নিয়ম পাল্টে শুরুতেই ‘ফিনিশার’ বেভানকে স্বীকৃতি দিল অস্ট্রেলিয়া
ক্রিকেটে ফিনিশার টার্মের প্রতিষ্ঠা মাইকেল বেভানের হাত ধরে। ওয়ানডে বিশেষজ্ঞ হিসেবে বিশেষ খ্যাতি ছিল তাঁর। গত শতাব্দীর শেষ আর এই শতাব্দীর শুরুর দিকে বেভান এমন কিছু ম্যাচ জিতিয়েছেন, যা তখন অনেকের ভাবনার বাইরে ছিল। সেই বেভান ১৫ বছর অপেক্ষার পর অবশেষে অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটের হল অব ফেমে অন্তর্ভুক্ত হলেন।
বেভানের দেড় দশক উপেক্ষিত থাকার কারণ হল অব ফেমে জায়গা করে নেওয়ার ক্ষেত্রে মানদণ্ড। আগের বাছাইয়ের মানদণ্ড অনুযায়ী, হল অব ফেমের অংশ হতে হলে কোনো ক্রিকেটারের টেস্ট ক্যারিয়ার কতটা সমৃদ্ধ, তা দেখা হতো। ২৩২ ওয়ানডেতে ৫৩.৫৮ গড়ে ৬৯১২ রান করা বেভানের টেস্ট ক্যারিয়ার সেভাবে এগোয়নি। ১৮ টেস্টে ৩০ ইনিংসে তাঁর রান ৭৮৫, নেই কোনো সেঞ্চুরি।
টেস্ট ক্যারিয়ার সমৃদ্ধ না হলে অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটের হল অব ফেমের জন্য বিবেচিত হবেন না—গত মাস পর্যন্তও এই মানদণ্ড কার্যকর ছিল। তবে ২০২৫ সাল থেকে নিয়মে পরিবর্তন আসায় ৫৪ বছর বয়সী বেভানকে সম্মাননা জানাতে কোনো বাধা ছিল না।
এটা অসাধারণ অনুভূতি। খেলাটি সম্পর্কে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি গঠনে ভূমিকা রাখতে পেরে আমি গর্বিতমাইকেল বেভান, অস্ট্রেলিয়ার সাবেক ক্রিকেটার
আজ সকালে মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে (এমসিজি) বেভানের হাতে হল অব ফেমের স্মারক তুলে দেন ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার (সিএ) হল অব হেমের চেয়ারম্যান পিটার কিং। তিনি বলেন, ‘মাইকেলের (বেভানের) অসাধারণ রেকর্ড এবং জনসাধারণের অবস্থান হল অব ফেম কমিটিকে মানদণ্ড পর্যালোচনা করতে বাধ্য করেছে। শুধু টেস্ট নয়, ওয়ানডে ও আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতেও যাঁরা উজ্জ্বল ছিলেন, এখন থেকে এই কমিটি তাঁদেরও সমানভাবে স্বীকৃতি প্রদান নিশ্চিত করবে।’
পিটার কিং আরও বলেন, ‘নিঃসন্দেহে মাইকেল সাদা বলের ক্রিকেটে বিপ্লব ঘটিয়েছেন। নিপুণ ব্যাটিং, খেলার প্রতি অবিশ্বাস্য নিবেদন এবং রান তাড়া করার সক্ষমতার কারণে ঘরে ঘরে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়েছিল। মাইকেলের চোখধাঁধানো পারফরম্যান্স ভক্তদের হয় স্টেডিয়ামে ভিড় জমাতে নয়তো টেলিভিশন চালু করতে বাধ্য করেছিল, যা অস্ট্রেলিয়া এবং বিশ্বব্যাপী ক্রিকেট খেলায় প্রভাব ফেলেছিল। তিনি সত্যিই অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট হল অব ফেমে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার যোগ্য।’
ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) নিক হকলি বেভানকে ‘আইকন ও অগ্রদূত’ বলেছেন।
অনেকে দেরিতে হলেও হল অব ফেমে যুক্ত হতে পেরে গর্বিত বেভান, ‘এটা অসাধারণ অনুভূতি। খেলাটি সম্পর্কে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি গঠনে ভূমিকা রাখতে পেরে আমি গর্বিত। আমার ধারণা আমার ভূমিকা ওয়ানডে ক্রিকেটকে সত্যিই সুন্দর রূপ দিয়েছিল।’
টেস্ট ক্যারিয়ারকে সমৃদ্ধ করতে না পারা প্রসঙ্গে বেভান বলেন, ‘আমি আমার দক্ষতা প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট থেকে টেস্ট ক্রিকেটেও স্থানান্তর করতে চেয়েছিলাম। মাঝে মাঝে পেরেছি। কিন্তু অধারাবাহিক ছিলাম। এতগুলো বছর আগে যা ঘটে গেছে, তাতে আমি মোটামুটি শান্তিতেই আছি।’
১৯৯৬ সালে অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটে হল অব ফেম চালু করা হয়। এ বছর বেভানের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার ২০১৫ ওয়ানডে বিশ্বকাপ জয়ী অধিনায়ক মাইকেল ক্লার্ক ও নারী দলের সাবেক উইকেটকিপার–ব্যাটার ক্রিস্টিনা ম্যাথুসকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এ নিয়ে অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটে হল অব ফেমের সদস্যসংখ্যা বেড়ে হলো ৬৬।
এটি একটি দুর্দান্ত অনুভূতি, গেমটি সম্পর্কে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি গঠনে ভূমিকা রাখতে পেরে এটি আমাকে খুব গর্বিত করে," তিনি বলেছিলেন। “আমি অনুমান করছি যে আমার ভূমিকা সত্যিই ওয়ানডে ক্রিকেটে রূপ নিয়েছে। “আমি আমার দক্ষতা প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট থেকে টেস্ট ক্রিকেটে স্থানান্তর করতে চেয়েছিলাম এবং আমি মাঝে মাঝে করেছি কিন্তু অসঙ্গতিপূর্ণ ছিলাম। এত বছর আগে যা ঘটেছিল তাতে আমি মোটামুটি শান্তিতে আছি।
মাইকেল বেভান অস্ট্রেলিয়ার ১৯৯৯ ও ২০০৩ ওয়ানডে বিশ্বকাপজয়ী দলের অপরিহার্য সদস্য। রান তাড়া করতে নেমে কঠিন পরিস্থিতি থেকে দলকে জেতানো তাঁর কাছে ছিল নিয়মিত ব্যাপার। নিজে খেলতেন মিডল অর্ডারে, ম্যাচ বের করে আনতেন টেলএন্ডারদের নিয়ে।
১৯৯৬ সালের নববর্ষে (১ জানুয়ারি) ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে তিন জাতির সিরিজের একটি ম্যাচে অস্ট্রেলিয়াকে ১ উইকেটের জয় এনে দিয়েছিলেন বেভান, যেটিকে ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে আইকনিক মুহূর্তগুলোর একটি বিবেচনা করা হয়। সেদিন ১৭৩ রান তাড়া করতে নেমে কার্টলি অ্যামব্রোস-কোর্টনি ওয়ালশ-ওটিস গিবসনদের নিয়ে গড়া ক্যারিবীয় বোলিং লাইনআপের বিরুদ্ধে ৩৮ রানে ৬ উইকেট হারিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। সেই পরিস্থিতি থেকে শেষ পর্যন্ত গ্লেন ম্যাকগ্রাকে নিয়ে দলকে লক্ষ্যে পৌঁছে দেন বেভান।
ফিনিশার হিসেবে বেভানের আরও উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ইনিংস আছে। ২০০২ সালে এমসিজিতে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ৮২ রানে ৬ উইকেট পড়েছিল অস্ট্রেলিয়ার। লক্ষ্য ছিল ২৪৬। সেই পরিস্থিতি থেকেও ম্যাচ বের করে আনেন বেভান। টেলএন্ডারদের সহযোগিতায় উপহার দেন ৯৫ বলে ১০২ রানের ইনিংস, অস্ট্রেলিয়া জেতে ২ উইকেটে।
২০০৩ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৭৪ রানের অপরাজিত ইনিংসটা তো তাঁকে ‘আল্টিমেট ফিনিশার’-এর তকমা এনে দেয়। ২০৫ রানের লক্ষ্য তাড়া করতে নামা অস্ট্রেলিয়া ১৩৫ রানে ৮ উইকেট হারিয়ে তখন হারের প্রহর গুনছিল। এর পরেরটা ইতিহাস। নবম উইকেটে অ্যান্ডি বিকেলের সঙ্গে অবিচ্ছিন্ন ৭৩ রানের জুটি গড়ে অস্ট্রেলিয়াকে অবিশ্বাস্য জয় এনে দেন বেভান।
বেভান আরেকটি লড়াকু ইনিংসের গল্প লিখেছিলেন বাংলাদেশেই, ২০০০ সালে ঢাকার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে। রেস্ট অব দ্য ওয়ার্ল্ডের (বাকি বিশ্ব) হয়ে এশিয়া একাদশে বিপক্ষে তাঁর অপরাজিত ১৮৫ রানের ইনিংসটা এখনো অনেকের চোখে লেগে থাকার কথা। তাঁর দল ম্যাচটা হেরেছিল ১ রানে। ম্যাচটির ওয়ানডে স্বীকৃতি না থাকায় বেভানের ইনিংস নিয়ে খুব কমই আলোচনা হয়।
সেই ফিনিশার বেভানেরই আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার ‘ফিনিশ’ হয়ে যায় ২০০৪ সালে। ৩৪তম জন্মদিনের কয়েক দিন আগে জানিয়ে দেওয়া হয়, তাঁকে আর অস্ট্রেলিয়া দলে দরকার নেই। অস্ট্রেলিয়া নতুন ফিনিশার পেয়ে গেছে—মাইকেল হাসি!