ডট, ডট, ডট—এভাবেই কি খেলে যাবে বাংলাদেশ

অধিনায়ক নাজমুলের পরাস্ত হওয়ার এ ছবিটি প্রতীকী। নিজেদের ইনিংসে প্রায় অধিকাংশ ডেলিভারিতেই রান নিতে পারে না বাংলাদেশ দলএএফপি

চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে বাংলাদেশ শিরোপা জিতবে—এ আশা সম্ভবত বাংলাদেশের কোনো সমর্থকেরই ছিল না। দুবাইয়ে উড়াল দেওয়ার আগে বাংলাদেশ অধিনায়ক নাজমুল হোসেন নিজেই সে আশার বীজ বপন করেছিলেন সমর্থকদের মনে। তবে বাস্তবতা যে অন্য কিছু সেটাও তাঁরা জানতেন। এ কারণেই ভারতের কাছে প্রথম ম্যাচে হারের পর সমর্থকদের মধ্যে তেমন উচ্চবাচ্য ছিল না। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে কাল রাতে বাঁচা–মরার ম্যাচেও হেরে শিরোপা–স্বপ্নের অকালমৃত্যুর পরও আবহাওয়া প্রায় অপরিবর্তিত। এমন কিছু যে ঘটবে, সেটা যেন সবারই জানা ছিল। তবে যেটা জানা ছিল না, বাঁচা–মরার ম্যাচেও আগে ব্যাটিংয়ে নেমে পুরো ৫০ ওভারে কীভাবে ১৭৮ বল ডট খেলা যায়!

আরও পড়ুন

হিসাব বলছে, ইনিংসের প্রায় ৬০ শতাংশ (৫৯.৩৩%) ডেলিভারি ডট খেলেছে বাংলাদেশ। হ্যাঁ, ইনিংসে বিপর্যয় ছিল, একপর্যায়ে ২১ রানের মধ্যে ৩ উইকেট পড়েছিল, সেই চাপ শুষে নিতেই এত বেশি ডট খেলার অজুহাত আশি–নব্বই দশকের ক্রিকেটে হয়তো মানানসই। এখন সালটা ২০২৫—যখন টি–টোয়েন্টির উত্তর–আধুনিক যুগে টি১০–ও চলে এসেছে। চ্যাম্পিয়নস ট্রফির বাকি ৭টি দল কিন্তু এ সময়ে এমন সব চাপের মধ্যেই টি–টোয়েন্টির মেজাজটা কাজে লাগাতে পারে। ‘নষ্টালজিক’ বাংলাদেশ সেটি পারেনি, নব্বই দশকের ব্যাটিং করেছে, তাই তো? কিন্তু এই মেজাজটাই তো বাংলাদেশকে এনে দিয়েছে সেই শিরোপা—চ্যাম্পিয়নস ট্রফির ইতিহাসে এক ইনিংসে সবচেয়ে বেশি ডট খেলার মুকুট।

স্ট্রাইক অদল–বদল করে খেলায় এখনো দক্ষ হয়ে উঠতে পারেননি বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানেরা
এএফপি

নাজমুল যেহেতু বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক, তাই মুকুটটি তাঁর মাথায়ই উঠবে। তখন তাঁকে দেখে কারও কারও ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’ সিনেমার শেষ দিকের সেই দৃশ্য মনে পড়তে পারে। কণ্টাকাকীর্ণ সিংহাসন ও কাঁটার মুকুট রাখা হয়েছিল নবাবের জন্য। নবাব তখন জনতার উদ্দেশে যে আবেতাড়িত ভাষণ দিয়েছিলেন, নাজমুলও তেমনি কণ্ঠে আবেগ ঢেলে বলতে পারেন, ‘এ তো নতুন কিছু না! এই তো বাংলাদেশ ক্রিকেটের ধারা! আমি শুধু দলকে স্বপ্ন দেখাতে চেয়েছিলাম।’

আরও পড়ুন

নাজমুলের দাবি কিন্তু মিথ্যা নয়। স্বপ্ন দেখার অধিকার সবারই আছে। নাজমুলও দেখেছেন। তবে নিজের স্বপ্ন জোর করে অন্য সবার ভেতরে প্রোথিত করাটা হয়তো একটু বাড়াবাড়ি হয়েছে। এ ছাড়া সব ঠিক আছে। সব কিছু আগের মতোই আছে। বাংলাদেশ ওয়ানডে স্ট্যাটাস পাওয়ার পর থেকে গত ২৮ বছরে টি–টোয়েন্টি ও টি১০ এসে ব্যাটিংয়ের মেজাজকে একদম পাল্টে দিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের কিছু পাল্টায়নি।

একটি উদাহরণ দেওয়া যায়। প্রথম আন্তর্জাতিক টি–টোয়েন্টি খেলা হয় ২০০৫ সালে। ধরে নেওয়া যাক, এই সংস্করণের ব্যাটিং ভালোভাবে রপ্ত করতে এবং ওয়ানডেতে তা কার্যকর করতে পাঁচ বছর লেগেছে দলগুলোর। তাহলে ২০১০ থেকে মানে টি–টোয়েন্টির স্বর্ণযুগ শুরুর পর থেকে ওয়ানডের হিসাবটি পেশ করা যায়—ক্রিকেটবিষয়ক ওয়েবসাইট ইএসপিএন-ক্রিকইনফোর এআইভিত্তিক পরিসংখ্যান বিভাগ ‘আস্ক ক্রিকইনফো’ জানিয়েছে, এই ১৫ বছরে বাংলাদেশ ইনিংসে ন্যূনতম ১৭৪টি বল ডট খেলেছে ১৫টি ম্যাচে!

ওয়ানডে মর্যাদা পাওয়ার ২৮ বছর পেরিয়েও ডটসংখ্যা কমাতে পারেনি বাংলাদেশ দল
এএফপি

অর্থাৎ ইনিংসে ১৫০–১৬০ বল ডট খেলা বাংলাদেশের জন্য খুব নতুন কিছু না। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচটায়ও আসলে বেশ চেনা ব্যাটিংই করেছে বাংলাদেশ। নাজমুল বলতে পারেন, তিনি নিজে চেষ্টা তো আর কম করেননি। ৭০ স্ট্রাইক রেটে ব্যাট করে ১১০ বলে ৭৭ রান করেছেন। কিন্তু আগে ব্যাটিং করা কোনো দলের ওপেনিংয়ে নামা ব্যাটসম্যানের জন্য এটা কি এ যুগে আদৌ কোনো ভালো স্ট্রাইক রেট!
গত ১৫ বছরে বাংলাদেশ যে ম্যাচে নিজেদের ইনিংসে সর্বোচ্চ ডট খেলেছে, সেটাও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে—২০১০ সালে ডানেডিনে পুরো ৫০ ওভার ব্যাট করে বাংলাদেশ তুলেছিল ৮ উইকেটে ১৮৩। আর ডট খেলেছিল স্কোরের চেয়ে বেশি ২০৫! তবে এই স্কোর দেখে ১৫ বছরের উন্নতিটাও চোখে পড়ে—কাল অন্তত দলীয় স্কোরের তুলনায় ডট বল কম খেলেছে বাংলাদেশ।

আরও পড়ুন

আরও কিছু তথ্য দেওয়া যাক। কোন বলে কত রান, সেই হিসাব রাখা শুরুর পর থেকে ওয়ানডেতে বাংলাদেশ এ পর্যন্ত ১৫ ম্যাচে নিজেদের ইনিংসে অন্তত ২০০টি ডট বল খেলেছে। এখানেও একটি ধারা আছে। সেই ধারাটা আসলে উন্নতি না করার ধারা। যেমন ধরুন, ১৯৯৭ সালে ওয়ানডে মর্যাদা পাওয়ার দুই বছর পর ১৯৯৯ সালে এমন ম্যাচ খেলেছে তিনটি। তখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে হামাগুঁড়ি দিয়ে চলার সময়, তাই ব্যাপারটা মেনে নেওয়াই যায়। কিন্তু পাঁচ বছর পরও উন্নতি হয়নি—২০০৪ সালেও তিনবার। এমনকি টি–টোয়েন্টি আসার পর ২০০৯ সালেও একই চিত্র দেখা গেছে দুবার, ২০০৮ ও ২০১০ সালে একবার করে।

ওই সময়ের জন্য তবু এটা মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু এখনকার যুগে সীমিত ওভারের ক্রিকেটে সেটা টি-টোয়েন্টি হোক বা ওয়ানডে, ডট বল খেলা তো রীতিমতো অপরাধ। ওয়ানডেতে ম্যাচের পরিস্থিতির কারণে ডট খেলতে হলেও সেটা পরে পুষিয়ে স্ট্রাইক রেট অন্তত ১০০-এর কাছাকাছি রাখতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশ এত বছরেও সেই খেলাটাই শিখতে পারেনি। কবে শিখবে কে জানে!