* শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ২৬ টেস্টে বাংলাদেশের একটাই জয়। সেটি আবার শ্রীলঙ্কাতে। সেই জয় বাংলাদেশের শততম টেস্টে বলে আপনার তা খুব ভালোমতোই মনে থাকার কথা।
* টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের ৬০০ ছাড়ানো একমাত্র স্কোরটি শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে। সেটিও শ্রীলঙ্কাতে।
* টেস্টে বাংলাদেশের কোনো ব্যাটসম্যানের প্রথম ডাবল সেঞ্চুরি শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে। হ্যাঁ, হ্যাঁ, সেটিও শ্রীলঙ্কাতেই।
শেষ দুটি আবার একে অন্যের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। দুটি একই টেস্টে। ২০১৩ সালে যে টেস্টে বাংলাদেশের ৬৩৮, সেটিতেই মুশফিকুর রহিমের ডাবল সেঞ্চুরি। টানা ১২ টেস্টে হারার পর শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে প্রথম ড্র-ও।
এই পুরোনো প্যাচাল খুব বেশি অপ্রাসঙ্গিক লাগবে না, যখন জানবেন ওই টেস্টটা হয়েছিল গল ইন্টারন্যাশনাল স্টেডিয়ামে। পশ্চাৎপটে অতিকায় গল ফোর্টের পাথুরে কাঠামো আর দুই পাশে সাগর মিলিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর স্টেডিয়ামের একটি। ২০০৪ সালে সুনামিতে লন্ডভন্ড হয়ে যাওয়ার পর পুনর্জন্ম নেওয়া গলের সেই মাঠেই আজ শুরু বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা প্রথম টেস্ট। শুরু আসলে তিন ধরনের ক্রিকেটেই একে অন্যের নাড়ি-নক্ষত্র বুঝে নেওয়ার লড়াই। যাতে টেস্ট আছে, ওয়ানডে আছে, আছে টি-টোয়েন্টিও। দুই টেস্টের পর সাদা বলের সিরিজে তিনটি করে ম্যাচ।
দুই দল পরস্পরের খুব চেনা। বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি ২৬টি টেস্ট খেলেছে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে। ঘন ঘন দেখা হলে হৃদ্যতা যেমন হয়, তেমনি রেষারেষিও। বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে। গত কয়েক বছরে এই দুই দল মুখোমুখি হলেই মাঠে বা মাঠের বাইরে উত্তেজনার ফুলকি ছুটেছে। ‘টাইমড আউট’ হয়তো সেটির এক নম্বরে, এর বাইরেও নানা কিছু মিলে লঙ্কা-বাংলা এখন গনগনে এক দ্বৈরথের নাম।
গত চার বছর দুই দলের মধ্যে চতুর্থ টেস্ট সিরিজ। দুই দলের জন্যই রণকৌশল ঠিক করা তাই খুব সহজ হওয়ার কথা। বাংলাদেশ দলের জন্য হয়তো তা থাকছে না শ্রীলঙ্কা দলে নতুনের সমারোহে। ১৮ জনের দলের এক–তৃতীয়াংশই এখনো টেস্ট খেলার অপেক্ষায়। বাংলাদেশ দলেও কিছু পরিবর্তন আছে, তবে তা ধর্তব্যের মধ্যে নয়।
তবে একটা পরিবর্তন হয়তো শ্রীলঙ্কাকে একটু হলেও বাড়তি পরিকল্পনা করতে বাধ্য করবে। প্রায় দুই বছর পর ফেরা ইবাদত হোসেনের কথা হচ্ছে না। গত বছরের মার্চে বাংলাদেশে দুই দলের সর্বশেষ টেস্ট সিরিজে অভিষিক্ত যে তরুণ সিলেটে ৫ উইকেট নিলেও রান বিলানোয় ছিলেন দাতা হাতেম তাই (ওভারপ্রতি ৬.৩২), মাঝখানের সময়টায় তাঁর বড় রূপান্তর হয়েছে। লাইন-লেংথ ঠিক রেখেই এখন গতির ঝড় তুলতে পারেন। কার কথা হচ্ছে, মনে হয় না তাঁর নাম বলার দরকার আছে। তারপরও নিয়মের একটা ব্যাপার আছে না? নাহিদ রানা নামটা বলা শুধু সে কারণেই।
বাংলাদেশের পেস বোলিংয়ে ইবাদত ছাড়াও যাঁর সঙ্গী খালেদ আহমেদ ও হাসান মাহমুদ। কিন্তু গলের উইকেট তাঁদের কজনকে খেলার সুযোগ দেবে, কে জানে! বাংলাদেশ ৬৩৮ করেছিল, মুশফিকুর রহিম ডাবল সেঞ্চুরি, মোহাম্মদ আশরাফুল ১৯১—এ থেকেই আবার গলের উইকেটের চরিত্র সম্পর্কে সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাবেন না। বাংলাদেশের ব্যাটিং নিয়ে তখন শ্রীলঙ্কানদের এমনই তুচ্ছতাচ্ছিল্য যে উইকেটে কী আসে–যায় ভেবে পরে ফিক্সিং কেলেঙ্কারিতে জড়ানো কিউরেটর জয়ানন্দ বর্ণবীরা যা বানিয়েছিলেন, তা ছিল রীতিমতো রাজপথ। উপায় থাকলে ব্যাটসম্যানরা যা সব জায়গায় সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন। বাংলাদেশ রানের পাহাড় দাঁড় করিয়ে ফেলার পর কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছিল বর্ণবীরাকে। শ্রীলঙ্কা দল অমনই চেয়েছিল বলেও পার পাননি।
অমন দু–একটা ব্যতিক্রম বাদ দিলে গলের উইকেট বরাবরই স্পিনের সুরে গান গায়। নইলে কি আর শ্রীলঙ্কার দুই স্পিন-গ্রেট মুরালিধরন ও হেরাথ—দুজনই এখানে উইকেটের ‘সেঞ্চুরি’ করে ফেলেন। তাঁদের উত্তরসূরি প্রবাত জয়াসুরিয়াও সেই পথেই এগোচ্ছেন। বাঁহাতি স্পিনার বলে আক্ষরিক অর্থে বললে তিনি হেরাথের উত্তরসূরি। ২০ টেস্টে যাঁর ১১৫ উইকেট, এর ৮০টিই গলে খেলা মাত্র ১০ টেস্টে। এখানে সবচেয়ে বড় হুমকিও হয়তো এই জয়াসুরিয়াই।
তা শুধু বাংলাদেশের জন্যই। তবে এই টেস্টে দুই দলের জন্যই কমন একটা হুমকি আছে। কয়েক দিন ধরেই গলে মেঘের ঘনঘটা আর বৃষ্টি। টেস্টের পাঁচ দিনও তা-ই থাকবে বলে পূর্বাভাস। খেলার ফাঁকে ফাঁকে বৃষ্টি হলে সমস্যা নেই। কিন্তু এমন যদি হয়, বৃষ্টির ফাঁকে ফাঁকে খেলতে হচ্ছে, তাহলেই সর্বনাশ! এমন হলে সবচেয়ে বেশি মন খারাপ হবে অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুসের। ১৫ বছর আগে এই মাঠেই জীবনের শেষ টেস্ট খেলেছিলেন মুত্তিয়া মুরালিধরন। গল তো গল, পুরো শ্রীলঙ্কাই উত্তাল হয়ে উঠেছিল যা নিয়ে। যেটির তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়েছিল ক্রিকেট–বিশ্বেই। মুরালির সঙ্গে ম্যাথুসকে মেলানোর প্রশ্নই ওঠে না। তারপরও ১৬ বছরের টেস্ট ক্যারিয়ার, ৮ হাজারের বেশি রান, চোট বাধা হয়ে না দাঁড়ালে হয়তো সেরা অলরাউন্ডারের তালিকাতেও উঠে যেত নাম—অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুসের টেস্ট ক্রিকেটকে বিদায় জানানোটাও অন্তত শ্রীলঙ্কান প্রেক্ষাপটে বেশ বড় ঘটনাই। আর যাবার আগে রাঙিয়ে দিতে কে না চায়! ম্যাথুসও নিশ্চয়ই তা চাইছেন। অনূর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেটে বাংলাদেশের বিপক্ষে ম্যাচে যাঁর সঙ্গে টস করতে নামতেন, সেই মুশফিকুর রহিম যেমন চাইবেন এই মাঠের সঙ্গে তাঁর প্রেমকাহিনির আরেকটি অধ্যায় লিখতে। এই মাঠে যাঁর ব্যাটিং গড় ১০৬.৩৩, ডাবল সেঞ্চুরির পরের দুটি ইনিংস ৮৫ ও ৩৪।
জ্বরে আক্রান্ত মেহেদী হাসান মিরাজ খেলতে পারবেন কি না, তাঁর কাছে ওয়ানডে অধিনায়কত্ব হারানো নাজমুল হোসেন কি সত্যিই ওপেন করবেন—টেস্ট শুরুর আগে আলোচিত এই প্রশ্ন দুটি তুললামই না। জল্পনাকল্পনা না করে একটু অপেক্ষা করাই ভালো। সবকিছু আগে জেনে গেলে কি আর মজা থাকে!
