হেডিংলি ১৯৮১: বোথাম, উইলিস এবং ৫০০-১ বাজি জেতার অলৌকিকতা

দুই দিনে দুই রকম বোথাম।  

আগের দিন অর্থাৎ চতুর্থ দিনের খেলা শেষে তাঁর বিখ্যাত ছবিটি তোলেন গেটি ইমেজের আলোকচিত্রী আদ্রিয়ান মুরেল। অকল্পনীয়, অবিশ্বাস্য ইনিংস খেলে সবে ড্রেসিংরুমে এসে বসেছেন। দিন শেষে অপরাজিত, সাদা–কালো ছবিতেই রোদে পোড়া চোখমুখ স্পষ্ট। ঠোঁটে সিগার, ধরাতে যাবেন এমন সময় দৃষ্টি সুদূরে; যেন এই মাত্র গানফাইট করে আসা ওয়েস্টার্ন কোনো আউট ল!

পরের দিন, অর্থাৎ পঞ্চম দিনের খেলা শেষে বোথাম ড্রেসিংরুমে খুঁজছিলেন রিকি রবার্টসকে। ছেলেটার বয়স ১৪ বছর, দক্ষিণ আফ্রিকান। ইংল্যান্ডের ড্রেসিংরুমে অ্যাটেনডেন্টের কাজ করে। বোথাম ছেলেটিকে শ্যাম্পেন আনতে বলবেন। এখন ওটা ছাড়া চলে! নিশ্চিত হার থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে তুলে নেওয়া জয়, যেখান থেকে গোটা টেস্ট ইতিহাসেই মাত্র একবার (তখন পর্যন্ত) কোনো দল জিতেছে, সেটাও ৮৭ বছর আগে; বোথামের খুব তেষ্টা পেয়েছিল, কিন্তু শুনলেন সব শ্যাম্পেন অস্ট্রেলিয়ানদের প্যাভিলিয়নে। প্রায় সাড়ে তিন দিন টেস্টের ভাগ্য নিজেদের হাতে ধরে রাখা কোনো দল যদি জয় উদ্‌যাপনের আগাম প্রস্তুতি হিসেবে বরফকুচিতে শ্যাম্পেনের বোতল রেখে দেয়, খুব কি দোষ দেওয়া যায়?

চিরকালের দাঙ্গা-হাঙ্গামাপ্রিয় (অস্ট্রেলিয়ানদের সঙ্গে তো বটেই) ‘বিফি’ বোথাম তাই গা করলেন না। রিকিকে অস্ট্রেলিয়ার ড্রেসিংরুমে যেতে বললেন, কী বলতে হবে সেটাও বলে দিলেন, ‘তোমাদের শ্যাম্পেন ইংল্যান্ডের ছেলেগুলোর জন্য নিয়ে গেলাম, এগুলো তো তোমাদের আর লাগবে না।’  

আরও পড়ুন

রিকি গিয়েছিল। অস্ট্রেলিয়ান ড্রেসিংরুমের দরজায় ঠকঠকও করেছিল। বোথাম দূর থেকে দেখেন, দরজা দিয়ে রে ব্রাইট ও রডনি মার্শের কটমটে মুখ। বোথামের ভাষায়, রিকি নাকি দৌড়ে পালিয়ে এসেছিল। তাঁর বিশ্বাস, এত দিনে ছেলেটি নিশ্চয়ই তাঁকে ক্ষমা করেছে। চার বছর আগে উইজডেনকে এই কথা বলেছিলেন স্যার ইয়ান টেরেন্স বোথাম কিংবা ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা এক অলরাউন্ডার।

অধিনায়কত্বের বোঝা ঘাড় থেকে নামা নিয়ে অনেক দিন পরে বোথাম কি বলেছিলেন শুনুন, ‘শিকলমুক্ত হলাম। অধিনায়কত্ব বোঝা মনে হচ্ছিল। মাঠের বাইরের ঘটনারও প্রভাব ছিল। ‘তোমার বাবা আবর্জনা’ স্কুলে এসব শুনছিল বাচ্চারা।’

জাত অলরাউন্ডার বলেই ওয়াইনও তৈরি করেন বোথাম। আছে ব্যক্তিগত সংগ্রহশালা এবং ওয়েবসাইটও। অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন জায়গা থেকেও ওয়াইন সংগ্রহ করেন। একজন জাত ইংরেজ হিসেবে উৎসবে, উপলক্ষে টোস্ট-প্রিয় বোথাম আজকের দিনে নিশ্চয়ই বসে নেই; হয়তো কড়া অস্ট্রেলিয়ান কোনো ফ্লেভারে চুমুক দিয়ে ডুবেছেন ৪৪ বছর আগের হেডিংলিতে। পাশে রাখা পত্রিকার খেলার পাতায় শিরোনাম, ‘বোথামের টেস্ট।’
আসলে ১৯৮১ সালের সেই অ্যাশেজ সিরিজটাই বোথামের। ‘বোথামস অ্যাশেজ’ নামে অলংকরণপ্রাপ্তির শুরুটা ছিল হেডিংলিতে তৃতীয় টেস্ট, যেটা কারও কারও চোখে ‘মিরাকল অব হেডিংলি।’

বোথাম সেই টেস্টের নায়ক। পার্শ্বনায়ক ছিলেন দুজন। তবে শুধু বোথামে তাকালে তাঁর জীবনের সঙ্গেও সেই সিরিজের বেশ মিল। একদিকে বিতর্ক কিংবা বাজে পারফরম্যান্স অন্যদিকে ক্রিকেটীয় সামর্থ্যে সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়ানো মিলিয়েই তো বোথাম। সেই সিরিজে প্রথম দুই টেস্ট যদি হয় এই দাবির প্রথম অংশ, শেষ তিন টেস্ট তাহলে শেষ অংশটুকু।

হেডিংলি ছিল তার মধ্যে সবচেয়ে বিস্ময়কর, যেখানে বোথামের ইনিংস পরবর্তী সময়ে ইংলিশ ক্রিকেট ফোকলোরে অংশ, সন্তানকে স্বপ্ন দেখিয়ে ঘুম পাড়াতে ইংরেজ মায়েদের ‘বেডটাইম স্টোরি’ এবং টেস্ট ইতিহাসেই অন্যতম সেরা। আর বোথামের নিজের জন্য সারাংশটা ‘ক্যাপ্টেনদের ক্যাপ্টেন’খ্যাত মাইক ব্রিয়ারলি, ‘ক্যারিয়ারের সেরা ইনিংস।’ সেটা কীভাবে হলো তা–ও অল্প দুটি কথায় বলেছিলেন ২০০৯ সালে গার্ডিয়ানে লেখায়, ‘ব্যাটিংয়ে মেরে খেলার লাইসেন্স দিয়েছিলাম, যেন আনন্দের সঙ্গে মারে: ভিলেজ গ্রিনের সেই কামারের মতো।’

ভিলেজ গ্রিনের কামারের প্রসঙ্গে পরে আসা যাবে, ব্রিয়ারলি কিন্তু বোথামের সেই ইনিংসের শিকড়। প্রায় চল্লিশ ছুঁই ছুঁই ব্রিয়ারলি বোথামকে অধিনায়কত্বের ‘বোঝা’ থেকে নিষ্কৃতি দিতে অল্প কিছুদিনের শর্তে ফিরেছিলেন ইংল্যান্ড দলে। অধিনায়কের সেই ফেরা ফিরিয়ে এনেছিল তাঁর ‘শিষ্য’ বোথামকেও।

আরও পড়ুন

সিরিজের মাঝে গেল অধিনায়কত্ব

সেটা ১৯৮০ সালে ফেব্রুয়ারির শেষ অংশ। গোল্ডেন জুবলি টেস্টে ভারতকে হারানোর পথে ১৩ উইকেট ও ১১৪ রান নিয়ে দেশে ফিরেছেন বোথাম। তত দিনে ২৫ টেস্টের ক্যারিয়ারে ৪০. ৪৮ গড়ে ১৩৩৬ রান ও ১৩৯ উইকেট ১৮.৫২ গড়ে! ব্রিয়ারলির কাছ থেকে অধিনায়কত্বের ব্যাটন নিতে বোথামের চেয়ে যোগ্য আর কেউ ছিল না। বয়কটের বয়স হয়েছে, গুচ তখনো সেভাবে প্রতিষ্ঠিত নন, গাওয়ার অনভিজ্ঞ এবং উইলিস লাজুক।

কিন্তু সম্মানের মুকুটটি ‘বোঝা’ হয় বোথামের জন্য। ১৯৮০ সালের জুন থেকে পরের বছরের এপ্রিল পর্যন্ত বোথামের অধিনায়কত্বে ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে দুবার উইজডেন ট্রফি হারে ইংল্যান্ড। মাঝে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ইংল্যান্ডে টেস্ট খেলার শতবর্ষপূর্তির ম্যাচটা শুধু ড্র করতে পেরেছে। অধিনায়ক বোথামের পারফরম্যান্সও ভালো ছিল না, যেটা বজায় থাকল ১৯৮১ সালের জুনে শুরু হওয়া অ্যাশেজের প্রথম দুই টেস্টেও। মাঝে ওয়ানডে সিরিজে ২-১ এ হার, এরপর টেস্ট সিরিজে এসে ট্রেন্টব্রিজে ৪ উইকেটের হার, লর্ডসে ড্র। ‘বোনাস’ হিসেবে লর্ডসে মিলল শূন্যের ভালোবাসা মানে ‘পেয়ার’—দুই ইনিংসেই ০ রানে আউট।

সিরিজে ‘১-০ তে পিছিয়ে থাকতে বোথাম অধিনায়কত্ব ছাড়লেন। আগেই বলা হয়েছিল, ওয়ানডে সিরিজ ও টেস্টের প্রথম দুই ম্যাচের জন্য তাঁর অধিনায়কত্ব নিশ্চিত। বাকিটা এই পর্যন্ত পারফরম্যান্স বুঝে। অধিনায়ক হিসেবে ১২ টেস্টে ৪ হার ও ৮ ড্র। এ সময় বোথামের রান ১৩.১৪ গড়ে মাত্র ২৭৬। বোলিংয়ে ৩৩.০৮ গড়ে ৩৫ উইকেট। নেই কোনো ‘ফাইফার’ বা সেঞ্চুরি। নাহ, এমন অধিনায়ক চলে না। বোথাম যেদিন অধিনায়কত্ব ছাড়লেন, সে রাতেই ইসিবির নির্বাচকদের প্রধান অ্যালেক বেডসার ফোনে কথা সেরে নেন ব্রিয়ারলির সঙ্গে। ব্রিয়ারলি তখন মিডলসেক্সের অধিনায়ক।

শর্তসাপেক্ষে ফিরে দল গোছানোর সময় ‘ফ্লু’তে ভোগায় বব উইলিসকে হেডিংলি টেস্টের দল থেকে বাইরে রেখেছিলেন ব্রিয়ারলি। বেডসার তা উইলিসকে ফোনে জানালে ইংরেজ পেসার বলেছিলেন, শুধু হেডিংলি টেস্টের জন্য ফিট হয়ে উঠতেই তিনি ওয়ারউইকশায়ারের ম্যাচে খেলেননি। বেডসার তাঁকে ফিটনেস প্রমাণে ম্যাচ খেলতে বলেন, উইলিসও একটি ঘরোয়া ওয়ানডে খেলে ব্রিয়ারলির দলে জায়গা করে নেন। তখন কে জানত, যাঁর এই টেস্টে খেলারই কথা ছিল না, সেই ইংরেজ পেসার উইলিস হয়ে উঠবেন বোথামের টেস্টের পার্শ্বনায়ক। কারও কারও মতে, উইলিসই নায়ক। কারণ, শেষ ভালো যাঁর সব ভালো তাঁর। সে গল্পে পরে আসা যাবে।

অধিনায়কত্বের বোঝা ঘাড় থেকে নামা নিয়ে অনেক দিন পরে বোথাম কি বলেছিলেন শুনুন, ‘শিকলমুক্ত হলাম। অধিনায়কত্ব বোঝা মনে হচ্ছিল। মাঠের বাইরের ঘটনারও প্রভাব ছিল। ‘তোমার বাবা আবর্জনা’ স্কুলে এসব শুনছিল বাচ্চারা।’

অধিনায়কত্ব চলে যাওয়া নিয়ে বোথামের কোনো ক্ষোভ আছে কি না, সেটাও টেস্টের প্রথম দিন সকালে নিশ্চিত হয়ে নিয়েছিলেন ব্রিয়ারলি। বোথামের ভাষায়, ‘মাঠে ব্রিয়ারলি এসে বলল, তুমি কি সত্যিই এই ম্যাচটা খেলতে চাও? আমি বললাম, কাদের বিপক্ষে খেলছি? অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। অবশ্যই খেলতে চাই।’

আরও পড়ুন

কী ঘটেছিল হেডিংলিতে

১৬ জুলাই, ১৯৮১। হেডিংলি।

টস জিতে অস্ট্রেলিয়া অধিনায়ক কিম হিউজ প্রায় ১০ মিনিট পর উইকেট দেখতে ডাকলেন রডনি মার্শ ও ডেনিস লিলিকে। সেদিন মেঘ ছিল আকাশে। প্যাড পরে প্রস্তুত ছিলেন গুচ ও বয়কট। কিন্তু হিউজ জানালেন, অস্ট্রেলিয়া আগে ব্যাট করবে!

উইকেট দেখে তাঁরা কী বুঝেছিলেন কে জানে, ইংল্যান্ড জানত ‘আনইভেন বাউন্স’–এর উইকট। অর্থাৎ কোনটা নামবে, কোনটা উঠবে ঠিক নেই। রান করতে হলে স্রেফ মাটি কামড়ে পড়ে থাকতে হবে। অস্ট্রেলিয়া ওপেনার জন ডাইসন ঠিক সেভাবে ব্যাট করেই সেঞ্চুরি পেলেন। ট্রেভর চ্যাপেল করলেন ১৩৫ বলে ২৭, গ্রায়েম উডের উইকেটটি নিলেন বোথাম। বৃষ্টির কারণে শেষ সেশনে অতিরিক্ত এক ঘণ্টার খেলায় সন্ধ্যা ৬টা ৪০ মিনিটে ডাইসন বোল্ড হলেন গ্রাহাম ডিলের ইয়র্কারে। ২৩৪ বলে ডাইসন ১০২ রানে আউট হওয়ার পর ৩ উইকেটে ২০৩ রানে প্রথম দিন শেষ করলেন হিউজ ও ব্রাইট। ৫৭ রানে ডাইসনের ক্যাচ ছাড়েন বোথাম। চ্যাপেলের ক্যাচ ছাড়েন উইলিস। ৫ ঘণ্টা ১০ মিনিটে ৮২ ওভারের খেলায় ইংলিশ ফিল্ডারদের ‘বাটার ফিঙ্গার’ ও অস্ট্রেলিয়ান আধিপত্যের এক দিন।

ইংল্যান্ডের প্রথম ইনিংসে ফিফটি পান বোথাম। সেটাও ছিল আক্রমণাত্বক ইনিংস
ইংল্যান্ড ক্রিকেট এক্স হ্যান্ডল

১৭ জুলাই, হেডিংলি।

৮৯ রান করতে ২০৮ বল খেললেন হিউজ। গ্রাহাম ইয়ালোপের ৫৮ করতে লাগল ১৬৭ বল। আগের দিনের বোলিং পারফরম্যান্স দেখে বোথামকে ‘সাইডস্টেপ কুইন’ (সুইংয়ের জন্য বোলিং ক্রিজের সাইড নো দাগের খুব কাছ থেকে বল করেছেন) বলে ডাকা ব্রিয়ারলি তাঁকে বললেন, বল বের (আউটসুইং) করার চেষ্টা না করে ভেতরে ঢোকাতে, আক্রমণাত্মক বোলিং করতে, যেমনটা তাঁর অধিনায়কত্বে সে আগে করেছেন। বোথাম বিনিময়ে বেশি সময় ধরে বল করতে চাইলেন। ইচ্ছেমতো করতে আগে ছন্দে তো ফিরতে হবে, সে জন্য সময়টা লাগবে।

বোথামকে দিয়ে ব্রিয়ারলি টানা ২২.৪ ওভারের একটি স্পেল করান, যার ছেদ পড়ে চা বিরতিতে। বোথামের নামের পাশে ততক্ষণে ৪৮ রানে ৫ উইকেট। দ্বিতীয় দিনে অস্ট্রেলিয়া ৯ উইকেটে ৪০১ রানে প্রথম ইনিংস ঘোষণার পর বোথামের বোলিং ফিগার ৩৯.২-১১-৯৫-৬। এর আগে বোথাম সর্বশেষ ‘ফাইফা’র পেয়েছিলেন অধিনায়ক হওয়ার আগের টেস্টে। বোথাম আসলে তখন ফেরার পথে।

বিনা উইকেটে ৭ রানে দ্বিতীয় দিনের খেলা শেষ করেন ইংল্যান্ড ওপেনার গুচ ও বয়কট।

আরও পড়ুন

১৮ জুলাই, হেডিংলি।

অস্ট্রেলিয়ার তিন পেসার টেরি অল্ডারম্যান, ডেনিস লিলি ও জিওফ লসনে ইংল্যান্ড লাঞ্চে ৩ উইকেটে ৭৮ ও চা বিরতির আগেই ১৭৪ রানে অলআউট। এর মধ্যে ৭৫ মিনিটের ব্যাটিংয়ে ৮ চারে ৫৪ বলে ৫০ করে পাল্টা আক্রমণের আনন্দ দেন বোথাম। বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না লিলির বলে মার্শকে ক্যাচ দিয়ে। টেস্টে সেই ক্যাচটি (২৬৪) অ্যালান নটকে টপকে উইকেটকিপার হিসেবে সবচেয়ে বেশি ডিসমিসালের রেকর্ড গড়েন মার্শ।

ডোন্ট ইভেন বদার লুকিং ফর দ্যাট। ইটস গোন ইনটো দ্য কনফেকশনারি হল অ্যান্ড আউট এগেইন!
বোথামের ছক্কা দেখে ধারাভাষ্যে রিচি বেনো

হিউজ ছাড় দেননি। ২২৭ রানে পিছিয়ে থাকা ইংল্যান্ডকে ফলোঅন করতে বলেন। দ্বিতীয় ইনিংসে শুধু গুচকে হারিয়ে ৬ রানে দিনটি পার করে ইংল্যান্ড, পিছিয়ে ২২১ রানে। এর মধ্যে স্কোরবোর্ড বেটিং প্রতিষ্ঠান ল্যাডব্রোকসের এই ম্যাচ নিয়ে হালনাগাদ বাজির দর দেখানো হয়, ৫০০-১। অর্থাৎ ইংল্যান্ডের জয়ের পক্ষে ১ পাউন্ড বাজি ধরলে এবং ইংল্যান্ড জিতলে মিলবে ৫০০ পাউন্ড!

পরের দিন রেস্ট ডে।

২০ জুলাই, হেডিংলি।

ইংল্যান্ডের ঘুরে দাঁড়ানোর শুরু চা বিরতির একটু আগে। অল্ডারম্যানের বলে বব টেলর আউট হওয়ায় দ্বিতীয় ইনিংসে ইংল্যান্ডের স্কোর তখন ৭ উইকেটে ১৩৫। তখনো ৯২ রানে পিছিয়ে। চা বিরতির আগে বোথাম ও ডিলের জুটিতে সেটাই হয় ৭ উইকেটে ১৭৬। সন্ধ্যা ৬টায় দিনের খেলা শেষ হওয়ার আগে ২৭ ওভারে উঠল ১৭৫ রান, যেখানে বোথামের একারই ১০৬!

ব্যক্তিগত ৩৯ রান থেকে বোথাম ১০৩ রানে পৌঁছান ১৪টি চার, একটি সিঙ্গেল ও এক ছক্কায়। অল্ডারম্যানকে মারা ছক্কাটা পাঠান হেডিংলি স্টেডিয়ামের কনফেকশনারি স্টলে। মাইক্রোফোনে রিচি বেনো বলেছিলেন, ‘ডোন্ট ইভেন বদার লুকিং ফর দ্যাট। ইটস গোন ইনটো দ্য কনফেকশনারি হল অ্যান্ড আউট এগেইন!’

অ্যাকশনে বোথাম। হেডিংলির সেই অবিষ্মরণীয় টেস্টে
আইসিসি এক্স হ্যান্ডল

গুচের কাছ থেকে ধার করা ব্যাট নিয়ে নামা বোথামের কাঁধে সেদিন কী ভর করেছিল কে জানে, জন উডকক ও ব্রিয়ারলিকে সেদিন তিনি আর.সি. শেরিফের রম্যনাট্য ‘ব্যাজার্স গি্রন’–এর সেই কামারকে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন। এক প্রতিষ্ঠান একটি গ্রামকে উন্নত করতে চায়। গ্রামবাসী বাধা দেয়। শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয় দুই পক্ষের ক্রিকেট ম্যাচে মুখোমুখি হওয়ার মাধ্যমে, যেখানে গ্রিন ভিলেজের কামার চোখধাঁধানো আনঅর্থোডক্স ব্যাটিং করেন।

ডিলে আউট হওয়ার পর ক্রিস উডের সঙ্গে ৬৭ রানের জুটিতে বোথামের একার ৩৮ এবং শেষ উইকেট উইলিস ৫ বল খেলার মধ্যেই একাই আরও ৩১ করেন বোথাম। ১৪৫ রানে অপরাজিত থেকে ফেরেন ড্রেসিংরুমে। দুই ইনিংস মিলিয়ে ১২৪ রানে এগিয়ে ইংল্যান্ড (৩৫১/৯)।

২১ জুলাই, হেডিংলি।

কাভারে ড্রাইভে বোথামের একটি চার ও উইলিসের একটি সিঙ্গেল, শেষ দিনে সকালের সেশনে স্কোরবোর্ডে এর বেশি যোগ করতে পারেনি ইংল্যান্ড।  ২৭ চার ও এক ছক্কায় ১৪৮ বলে ১৪৯ রানে অপরাজিত বোথাম। ৯ বলে ২ রানে আউট উইলিস।

দ্বিতীয় ইনিংসে ৩৫৬ রানে অলআউট হওয়ায় জয়ের জন্য ১৩০ রানের লক্ষ্য পায় অস্ট্রেলিয়া। সহজ লক্ষ্য।

উডকে আবারও ফেরান বোথাম। কিন্তু ডাইসন-চ্যাপেলের জুটিতে ১ উইকেটে ৫৬ তুলে ফেলে অস্ট্রেলিয়া। আর দরকার মাত্র ৭৪। এর মধ্যে হিল লেন থেকে বাতাসের পক্ষে উইলিসকে দিয়ে ৫ ওভার বোলিং করিয়ে ফায়দা না পাওয়ায় কির্কস্টল লেন থেকে উইলিসকে নিয়ে আসেন ব্রিয়ারলি। শুরু হয় ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় দফা ঘুরে  দাঁড়ানো। ১১ বলের মধ্যে ৩ উইলিস। ৪ উইকেটে ৫৮ রানে লাঞ্চে অস্ট্রেলিয়া। পরে ব্রিয়ারলি, বোথাম থেকে উইলিস সবাই স্বীকার করেছেন, লাঞ্চের সময় থেকে তাঁরা বিশ্বাস করেছেন ম্যাচটা জেতা সম্ভব।

বব উইলিসের অবিশ্বাস্য বোলিংয়ে জিতেছিল ইংল্যান্ড
আইসিসি ফেসবুক হ্যান্ডল

উইলিস সেই বিশ্বাসকে বাস্তবে রূপ দেন। ৬ ওভারে ৬ উইকেট নেওয়া এই পেসারকে লিলি ও ব্রাইটের ৩৫ রানের জুটি ভাঙতে হতো। মাইক গ্যাটিংয়ের পরামর্শ শুনে স্টাম্পে বল করে লিলিকে ফেরান উইলিস। ২০ রানের দূরত্বে থাকতে অস্ট্রেলিয়ার শেষ ব্যাটসম্যান নামেন। উইলিস ব্রাইটরে স্টাম্প উপড়ে জন্ম দেন ইতিহাসের। ১৫.১ ওভারে ৪৩ রানে ৮ উইকেট! ৩৬.১ ওভারে অস্ট্রেলিয়া ১১১ রানে অলআউট হওয়ায় ইংল্যান্ডের ১৮ রানের অবিশ্বাস্য জয়।

মাঠে বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারেনি ইংল্যান্ড দল। অসাধারণ, অবিশ্বাস্য এক জয় দেখার আনন্দে পড়িমড়ি করে মাঠে ঢুকে পড়ে দর্শক। প্রয়াত উইলিস অনেক দিন পরে সেই ম্যাচ নিয়ে ইএসপিএনক্রিকইনফোকে বলেছিলেন, ‘সেদিনের পর আর কখনো ক্রিকেট ম্যাচে ৫০০-১ বাজির দর দেখিনি।’

বোথামের সেই টেস্টে সে জয়েরই ৪৪ বছর পূর্তি আজ।

৫০০-১

টেস্টের তৃতীয় দিন ল্যাডব্রোকসে এই বাজির দর দেখে আর দেরি করেননি অস্ট্রেলিয়ার দুই ক্রিকেটার ডেনিস লিলি ও রডনি মার্শ। দলের ট্যুরিস্ট বাসের ড্রাইভার পিটার ট্রাইবকে দিয়ে বাজি ধরেন নিজ দলের বিপক্ষে! লিলি ১০ পাউন্ড ও মার্শ ৫ পাউন্ড বাজি ধরেন। ফল? বোথামের ভাষায়, ‘৭৬০০ পাউন্ড’ পেয়েছিল, সেটা এখন মিলিয়নের সমান!

উইলিসের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, বাজির ওই দর দেখার পর ইংল্যান্ড দলের কেউ আগ্রহী হয়েছিলেন কি না? উইলিস মজা করে বলেছিলেন, ‘বব টেলর সম্ভবত ইংল্যান্ডের পক্ষে কিছু খরচ করেছে। আর গডফ্রে ইভানস তো ল্যাডব্রোকসের উপদেষ্টা!’

পরে যা হলো

হেডিংলি টেস্ট জিতে ৬ টেস্টের সিরিজ ১-১ করে ইংল্যান্ড। এজবাস্টনে চতুর্থ টেস্টও ইংল্যান্ড জেতে ২৯ রানে। অস্ট্রেলিয়ার দ্বিতীয় ইনিংসে ১১ রানে ৫ উইকেট নেন বোথাম। ম্যানচেস্টারে পঞ্চম টেস্টে ইংল্যান্ডের ১০৩ রানের জয়ে সেঞ্চুরি পান। আর ওভালে ড্র টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার দুই ইনিংস মিলিয়ে নেন ১০ উইকেট। ৩-১ এ সিরিজ জেতে ইংল্যান্ড। হেডিংলিতে ম্যাচসেরা বোথাম সিরিজসেরাও।

পাঠকের জন্য তথ্য:

ইয়ান বোথাম ক্রিকেট ইতিহাসে সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডারদের একজন। ইংল্যান্ডের হয়ে ১০২ টেস্ট ও ১১৬ ওয়ানডে খেলা এই কিংবদন্তি আশির দশকে বিশ্বের অন্যতম সেরা ক্রিকেটার এবং ইংল্যান্ডের ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব।

সমারসেটে কাউন্টি খেলেছেন দীর্ঘদিন। রিচার্ড হ্যাডলি টপকে যাওয়ার আগে ১৯৮৬ থেকে ১৯৮৮ পর্যন্ত টেস্টে সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি ছিলেন। ২৮.৪০ গড়ে তাঁর টেস্ট উইকেটসংখ্যা ৩৮৩।

ওয়ানডেতে নিয়েছেন ১৪৫ উইকেট। খেলেছেন ১৯৭৯ ও ১৯৯২ বিশ্বকাপের ফাইনাল। টেস্টে ১৪ সেঞ্চুরি (৫২২০ রান) ২২ ফিফটির পাশাপাশি ওয়ানডেতে ৯ ফিফটিতে করেছেন ২১১৩ রান।

টেস্ট ইতিহাসে চারবার ফলোঅনে পড়েও জয়ের নজির দেখা গেছে। ১৮৯৪ সালে সিডনিতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে জিতেছে ইংল্যান্ড। ১৯৮১ সালে হেডিংলিতে যার পুনরাবৃত্তি করে সেই ইংল্যান্ডই। এরপর ২০০১ সালে কলকাতায় জেতে ভারত। এবারও প্রতিপক্ষ অস্ট্রেলিয়া! সর্বশেষ ২০২৩ সালে ওয়েলিংটন টেস্টে জয়ীর কাতারে নিউজিল্যান্ড আর হারতে হয় ইংল্যান্ডকে।