বৃষ্টিকে ‘অভিশাপ’ বানিয়েছে বাংলাদেশই

আরেকটি উইকেট পতন বাংলাদেশে, আফগানদের আরও একবার উদ্‌যাপনশামসুল হক

ক্রিকেটে বৃষ্টি কখনো আশীর্বাদ হয়, কখনো হয় অভিশাপ। তবে বৃষ্টিকে আশীর্বাদ বানাতেও প্রয়োজন ক্রিকেটীয় সামর্থ্যের। খেলাটাকে আপনাকে এমন জায়গায় নিয়ে যেতে হবে, যেখান থেকে বৃষ্টিও আপনাকে ভাসিয়ে নিতে পারবে না। আর নইলে তিন দফা বৃষ্টি এসেও পারবে না আপনাকে বাঁচাতে। বৃষ্টিভেজা হারই হয়ে ওঠে পরিণতি।

জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে আজ সেই পরিণতিই বরণ করেছে বাংলাদেশ। অন্যদিকে বাংলাদেশের ইনিংসটাকে ১৬৯ রানে আটকে রেখে আফগানিস্তান নিজেদের এমন জায়গায় নিয়ে গিয়েছিল যে, প্রথম দুই দফায় প্রায় ২ ঘণ্টা খেলা বন্ধ থাকার পরও তৃতীয় দফা বৃষ্টির আগেই জয়ের সুবাস পাচ্ছিল তারা। তৃতীয়বার আসা বৃষ্টি খেলা আর শুরুই হতে দেয়নি। তবু প্রথম ওয়ানডেটা ডিএলএস পদ্ধতিতে আফগানিস্তানই জিতেছে ১৭ রানে।

প্রথম দফায় ৫০ মিনিট, এরপর আরও ১ ঘণ্টা। দুই দফায় প্রায় ২ ঘণ্টা খেলা বন্ধ থাকলে খেলার মজাটাই আর থাকে না। বৃষ্টি এসেছে আফগানিস্তানের ইনিংসের সময়ও। খেলার যারা প্রাণ, সেই দর্শকেরা বারবার বৃষ্টিতে ভিজে হলেন জবুথবু।

বৃষ্টি শুরু হলেই গ্যালারিতে দেখা গেছে দৌড়াদৌড়ি। কিন্তু দৌড়ে দর্শকেরা যাবেন কোথায়! জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামের সাধারণ গ্যালারিতে মাথার ওপর চাতাল নেই। পূর্ব গ্যালারির নিচের ধাপের দর্শকেরা তবু পেছনে উঠে গিয়ে ওপরের ধাপের নিচে দাঁড়িয়ে সামান্য আশ্রয় খুঁজে পান। এক তলা পশ্চিম গ্যালারিতে সেটিও নেই।

বৃষ্টিতে মাঠ ছাড়ছেন লিটনরা
প্রথম আলো

পকেটের টাকায় টিকিট কেটে, বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে দর্শকেরা দেখলেন বাংলাদেশের অপরিকল্পিত ভাঙাচোরা ব্যাটিংয়ের প্রদর্শনী। নিরীহ দর্শন সব বলেও একের পর এক সহজ ক্যাচ তুলে দিয়ে ড্রেসিংরুমে ফিরে আসার মিছিল। বিপর্যয় সামলে উঠতে উঠতেই আবার ধসে পড়ার একটা ডকুমেন্টারি দেখা গেল। দর্শকেরা আরও দেখলেন আউটের হাত থেকে বেঁচে গিয়েও বাংলাদেশ ব্যাটসম্যানদের উইকেট বিলিয়ে দিয়ে আসা। এসবের ধারাবাহিকতায় আফগানিস্তানের মতো দলের বিপক্ষেও ৯ উইকেট হারিয়ে মাত্র ১৬৯ রানে শেষ হয় বাংলাদেশের ইনিংস।

বৃষ্টির হানায় বারবার ম্যাচ থামলেও হারের জন্য সেটাকে কোনোভাবেই দায় দিতে পারবে না বাংলাদেশ। এমন নয় যে, ডিএলএস পদ্ধতিই সহজ করে দিয়েছে আফগানদের কাজ। বাংলাদেশের হারটা এসেছে ভুলে ভরা ব্যাটিংয়ের মাশুল দিয়েই।

তৃতীয় দফা বৃষ্টি শুরুর আগেই তাই স্বস্তির হাওয়া বইতে শুরু করেছিল আফগান ড্রেসিংরুমে। ৪৩ ওভারে ১৬৪ রানের লক্ষ্যে নেমে ততক্ষণে ২১.৪ ওভারে ২ উইকেটে ৮৩ রান করে ফেলেছিল তারা। বৃষ্টি থামলে রাত ১০টা ৩৫ মিনিটে আবার খেলা শুরু হতো। আফগানদের লক্ষ্য হতো তখন ২৯ ওভারে ১১১ রান, তার মানে আর ৭.২ ওভারে ২৮ রান করলেই তারা পৌঁছে যেত কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে। বৃষ্টি না থামায় তাদের সে কষ্টটাও করতে হয়নি।

বাংলাদেশের ইনিংসের ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়ায় আফগান বোলারদের কৃতিত্ব খুব একটা ছিল না। পুরোটাই বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের হাতে লেখা ‘সুইসাইড নোট’। হ্যাঁ, ফজলহক ফারুকির ব্যাপার তো বরাবরই আলাদা। বাংলাদেশ-আফগানিস্তান ম্যাচ মানেই এক একটা তামিম-ফারুকি দ্বৈরথ এবং তাতে ফারুকির জয়

আরেকবার ফজলহক ফারুকির বলে আউট হয়েছেন তামিম ইকবাল
প্রথম আলো

গত বছর চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামেই টানা তিন ম্যাচে ফারুকির বলে আউট হয়েছিলেন তামিম। এবারও সেটারই পুনরাবৃত্তি, ফারুকির টানা চতুর্থ জয়ের হাসি। আজ তো ২৪ রানে ৩ উইকেট নিয়ে তিনিই সফলতম আফগান বোলার।

ফারুকির করা ইনিংসের সপ্তম ওভারের প্রথম বলটা অফ স্টাম্পের বাইরে পেয়ে কাট করে বাউন্ডারি পেয়েছিলেন তামিম। পরের তিন বল ডট দিয়ে পঞ্চম বলে কট বিহাইন্ড। আফগানিস্তান প্রথম উইকেটের দেখা পেয়ে যায় প্রথম পাওয়ার প্লেতেই, বাংলাদেশের রান তখন মাত্র ৩০।

আরেক ওপেনার লিটনের শুরুটা ভালো ছিল। তিনে নেমে ফর্মে থাকা নাজমুল হোসেনও শুরু করেছিলেন আজমতউল্লাহর বলে চার মেরে। কিন্তু দলের ৭২ রানের মধ্যে দুজনই ফিরে যান দুই স্পিনার মুজিব উর রেহমান ও মোহাম্মদ নবীকে উইকেট দিয়ে। মুজিবকে অযথা তুলে মারতে গিয়ে লিটন ক্যাচ দেন ডিপ স্কয়ার লেগে, পরের ওভারে নবীকে সুইপ করতে গিয়ে নাজমুল ক্যাচ শর্ট ফাইন লেগে।

সাকিব আল হাসান আর তাওহিদ হৃদয়ের চতুর্থ উইকেট জুটিতে মনে হচ্ছিল শুরুর বিপর্যয় বুঝি বাংলাদেশ কাটিয়ে উঠতে শুরু করেছে। ১৩ থেকে ২৩—তাদের খেলা এই ১১ ওভারেই বাংলাদেশ ইনিংসে যা একটু স্বস্তি দেখা গেছে।

আরও পড়ুন
৫১ রান করেছেন তাওহিদ হৃদয়
প্রথম আলো

বৃষ্টির বাধাও এ সময়ই প্রথম আসে, ১৬তম ওভারের প্রথম বলের পর খেলা বন্ধ। ৫০ মিনিট পর যখন খেলা আবার শুরু হলে হৃদয় জীবন পান আফগান উইকেটকিপার রহমানউল্লাহ গুরবাজ কঠিন একটি ক্যাচ নিতে না পারায়। কিন্তু সাকিবের সেই সৌভাগ্যও হয়নি।

২৩তম ওভারের শেষ বলে আজমতউল্লাহ ওমরজাইয়ের অফ স্টাম্পের বাইরের বলে ড্রাইভ করেছিলেন সাকিব। এক্সট্রা কাভারে দুর্দান্ত ডাইভে সেটাকেই ক্যাচ বানান নবী। সাকিব-হৃদয়ের ৩৭ রানের জুটি ভাঙার পর ৫৫ রানে আরও ৫ উইকেট হারায় বাংলাদেশ। অথচ এ সময় হৃদয়, আফিফ হোসেন একাধিকবার আউটের হাত থেকে বেঁচেছেন। বেশি দৃষ্টিকটু লেগেছে রশিদের নিরীহ গুগলি বুঝতে না পেরে বিভ্রান্ত মুশফিকুর রহিমের বোল্ড হওয়াটা। বল স্টাম্পে লেগেছে তাঁর দু পায়ের ফাঁক গলে, পা ছুঁয়ে।

৩০০
ওয়ানডে ক্যারিয়ারের প্রথম ছয় ইনিংসে তাওহিদ হৃদয়ের রান, যা বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের সর্বোচ্চ। আগের রেকর্ড শামসুর রহমানের, প্রথম ৬ ইনিংসে ২১৫ রান। ওই রান অবশ্য পঞ্চম ইনিংসেই ছাড়িয়েছেন তাওহিদ। ওয়ানডেতে প্রথম ৬ ইনিংসে সবচেয়ে বেশি রান দক্ষিণ আফ্রিকার ইয়ানেমান ম্যালানের (৪৮৩)।

অন্য ব্যাটসম্যানদের ব্যর্থতার মধ্যে ব্যতিক্রম কেবল হৃদয়। নিজের সপ্তম ওয়ানডেতে তৃতীয় ফিফটির দেখা পেয়েছেন এই তরুণ। ৪১তম ওভারে নবম ও শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে আউট হওয়ার আগে ৬৯ বলে তিন বাউন্ডারিসহ করেছেন ৫১ রান। অবশ্য  ফিফটির পরপরই ফারুকিকে কাট করতে গিয়ে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিয়েছেন হৃদয়।

আরও পড়ুন
গুরবাজকে আউট করেছেন সাকিব আল হাসান
প্রথম আলো

বৃষ্টিতে আগেই একবার ম্যাচের দৈর্ঘ্য কমে ৪৩ ওভার হয়ে যাওয়ায় বাংলাদেশকে অলআউট হতে হয়নি, এটাই সান্ত্বনা। তবে সেটার মেয়াদ আফগানিস্তান ইনিংসের আগ পর্যন্তই ছিল। ইনিংসের শুরুর সমীকরণ ছিল, ৪৩ ওভারে ১৬৪ করলেই জিতবে আফগানিস্তান। রহমানউল্লাহ-ইব্রাহিম জাদরানের ৫৪ রানের ওপেনিং জুটিতে সেই কাজ সহজ হয়ে যায় অনেক।

আফগান ইনিংসের শুরুতে তিন পেসারকে দিয়েই চেষ্টা করেছেন অধিনায়ক তামিম। তাতে কাজ না হওয়ায় ১০ম ওভারে আসেন সাকিব। মেডেন নেওয়া সে ওভারে একবার উইকেটের সম্ভাবনাও জাগিয়েছিলেন। সে সম্ভাবনা বাস্তব না হলেও ১৬তম ওভারে রহমানউল্লাহকে ফিরিয়ে প্রথম ব্রেক থ্রুটা দিয়েছিলেন সাকিবই। অন্য উইকেটটা নেন তাসকিন আহমেদ।

এরপর আবার বৃষ্টি বিরতি এবং খেলা শুরুর অপেক্ষা। আসলে শুরু, নাকি শেষের অপেক্ষাই ছিল? খেলা যদি আবার শুরুও হতো, অতিনাটকীয় কিছু না ঘটলে বাংলাদেশের এ ম্যাচ থেকে আর কিছু পাওয়ার ছিল বলে তো মনে হয়নি!