‘তিন মোড়লের ভদ্রপল্লী’তে যাবে টেস্টের সব রেকর্ড

অস্ট্রেলিয়া, ভারত ও ইংল্যান্ড বিশ্ব ক্রিকেটের তিন মোড়ল হিসেবে পরিচিতছবি : সংগৃহীত

জেসন হোল্ডার, আনরিখ নরকিয়ারা বাংলা জানেন না। নিশ্চিতভাবে মানিক বন্দোপাধ্যায়ের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাসও পড়েননি। যদি পড়তেন, হয়তো ‘ভদ্রপল্লী’র উদাহরণই টানতেন। সেই যে কেতুপুরের জেলেপাড়ার বর্ণনা দিতে গিয়ে মানিক লিখেছিলেন, ‘জীবনের স্বাদ এখানে শুধু ক্ষুধা ও পিপাসায়...ঈশ্বর থাকেন ওই গ্রামে, ভদ্রপল্লীতে।’

পদ্মাপারে অপ্রাপ্তির হাহাকারে ভরা জেলেপাড়ার সঙ্গে ‘ভদ্রপল্লী’র ব্যবধানের সেই সুরই যেন ভিন্ন ভাষায় বলে গেলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের হোল্ডার আর দক্ষিণ আফ্রিকার নরকিয়া। প্রোটিয়া পেসার নরকিয়া বলছিলেন, ‘আমি হয়তো কখনোই ৫০তম টেস্ট খেলতে পারব না। ওই পর্যন্ত যেতে হলে আমার আরও সাত বছর লাগবে। অথচ কয়েকটি দেশ আগামী কয়েক মাসেই ২০টি ম্যাচ খেলবে।’

একই সুর প্রতিধ্বনিত হয়েছে সাবেক ওয়েস্ট ইন্ডিজ অধিনায়ক হোল্ডারের মন্তব্যে, ‘বিশ্ব ক্রিকেট যে পথে যাচ্ছে, “বিগ থ্রি” ছাড়া অন্যরা তো বলতে গেলে টেস্টই খেলে না।’

জোহানেসবার্গ টেস্টে ব্যাট–বলে আলো ছড়িয়েছেন জেসন হোল্ডার
ছবি : এএফপি

হোল্ডার ও নরকিয়ার কথাগুলো সামনে এসেছে দক্ষিণ আফ্রিকা-ওয়েস্ট ইন্ডিজ সেঞ্চুরিয়ন টেস্টের সময়। অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড ও ভারতকে নিয়ে গড়া ‘বিগ থ্রি’ নামে কথিত ‘তিন মোড়ল’, অন্য অর্থে ক্রিকেটের ‘ভদ্রপল্লী’ যে পরিমাণ ম্যাচ খেলে, সে তুলনায় নিজেদের সুযোগ কত সীমিত, সেটি বোঝাতেই নরকিয়া–হোল্ডারদের মুখে অমন মন্তব্য।

আরও পড়ুন

আফ্রিকা মহাদেশের জোহানেসবার্গ থেকে ওশেনিয়া মহাদেশের নিউজিল্যান্ডে তাকানো যাক। সাত মাস পর ক্রাইস্টচার্চে টেস্ট খেলতে নেমেছে শ্রীলঙ্কা। হোল্ডারের মতো সাবেক শ্রীলঙ্কা অধিনায়ক অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুজের কথাও মনে হবে একই, ‘সবাই বলছে টেস্ট ক্রিকেট মরে যাচ্ছে। কিন্তু বছরে পাঁচটা ম্যাচ খেলে আমরাই–বা টেস্ট ক্রিকেটের জন্য কী করছি? পাঁচ টেস্ট যথেষ্ট কিছু নয়।’

শ্রীলঙ্কা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, দক্ষিণ আফ্রিকার মতো কম টেস্ট খেলার এই আক্ষেপটা আছে নিউজিল্যান্ড, পাকিস্তানেরও। যা সুযোগ, প্রায় সবই দুই ম্যাচের সিরিজে সীমাবদ্ধ। জিম্বাবুয়ে, আফগানিস্তান, আয়ারল্যান্ড তো একটা টেস্টের ব্যবস্থা করতেই হিমশিম খাচ্ছে। পাঁচ বছর আগে আইসিসির পূর্ণ সদস্য হওয়া আইরিশরা যেমন ২০১৯ সালের পর একটি টেস্ট ম্যাচও খেলতে পারেনি। বিপরীতে তিন টেস্ট তো বটেই, চার এমনকি পাঁচ টেস্টের সিরিজ নিয়মিতই খেলে যাচ্ছে ‘বিগ থ্রি’র দেশগুলো।

চোটের কারণে জোহানেসবার্গ টেস্টে খেলতে পারছেন না আনরিখ নরকিয়া
ছবি : এএফপি

এফটিপি কী বলছে, কার কত টেস্ট
শুধু বর্তমান নয়, সামনেও বেশির ভাগ টেস্ট খেলবে ভারত, অস্ট্রেলিয়া আর ইংল্যান্ডই। গত বছরের শেষ দিকে ২০২৩–২৭ মেয়াদের ভবিষ্যৎ সফরসূচি (এফটিপি) চূড়ান্ত করেছে আইসিসি। চার বছরের এই চক্রে ১২টি পূর্ণ সদস্য দেশ মোট ১৭৩টি টেস্ট খেলবে। যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৪৩টি ইংল্যান্ডের। অনুমেয়ভাবে দ্বিতীয় আর তৃতীয় সর্বোচ্চ ম্যাচ অস্ট্রেলিয়া, ভারতের। চার বছরে অস্ট্রেলিয়া খেলবে ৪০ টেস্ট, ভারত ৩৮। ওয়ার্ল্ড টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে উঠলে ম্যাচের সংখ্যা আরও বাড়বে। নিজেদের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের বাইরে ম্যাচ বাড়ানোর সুযোগ তো আছেই।

আরও পড়ুন

‘বিগ থ্রি’র বাইরে বাকি ৯ দেশের এফটিপি টেস্ট সংখ্যা এ রকম—বাংলাদেশ (৩৪), নিউজিল্যান্ড (৩২), দক্ষিণ আফ্রিকা (২৮), পাকিস্তান (২৭), ওয়েস্ট ইন্ডিজ (২৬), শ্রীলঙ্কা (২৫), আফগানিস্তান (২১), জিম্বাবুয়ে (২০) ও আয়ারল্যান্ড (১২)।

দেখা যাচ্ছে, সবচেয়ে বেশি ম্যাচ পাওয়া ইংল্যান্ড প্রতিবছর খেলবে গড়ে ১১টি টেস্ট, আর আয়ারল্যান্ড খেলবে ৩টি; প্রায় চার ভাগের এক ভাগ! ওয়েস্ট ইন্ডিজ, শ্রীলঙ্কার মতো দলগুলো খেলবে বছরে ৬টি, সর্বোচ্চ ৭টির মতো ম্যাচ।

‘বিগ থ্রি’র ম্যাচ সংখ্যা সবচেয়ে বেশি; কারণ, তারা নিজেদের মধ্যে খেলবে বেশি। চার বছর চক্রে ভারত–অস্ট্রেলিয়া বোর্ডার গাভাস্কার ট্রফি খেলবে দুবার; দুটিই পাঁচ টেস্টের। আবার অস্ট্রেলিয়া–ইংল্যান্ডের পাঁচ টেস্টের অ্যাশেজ তো আছেই। এদিকে ভারত–ইংল্যান্ডের মধ্যেও পাঁচ টেস্টের সিরিজ আছে দুটি।

আগামী পাঁচ বছরে ৩৪টি টেস্ট খেলবে বাংলাদেশ
ছবি : এএফপি

সব রেকর্ড হবে ‘ভদ্রপল্লী’র ক্রিকেটারদের
ওয়েস্ট ইন্ডিজের কম টেস্ট নিয়ে হোল্ডারের বক্তব্যটি এসেছিল একটি রেকর্ডের সূত্রে। গ্যারি সোবার্সের পর দ্বিতীয় ক্যারিবীয় ক্রিকেটার হিসেবে টেস্টে ১৫০ উইকেট ও আড়াই হাজার রানের মাইলফলক স্পর্শ করেছেন হোল্ডার। সর্বকালের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার বলে বিবেচিত সোবার্স ৯৩ টেস্টের ক্যারিয়ারে বল হাতে ২৩৫ উইকেট আর ব্যাট হাতে ৮ হাজার ৩২ রান করেছিলেন। রানের দিক থেকে হোল্ডার অনেক পেছনে হলেও অন্তত ম্যাচ সংখ্যায় তাঁকে পার করার কথা ভাবতে পারতেন হোল্ডার। ২০১৪ সালে অভিষিক্ত এই বোলিং অলরাউন্ডার গত ৯ বছরে খেলতে পেরেছেন মাত্র ৬১ টেস্ট। তাঁর বয়স এখন ৩১। আরও চার বছর উইন্ডিজের প্রতিটি টেস্ট খেললেও ম্যাচ সংখ্যা ৯০–তে পৌঁছাতে পারবেন না।

ওয়েস্ট ইন্ডিজের বর্তমান টেস্ট অধিনায়ক ক্রেগ ব্রাফেটকে দিয়ে ‘বঞ্চনা’র উদাহরণ টেনেছেন হোল্ডার, ‘ব্রাফেটের দিকেই দেখুন না। এত দিন ধরে (২০১১ সালের মে থেকে) খেললেও সে এখন ১০০তম ম্যাচ খেলতে পারেনি (বর্তমানে ৮৫)। সে কিন্তু জো রুটের (অভিষেক ২০১২ সালের ডিসেম্বরে) আগে থেকে খেলছে। রুটের ম্যাচ এখন ১৩০টার মতো হয়ে গেছে। তাহলে বুঝুন, আমাদের তুলনায় ইংল্যান্ড কত বেশি টেস্ট খেলে।’

সবচেয়ে বেশি টেস্ট খেলে ইংল্যান্ড
ছবি : এএফপি

দক্ষিণ আফ্রিকার কাগিসো রাবাদার দুঃখটা এ ক্ষেত্রে আরও বেশি। ২৭৬ উইকেট নিয়ে রাবাদা এখন দক্ষিণ আফ্রিকার তৃতীয় সর্বোচ্চ উইকেটের মালিক। সামনে থাকা জ্যাক ক্যালিস মাত্র ১৫ উইকেট এগিয়ে। কিন্তু কবে ক্যালিসকে পার করবেন, কিংবা আদৌ ডেল স্টেইনের ৪৩৯ উইকেট টপকাতে পারবেন কি না, তা একদমই অনিশ্চিত। কারণ, ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজ শেষ প্রোটিয়াদের পরের টেস্ট সাত মাস পর, এ বছরের শেষ দিকে। একইভাবে ১৯ টেস্টের ক্যারিয়ারে ৭০ উইকেট নেওয়া নরকিয়াও জানেন না, কবে টেস্টে ১০০ উইকেট পাবেন।

আরও পড়ুন

অথচ গত কয়েক বছরের মধ্যে উইকেটের সংখ্যা ১০০ থেকে ২০০, ৩০০–সহ ওপরের দিকে নিয়ে গেছেন জিমি অ্যান্ডারসন, স্টুয়ার্ট ব্রড, নাথান লায়ন, রবিচন্দ্রন অশ্বিনরা। ব্যাট হাতেও বেশির ভাগ সময়, ম্যাচ ও রানের রেকর্ড গড়ছেন বেন স্টোকস, উসমান খাজা, হ্যারি ব্রুকরা। গত কিছুদিনের টেস্ট পরিসংখ্যানই সেই সাক্ষ্য দিচ্ছে—স্টোকসের সর্বোচ্চ ছক্কা, ২০২২ সালের পর খাজার সর্বোচ্চ রান, অশ্বিনের সাড়ে ৩০০ থেকে সাড়ে ৪০০ উইকেটে পদার্পণ, অ্যান্ডাসন–ব্রড জুটির হাজার উইকেট, লায়নের উইকেট সংখ্যা।

অ্যান্ডারসন–ব্রড জুটি হাজার উইকেটের মাইলফলক ছুঁয়েছেন
ছবি : এএফপি

সমাধান কী
ম্যাথুজ, হোল্ডার, নরকিয়াদের ‘ভদ্রপল্লী’র তুলনায় পিছিয়ে থাকার যে আক্ষেপ, সেটি আপাতত কাটানোর উপায় নেই। এফটিপি চূড়ান্ত হয়ে গেছে। ক্রিকেটের আইন প্রণয়নকারী প্রতিষ্ঠান এমসিসির ক্রিকেট কমিটি এ নিয়ে উদ্বেগের কথা জানিয়েছে। আগামী চার বছরের সূচি চূড়ান্ত হয়ে যাওয়ায় পরের চক্রে ম্যাচ সংখ্যায় সমতা রাখার আহ্বান জানিয়েছে তারা।
সে না হয় ২০২৭ সালে পরিবর্তন হবে। তার আগ পর্যন্ত তাহলে ‘বিগ থ্রি’ই টেস্ট খেলে যাবে! রেকর্ডও গড়বেন শুধু ‘ভদ্রপল্লী’র ক্রিকেটাররাই!

আরও পড়ুন