গ্যালারি যখন টেস্ট ক্রিকেটের পাঠশালা

মিরপুরের গ্যালারিতে স্কুল–কলেজ–মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের ভিড়ছবি: প্রথম আলো

রিফাতের স্কুল শেষ হয়েছে ১২টায়। প্রতিদিনের মতো গতকালও সহপাঠীদের সঙ্গে লোকাল বাসে দাঁড়িয়ে বাড়ি যাচ্ছিল সে। মিরপুর ২ নম্বর সিগন্যালে যখন রিফাতের বাস দাঁড়িয়ে, তখন মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়াম থেকে দর্শকদের হইচইয়ের শব্দ কানে আসে রিফাতের। হুট করেই মনে হলো, বাড়ি ফেরার আগে একটু খেলা দেখে গেলে তো মন্দ হয় না!

যেই ভাবা সেই কাজ। সহপাঠীদের নিয়ে হুড়মুড় করে বাস থেকে নেমে পড়া। স্কুল ড্রেস পরা থাকায় স্টেডিয়ামের নিরাপত্তাকর্মীদের রিফাতদের মাঠে ঢুকতে দিতে কোনো আপত্তি ছিল না। কিন্তু সমস্যা একটাই। স্কুলব্যাগ নিয়ে মাঠে ঢোকা যাবে না।

ক্রিকেটারদের পানি পান বিরতি নিতে দেখে সাথী নামের কলেজপড়ুয়া এক ছাত্রী কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘খেলায় এমন ব্রেক দিনে কয়বার দেয়?’ টেস্ট ম্যাচে দিনের বিরতির বিষয়টি সাথীকে বুঝিয়ে দেয় তার এক বন্ধু। মেহেদী হাসান মিরাজের বোলিংয়ের সময় একঝাঁক ফিল্ডারের ব্যাটসম্যানকে ঘিরে ধরতে দেখেও প্রশ্ন জাগে আরেক ছাত্রীর মনে, ‘টি-টোয়েন্টিতে তো এমন দৃশ্য খুব একটা দেখি না?’

রিফাতদের দলটার একজন এর আগে একবার মাঠে এসেছে। ব্যাগ কোথায় রাখতে হয়, সেটা তার ভালো জানা। স্টেডিয়ামের উল্টো পথে এক সেলুনে ১০ টাকা দিলেই ব্যাগ জমা রাখা যায়। দল বেঁধে সেখানে ব্যাগ জমা রেখে স্টেডিয়ামের দক্ষিণ গ্যালারিতে ঢুকে গেল ছাত্রদের দলটা। প্রথমবার মাঠে আসার রোমাঞ্চ বেশির ভাগের চোখেমুখে। প্রথমবারের মতো মাঠে আসার গল্পটা শোনা গেল রিফাতের মুখেই। যদিও সেটি প্রচণ্ড গরমে হাঁপাতে হাঁপাতে।

স্টেডিয়ামের দক্ষিণ গ্যালারিতে ছাত্রছাত্রীদের বেশ ভিড় দেখা গেল। কেউ পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে এক সেশনের টেস্ট ক্রিকেট দেখতে এসেছেন। কেউ ক্লাস শেষে। কেউ আবার ক্লাস ফাঁকি দিয়ে এসেছেন মুশফিক-লিটনদের সামনে থেকে দেখতে, তাঁদের সঙ্গে সেলফি তুলতে।

আরও পড়ুন
স্লিপে এত ফিল্ডার কেন—এ নিয়ে বন্ধুর কাছে প্রশ্ন করেছে খেলা দেখতে আসা স্কুল–কলেজের শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ!
ছবি: শামসুল হক

তাদের সেলফি তোলার বিষয়টা অবশ্য অন্য রকম। সে জন্য ক্রিকেটারদের কাছে যাওয়ার দরকার নেই। গ্যালারিতে বসেই তা নেওয়া যায়। লং অন বাউন্ডারিতে দাঁড়িয়ে থাকা মাহমুদুল হাসানকে পেছনে রেখে যেমন সেলফি তুলতে দেখা গেল অনেককে। তাদের কাছে এটাই মাহমুদুলের সঙ্গে সেলফি তোলার মতো। ছবি তোলার পর্ব শেষেই মাঠের ক্রিকেট নিয়ে আগ্রহ বাড়ে খুদে দর্শকদের।

ক্রিকেটারদের পানি পান বিরতি নিতে দেখে সাথী নামের কলেজপড়ুয়া এক ছাত্রী কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘খেলায় এমন ব্রেক দিনে কয়বার দেয়?’ টেস্ট ম্যাচে দিনের বিরতির বিষয়টি সাথীকে বুঝিয়ে দেয় তার এক বন্ধু। মেহেদী হাসান মিরাজের বোলিংয়ের সময় একঝাঁক ফিল্ডারের ব্যাটসম্যানকে ঘিরে ধরতে দেখেও প্রশ্ন জাগে আরেক ছাত্রীর মনে, ‘টি-টোয়েন্টিতে তো এমন দৃশ্য খুব একটা দেখি না?’

দর্শকদের কয়েকজনের মধ্যে তখন আফগানদের ফলোঅন করানো নিয়ে আলোচনা শুরু হয়ে যায়। একজন বলছিলেন, ‘বাংলাদেশ তো ৩৮২ করেছে। এর অর্ধেকের মধ্যে আউট করলে ফলোঅন না?’ আরেকজন সেটি শুনে ফলোঅনের নিয়ম বুঝিয়ে দেন। ফলোঅন এড়াতে হলে আফগানদের ১৮২ রান করতে হতো, সেটি জানান।

প্রশ্নটা শুনে নিচের সারিতে বসা এক দর্শক হেসেই দিলেন। পরে ‘ক্লোজ-ইন ফিল্ডার’–এর বিষয়টি বুঝিয়েও দিলেন। শর্ট লেগ ও সিলি পয়েন্ট শব্দগুলো অবশ্য সেই ছাত্রী কতটা বুঝতে পারল, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। টেস্ট ক্রিকেটের সঙ্গে সেই ছাত্রীর প্রথম পরিচয়টা ছিল এমনই।

আফগান ব্যাটসম্যান নাসির জামাল এমন সময় ইবাদত হোসেনের শর্ট বল কাভারে ঠেলে দুই রানের জন্য দৌড় দিলেন। তাঁর সঙ্গী আফজার জাজাই এক রান নিয়ে দ্বিতীয় রানের জন্য দৌড়াতে হিমশিম খাচ্ছিলেন। প্রচণ্ড গরমে দৌড়ে রান নিতে কষ্ট হচ্ছিল এই আফগান-উইকেটকিপারের।

আরও পড়ুন

মাদ্রাসার এক ছাত্র বিষয়টি লক্ষ করে দ্বিতীয় রান নেওয়ার সময় চেঁচিয়ে উঠল, ‘এই গরমে দুই রান নিস না!’ তার কাছে এর ব্যাখ্যাও ছিল, ‘২০২১ সালে পাকিস্তানের বাবর আজমকে ব্যাটিং করতে দেখেছি। শাহিন আফ্রিদিকে নিয়ে সে শুধু বাউন্ডারি মেরে ৭০-৮০ রান যোগ করেছিল। নাসির জামালেরও এখন তাই করা দরকার।’

এমন সময় দক্ষিণ গ্যালারির দিকে এগিয়ে আসেন শরীফুল ইসলাম। তরুণ এই পেসারকে দেখে ‘শরীফুল’, ‘শরীফুল’ রব উঠল গ্যালারিতে। ছাত্রদের একজনের গলাটা একটু আলাদা করেই কানে এল, ‘আজ শরীফুলের গতি ভালো ছিল। জায়গা ভালো ছিল। ৩ উইকেটও পেয়েছে।’ আরেকজন শুধরে দিল, ‘২ উইকেট পেয়েছে। কিন্তু গতি বেশি ছিল ইবাদতের। মাঠে আসার আগে টিভিতে দেখেছি ১৪০-এ করতে। ইবাদত ৪ উইকেট পেয়েছে।’

আর এক উইকেট পেলেই ৫ উইকেট হবে ইবাদতের। দর্শকদের একটা অংশ সেটার অপেক্ষায় ছিলেন। চা পান বিরতির আগে ইবাদতকে বিশ্রাম দিয়ে তাইজুল ইসলামকে বোলিংয়ে আনায় কয়েকজনকে লিটন দাসের অধিনায়কত্ব নিয়েও প্রশ্ন করতে শোনা যায়। শেষ পর্যন্ত ৫ উইকেট নেওয়া হয়নি ইবাদতের। তাইজুল-মিরাজের স্পিনেই আফগান ইনিংস থেমে গেছে ১৪৬ রানে।

দর্শকদের কয়েকজনের মধ্যে তখন আফগানদের ফলোঅন করানো নিয়ে আলোচনা শুরু হয়ে যায়। একজন বলছিলেন, ‘বাংলাদেশ তো ৩৮২ করেছে। এর অর্ধেকের মধ্যে আউট করলে ফলোঅন না?’ আরেকজন সেটি শুনে ফলোঅনের নিয়ম বুঝিয়ে দেন। ফলোঅন এড়াতে হলে আফগানদের ১৮২ রান করতে হতো, সেটি জানান।
স্টেডিয়ামের গ্যালারি যেন টেস্ট ক্রিকেটের এক পাঠশালা। আর দর্শকদের কেউ এই পাঠশালার শিক্ষক, কেউ ছাত্রছাত্রী।

আরও পড়ুন