লিলিকে কেন মারতে গিয়েছিলেন মিয়াঁদাদ, বোথামের সঙ্গে লেগেছিল কী নিয়ে
স্যার ইয়ান টেরেন্স বোথাম। ইয়ান বোথাম—সর্বকালের সেরা ইংলিশ ক্রিকেটার। সর্বকালের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার। মাঠে এবং মাঠের বাইরে বর্ণাঢ্য এক চরিত্র। নন্দিত, বিতর্কিতও। ক্রিকেট মাঠের মতো নিজের লেখা বইয়ের পাতাতেও যিনি বেশ অকপট। অনেকগুলো বই লিখেছেন। তবে বোথাম নিজের সময়ের অন্য সেরা ক্রিকেটারদের সম্পর্কে কী ভাবতেন, সেটা বোঝা যাবে তাঁর “বোথাম’স সেঞ্চুরি: মাই হান্ড্রেড গ্রেট ক্রিকেটিং ক্যারেক্টারস” পড়লে। সেই বইয়েই একটা অধ্যায় আছে তাঁর সময়ের আরেক বর্ণাঢ্য চরিত্র, তাঁর মতোই খ্যাপাটে একজনকে নিয়ে। অধ্যায়ের নাম ‘জাভেদ মিয়াঁদাদ’।
কী লিখেছেন বোথাম
জাভেদ মিয়াঁদাদ সম্পর্কে সবচেয়ে দারুণ কথাটা বলেছিলেন তাঁর ‘প্রিয়’ স্বদেশি ইমরান খান: ‘জাভেদ হলো একই সঙ্গে পাকিস্তানি ব্যাটিংয়ের সব ভালো ও খারাপের প্রতীক। অসাধারণ শটের সঙ্গে আত্মঘাতী ঝোঁক।’
জাভেদের ওই আত্মঘাতী প্রবণতা সবচেয়ে ভালোভাবে দেখা গিয়েছিল ১৯৮১ সালে ওয়াকা টেস্টে। জাভেদ তখন পাকিস্তানের অধিনায়ক, সামনে বোলার খোদ ডেনিস লিলি! লিলি লম্বা-চওড়া, দশাসই চেহারা, আর জাভেদ? লিলির তুলনায় সাইজে নেহাতই বাচ্চা ছেলে! যদি বক্সিং ম্যাচ হতো, ডন কিংও বোধ হয় এই অসম লড়াইয়ে নামার সাহস পেতেন না! তো সেই ম্যাচে কী হলো? জাভেদ একটা সিঙ্গেল নেওয়ার জন্য দৌড়াতে যাচ্ছিল, লিলির সঙ্গে লাগল ধাক্কা! এরপর যা হলো, তা আরও নাটকীয়। ডেনিস লিলি তাকে লাথি মেরে বসল! জাভেদও তো কম যায় না। ব্যাট তুলে লিলিকে মারতে তেড়ে গেল! ভাগ্যিস আম্পায়ার টনি ক্রাফটার মাঝখানে এসে পরিস্থিতি সামাল দিলেন।
১২০ পাউন্ড জরিমানা হয়েছিল লিলির, কিন্তু আম্পায়াররা সেটা কম মনে করায় পরে তাকে দুই ম্যাচ নিষিদ্ধও করা হয়। আর জাভেদ? সে ক্ষমা চাইবে, এই আশা কেউই করেনি। ও রকম ধাতই তার নয়।
এটাই আসলে জাভেদ। বোলারদের মনে ভয় ধরানো আর সুযোগ পেলেই সেটার ফায়দা লোটা, এটাই ছিল জাভেদের খেলার স্টাইল! বিতর্ক আর ঝগড়াঝাঁটি যেন তার খুব পছন্দের। কাউকেই পাত্তা দিত না। কঠিন টেনশনের মুহূর্তেও তার মুখে হাসি লেগে থাকত। বরং মনে হতো ওই রকম সময়ে জাভেদের ব্যাট যেন আরও চওড়া হয়ে যেত, ওদিকে ফিল্ডিং দলের হতাশা বাড়ত।
শুধু ডেনিস লিলি নয়, আমার সঙ্গেও জাভেদের কয়েকবার ঠোকাঠুকি লেগেছে। আমাদের শেষ সিরিয়াস ‘যুদ্ধ’টা হয়েছিল ১৯৯২ সালে, পাকিস্তান দল যখন ইংল্যান্ডে খেলতে এসেছিল। সেই সময়টায় বল টেম্পারিং নিয়ে ক্রিকেটে উত্তাপ বইছে। দুই বোর্ড টেস্ট সিরিজের আগে-পরে একটা এক দিনের ক্রিকেট টুর্নামেন্ট আয়োজন করল।
এর কয়েক মাস আগেই মেলবোর্নে বিশ্বকাপ ফাইনালে পাকিস্তানের কাছে হারায় আমরা তখন প্রতিশোধের জন্য তেতে ছিলাম। ওই বিশ্বকাপে পাকিস্তান সেমিফাইনালে উঠেছিলও খুব কষ্টে। লিগ পর্বের একটা ম্যাচে আমরা ওদের ৭৪ রানে অলআউট করে দেওয়ার পরেও বৃষ্টি এসে সব মাটি করে দিয়েছিল! ওয়ানডে ক্রিকেটে সেটাই ছিল পাকিস্তানের সবচেয়ে কম স্কোর!
অথচ সেই পাকিস্তানই কিনা ফাইনালে আমাদের ২২ রানে হারিয়ে বিশ্বকাপ ট্রফি নিয়ে গেল! আমার কপালে জুটল বিশ্বকাপ ফাইনালে দ্বিতীয়বারের মতো হেরে যাওয়ার মেডেল! ফাইনালে একসময় আমরা ২৪ রানে ২ উইকেট ফেলে দিয়ে পাকিস্তানকে বেশ চাপে রেখেছিলাম। ওই সময় ডেরেক প্রিঙ্গল জাভেদকে একেবারে পরিষ্কার এলবিডব্লিউ করল। প্রায় এক দশক পরেও প্রিঙ্গলের এটা বুঝে আসে না, কেন আম্পায়ার স্টিভ বাকনার সেদিন আঙুল তোলেননি। জাভেদ ৫৮ রান করেছিল, পরে সে রিচার্ড ইলিংওয়ার্থের বলে আমার হাতে ক্যাচ দিল। কিন্তু এর আগেই ইমরান আর সে মিলে তৃতীয় উইকেটে ১৩৯ রানের জুটি গড়ে ফেলেছিল, সেটাই ফাইনালের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল।
তবে হ্যাঁ, আমরা সান্ত্বনা পুরস্কার পেয়েছিলাম আগের বিশ্বকাপে (১৯৮৭)। রাওয়ালপিন্ডিতে ফিলিপ ডিফ্রেটাস জাভেদকে এলবিডব্লু করার পর। অস্ট্রেলিয়ান আম্পায়ার টনি ক্রাফটার যখন জাভেদকে আউট দিলেন, প্রায় দাঙ্গা বাধার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। আমরা বুঝতে পারছিলাম না, কেন! পরে কারণটা জানতে পারি। জাভেদ ১৯৭৩ সাল থেকে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলছে, আর ১১ বছর ধরে টেস্ট। বিশ্বাস করবেন কি না, এই দীর্ঘ সময়ে পাকিস্তানে কেউ তাকে একটিবারের জন্যও এলবিডব্লু দেয়নি! আউট হওয়ার পরও তাই জাভেদ নড়তেই চাইছিল না। ড্যাফি, ডেভিড ক্যাপেলের মতো কয়েকজনের ‘উৎসাহব্যঞ্জক কিছু কথা’ তার ক্ষোভ আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল!
যা–ই হোক, ১৯৯২ সালে ওভালের গল্পে ফেরা যাক। আবারও জাভেদের বিপক্ষে এলবিডব্লুর আবেদন! বোলার আমি। কিছু উইকেট আমার কাছে অন্যগুলোর চেয়ে বেশি মূল্যবান। শুধু এই কারণে নয় যে তাঁরা বিশ্বের সেরা ব্যাটসম্যান ছিলেন। বরং এই কারণে যে ম্যাচের পরিস্থিতি বা তাঁদের মানসিক অবস্থা যা–ই হোক না কেন, ওই খেলোয়াড়েরা সহজে উইকেট দিতেন না। ভিভ রিচার্ডস ছিলেন সেই তালিকার শীর্ষে। অ্যালান বোর্ডার ও জাভেদ তার ঠিক পরেই। যখন তাঁদের মধ্যে কেউ আমার বলে আউট হয়ে প্যাভিলিয়নের দিকে ফিরতেন, আমি বাড়তি আনন্দ পেতাম। কারণ, তাঁদের আউট করতে বিশেষ কিছু করতে হতো।
সেদিনের ম্যাচে জাভেদ ৩৮ রান করেছিল। পাকিস্তান ৩০২ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে তখন ৪ উইকেটে ২২০ রানে। আমার বল সোজা গিয়ে লাগল জাভেদের প্যাডে। ঠিক নিশ্চিত ছিলাম না মার্ভ কিচেন আমার প্রাণপণ আবেদনে সাড়া দেবেন কি না। কিন্তু তিনি দিলেন! আমি আমার স্বভাববিরুদ্ধ শান্তশিষ্ট ভাব ছেড়ে চেঁচিয়ে উঠলাম—‘ইউ ফ****** বিউটি!’
আর ওখানেই শুরু হলো আসল গণ্ডগোল! জাভেদ ওই ‘এফ’ ওয়ার্ডটা শুনে ভাবল ওটা তাকে বলা হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে কিচেনের কাছে গিয়ে কথা–কাটাকাটি শুরু করল। আমি ভেবেছিলাম সে আউটের সিদ্ধান্ত নিয়ে অভিযোগ করছে। পরে বুঝলাম ও আসলে আমার উদ্যাপনের সময় বলা কথাটার প্রতিবাদ করছে!
এরপর তো যা হওয়ার তা–ই হলো। পাকিস্তানের ম্যানেজার ইন্তিখাব আলম আর ম্যাচ রেফারি বব কাউপারও এসে জুটলেন। দীর্ঘ বচসার পর জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিরা একটা বিবৃতি দিলেন: ‘কথার ভুল ব্যাখ্যা হয়েছে, যার ফলে ভুল–বোঝাবুঝি।’
এই হলো জাভেদ মিয়াঁদাদ। শেষ পর্যন্ত লড়াকু আর তর্কপ্রিয়! এমন একজন, যার ভেতরের আগুনটা বয়সের সঙ্গে সঙ্গে একটুও কমেনি। ক্রিকেট থেকে অবসর নেওয়ার পর (সে-ই একমাত্র খেলোয়াড়, যে প্রথম ছয়টি বিশ্বকাপেই খেলেছে। ১২৪ টেস্টে ২৩টি সেঞ্চুরিসহ ৮৮৩২ রান) জাভেদ দুবার পাকিস্তানের কোচের দায়িত্ব পালন করেছে, তার স্টাইল কিন্তু একটুও পাল্টায়নি! কাইয়ুম রিপোর্টে সাহস করে মুখ খুলেছে ফিক্সিংয়ের বিরুদ্ধে, ড্রেসিংরুমে কী কী হচ্ছে, তার গন্ধ পেয়ে চুপ করে থাকেনি। জাভেদ শুধু একজন অসাধারণ ব্যাটসম্যান, বুদ্ধিমান ক্রিকেটার আর জন্মগত নেতা-ই ছিল না, ছিল খেলার অন্যতম সেরা মস্তিষ্ক! আর হ্যাঁ, আমার দেখা সেরা কাভার ফিল্ডারদের মধ্যেও সে একজন।
১৯৮২ সালের উইজডেন অ্যালমানাকে আমাদের দুজনকে ‘বর্ষসেরা ক্রিকেটার’ ঘোষণা করা হয়েছিল, আগের গ্রীষ্মে অ্যাশেজে দারুণ কীর্তির জন্য আমাকে, আর গ্ল্যামরগনের হয়ে ১৯৮১ সালের গ্রীষ্মে অবিশ্বাস্য পারফরম্যান্সের জন্য জাভেদকে। ওয়েলসের মানুষ তাকে খুব ভালোবাসে, কারণ সে দারুণভাবে কাউন্টি দলটাকে অনুপ্রাণিত করেছিল।
জাভেদের ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা মুহূর্ত ছিল ওই মৌসুমের শেষের দিকে এসেক্সের বিপক্ষে ১৩ রানে হেরে যাওয়া ম্যাচটা। ধুলাময় কোলচেস্টারের উইকেটে ৩২৫ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে গ্ল্যামরগন ৪৪ রানে ৪ উইকেট হারিয়ে ধুঁকছিল। একসময় জাভেদের সব সঙ্গী আউট হয়ে গেল, কিন্তু সে একাই লড়ে গেল, অপরাজিত রইল ২০০ রানে! ওটা ছিল সেই মৌসুমে তার সপ্তম সেঞ্চুরি। সোফিয়া গার্ডেন্সে লেস্টারশায়ারের বিপক্ষে শেষ ম্যাচে আরও একটা সেঞ্চুরি করে সে শুধু গিলবার্ট পার্কহাউসের রেকর্ডই ভাঙেনি, সেই সঙ্গে হয়ে যায় ওয়েলশ কাউন্টি থেকে ২০০০ রান করা মাত্র চতুর্থ খেলোয়াড়ও!
যদিও এটা একটা শ্রদ্ধার্ঘ্য জাতীয় লেখা, তবে আমার মনে হয়, তাকেই শেষ কথা বলার সুযোগ দেওয়া উচিত। আবারও আমরা ওভালে মুখোমুখি, ১৯৮৭ সালে। ইংল্যান্ড ফলো-অন করার পর মাইক গ্যাটিং আর আমি পঞ্চম উইকেটে প্রায় ২০০ রানের জুটি গড়ে শেষ টেস্টটা বাঁচিয়েছিলাম। তবে পাকিস্তান প্রথম ইনিংসে ৭০৮ রান (যা তাদের টেস্ট ইতিহাসে সর্বোচ্চ) করার পর আমরা দুই ইনিংস মিলিয়ে ২৭৭ রানের ‘সামান্য’ ব্যবধানে পিছিয়ে ছিলাম।
সেই বিশাল স্কোরে জাভেদের ছিল ২৬০ রান, ১০ ঘণ্টার বেশি সময় ব্যাট করেছিল সে এবং একসময় স্যার গ্যারি সোবার্সের ৩৬৫ রানের রেকর্ড ভাঙার পথেও ছিল। জাভেদ যখন ব্যাট করতে আসে, পাকিস্তানের রান ছিল ২ উইকেটে ৪০। যখন আউট হয় তখন ৫ উইকেটে ৫৭৩। ব্যাটসম্যান জাভেদের সব গুণ—উদ্ভাবনী ক্ষমতা, জেদ, প্রতিরোধ আর অবশ্যই অসাধারণ দক্ষতা সবকিছুর দেখা মিলবে ওই ইনিংসে। সেই উইকেন্ডে জাভেদ মিয়াঁদাদ আমাকে যা ‘উপহার’ দিয়েছিল, তা হলো ক্রিকেট ইতিহাসে কোনো ইংলিশ বোলারের সবচেয়ে খারাপ বোলিং পরিসংখ্যান—৫২ ওভারে ২১৭ রানে ৩ উইকেট! ওটা নিয়ে সে পরে কতবার যে দেখা হওয়ার পর হাসাহাসি করেছে!
এত সব ঝগড়া আর মাঠের লড়াইয়ের পরও জাভেদ কিন্তু মানুষ হিসেবে খুবই মিশুক আর অতিথিপরায়ণ।
ও হ্যাঁ, জাভেদকে নিয়ে ক্রিকেট–বিশ্বের সবচেয়ে জঘন্য কৌতুকটা তো আপনাদের বলাই হয়নি! শুনবেন নাকি?
প্রশ্ন: পাকিস্তানের হয়ে একই সঙ্গে খেলেছেন এমন বাবা-ছেলে কারা?
উত্তর: জাভেদ, মি অ্যান্ড ড্যাড…
(রসিকতাটা অনেক পাঠক না–ও বুঝতে পারেন। ‘মি অ্যান্ড ড্যাড’ কথাটা দ্রুত পড়ে দেখুন, ‘মিয়ানদাদ’ শোনা যাচ্ছে কি?)
পাঠকের জন্য তথ্য
পাকিস্তান ক্রিকেটের ‘বড়ে মিয়াঁ’ হিসেবে খ্যাত জাভেদ মিয়াঁদাদ ছিলেন সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে থাকা ব্যাটসম্যান, এবং সম্ভবত এখনো পাকিস্তানের ইতিহাসে তিনিই সেরা। অন্তত ২০ টেস্ট খেলেছেন, এমন ব্যাটসম্যানদের মধ্যে ইতিহাসে মাত্র দুজনের ব্যাটিং গড় কখনোই ৫০-এর নিচে নামেনি, একজন ইংল্যান্ডের কিংবদন্তি হার্বার্ট সাটক্লিফ, অন্যজন জাভেদ মিয়াঁদাদ! টেস্টে ৫২.৫৭ ব্যাটিং গড় নিয়ে ক্যারিয়ার শেষ করা মিয়াঁদাদের ওয়ানডে গড় ৪১.৭০, রান ৭৩৮১। যেকোনো বিষয়ে স্পষ্ট মত দিতে পছন্দ করেন, এখনো সেই খেলোয়াড়ি জীবনের মতোই চাঁছাছোলা। ইয়ান বোথামও অনেকটা তা-ই। এত বৈরিতার পরও কেন বোথামের এমন শ্রদ্ধা মিয়াঁদাদের প্রতি, সেটা বোঝা তাই কঠিন কিছু নয়।
