তাসকিন–মোস্তাফিজদের সেই ঝাঁজ কই

দলের পেস বোলাররা হঠাৎই এমন নিজেদের হারিয়ে খুঁজছেন কেন! পাওয়ারপ্লেতে পেসাররা কেন উইকেট তুলে নিতে পারছেন না?

শরীফুল (বাঁয়ে), মোস্তাফিজ (মাঝে), তাসকিনদের কাছে বাংলাদেশ সমর্থকদের প্রত্যাশা অনেকছবি : শামসুল হক

বিশ্বকাপের প্রথম দুই ম্যাচেই ব্যর্থ দলে আসা নতুন ওপেনার তানজিদ হাসান। আফগানিস্তানের বিপক্ষে ৫ রানে আউট হয়ে গেছেন। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১ রানে। তারপরও তাঁকে নিয়ে চন্ডিকা হাথুরুসিংহেকে খুব একটা চিন্তিত বলে মনে হলো না। সাংবাদিকদের মনে করিয়ে দিলেন, গুয়াহাটিতে বিশ্বকাপের দুটি প্রস্তুতি ম্যাচেই রান করেছেন তানজিদ।

বাংলাদেশ দলের প্রধান কোচ পাওয়ারপ্লেতেই ৪–৫ উইকেট হারিয়ে ফেলা নিয়ে অবশ্যই চিন্তিত। এখানে তিনি সর্বোচ্চ ৩টি উইকেট পর্যন্ত মানতে পারেন। এর বেশি হলে ম্যাচ জেতার আর কোনো আশা দেখেন না।

আরও পড়ুন

শুরুর ব্যাটিং নিয়ে দুশ্চিন্তা আছে। তবে হাথুরুসিংহে এর চেয়েও বেশি চিন্তিত, বলা ভালো, একটু অবাক বাংলাদেশের অন্য একটা বিভাগের ব্যর্থতায়। একটা প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজছেন তিনি—দলের পেস বোলাররা হঠাৎই এমন নিজেদের হারিয়ে খুঁজছেন কেন! পাওয়ারপ্লেতে পেসাররা কেন উইকেট তুলে নিতে পারছেন না?

আফগানিস্তানের বিপক্ষে সেই ব্যর্থতা বড় হয়ে দেখা দেয়নি স্পিনাররা বাংলাদেশকে ম্যাচে ফিরিয়ে আনায়। সেদিন প্রথম ব্রেক থ্রু দিয়েছিলেন অধিনায়ক সাকিব আল হাসান। ইংল্যান্ডের উদ্বোধনী জুটিকে বিচ্ছিন্ন করার কাজটাও করেছে তাঁর বাঁহাতি স্পিন। কিন্তু ইংল্যান্ড তো আফগানিস্তান নয়। ভালো শুরুর পরও নাটকীয়ভাবে ভেঙে পড়েছিল আফগান ব্যাটিং। ইংল্যান্ডের ইনিংসেও একটা ধস নেমেছে। ৯৮ রানে ৮ উইকেট তো ধসের বাবা। কিন্তু তাতেও স্কোরটাকে বাংলাদেশের নাগালের বাইরে নিয়ে যেতে সমস্যা হয়নি। কারণ, কাজের কাজটা এর আগেই করে ফেলেছেন ইংলিশ ব্যাটিংয়ের প্রথম তিন।

ইংল্যান্ডের বিপক্ষে শরীফুলই কিছুটা ভালো করেছেন
ছবি: আইসিসি

ম্যাচ শুরু সকাল সাড়ে ১০টায়, তার ওপর প্রায় ভোর রাত পর্যন্ত বৃষ্টি হয়েছে ধর্মশালায়। হাথুরুসিংহের এটাও দৃষ্টি এড়ায়নি যে কাভারের ফাঁকফোকর দিয়ে একটু পানিও গড়িয়ে পড়েছে উইকেটে। টসে জেতার পর সাকিব আল হাসানের মুখে তাই হাসি ফোটারই কথা ছিল। সেই হাসিতে আনন্দ আর স্বস্তি মিলেমিশে একাকার। উইকেটে পেসারদের জন্য নিশ্চিত কিছু না কিছু আছে। তা কাজে লাগানোর সুযোগটা বাংলাদেশের পেসাররাই পাচ্ছেন, আনন্দ হলো এটা। আর স্বস্তি সহায়ক কন্ডিশনে ইংল্যান্ডের দারুণ পেস আক্রমণের সামনে পড়তে হচ্ছে না বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের।

রাতের বৃষ্টিতে স্টেডিয়ামের পেছনের পাহাড়ে জমে থাকা বরফ যেমন সূর্যের আলোতে ধীরে ধীরে উবে গেছে, সাকিবের আনন্দ বলুন বা স্বস্তি, তা উবে যেতেও বেশি সময় লাগেনি। পেসারদের জন্য দল থেকে যে প্রেসক্রিপশন দেওয়া হয়েছিল, তা একেবারেই সরল। বলতে পারেন পেস বোলিংয়ের প্রথম পাঠ। উইকেট টু উইকেট বল করো। বাকি কাজটা পিচই করে দেবে। সেই ‘সরল’ কাজটাই করতে ব্যর্থ বাংলাদেশের পেসাররা। এই দলের পেস বোলিংয়ের নেতা হিসেবে অনেক দিনই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছেন তাসকিন আহমেদ।

আরও পড়ুন

পরিকল্পনা কার্যকর করতে না পারার ব্যর্থতা নির্দ্বিধায় স্বীকার করে নিচ্ছেন তিনি। আউটফিল্ড বৃষ্টিতে আরও ভারী হয়েছে, পায়ের নিচে নরম-নরম লাগছিল—এসব বললেন রানআপে ছন্দ খুঁজে পেতে সমস্যা নিয়ে প্রশ্নের উত্তরে। কিন্তু তা বলার পরই পরিষ্কার করে দিলেন, এসবকে যেন কেউ আবার অজুহাত মনে না করে। ‘আমরা পারিনি, এটাই হলো শেষ কথা। অজুহাত দিয়ে লাভ নেই। এর চেয়ে খারাপ কন্ডিশনেও আমরা এর চেয়ে ভালো বোলিং করেছি’—তাসকিনের এই কথার পর আর কথা চলে না।

কিন্তু এরপরও এ নিয়ে প্রশ্ন হতেই থাকল। ফাস্ট বোলাররা বক্সার বা স্প্রিন্টারদের মতো একটু খ্যাপাটে হয়ে থাকেন। তাসকিন অবশ্যই ব্যতিক্রম। বোলিংয়ের সময় যতই আক্রমণাত্মক মেজাজে দেখা দেন না কেন, মাঠের বাইরে মুখে হাসি লেগেই থাকে। তারপরও তিনি তো ফাস্ট বোলার। একটা সময় তো সেই অহম ফুটে বেরোবেই। পেসারদের ব্যর্থতা নিয়ে প্রশ্নের পর প্রশ্নে একটা সময় আর সামলাতে পারলেন না নিজেকে। লালচে হয়ে যাওয়া মুখে বললেন, ‘দুই ম্যাচে যদি দুই বছরের অর্জনকে এলোমেলো মনে করেন, তাহলে ব্যর্থতা। কিছু করার নেই।’

প্রত্যাশা পূরণ করতে পারছেন না তাসকিনরা
ছবি : প্রথম আলো

দুই ম্যাচের ব্যর্থতায় অবশ্যই দুই বছরের অর্জন মুছে যাওয়ার নয়। তবে ওই দুই বছরের অর্জনের কারণেই তো এটি বড় হয়ে উঠছে। হাথুরুসিংহেও যে কারণে বলছেন, ‘টানা দুই ম্যাচে পেসাররা এমন বিবর্ণ কেন, বুঝতে পারছি না।’ গত দুই বছরের পরিসংখ্যানও স্পিননির্ভর দল থেকে বাংলাদেশের পেসারদের দল হয়ে ওঠার সাক্ষ্য দেয়। ২০২১ সালের শুরু থেকে যদি ধরেন, ৪৭ ম্যাচে বাংলাদেশের স্পিনাররা যেখানে ১৪৯ উইকেট নিয়েছেন, পেসাররা নিয়েছেন ১৯৪ উইকেট। এই সময়ে স্পিনারদের চেয়ে ১০০ ওভারেরও বেশি বোলিং করেছেন। এটাও তো পেসারদের ভরসা হয়ে ওঠারই প্রমাণ।

২০১৯ বিশ্বকাপজয়ী ইংল্যান্ডের অধিনায়ক এউইন মরগান যদিও বাংলাদেশের বর্তমান পেসারদের চেয়ে এগিয়ে রাখতে চান ২০১৫ বিশ্বকাপের পেস আক্রমণকে। মূলত অ্যাডিলেড ম্যাচের আলোকেই কথাটা বলা। যে ম্যাচে মাশরাফি ও রুবেলের সঙ্গে বাংলাদেশের পেস ত্রয়ীর তৃতীয় সদস্য ছিলেন তাসকিন। তুলনাটা তাই তিনিই ভালো করতে পারবেন। মরগানের সঙ্গে একদমই একমত নন, ‘ওটাও ভালো ছিল। তবে গত দুই বছর যদি দেখেন...।’

আরও পড়ুন

একটা বড় পার্থক্য তো আছেই। ২০১৫ বিশ্বকাপের অমর এক ছবি হয়ে আছে মাশরাফির সঙ্গে তাসকিনের ‘চেস্ট বাম্প’ উদ্‌যাপন। এই দলে তা করার মতো কোনো পেসার কি আছে? তাসকিনের মুখে সেই পরিচিত হাসিটা ফিরে এল এবার, ‘দাঁড়ান না একটু, দেখবেন এবার আমরা অন্যভাবে সেলিব্রেশন করব।’