বিসিবির একপেশে নির্বাচনে সভাপতি হচ্ছেন কে
সরকারি হস্তক্ষেপের অভিযোগ, একযোগে ১৬ প্রার্থীর মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার, পরে আরও চার প্রার্থীর নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা, আদালতে পাল্টাপাল্টি রিট–বিতর্কের সমুদ্র পাড়ি দিয়ে আজ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) পরিচালনা পর্ষদের বিতর্কিত ও একপেশে নির্বাচন।
প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলের বলরুমে সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত চলবে ভোট গ্রহণ। তফসিল অনুযায়ী বোর্ড পরিচালক নির্বাচনের প্রাথমিক ফলাফল প্রকাশ হবে সন্ধ্যা ছয়টায়। এর পরপরই পরিচালনা পর্ষদের সভায় নির্বাচিত হবেন বিসিবির নতুন সভাপতি ও দুজন সহসভাপতি। সভাপতি ও সহসভাপতি নির্বাচনের ফল ঘোষণা হওয়ার কথা রাত ৯টায়।
বিসিবির পরিচালনা পর্ষদের এবারের নির্বাচন অনেকটাই যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়ার করা ছকে হচ্ছে। বর্তমান সভাপতি আমিনুল ইসলামের নতুন করে বোর্ড সভাপতি হওয়াটা তাই অনেকটাই নিশ্চিত বলে ধারণা করা হচ্ছে। অভিযোগ আছে, জেলা ও বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থাগুলোর অ্যাডহক কমিটিতে শেষ মুহূর্তে বদল এনে ক্রীড়া উপদেষ্টার পছন্দের ব্যক্তিদের বিসিবির কাউন্সিলর করা হয়েছে। এ ছাড়া ক্লাব কাউন্সিলরদের ভয়ভীতি দেখানোর অভিযোগও আছে। এই অভিযোগ এর আগে করেছিলেন ওল্ড ডিওএইচএসের কাউন্সিলর জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক তামিম ইকবালও।
তবে বিসিবি সভাপতি আমিনুল ইসলাম গতকালও এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। বিসিবি কার্যালয়ে নিজের নির্বাচন করা প্রসঙ্গে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘এখানে আমার কাছে (সরকারের) প্রভাব কিছু মনে হয়নি। আমার মনে হয়েছে, বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য আমার (বিসিবিতে) চালিয়ে যাওয়া দরকার। আমাকে যাঁরা ভোট দিচ্ছেন বা ভোট দেবেন না অথবা আপনারা (সাংবাদিক) যাঁরা আছেন, যদি মনে করেন আমি যথেষ্ট ভালো না, আমি চলে যেতে আগ্রহী আছি যেকোনো সময়।’ এর আগে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল যমুনা টিভিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ক্রীড়া উপদেষ্টাও।
গঠনতন্ত্র অনুযায়ী তিনটি ক্যাটাগরি থেকে বিসিবির সাধারণ পরিষদের ১৯২ জন কাউন্সিলরের ভোটে নির্বাচিত হন ২৫ জন পরিচালক। নরসিংদী জেলা থেকে কেউ না থাকায় এবার কাউন্সিলর ১৯১ জন। জেলা ও বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থা মিলিয়ে ক্যাটাগরি-১ এর ৭১ জন কাউন্সিলর নিজ নিজ বিভাগ থেকে নির্বাচিত করেন মোট ১০ জন পরিচালক। ঢাকার ৭৬টি ক্লাবের কাউন্সিলদের ভোটে ক্যাটাগরি-২ থেকে নির্বাচিত হন ১২ পরিচালক। ক্যাটাগরি-৩ এ সাবেক ক্রিকেটার ও অধিনায়ক, বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিভিন্ন সংস্থার ৪৫ জন কাউন্সিলরের ভোটে নির্বাচিত হন একজন পরিচালক। বাকি দুজন পরিচালক আসেন জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের (এনএসসি) মনোনয়নে। এই ২৫ জন পরিচালক প্রথম বোর্ড সভায় সভাপতি ও সহসভাপতি নির্বাচন করেন।
কাউন্সিলর ১৯১ জন হলেও পাঁচটি বিভাগে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন হয়ে যাওয়ায় আজ ভোট দেবেন ১৫৬ জন। তবে ভোটে শেষ পর্যন্ত কতজন ভোটার সশরীর হাজির থাকেন, সেটি কৌতূহলের বিষয়। অনেকে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেছেন, নির্বাচনে অস্বচ্ছতার প্রতিবাদে অনেক ক্লাব প্রতিনিধি ভোট দেবেন না বলে জানিয়েছেন। অবশ্য বিতর্কিত ১৫টি ক্লাবের কাউন্সিলরের নাম চূড়ান্ত ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তির কার্যক্রম স্থগিত করে হাইকোর্ট যে আদেশ দিয়েছিলেন, নাখালপাড়া ক্রিকেটার্সের কাউন্সিলর লোকমান হোসেন ভুঁইয়ার করা আবেদনের শুনানি নিয়ে গতকাল সেটি স্থগিত করে আদেশ দেন আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতি ফারাহ মাহবুব।
এতে বিতর্কিত ১৫টি ক্লাবের কাউন্সিলরদেরও ভোট দেওয়ার পথ খুলেছে। এ ছাড়া এই ক্লাবগুলোর একটি ভাইকিংস ক্রিকেট একাডেমির কাউন্সিলর ইফতেখার রহমানের সুযোগ তৈরি হলো পরিচালক পদে নির্বাচন করার। বোর্ডের একটি সূত্র জানিয়েছে, আদালতের আদেশের পর ইফতেখার রহমানের নাম রেখে গতকাল নতুন করে ব্যালট পেপার ছাপা হয়েছে। তাঁকে প্রার্থী রেখে ই–ভোটও নেওয়া হচ্ছে নতুন করে।
নির্বাচনে সরকারি হস্তক্ষেপের অভিযোগ তুলে ১ অক্টোবর মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেন ওল্ড ডিওএইচএসের কাউন্সিলর জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক তামিম ইকবালসহ ১৬ প্রার্থী। পরে অনিয়মের অভিযোগ তুলে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান আরও চার প্রার্থী। লিজেন্ডস অব রূপগঞ্জের লুৎফর রহমান, কাঁঠালবাগান গ্রিন ক্রিসেন্টের মেজর ইমরোজ আহমেদ (অব.) ও রাজশাহী বিভাগের হাসিবুল আলমের পর সর্বশেষ গতকাল সরে দাঁড়ান জামালপুর জেলা ক্রীড়া সংস্থার কাউন্সিলর আবদুল্লাহ আল ফুয়াদ রেদুয়ান। বিসিবির নির্বাচনকে আওয়ামী লিগ সরকারের ‘রাতের ভোটের’ সঙ্গে তুলনা করে মিরপুরে বিসিবি কার্যালয়ের সামনে সাংবাদিকদের রেদুয়ান বলেন, ‘তবু তো ওরা ব্যালট বাক্স ভরেছে, সেটা আলাদা জিনিস। এরা তো সুকৌশলে এমন কাজ করছে, সেটা (রাতের ভোটের) ব্যালট বাক্সকেও হার মানিয়ে ফেলছে!’
রেদুয়ান নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোয় ঢাকা বিভাগ থেকে বর্তমান বোর্ড সভাপতি আমিনুল ইসলাম ও পরিচালক নাজমূল আবেদীনের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পরিচালক নির্বাচিত হওয়া অনেকটাই নিশ্চিত হয়ে গেল, যদিও নির্ধারিত সময়ে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার না করায় ব্যালট পেপারে রেদুয়ানের নাম থাকবে।
জেলা ও বিভাগের ১০ জন পরিচালকের মধ্যে এর আগে ৬ জনই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। তাঁরা হলেন খুলনা থেকে আবদুর রাজ্জাক ও জুলফিকার আলী খান, সিলেট থেকে রাহাত সামস্, বরিশাল থেকে শাখাওয়াত হোসেন এবং চট্টগ্রাম থেকে সংগীতশিল্পী আসিফ আকবর ও আহসান ইকবাল চৌধুরী। আমিনুল ও নাজমূল যোগ হলে ক্যাটাগরি–১ এর ১০ পরিচালকের আটজনই হবেন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত।
ক্যাটাগরি–৩ এর একটি পরিচালক পদের জন্য লড়বেন জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক খালেদ মাসুদ ও ক্রিকেটারদের সংগঠন কোয়াবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক দেবব্রত পাল। এই ক্যাটাগরির আরেক প্রার্থী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কাউন্সিলর সিরাজউদ্দীন মো. আলমগীর আগেই মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেছেন।
ঢাকার ক্লাবগুলো নিয়ে গঠিত ক্যাটাগরি–২ এর ১২টি পদের জন্য ব্যালটে নাম থাকবে ১৭ জন প্রার্থীর। তবে লুৎফর রহমান ও মেজর ইমরোজ আহমেদ (অব.) সরে দাঁড়ানোয় প্রার্থীর সংখ্যাটা কার্যত ১৫ জন। তাতে অবশ্য তেমন কিছু যায় আসে না। জেলা ও বিভাগ থেকে যেমন বেশির ভাগ পরিচালকই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে গেছেন, ক্লাব ক্যাটাগরি থেকে কারা নির্বাচিত হচ্ছেন, সেটাও অনেকটাই জানা। পছন্দের তালিকাটা যে ‘অনুমোদিত’ একই জায়গা থেকে!
গত ১ সেপ্টেম্বর বিসিবির নির্বাচনের সময় ঘোষণার পর থেকেই বাংলাদেশের ক্রিকেট পার করছে বিতর্কিত সময়। নির্বাচনে মুখোমুখি হয়ে যান সরকার ও বিএনপিপন্থী সংগঠকেরা। তামিমের নেতৃত্বে বিএনপিপন্থীরা শুরু থেকেই নির্বাচনে সরকারি হস্তক্ষেপ ও গঠনতন্ত্র লঙ্ঘনের অভিযোগ তোলেন। তবে বিএনপিপন্থীরাও নির্বাচনের মাঠে নেমেছিলেন ক্রিকেটের সঙ্গে সম্পর্কহীনদের সঙ্গে নিয়ে। এর মধ্যে বেশ কজন ছিলেন, যাঁদের মূল পরিচয় বিএনপির কোনো না কোনো নেতার পুত্র। শেষ পর্যন্ত অবশ্য তাঁদের ছাড়াই হচ্ছে বিসিবির একপেশে নির্বাচন।
