ভারত–পাকিস্তান: যেখানে মিলিয়ে যায় রাজনীতির রং
লিফটের সামনে দাঁড়িয়ে ওয়াসিম আকরাম। তাঁর তাড়া ব্রডকাস্টিংয়ের কাজে যোগ দেওয়ার। লিফটের সামনেই তাঁকে ঘিরে ধরলেন কয়েকজন ভারতীয় সমর্থক। শুরুতে ইতস্তত করেও কিছু বলে উঠতে পারলেন না তাঁরা। লিফটে ওঠার সময়ই ওয়াসিমকে আবদার জানালেন, ‘একটা ছবি তোলা যাবে?’
ততক্ষণে ভেতরে ঢুকে যাওয়া পাকিস্তানি কিংবদন্তি পেসার তাঁদের জানালেন তাড়ার কথা। এরপর বললেন, ‘ভেতরে চলে এসো, তাহলে আমার সময়টাও বাঁচল…।’ সেখানে দাঁড়িয়ে ভারতীয় জার্সি গায়ে চাপানো সমর্থকেরা কেবল ছবিই তুললেন না, ছেলেবেলা থেকে ওয়াসিমের জন্য কতটা পাগল ছিলেন জানালেন সেটিও, ‘আপনি ছিলেন সত্যিকারের জাদুকর।’
এই ছবি দূর দেশের এক সাংবাদিক হিসেবে এশিয়া কাপ কাভার করার অভিজ্ঞতার সঙ্গে মেলে না একদমই। টুর্নামেন্টজুড়ে ক্রিকেটীয় লড়াইটা যেমনই থাক, বড় হয়ে উঠেছিল ভারত-পাকিস্তানের মাঠের বাইরের লড়াই; যেখানে বেশির ভাগজুড়েই ছিল রাজনৈতিক উত্তাপ। অথচ আজ দুই দেশের রাজনৈতিক রং দুবাই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে এসে মিলিয়ে গেল।
স্লোগান ভিন্ন থাকল, পতাকার রং কিংবা গায়ের জার্সিও। কেউ বললেন, ‘জিতেগা ভাই, জিতেগা, ইন্ডিয়া জিতেগা’—কেউ জানালেন পাকিস্তানের জয়ের আশার কথা। কিন্তু রাজনৈতিক রং তাতে থাকল কমই।
দর্শকদের ভিড়েই যেমন দেখা গেল এক দম্পতিকে। নরওয়েতে তাঁদের পরিচয়—স্বামীর গায়ে পাকিস্তানের আর স্ত্রীর গায়ে ভারতের জার্সি। পাকিস্তান যদি জিতে যায়? এমন প্রশ্নের উত্তরেও স্ত্রী বললেন, ‘তাহলেও খারাপ কী! ওর মন তো খুশি থাকবে…’
সেটা না হয় স্বামীর প্রতি ভালোবাসা। কিন্তু দুই দলের সমর্থকেরা দুবাইয়ের একই পথ ধরে যখন এলেন স্টেডিয়ামে—একমুহূর্তের জন্যও মনে হলো না বিভেদের চিহ্নরেখা এঁকে দিয়েছে দুই দেশের ভিন্ন রাজনীতি।
ভারতের এক সমর্থককে দেখা গেল তাঁর মাকে হুইলচেয়ারে বসিয়ে নিয়ে আসছেন খেলা দেখতে। মায়ের বুকে জড়িয়ে আছে দেশের পতাকা। পাকিস্তানের সমর্থকেরাও পরিবারকে নিয়ে এসেছেন খেলা দেখতে। স্টেডিয়াম থেকে প্রায় এক কিলোমিটার পথের পুরোটাজুড়েই কোথাও সবুজ, কোথাও দেখা গেল নীলের মেলা। তাঁদের কণ্ঠে দেশের জন্য সমর্থনের বার্তা আছে ঠিকই, কিন্তু নেই প্রতিপক্ষের জন্য বিদ্বেষ।
মাঠের উত্তাপটা যদিও এখনো কমেনি। আজও টসের পর হাত মেলাননি সূর্যকুমার যাদব ও সালমান আগা। আগের দুই ম্যাচের পরও হাত না মেলানোকে কেন্দ্র করে ঘটেছে নানা ঘটনা। পাকিস্তান একটা আন্তর্জাতিক ম্যাচই পিছিয়ে দিয়েছিল এক ঘণ্টার জন্য। ভারত জানিয়ে দিয়েছে, তাদের খেলোয়াড়েরা আর হাত মেলাবেন না পাকিস্তানের ক্রিকেটারদের সঙ্গে।
ফাইনালে উঠে যাওয়া দুটি দলের অধিনায়কও একসঙ্গে দাঁড়াননি ফটোসেশনে। অথচ রীতি মেনে সব ফাইনালের আগেই তা হয়ে এসেছে বারবার। এসবের কিছুই হয়তো ছুঁয়ে যায় না হুইলচেয়ারে বসে পতাকা জড়িয়ে মাঠে আসা ভারতীয় কিংবা আটজনের পরিবারের সবাইকে নিয়ে খেলা দেখতে আসা পাকিস্তানের সমর্থককে।
কারণটাও স্পষ্ট—সব ছাপিয়ে তো ক্রিকেটই আসল। যেখানে সমর্থকদের ভালোবাসাটা নিখাদ থাকে। বিদ্বেষ যাঁর বিপরীত একটা শব্দই। বৈরিতার গল্পটাও বেশ দূরের ঘটনা। ক্রিকেটের কল্যাণেই, আদতে এশিয়া কাপের কারণেই তো একসঙ্গে মিশে যায় দুটি দেশের রাজনৈতিক রং!