স্মিথনামায় উঠে আসেন ব্র্যাডম্যানও

সাদা পোশাকের ক্রিকেটে রেকর্ড বইয়ের পাতা নতুন করে লিখছেন স্মিথছবি: রয়টার্স

‘স্টিভেন স্মিথ আধুনিক যুগের ব্র্যাডম্যান...।’

কথাটা মোটেই এই প্রতিবেদকের নয়। কথাটা ধারাভাষ্যকার ড্যানিয়েল ক্রসের।
ক্রিকেটের খোঁজখবর যাঁরা একটু বিশেষভাবে রাখেন, তাঁরা হয়তো ধারাভাষ্যকার ড্যানিয়েল ক্রসের নামটা শুনেছেন। যাঁরা চিনতে পারেননি, পরিচয়টা তাঁদের জন্য—ভদ্রলোক ব্রিটিশ রেডিও অনুষ্ঠান ‘টেস্ট ম্যাচ স্পেশাল’–এ ধারাভাষ্য দেন। গতকাল বিবিসিতে স্টিভ স্মিথকে নিয়ে এই মন্তব্য করেছেন এই ধারাভাষ্যকার।

ড্যানিয়েল ক্রস সম্ভবত কথাটা খুব একটা খারাপ বলেননি। স্মিথ যেভাবে সাদা পোশাকের ক্রিকেটে রেকর্ড বইয়ের পাতা নতুন করে লিখছেন, তাতে এমন প্রশংসা পাওয়া তাঁর প্রাপ্যই।

এই যেমন টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালের আগে স্মিথকে এই প্রজন্মের সেরা টেস্ট ক্রিকেটার দাবি করেছিলেন বিরাট কোহলি। এই প্রজন্মের সেরা টেস্ট ক্রিকেটার কে—বহুনির্বাচনী পদ্ধতিতে যদি এই প্রশ্ন আসে, তাহলে নিশ্চিতভাবেই একটা অপশনে লেখা থাকবে কোহলির নিজের নামও। থাকবে জো রুট, কেইন উইলিয়ামসনদের নামও। কোহলি অবশ্য নিজেকেসহ তাঁদের কাউকেই বেছে নেননি। সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বী স্মিথের নামটাই বলেছেন।

কোহলির মতে এই প্রজন্মের সেরা টেস্ট ক্রিকেটার স্মিথ
ফাইল ছবি

এই প্রজন্মের তো সেরা, কিন্তু টেস্ট ক্রিকেট ইতিহাসে স্মিথের জায়গা কোথায়? এই প্রশ্নের উত্তরে সর্বকালের অন্যতম সেরা বলে নিরাপদে থাকাই শ্রেয়। তবে একটা বিষয় কিন্তু নিশ্চিত। এই স্মিথ শুধু কোহলি, রুট, উইলিয়ামসনদেরই টক্কর দিচ্ছে না, তাঁর লড়াই শচীন টেন্ডুলকার, রিকি পন্টিংদের মতো গ্রেটদের সঙ্গেও। অন্তত পরিসংখ্যান তা–ই বলছে।

কীভাবে?

এতক্ষণে সবাই জেনে গেছেন, লর্ডস টেস্টের দ্বিতীয় দিনেই ক্যারিয়ারের ৩২ নম্বর সেঞ্চুরির দেখা পেয়েছেন স্মিথ, যা অস্ট্রেলিয়ার হয়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। অস্ট্রেলিয়ার হয়ে সর্বোচ্চ সেঞ্চুরির মালিক পন্টিং, স্মিথের চেয়ে তাঁর সেঞ্চুরি বেশি আরও ৯টি। অ্যাশেজের সেঞ্চুরিতে অবশ্য পন্টিংকে স্মিথ অনেক আগেই পেছনে ফেলেছেন। ক্রিকেটের এই আদি দ্বৈরথে স্মিথের সেঞ্চুরি ১২টি। স্মিথের চেয়ে সেঞ্চুরি বেশি শুধু একজনের—কিংবদন্তি ডন ব্র্যাডম্যান—১৯টি। আরও এক কীর্তিতে ব্র্যাডম্যানের পরের নামটাই স্মিথের। ইংল্যান্ডের মাটিতে বিদেশি ক্রিকেটার হিসেবে স্মিথের সেঞ্চুরি ৮টি, ব্র্যাডম্যানের ১১টি।

আরও পড়ুন

অ্যাশেজে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকের তালিকায় স্মিথের অবস্থান চতুর্থ (৩১৭৬)। পন্টিং, মার্ক টেলর, ম্যাথু হেইডেনের চেয়ে স্মিথের রানসংখ্যা বেশি। তবে স্মিথ এই সিরিজে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকও হয়ে যেতে পারেন। দুইয়ে থাকা ইংলিশ কিংবদন্তি জ্যাক হবসের রান স্মিথের চেয়ে বেশি ৪৬০ রান।

লর্ডস টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসসহ অ্যাশেজে এখনও স্মিথের ব্যাটিং করার কথা আরও ৭ ইনিংস। দুর্দান্ত ছন্দে থাকা স্মিথ ৭ ইনিংসে ৪৬০ করতেই পারেন। ৩ নম্বরে থাকা আরেক অস্ট্রেলিয়ান কিংবদন্তি অ্যালান বোর্ডারকে এই সিরিজে তাঁর ছাড়িয়ে যাওয়ার কথাই, এমনকি ছুঁতে পারেন এই টেস্টেও। বোর্ডার স্মিথের চেয়ে এগিয়ে আছেন মাত্র ৪৬ রানে।

টেস্টে ৩২টি সেঞ্চুরি স্মিথ করেছেন দ্রুততম ক্রিকেটার হিসেবে। এই তালিকায় স্মিথের পরই অবস্থান পন্টিং, শচীনদের। টেস্টে ৩২টি সেঞ্চুরি করতে স্মিথের লেগেছে ১৭৪ ইনিংস, পন্টিংয়ের আরও ২টি বেশি। টেস্টে ৫১ সেঞ্চুরির মালিক শচীনের প্রয়োজন হয়েছে ১৭৯ ইনিংস।

আরও পড়ুন

৩২ সেঞ্চুরির পথে টেস্টের প্রথম ইনিংসে সর্বোচ্চ সেঞ্চুরির (২২) মালিকও হয়েছেন এই অস্ট্রেলিয়ান কিংবদন্তি। গতকালই ভেঙেছেন প্রথম ইনিংসে করা পন্টিংয়ের ২১ সেঞ্চুরির রেকর্ড। এই তালিকার শীর্ষে পাঁচে আরও আছেন জ্যাক ক্যালিস (২০), শচীন (২০) ও স্টিভ ওয়াহর (১৭) মতো ক্রিকেটাররা। তাঁদের চেয়ে বেশি সেঞ্চুরি তো বটেই, সবার চেয়েই গড় অনেক বেশি স্মিথের। টেস্টে প্রথম ইনিংসে স্মিথের গড় ৮৭.২৪, শীর্ষ পাঁচে থাকা ক্রিকেটারদের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ শচীনের—৬৫.৯৭।

ডন ব্র্যাডম্যান
সংগৃহীত

এর আগে লর্ডস অ্যাশেজের দ্বিতীয় ম্যাচের প্রথম দিন নিজের টেস্টে ৯ হাজারের ক্লাবে নাম লেখান স্মিথ। ৯৯ ম্যাচের ১৭৪ ইনিংসে এই মাইলফলক স্পর্শ করেন তিনি। স্মিথের চেয়ে কম ইনিংসে ৯ হাজার রান করতে পেরেছিলেন শুধু লঙ্কান কিংবদন্তি কুমার সাঙ্গাকারা। ২০১১ সালের নভেম্বরে ১৭২তম টেস্ট ইনিংসে এই কীর্তি গড়েন শ্রীলঙ্কার কিংবদন্তি ব্যাটসম্যান। স্মিথ স্পর্শ করেছেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ১৫০০০ রানের মাইলফলকও।

৩৫১তম ইনিংসে ক্রিকেটের তিন সংস্করণ মিলিয়ে ১৫০০০ রান ছুঁয়েছেন স্মিথ। অস্ট্রেলিয়ার ৯ম ব্যাটসম্যান ও সব মিলিয়ে  ৪১তম ব্যাটসম্যান হিসেবে ১৫০০০ রান করেছেন। আপাত দুষ্টিতে এই কীর্তির মাহাত্ম্য চোখে না পড়লেও, একটা পরিসংখ্যান এই কীর্তির গুরুত্ব বাড়াবে কয়েক গুণ। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ১৫০০০ রান স্মিথ করেছেন ৪৯.৬৭ গড়ে। এর চেয়ে বেশি গড়ে ১৫০০০ রান আছে শুধু কোহলির( ৫৩.৪৪)।

৩৪ বছর বয়সী স্মিথ কোথায়, কবে থামবেন, সেটা কেউ জানেন না। তবে যেখানেই তিনি থামেন না কেন, এরই মধ্যে টেস্ট ব্যাটসম্যান হিসেবে গ্রেটদের কাতারে উঠে এসেছেন। গ্রেটদের কাতারে স্মিথ কোথায় থাকবেন, সেই উত্তরও দিতে পারবে শুধু মহাকাল। কারণ? গ্রেটনেসের চূড়ান্ত বিচারক নাকি এই মহাকাল!

আরও পড়ুন