োজন করতে এসিসির প্রায় ৩ কোটি ৮০ লাখ ডলার (৪৬৩ কোটি টাকা) খরচ হবে। এ খরচের বেশির ভাগ অর্থ আসবে সম্প্রচারস্বত্ব থেকে।

আরও পড়ুন

কিন্তু টুর্নামেন্টে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ কমে গেলে সম্প্রচারকারী প্রতিষ্ঠান স্বাভাবিকভাবেই এসিসিকে বিপুল অর্থ দিতে অস্বীকৃতি জানাবে। এতে ক্ষতির মুখে পড়বে সংস্থাটি। এমনকি এশিয়া কাপের ভবিষ্যৎ নিয়েও ঘোর অমানিশা তৈরি হবে।

আইসিসির ক্ষেত্রেও ব্যাপারটি একই রকম। সম্প্রচারস্বত্ব ও পৃষ্ঠপোষক—এই দুই খাত থেকে আইসিসি সবচেয়ে বেশি আয় করে থাকে। ২০২৪ থেকে ২০২৭ চক্রে সম্প্রচারস্বত্ব থেকেই আইসিসির ৩২০ কোটি ডলার (৩৮ হাজার ২৫৫ কোটি ৫২ লাখ টাকা) আসার কথা। এই সময়ে অন্যান্য খাত থেকে সংস্থাটি আরও ১০০ কোটি ডলার (১১ হাজার ৯৫৪ কোটি ৮৫ লাখ টাকা) প্রত্যাশা করছে।

ভারত–পাকিস্তান ম্যাচ না হলে বড় টুর্নামেন্ট ঘিরে দর্শকদের আগ্রহ কমে যাবে
ছবি: এএফপি

আইসিসির বিপুল পরিমাণ আয়ের বড় উৎস ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ, যা ধারাবাহিকভাবে রেকর্ড দর্শক নিয়ে আসে এবং ক্রিকেটপ্রেমীদের আগ্রহ তুঙ্গে নিয়ে যায়।

কিন্তু ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বিদ্যমান উত্তেজনায় কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ উপার্জনের আশা আপাতত আইসিসি ও এসিসিকে ছেড়ে দিতেই হচ্ছে।